দেশের অর্থনীতি এখন গতিময়ঃ ড. আতিউর রহমান by সাইদ আরমান
[বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার ফলে উন্নত বিশ্বসহ বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলোর আর্থিক খাতে চলছে অস্থিতিশীলতা। ফলে বাংলাদেশের আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা ধরে রাখাটা বড় চ্যালেঞ্জ। অপরদিকে একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে চলছে বর্তমান সরকারের দীর্ঘমেয়াদী রূপকল্পের পর্যায়ক্রমিক বাস্তবায়ন।
এজন্য আর্থিক খাতের উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিগত, আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক বহুমাত্রিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে। আর এ পুরো সময়টাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বে রয়েছেন গভর্নর ড. আতিউর রহমান। তিনি ২০০৯ সালের মে মাসে গভর্নর হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই গুরুদায়িত্বটি গ্রহণ করেন। আগামী ২ মে মেয়াদের শেষ বছর শুরু করছেন তিনি। এরই মধ্যে তার অনেক উদ্যোগ প্রশংসিত হয়েছে। পরিচিতি পেয়েছেন গরিববান্ধব গভর্নর হিসেবে। ব্যাংকিং খাতকে মানবিক করতে তার প্রশংসা দেশ ছাড়িয়ে আজ বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
সম্প্রতি এর স্বীকৃতি হিসেবে মনোনীত হয়েছেন ইন্দিরা গান্ধী পুরস্কারের জন্য। আগামী ৭ মে আনুষ্ঠানিকভাবে তা গ্রহণ করতে ভারতে যাচ্ছেন তিনি। ঠিক এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের নানাবিধ অর্জন নিয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে একান্তে কথা বলেছেন তিনি। তার দেওয়া সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এর সিনিয়র ইকোনমিক করেসপন্ডেন্ট সাইদ আরমান]
বাংলানিউজ : আপনার সময়ে ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা আনতে বেশ কিছু কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে আইনগত, নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার পদক্ষেপ সম্পর্কে কিছু বলুন।
গভর্নর : একটি গতিশীল, দক্ষ ও ঝুঁকি মোকাবিলায় সক্ষম আর্থিক পদ্ধতি গড়ে তোলার জন্যে বাংলাদেশ ব্যাংক পাঁচ বছর মেয়াদী (২০১০-১৪) কৌশলগত পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। কর্মসূচির আওতায় আর্থিক খাতকে শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল রাখতে নিয়ন্ত্রণমূলক ও নজরদারি কাঠামোকে শক্তিশালী করা হচ্ছে। বিশেষ করে, ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বচ্ছলতা, তারল্য, মূলধন পর্যাপ্ততা এবং কার্যকর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
মানি লন্ডারিং (অর্থ পাচার) ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে এবং আর্থিক খাতকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যে অনুসরণীয় নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০০৯ এর আওতায় সম্পৃক্ত অপরাধ হিসেবে নতুন বেশ কিছু অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা সুসংহতকরণের লক্ষ্যে ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মূলধনের পর্যাপ্ততা নিরূপণের জন্যে ২০১০ থেকে ব্যাসেল-২ নীতিমালা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় কর্পোরেট গভর্নেন্স নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ইস্যু করা হয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা লাভের লক্ষ্যে তাদের জন্যেও কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।
ব্যাংকগুলোতে ঝুঁকি বহন ক্ষমতা যাচাইয়ের জন্যে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে প্রতিবেদন করা হচ্ছে এখন। ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষায় কার্যকর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে বিদ্যমান ঝুঁকিসমূহ শনাক্তকরণ, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যাংকগুলোতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ইউনিট গঠন করা হয়েছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকেও একটি সেল কাজ করছে এখন।
বাংলানিউজ : আপনি অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির (ইনক্লুসিভ ইকোনমি) কথা বলেন। বলেন, এটি ছাড়া সামষ্টিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণমূলক অন্যান্য পদক্ষেপ কি নিয়েছেন?
গভর্নর : ছাত্র/ছাত্রীদের ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনার জন্যে ১৪টি ব্যাংক স্কুল-ব্যাংকিং স্কিম চালু করেছে। বেকারত্ম দূর করার জন্যে সরকার-গৃহীত ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির আওতায় বেকার যুবক/যুব নারীরা ৫০ টাকায় ব্যাংকে সঞ্চয়ী হিসাব খুলতে পারছেন।
অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান ও তাদের ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনার জন্যে জাতীয় পরিচয়পত্র এবং খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়-ইস্যুকৃত কর্মী-পরিচিতি/নিবন্ধন কার্ডের বিপরীতে ওই কর্মসূচির সুবিধাভোগী শ্রমিক এবং জাতীয় পরিচয়পত্র ও মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পরিশোধ বইয়ের বিপরীতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দশ টাকায় হিসাব খোলার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত ৩০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা এই হিসাব খুলেছেন।
এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বয়স্কভাতা, অসচ্ছল প্রতিবন্ধীভাতা এবং বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ত দুঃস্থ মহিলাদের ভাতা প্রদান কার্যক্রম সহজতর, হয়রানিমুক্ত এবং স্বচ্ছ করার জন্য ১৪ হাজার ভাতাভোগীর হিসাব খোলা হয়েছে।
হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে অনুদানপ্রাপ্ত দুঃস্থরা হিসাব খুলেছেন দশ টাকার মাধ্যমে। এভাবে আরও প্রায় চল্লিশ লাখ হিসাব খোলা সম্ভব হবে। এ সমস্ত উদ্যোগের ফলে অংশগ্রহণমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জনের বাস্তব ভিত্তি আরও প্রসারিত হচ্ছে।
বাংলানিউজ : দেশের অর্থনীতির অন্যতম নিয়ামক ব্যাংক। ব্যাংক ব্যবস্থার আধুনিকায়নে কি উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন আপনি?
গভর্নর : ২০১১ সালের জুলাই মাসে ঋণ-তথ্য ব্যুরো (সিআইবি) অনলাইন কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ফলে অনলাইনের মাধ্যমে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সার্চিং করে অতি দ্রুত সিআইবি রিপোর্ট সংগ্রহ করছে। সিআইবি রিপোর্ট প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আগে যেখানে ৫ দিন থেকে ক্ষেত্রবিশেষে এক মাস সময় লাগতো, বর্তমানে মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই এ রিপোর্ট পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। ফলে, ঋণ প্রদানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
এছাড়া অটোমেটেড ক্লিয়ারিং হাউজসহ গত ২০১১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলাদেশ ইলেক্ট্রনিক ফান্ড সলভ ট্রান্সফার নেটওয়ার্ক’র কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক একটি আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষ ও নিরাপদ ব্যাংকিং খাত গড়ে তুলতে কাজ করে যাচ্ছে। অনলাইন ব্যাংকিং কার্যক্রম, সিআইবি অনলাইন, অটোমেটেড ক্লিয়ারিং হাউস, মোবাইল ব্যাংকিংসহ ই-কর্মাস তারই সুফল।
এরই মধ্যে ৪৭টি ব্যাংকের মধ্যে ৩৭টি পুরোপুরি এবং ৪টি আংশিকভাবে অনলাইনে সেবা দেওয়া শুরু করেছে।
বাংলানিউজ : ব্যাংকের গ্রাহকসেবার মানোন্নয়নে কি কি পদক্ষেপ নিয়েছেন?
গভর্নর : গ্রাহকসেবার মানোন্নয়নে আমানত ও ঋণের সুদের হার এবং শিডিউল অব চার্জেস এর পূর্ণ তালিকা গ্রাহকের জন্য প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নিজস্ব ওয়েবসাইটে এটি প্রদর্শন করার জন্য ব্যাংকগুলোকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সেবার বিপরীতে গৃহীত চার্জের যথাসম্ভব যৌক্তিকীকরণের জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ব্যাংকিং খাতে গ্রাহকের আস্থা ও সন্তুষ্টি বজায় রাখার জন্য গ্রাহকদের অভিযোগ নিষ্পত্তির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ও শাখা অফিসগুলোতে ‘গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ কেন্দ্র’ স্থাপন করা হয়েছে।
আশা করি, এসব উদ্যোগ গ্রাহকস্বার্থ রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
বাংলানিউজ : বাংলাদেশ ব্যাংককে ডিজিটালাইজড করতে গৃহীত পদক্ষেপগুলো কি কি?
গভর্নর : সরকারের ``ডিজিটাল বাংলাদেশ`` গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যকে সামনে রেখে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ই-টেন্ডারিং, ই-রিক্রুটমেন্ট, অন-লাইন ব্যাংকিং নেটওয়ার্কিং, এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং, ইন্টারনেট সিস্টেম ইত্যাদি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এসবের মাধ্যমে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে। একই সঙ্গে সম্ভব হচ্ছে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ।
এসবের ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রম আরো স্বচ্ছ ও গতিশীল হয়েছে।
বাংলানিউজ : ব্যাংকগুলো কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনে কতদূর এগিয়েছে?
গভর্নর : আর্থিক খাতে কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) পালনকে বাধ্যতামূলক করায় ব্যাংকগুলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, ক্রীড়া, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ দারিদ্র্য দূরীকরণ-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সিএসআর কার্যক্রমে ২০০৯ সালে ৫৫ কোটি ব্যয় করে। কিন্তু ২০১০ সালে ৩৯১ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। ২০১১ সালের এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগের ফলে সিএসআর এখন ব্যাংকগুলোর কার্যক্রমের অংশ হয়ে গেছে। ব্যাংকগুলো এগিয়ে এসেছে। সরকারের দারিদ্র্য দূরীকরণ ও কর্মসৃজন কর্মসূচির আওতায় ব্যাংকগুলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, খেলাধুলা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য এগিয়ে এসেছে।
বাংলানিউজ : আপনি ঘরে ঘরে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রমকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। মোবাইল ব্যাংকি সেবার বিষয়ে কিছু বলুন।
গভর্নর : ব্যাংকিং ব্যবস্থার আধুনিকায়নে বর্তমান সরকারের সময়ে প্রবর্তন করা হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং। এ পর্যন্ত ১৪টি ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করেছে। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে মোবাইল ফোন প্রযুক্তির সহায়তায় জনসাধারণকে জরুরি কতগুলো ব্যাংকিং ও আর্থিক সেবা প্রদান সম্ভব হচ্ছে। যেমন, টাকা জমা করা, টাকা তোলা, কেনাকাটার বিল ও ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, বেতন প্রদান, এটিএম থেকে টাকা তোলা, বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিট্যান্স বিতরণ ও তহবিল স্থানান্তর ইত্যাদি সেবা প্রদান করা যাচ্ছে।
এসবের মাধ্যমে দ্রুত ও কম খরচে লেনদেন এবং আধুনিক ব্যাংকিং সেবায় প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি হবে। গ্রামীণ জনপদে অর্থপ্রবাহ বাড়বে। এর ফলে অংশগ্রহণমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ভিত্তি আরো প্রসারিত হয়েছে।
বাংলানিউজ : কর্মরত ব্যাংকগুলোর শাখা বিস্তারের উদ্যোগ নিয়ে কিছু বলুন।
গভর্নর : বর্তমান সরকারের বিগত তিন বছরে মোট ১,১১২টি নতুন ব্যাংক-শাখা খোলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। শাখা সম্প্রসারণ প্রবৃদ্ধির হার ৮১৯ শতাংশ। পক্ষান্তরে, বিগত তিন বছরে কৃষি ও এসএমই খাতের উন্নয়নে ব্যাংকগুলোকে ১২৬টি কৃষি/এসএমই শাখা খোলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যা এর আগে কোনো সময় দেওয়া হয়নি।
বাংলানিউজ : নতুন ব্যাংক স্থাপনের বিষয়টি সামনে এসেছে। এটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা আছে। আপনার বক্তব্য কি?
গভর্নর : বর্তমান সরকারের আমলে বৈদেশিক কর্মসংস্থান তথা জনশক্তি রফতানিতে আর্থিক সহায়তা দান ও প্রবাসীদের দেশে বিনিয়োগ সুবিধা সম্প্রসারণসহ প্রবাসীদের সামগ্রিক কল্যাণে ‘প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক’ নামে নতুন একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এছাড়া নতুন ব্যাংকের জন্য আবেদন চাওয়া হয়েছিলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ আলোচনা করে চূড়ান্ত করেছে দেশীয় উদ্যোক্তাদের জন্য ৬টি নতুন ব্যাংক এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের উদ্যোগে তিনটি এনআরবি ব্যাংক স্থাপনের। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে কাজ করেছে।
বাংলানিউজ : কৃষিঋণ নীতিমালা ও কর্মসূচি বিষয়ে অগ্রগতি কি হয়েছে?
গভর্নর : ২০০৯-১০ এবং ২০১০-১১ অর্থবছরে মোট কৃষিঋণ বিতরণ করা হয়েছে যথাক্রমে ১১ হাজার ৫১২ ও ১২ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৯৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ১৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
কৃষিখাতে ব্যাপক ঋণসুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি ঋণ সরবরাহ প্রক্রিয়াতে গুণগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে করে প্রকৃত কৃষকরা স্বচ্ছতার সঙ্গে এবং হয়রানিমুক্তভাবে সময়মতো কৃষিঋণ পাচ্ছেন বলে আমি মনে করি। এজন্যে মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যায়ে এ মনিটরিং কার্যক্রম আরো জোরদার করতে পৃথক একটি পরিদর্শন বিভাগ খোলা হয়েছে।
বাংলানিউজ : কৃষকদের দশ টাকায় ব্যাংক-হিসাব খোলার সফলতা কেমন?
গভর্নর : হিসাব খোলার এরকম সৃজনশীল কোনো ব্যবস্থা এর আগে ছিল না। সরকারের দেওয়া বিভিন্ন ভর্তুকি ব্যাংকের মাধ্যমে সহজে পেতে মাত্র ১০ টাকা জমা দিয়ে এ পর্যন্ত ৯৫ লক্ষাধিক কৃষক ব্যাংকে গিয়ে তাদের হিসাব খুলেছেন। কৃষকরা ব্যাংকিং খাতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে আধুনিক ব্যাংকিং সুবিধা গ্রহণ করছেন।
এর বাইরে সব মিলিয়ে প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ মানুষ ১০ টাকায় হিসাব খুলতে পেরেছেন। এটা বড় অর্জন।
বাংলানিউজ : এসএমই খাতের উন্নয়নে গৃহীত পদক্ষেপগুলো কি কি?
গভর্নর : ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতের অধিকতর বিকাশ ও উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি পৃথক বিভাগ খোলা হয়েছে। ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো একটি বিস্তৃত এসএমই ঋণ-নীতিমালা প্রণয়ন করে ৩৮ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। ওই বছরে ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মোট ৫৩ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা এসএমই ঋণ বিতরণ করেছে। এটা মোট লক্ষ্যমাত্রার ১৩৮ শতাংশ।
চলতি বছর (২০১১) এসএমই ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৬ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা।
এসএমই খাতের অর্থায়ন সমস্যার সমাধানে সুলভে ও সহজ শর্তে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের অর্থায়নের বিপরীতে তিনটি আবর্তনশীল পুনঃঅর্থায়ন তহবিল (বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব, আইডিএ ও এডিবি ফান্ড) থেকেও ঋণ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি এর স্বীকৃতি হিসেবে মনোনীত হয়েছেন ইন্দিরা গান্ধী পুরস্কারের জন্য। আগামী ৭ মে আনুষ্ঠানিকভাবে তা গ্রহণ করতে ভারতে যাচ্ছেন তিনি। ঠিক এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের নানাবিধ অর্জন নিয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে একান্তে কথা বলেছেন তিনি। তার দেওয়া সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এর সিনিয়র ইকোনমিক করেসপন্ডেন্ট সাইদ আরমান]
বাংলানিউজ : আপনার সময়ে ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা আনতে বেশ কিছু কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে আইনগত, নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার পদক্ষেপ সম্পর্কে কিছু বলুন।
গভর্নর : একটি গতিশীল, দক্ষ ও ঝুঁকি মোকাবিলায় সক্ষম আর্থিক পদ্ধতি গড়ে তোলার জন্যে বাংলাদেশ ব্যাংক পাঁচ বছর মেয়াদী (২০১০-১৪) কৌশলগত পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। কর্মসূচির আওতায় আর্থিক খাতকে শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল রাখতে নিয়ন্ত্রণমূলক ও নজরদারি কাঠামোকে শক্তিশালী করা হচ্ছে। বিশেষ করে, ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বচ্ছলতা, তারল্য, মূলধন পর্যাপ্ততা এবং কার্যকর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
মানি লন্ডারিং (অর্থ পাচার) ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে এবং আর্থিক খাতকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যে অনুসরণীয় নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০০৯ এর আওতায় সম্পৃক্ত অপরাধ হিসেবে নতুন বেশ কিছু অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা সুসংহতকরণের লক্ষ্যে ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মূলধনের পর্যাপ্ততা নিরূপণের জন্যে ২০১০ থেকে ব্যাসেল-২ নীতিমালা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় কর্পোরেট গভর্নেন্স নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ইস্যু করা হয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা লাভের লক্ষ্যে তাদের জন্যেও কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।
ব্যাংকগুলোতে ঝুঁকি বহন ক্ষমতা যাচাইয়ের জন্যে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে প্রতিবেদন করা হচ্ছে এখন। ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষায় কার্যকর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে বিদ্যমান ঝুঁকিসমূহ শনাক্তকরণ, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যাংকগুলোতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ইউনিট গঠন করা হয়েছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকেও একটি সেল কাজ করছে এখন।
বাংলানিউজ : আপনি অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির (ইনক্লুসিভ ইকোনমি) কথা বলেন। বলেন, এটি ছাড়া সামষ্টিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণমূলক অন্যান্য পদক্ষেপ কি নিয়েছেন?
গভর্নর : ছাত্র/ছাত্রীদের ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনার জন্যে ১৪টি ব্যাংক স্কুল-ব্যাংকিং স্কিম চালু করেছে। বেকারত্ম দূর করার জন্যে সরকার-গৃহীত ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির আওতায় বেকার যুবক/যুব নারীরা ৫০ টাকায় ব্যাংকে সঞ্চয়ী হিসাব খুলতে পারছেন।
অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান ও তাদের ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনার জন্যে জাতীয় পরিচয়পত্র এবং খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়-ইস্যুকৃত কর্মী-পরিচিতি/নিবন্ধন কার্ডের বিপরীতে ওই কর্মসূচির সুবিধাভোগী শ্রমিক এবং জাতীয় পরিচয়পত্র ও মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পরিশোধ বইয়ের বিপরীতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দশ টাকায় হিসাব খোলার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত ৩০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা এই হিসাব খুলেছেন।
এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বয়স্কভাতা, অসচ্ছল প্রতিবন্ধীভাতা এবং বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ত দুঃস্থ মহিলাদের ভাতা প্রদান কার্যক্রম সহজতর, হয়রানিমুক্ত এবং স্বচ্ছ করার জন্য ১৪ হাজার ভাতাভোগীর হিসাব খোলা হয়েছে।
হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে অনুদানপ্রাপ্ত দুঃস্থরা হিসাব খুলেছেন দশ টাকার মাধ্যমে। এভাবে আরও প্রায় চল্লিশ লাখ হিসাব খোলা সম্ভব হবে। এ সমস্ত উদ্যোগের ফলে অংশগ্রহণমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জনের বাস্তব ভিত্তি আরও প্রসারিত হচ্ছে।
বাংলানিউজ : দেশের অর্থনীতির অন্যতম নিয়ামক ব্যাংক। ব্যাংক ব্যবস্থার আধুনিকায়নে কি উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন আপনি?
গভর্নর : ২০১১ সালের জুলাই মাসে ঋণ-তথ্য ব্যুরো (সিআইবি) অনলাইন কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ফলে অনলাইনের মাধ্যমে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সার্চিং করে অতি দ্রুত সিআইবি রিপোর্ট সংগ্রহ করছে। সিআইবি রিপোর্ট প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আগে যেখানে ৫ দিন থেকে ক্ষেত্রবিশেষে এক মাস সময় লাগতো, বর্তমানে মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই এ রিপোর্ট পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। ফলে, ঋণ প্রদানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
এছাড়া অটোমেটেড ক্লিয়ারিং হাউজসহ গত ২০১১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলাদেশ ইলেক্ট্রনিক ফান্ড সলভ ট্রান্সফার নেটওয়ার্ক’র কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক একটি আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষ ও নিরাপদ ব্যাংকিং খাত গড়ে তুলতে কাজ করে যাচ্ছে। অনলাইন ব্যাংকিং কার্যক্রম, সিআইবি অনলাইন, অটোমেটেড ক্লিয়ারিং হাউস, মোবাইল ব্যাংকিংসহ ই-কর্মাস তারই সুফল।
এরই মধ্যে ৪৭টি ব্যাংকের মধ্যে ৩৭টি পুরোপুরি এবং ৪টি আংশিকভাবে অনলাইনে সেবা দেওয়া শুরু করেছে।
বাংলানিউজ : ব্যাংকের গ্রাহকসেবার মানোন্নয়নে কি কি পদক্ষেপ নিয়েছেন?
গভর্নর : গ্রাহকসেবার মানোন্নয়নে আমানত ও ঋণের সুদের হার এবং শিডিউল অব চার্জেস এর পূর্ণ তালিকা গ্রাহকের জন্য প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নিজস্ব ওয়েবসাইটে এটি প্রদর্শন করার জন্য ব্যাংকগুলোকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সেবার বিপরীতে গৃহীত চার্জের যথাসম্ভব যৌক্তিকীকরণের জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ব্যাংকিং খাতে গ্রাহকের আস্থা ও সন্তুষ্টি বজায় রাখার জন্য গ্রাহকদের অভিযোগ নিষ্পত্তির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ও শাখা অফিসগুলোতে ‘গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ কেন্দ্র’ স্থাপন করা হয়েছে।
আশা করি, এসব উদ্যোগ গ্রাহকস্বার্থ রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
বাংলানিউজ : বাংলাদেশ ব্যাংককে ডিজিটালাইজড করতে গৃহীত পদক্ষেপগুলো কি কি?
গভর্নর : সরকারের ``ডিজিটাল বাংলাদেশ`` গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যকে সামনে রেখে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ই-টেন্ডারিং, ই-রিক্রুটমেন্ট, অন-লাইন ব্যাংকিং নেটওয়ার্কিং, এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং, ইন্টারনেট সিস্টেম ইত্যাদি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এসবের মাধ্যমে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে। একই সঙ্গে সম্ভব হচ্ছে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ।
এসবের ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রম আরো স্বচ্ছ ও গতিশীল হয়েছে।
বাংলানিউজ : ব্যাংকগুলো কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনে কতদূর এগিয়েছে?
গভর্নর : আর্থিক খাতে কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) পালনকে বাধ্যতামূলক করায় ব্যাংকগুলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, ক্রীড়া, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ দারিদ্র্য দূরীকরণ-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সিএসআর কার্যক্রমে ২০০৯ সালে ৫৫ কোটি ব্যয় করে। কিন্তু ২০১০ সালে ৩৯১ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। ২০১১ সালের এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগের ফলে সিএসআর এখন ব্যাংকগুলোর কার্যক্রমের অংশ হয়ে গেছে। ব্যাংকগুলো এগিয়ে এসেছে। সরকারের দারিদ্র্য দূরীকরণ ও কর্মসৃজন কর্মসূচির আওতায় ব্যাংকগুলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, খেলাধুলা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য এগিয়ে এসেছে।
বাংলানিউজ : আপনি ঘরে ঘরে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রমকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। মোবাইল ব্যাংকি সেবার বিষয়ে কিছু বলুন।
গভর্নর : ব্যাংকিং ব্যবস্থার আধুনিকায়নে বর্তমান সরকারের সময়ে প্রবর্তন করা হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং। এ পর্যন্ত ১৪টি ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করেছে। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে মোবাইল ফোন প্রযুক্তির সহায়তায় জনসাধারণকে জরুরি কতগুলো ব্যাংকিং ও আর্থিক সেবা প্রদান সম্ভব হচ্ছে। যেমন, টাকা জমা করা, টাকা তোলা, কেনাকাটার বিল ও ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, বেতন প্রদান, এটিএম থেকে টাকা তোলা, বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিট্যান্স বিতরণ ও তহবিল স্থানান্তর ইত্যাদি সেবা প্রদান করা যাচ্ছে।
এসবের মাধ্যমে দ্রুত ও কম খরচে লেনদেন এবং আধুনিক ব্যাংকিং সেবায় প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি হবে। গ্রামীণ জনপদে অর্থপ্রবাহ বাড়বে। এর ফলে অংশগ্রহণমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ভিত্তি আরো প্রসারিত হয়েছে।
বাংলানিউজ : কর্মরত ব্যাংকগুলোর শাখা বিস্তারের উদ্যোগ নিয়ে কিছু বলুন।
গভর্নর : বর্তমান সরকারের বিগত তিন বছরে মোট ১,১১২টি নতুন ব্যাংক-শাখা খোলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। শাখা সম্প্রসারণ প্রবৃদ্ধির হার ৮১৯ শতাংশ। পক্ষান্তরে, বিগত তিন বছরে কৃষি ও এসএমই খাতের উন্নয়নে ব্যাংকগুলোকে ১২৬টি কৃষি/এসএমই শাখা খোলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যা এর আগে কোনো সময় দেওয়া হয়নি।
বাংলানিউজ : নতুন ব্যাংক স্থাপনের বিষয়টি সামনে এসেছে। এটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা আছে। আপনার বক্তব্য কি?
গভর্নর : বর্তমান সরকারের আমলে বৈদেশিক কর্মসংস্থান তথা জনশক্তি রফতানিতে আর্থিক সহায়তা দান ও প্রবাসীদের দেশে বিনিয়োগ সুবিধা সম্প্রসারণসহ প্রবাসীদের সামগ্রিক কল্যাণে ‘প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক’ নামে নতুন একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এছাড়া নতুন ব্যাংকের জন্য আবেদন চাওয়া হয়েছিলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ আলোচনা করে চূড়ান্ত করেছে দেশীয় উদ্যোক্তাদের জন্য ৬টি নতুন ব্যাংক এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের উদ্যোগে তিনটি এনআরবি ব্যাংক স্থাপনের। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে কাজ করেছে।
বাংলানিউজ : কৃষিঋণ নীতিমালা ও কর্মসূচি বিষয়ে অগ্রগতি কি হয়েছে?
গভর্নর : ২০০৯-১০ এবং ২০১০-১১ অর্থবছরে মোট কৃষিঋণ বিতরণ করা হয়েছে যথাক্রমে ১১ হাজার ৫১২ ও ১২ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৯৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ১৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
কৃষিখাতে ব্যাপক ঋণসুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি ঋণ সরবরাহ প্রক্রিয়াতে গুণগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে করে প্রকৃত কৃষকরা স্বচ্ছতার সঙ্গে এবং হয়রানিমুক্তভাবে সময়মতো কৃষিঋণ পাচ্ছেন বলে আমি মনে করি। এজন্যে মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যায়ে এ মনিটরিং কার্যক্রম আরো জোরদার করতে পৃথক একটি পরিদর্শন বিভাগ খোলা হয়েছে।
বাংলানিউজ : কৃষকদের দশ টাকায় ব্যাংক-হিসাব খোলার সফলতা কেমন?
গভর্নর : হিসাব খোলার এরকম সৃজনশীল কোনো ব্যবস্থা এর আগে ছিল না। সরকারের দেওয়া বিভিন্ন ভর্তুকি ব্যাংকের মাধ্যমে সহজে পেতে মাত্র ১০ টাকা জমা দিয়ে এ পর্যন্ত ৯৫ লক্ষাধিক কৃষক ব্যাংকে গিয়ে তাদের হিসাব খুলেছেন। কৃষকরা ব্যাংকিং খাতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে আধুনিক ব্যাংকিং সুবিধা গ্রহণ করছেন।
এর বাইরে সব মিলিয়ে প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ মানুষ ১০ টাকায় হিসাব খুলতে পেরেছেন। এটা বড় অর্জন।
বাংলানিউজ : এসএমই খাতের উন্নয়নে গৃহীত পদক্ষেপগুলো কি কি?
গভর্নর : ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতের অধিকতর বিকাশ ও উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি পৃথক বিভাগ খোলা হয়েছে। ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো একটি বিস্তৃত এসএমই ঋণ-নীতিমালা প্রণয়ন করে ৩৮ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। ওই বছরে ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মোট ৫৩ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা এসএমই ঋণ বিতরণ করেছে। এটা মোট লক্ষ্যমাত্রার ১৩৮ শতাংশ।
চলতি বছর (২০১১) এসএমই ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৬ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা।
এসএমই খাতের অর্থায়ন সমস্যার সমাধানে সুলভে ও সহজ শর্তে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের অর্থায়নের বিপরীতে তিনটি আবর্তনশীল পুনঃঅর্থায়ন তহবিল (বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব, আইডিএ ও এডিবি ফান্ড) থেকেও ঋণ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
No comments