গতকাল সমকাল-প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরের তাত্পর্য by ফারুক চৌধুরী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের সরকারি সফরে ১০ জানুয়ারি ২০১০-এ দিল্লি যাচ্ছেন। কাকতালীয়ভাবে সেদিন থেকে ঠিক ৩৮ বছর আগে, ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে লন্ডন হয়ে ঢাকার পথে দিল্লিতে পদার্পণ করেন।


এই ৩৮ বছরে পৃথিবীর মানচিত্র অনেক বদলে গেছে, আমূল পরিবর্তন এসেছে বিশ্ব রাজনীতিতে। এই ৩৮ বছরে বিংশ শতাব্দীর সমাপ্তিতে এবং একবিংশ শতাব্দীর প্রথম যুগের শেষে মানবসভ্যতা রোমাঞ্চকর ও বৈপ্লবিক সব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের অমিত সম্ভাবনার এবং তারই সঙ্গে বৈশ্বিক জলবায়ুর ক্ষেত্রে একটি ভীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি। এই ৩৮ বছরে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আজ একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
বাংলাদেশ ভারত পরিবেষ্টিত একটি দেশ। এই ভৌগোলিক বাস্তবতাটি স্বাভাবিকভাবেই আমাদের দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যাবলিতে প্রতিফলিত হয়। তবে এই নৈকট্য যে সহযোগিতার পথও সুগম করতে পারে, এই উপলব্ধি এখন দুই দেশের জনগণ আর সরকারের মধ্যে দানা বাঁধছে; এবং তা শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরকে একটি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছে।
বাংলাদেশে ও ভারতে দুই নির্বাচিত সরকারই এখন তাদের নিজ নিজ মেয়াদের শুরুতে রয়েছে। তাই পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে গৃহীত কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের সময় দুই সরকারের হাতেই রয়েছে। তা ছাড়া আসন্ন এই শীর্ষ সফরের প্রস্তুতি বেশ কিছু দিন থেকেই চলছে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এরই মধ্যে ভারত সফর করেছেন, ভারতের বিদেশসচিব এসেছেন আমাদের দেশে—অতএব সফরের সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে দুই দেশের সরকারই ওয়াকিবহাল।
আরও একটি কথা এখানে বলার প্রয়োজন রয়েছে। হাসিনা সরকারের এক বছর পূর্তি হলো। এই এক বছরের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পররাষ্ট্র অঙ্গনে একটি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন। সেই ক্ষেত্রে তাঁর প্রথম ও প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল বাংলাদেশের গত কয়েক বছরের ভূলুণ্ঠিত ভাবমূর্তিটিতে পরিবর্তন আনা। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ একটি অন্তর্মুখী, ধর্মীয় সন্ত্রাসকে আশকারা দেওয়া একটি রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল। দায়িত্ব নেওয়ার এক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের এই দুর্ভাগ্যজনক ভাবমূর্তিতে পরিবর্তন আনতে পেরেছেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ আজ একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, উদারপন্থী, আধুনিকমনা রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শেখ হাসিনার কর্মতত্পরতা, তা জলবায়ু পরিবর্তনের উদ্বেগজনক পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করেই হোক, অথবা জাতিসংঘে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের ভূমিকায়, বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তায় তাঁর আগ্রহেই হোক অথবা সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় তাঁর দৃঢ়তায়—তিনি এরই মধ্যে বিশ্ববাসীর নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছেন। তাই ভারতের সরকার ও জনগণ শেখ হাসিনার সফরকে একটি বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। সম্প্রতি ভারতে দিন দশেক অবস্থানকালে দেখেছি, তারা সাগ্রহে শেখ হাসিনার সফরের অপেক্ষায় রয়েছে। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় জয়ন্ত ঘোষাল নয়াদিল্লি থেকে লিখেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে শেখ হাসিনার এই সফরকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে দিল্লি। কোপেনহেগেন থেকে ফিরেই বিদেশ মন্ত্রকের বাংলাদেশ ডেস্কের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। দুই দেশের সম্পর্কের খুঁটিনাটি হালচাল সেখানে খতিয়ে দেখা হয়। তারপর সিদ্ধান্ত হয়, দীর্ঘ এবং পরিশ্রমসাধ্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় ঢাকার সঙ্গে যে সুসম্পর্কের সূত্রপাত হয়েছে, তাকে এগিয়ে যেতে অত্যন্ত সাবধানে পা ফেলতে হবে।...ঠিক হয়েছে শেখ হাসিনার এই সফরে নিরাপত্তার প্রসঙ্গ ছাড়া অন্য চাওয়া-পাওয়ার বিষয়গুলো নিয়ে একেবারেই জোরাজুরি করা হবে না।’
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব এবং আশির দশকে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার কৃষ্ণান শ্রীনিবাসন ইংরেজি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর একটি বিশ্বাস জন্মেছিল যে, ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক কামনা করে কোনো রাজনৈতিক দলই নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারবে না। সেই ধারণা যে ভুল, তা শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন।’ তিনি আরও বলেছেন, গত সেপ্টেম্বরে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে আলোচনায় এটা উঠে এসেছে যে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রগতিতে ভারতের সাহায্যের প্রয়োজন রয়েছে। তিনি বলেছেন, ভারতকে ‘ভুল মাত্রায় হলেও উদার হতে হবে’ (generous to a fault)। তাঁর কথায়, ‘ভারতের উচিত একটি বৃহত্ মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশকে তার কৌশলগত অংশীদার হিসেবে গ্রহণ করা (strategic partner)।’
তিনি বাংলাদেশি দ্রব্যাদি বিনা শুল্কে আমদানির সুপারিশ করেছেন, বাংলাদেশকে অন্তত ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ সরবরাহের কথা বলেছেন। বলেছেন, তিস্তা নদীর পানিবণ্টন এবং বরাক নদীর ওপর টিপাইমুখ যাতে ‘আরও একটি ফারাক্কায়’ পরিণত না হয়, সেই দিকে জরুরি দৃষ্টি দেওয়ার কথা। তিনি সীমান্তসীমা নির্ধারণ সম্পন্ন করার ওপর জোর দিয়েছেন।
আরও অনেক কথার মধ্যে কৃষ্ণান শ্রীনিবাসন বলেছেন, আজ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি সুফলভিত্তিক সহযোগিতার রোডম্যাপের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘প্রায় ৪০ বছর পর বলটি এবার নয়াদিল্লির কোর্টে’।
একটি সফরে দৃশ্যমান কিছু অর্জনের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন হলো উদ্ভূত যেকোনো দ্বিপক্ষীয় সমস্যা সমাধানের রাজনৈতিক সদিচ্ছা। সেই সদিচ্ছার ঘাটতি এ যাত্রায় হবে বলে মনে হয় না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফর আমাদের দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন একটি পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারবে। আজ এই সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদনটি লিখতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর একটি কথা বারবার মনে পড়ছে। ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতার রাজভবনে একটি আনুষ্ঠানিক ভাষণে তিনি উপমহাদেশে অর্থনৈতিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন, যাতে এই অঞ্চলের দরিদ্র জনসাধারণ আমাদের স্বাধীনতার সুফল পায়। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা যদি তা অর্জন করতে ব্যর্থ হই, তা হলে ভবিষ্যত্ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।’ ৩৮ বছর আগে উচ্চারিত এই মূল্যবান সাবধানবাণীর তাত্পর্য প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশ আর ভারতের মধ্যে নিত্যনতুন সমস্যার উদ্ভব হতেই পারে, তবে সেগুলোকে সমস্যা হিসেবে গণ্য না করে দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত প্রশ্ন হিসেবে বিচার করাই হবে বাস্তবধর্মী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর সহযোগিতার সুবিস্তৃত ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে সহায়ক হোক—তা-ই আমাদের ঐকান্তিক কামনা। দেশবাসীর আন্তরিক শুভেচ্ছা তাঁর সঙ্গে অবশ্যই রইবে।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্র সচিব।

No comments

Powered by Blogger.