চলতি পথে-বিরাজমান নির্বাণের নিশ্চয়তাও by দীপংকর চন্দ
রাত অনেক। সে কারণেই সৈকতে ছিল না খুব বেশি পর্যটকের উপস্থিতি। যে কয়েকজন ছিল এতক্ষণ, একমনে তারা গান শুনছিল একজন অন্ধ বাউলের। বাউলের হাতে একতারা ছিল। একটি ছোট্ট মেয়ে বসে ছিল বাউলের মলিন পোশাক স্পর্শ করে। ছোট্ট মেয়েটির ঘুম পেয়েছিল খুব। পাবে না-ই বা কেন? সেই সকালে বেরিয়েছে তারা।
দুপুরে খাওয়া হয়েছে নামেমাত্র। আধপেটা মেয়েটির কথা মাথায় রেখেই শেষবারের মতো গাইল বাউল—‘সময় গেলে সাধন হবে না...’। সময় থাকতেই সময়ের কাজ শেষ করার বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করে উঠে পড়ল বাউল। অন্ধ বাউল চলে যাওয়ার মিনিট পনেরোর মধ্যেই সৈকত ফাঁকা। আকাশভরা তারার নিচে আমি আর রানা রইলাম কেবল। কোথায় যাব আমরা সৈকত ছেড়ে! আমাদের রাত্রিবাসের নির্ধারিত স্থান যে সৈকতেই গড়ে ওঠা এলজিইডির বাংলোর দ্বিতল কক্ষে! তাই আমরা ঘুমাতে গেলাম রাতের তৃতীয় প্রহরে। সাগরের উত্তাল তরঙ্গ সাক্ষী রেখে ঘুমালাম। স্বাভাবিকভাবেই পরদিন বেশ বেলা করে বিছানা ছাড়লাম। তারপর তাড়াহুড়ো করে ছুটলাম এ অঞ্চলের আদি বাসিন্দাদের খোঁজ নিতে।
কুয়াকাটার আদি বাসিন্দা হিসেবে চিহ্নিত করা যায় কাদের? নিঃসন্দেহে রাখাইনদের। কারণ, ফ্রেডরিক ম্যানরিক নামের একজন প্রসিদ্ধ ভূ-পর্যটকের ১৬৪১ খ্রিষ্টাব্দের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী পটুয়াখালী, বরগুনার দক্ষিণাঞ্চল সে সময় জনবসতিহীন ছিল। খাপড়াভাঙ্গা, লতাচাপলি, বড় বাইশদিয়া, রাঙ্গাবালীসহ বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চল তখন ছিল বনজঙ্গলে পূর্ণ। বর্মী ভাষায় লিখিত ওয়াজোঁয়ে রাজওয়ে নামের একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থমতে, সপ্তদশ শতকের শেষ পাদে আরাকানে রাজনৈতিক অরাজকতার সৃষ্টি হলে ক্যাপ্টেন প্যো অং, উ গোস্বাগ্রী ও অক্যো চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৫০টি রাখাইন পরিবার নৌকাযোগে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে উপস্থিত হয় গলাচিপা উপজেলার রাঙ্গাবালী দ্বীপে। জনমানবহীন, জঙ্গলাকীর্ণ সেই দ্বীপাঞ্চল পরিষ্কার করে বসতি গড়ে তোলে তারা। আনুমানিক ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দে রাঙ্গাবালীতে এই নতুন বসতি গড়ে তোলার পর আরও দক্ষিণে অগ্রসর হতে হতে রাখাইনেরা একদিন এসে পৌঁছায় কলাপাড়ার শেষ প্রান্তের সমুদ্রের নিকটবর্তী স্থানে। জনমানবহীন অতি মনোরম এই স্থানটি ভীষণ মুগ্ধ করে তাদের। তারা ভাবে, বঙ্গোপসাগরের এই কূলেই ভাগ্যের পরিবর্তন হবে তাদের। তাই রাখাইনেরা এই স্থানটির নাম রাখে ‘ক্যাংছাই’। রাখাইন ভাষায় ‘ক্যাং’ অর্থ ‘ভাগ্য’, ‘ছাই’ অর্থ ‘কূল’। কিন্তু এই ভাগ্যকূলে প্রথম দিকে রাখাইনেরা পানীয় জলের নিদারুণ সমস্যায় পড়ে। সুপেয় জলের জন্য মরিয়া হয়ে একের পর এক কুয়া কাটে তারা। অবশেষে সৈকতসংলগ্ন একটি কুয়ায় খুঁজে পায় বহু কাঙ্ক্ষিত সুপেয় জল। জল প্রাপ্তির ঐতিহাসিক সূত্র ধরেই একসময় এই অঞ্চলের বাংলা নামকরণ করা হয় ‘কুয়াকাটা’।
‘রাখাইনদের খনিত সেই আদি কুয়াটি এখনো রয়েছে কুয়াকাটায়’—জানালেন সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে আসা মো. ইউনুসুর রহমান। কলাপাড়া উপজেলা রিসোর্স সেন্টারে ইনস্ট্রাকটর পদে কর্মরত এই যুবকের নির্দেশনা অনুযায়ী কুয়াকাটা বাজারের দিকে অগ্রসর হলাম আমরা। বাজারের খুব কাছেই প্রেসক্লাব, কৃষি ব্যাংক। কর্মব্যস্ত এই প্রতিষ্ঠান দুটো পেছনে ফেলে আমরা পৌঁছালাম কুয়াকাটা রাখাইন মহিলা মার্কেটের সামনে। মার্কেটের পশ্চিম প্রান্তে রাখাইন তরুণী মা চো-এর দোকান। সেই দোকান অতিক্রম করে কিছুটা পথ পেরোলেই নিচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা খানিকটা উঁচু জায়গা। লোহার গ্রিলে তৈরি একটা গেট সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম আমরা। হাতের বাঁ দিকে নাতিদীর্ঘ শীর্ষবিশিষ্ট অষ্টভুজাকৃতি ছাউনি। সেই ছাউনির কেন্দ্রস্থলে স্টিলের ফ্রেম দিয়ে ঘেরা একটি বাঁধানো কুয়া। হ্যাঁ, এটিই সেই কুয়া, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কুয়াকাটার নামকরণের ইতিহাস। আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম কুয়াটির সামনে, জীবনের নগণ্য অভিজ্ঞতার সঙ্গে আরও একটি নতুন অধ্যায় যোজন করে নিতে নিতে কুয়াটির প্রান্ত ছুঁয়ে ওপরে উঠে যাওয়া একটি অপরিসর সিঁড়ির দিকে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করলাম। বেশ কিছু ধাপযুক্ত এই সিঁড়িটির শেষ প্রান্তে ইন্দোচীন স্থাপত্যরীতিতে তৈরি একটি বৌদ্ধবিহার। দুই শতাধিক বছরের পুরোনো এই বিহারটি শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধবিহার নামেই পরিচিত স্থানীয় জনসাধারণের কাছে। কাঠ ও টিনে নির্মিত বিহারটি বর্তমানে পরিত্যক্ত অবস্থায় দণ্ডায়মান। কারণ, এর ঠিক পশ্চিম কোণেই আধুনিক স্থাপত্যরীতিতে তৈরি হয়েছে শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধবিহারের নতুন ভবন। অত্যন্ত আকর্ষণীয় এই নতুন ভবনের ভেতরে প্রবেশ করতেই সাড়ে ৩৭ মণ ওজনের অষ্টধাতুতে নির্মিত ধ্যানমগ্ন বুদ্ধমূর্তির মুখোমুখি হলাম আমরা। একটি সুবিশাল কক্ষের শেষ প্রান্তে চার ধাপবিশিষ্ট বেদির ওপর উপবিষ্ট বুদ্ধমূর্তিটির সামনে প্রার্থনারত রাখাইন পূজারি মা তেন। পূর্ণ শ্রদ্ধায় মাথা নত করে আমরা দাঁড়ালাম তাঁর কাছেই। প্রার্থনা শেষ করে স্মিতহাস্যে আমাদের দিকে তাকালেন প্রৌঢ়া পূজারি। কুশল জিজ্ঞেস করলেন এমনভাবে যেন আমাদের মধ্যে যুগ-যুগান্তের আত্মীয়তার বন্ধন বিরাজমান। মা তেনের সরল ব্যবহারে জাতি-ধর্ম-বর্ণভেদের ভ্রান্ত দূরত্ব দূর হলো নিমিষেই। আমরা মেতে উঠলাম কথোপকথনে। দীর্ঘ এই কথোপকথনের ফাঁকে ফাঁকে কতবার যে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো মহামতি বুদ্ধের মুখশ্রীতে! মহামূল্যবান এক মুগ্ধতা, পরার্থকাতর এক স্নিগ্ধতা বিরাজমান সেখানে! বিরাজমান দুঃখবিনাশী আশ্বাস, বিরাজমান নির্বাণের নিশ্চয়তাও!
কুয়াকাটার আদি বাসিন্দা হিসেবে চিহ্নিত করা যায় কাদের? নিঃসন্দেহে রাখাইনদের। কারণ, ফ্রেডরিক ম্যানরিক নামের একজন প্রসিদ্ধ ভূ-পর্যটকের ১৬৪১ খ্রিষ্টাব্দের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী পটুয়াখালী, বরগুনার দক্ষিণাঞ্চল সে সময় জনবসতিহীন ছিল। খাপড়াভাঙ্গা, লতাচাপলি, বড় বাইশদিয়া, রাঙ্গাবালীসহ বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চল তখন ছিল বনজঙ্গলে পূর্ণ। বর্মী ভাষায় লিখিত ওয়াজোঁয়ে রাজওয়ে নামের একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থমতে, সপ্তদশ শতকের শেষ পাদে আরাকানে রাজনৈতিক অরাজকতার সৃষ্টি হলে ক্যাপ্টেন প্যো অং, উ গোস্বাগ্রী ও অক্যো চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৫০টি রাখাইন পরিবার নৌকাযোগে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে উপস্থিত হয় গলাচিপা উপজেলার রাঙ্গাবালী দ্বীপে। জনমানবহীন, জঙ্গলাকীর্ণ সেই দ্বীপাঞ্চল পরিষ্কার করে বসতি গড়ে তোলে তারা। আনুমানিক ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দে রাঙ্গাবালীতে এই নতুন বসতি গড়ে তোলার পর আরও দক্ষিণে অগ্রসর হতে হতে রাখাইনেরা একদিন এসে পৌঁছায় কলাপাড়ার শেষ প্রান্তের সমুদ্রের নিকটবর্তী স্থানে। জনমানবহীন অতি মনোরম এই স্থানটি ভীষণ মুগ্ধ করে তাদের। তারা ভাবে, বঙ্গোপসাগরের এই কূলেই ভাগ্যের পরিবর্তন হবে তাদের। তাই রাখাইনেরা এই স্থানটির নাম রাখে ‘ক্যাংছাই’। রাখাইন ভাষায় ‘ক্যাং’ অর্থ ‘ভাগ্য’, ‘ছাই’ অর্থ ‘কূল’। কিন্তু এই ভাগ্যকূলে প্রথম দিকে রাখাইনেরা পানীয় জলের নিদারুণ সমস্যায় পড়ে। সুপেয় জলের জন্য মরিয়া হয়ে একের পর এক কুয়া কাটে তারা। অবশেষে সৈকতসংলগ্ন একটি কুয়ায় খুঁজে পায় বহু কাঙ্ক্ষিত সুপেয় জল। জল প্রাপ্তির ঐতিহাসিক সূত্র ধরেই একসময় এই অঞ্চলের বাংলা নামকরণ করা হয় ‘কুয়াকাটা’।
‘রাখাইনদের খনিত সেই আদি কুয়াটি এখনো রয়েছে কুয়াকাটায়’—জানালেন সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে আসা মো. ইউনুসুর রহমান। কলাপাড়া উপজেলা রিসোর্স সেন্টারে ইনস্ট্রাকটর পদে কর্মরত এই যুবকের নির্দেশনা অনুযায়ী কুয়াকাটা বাজারের দিকে অগ্রসর হলাম আমরা। বাজারের খুব কাছেই প্রেসক্লাব, কৃষি ব্যাংক। কর্মব্যস্ত এই প্রতিষ্ঠান দুটো পেছনে ফেলে আমরা পৌঁছালাম কুয়াকাটা রাখাইন মহিলা মার্কেটের সামনে। মার্কেটের পশ্চিম প্রান্তে রাখাইন তরুণী মা চো-এর দোকান। সেই দোকান অতিক্রম করে কিছুটা পথ পেরোলেই নিচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা খানিকটা উঁচু জায়গা। লোহার গ্রিলে তৈরি একটা গেট সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম আমরা। হাতের বাঁ দিকে নাতিদীর্ঘ শীর্ষবিশিষ্ট অষ্টভুজাকৃতি ছাউনি। সেই ছাউনির কেন্দ্রস্থলে স্টিলের ফ্রেম দিয়ে ঘেরা একটি বাঁধানো কুয়া। হ্যাঁ, এটিই সেই কুয়া, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কুয়াকাটার নামকরণের ইতিহাস। আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম কুয়াটির সামনে, জীবনের নগণ্য অভিজ্ঞতার সঙ্গে আরও একটি নতুন অধ্যায় যোজন করে নিতে নিতে কুয়াটির প্রান্ত ছুঁয়ে ওপরে উঠে যাওয়া একটি অপরিসর সিঁড়ির দিকে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করলাম। বেশ কিছু ধাপযুক্ত এই সিঁড়িটির শেষ প্রান্তে ইন্দোচীন স্থাপত্যরীতিতে তৈরি একটি বৌদ্ধবিহার। দুই শতাধিক বছরের পুরোনো এই বিহারটি শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধবিহার নামেই পরিচিত স্থানীয় জনসাধারণের কাছে। কাঠ ও টিনে নির্মিত বিহারটি বর্তমানে পরিত্যক্ত অবস্থায় দণ্ডায়মান। কারণ, এর ঠিক পশ্চিম কোণেই আধুনিক স্থাপত্যরীতিতে তৈরি হয়েছে শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধবিহারের নতুন ভবন। অত্যন্ত আকর্ষণীয় এই নতুন ভবনের ভেতরে প্রবেশ করতেই সাড়ে ৩৭ মণ ওজনের অষ্টধাতুতে নির্মিত ধ্যানমগ্ন বুদ্ধমূর্তির মুখোমুখি হলাম আমরা। একটি সুবিশাল কক্ষের শেষ প্রান্তে চার ধাপবিশিষ্ট বেদির ওপর উপবিষ্ট বুদ্ধমূর্তিটির সামনে প্রার্থনারত রাখাইন পূজারি মা তেন। পূর্ণ শ্রদ্ধায় মাথা নত করে আমরা দাঁড়ালাম তাঁর কাছেই। প্রার্থনা শেষ করে স্মিতহাস্যে আমাদের দিকে তাকালেন প্রৌঢ়া পূজারি। কুশল জিজ্ঞেস করলেন এমনভাবে যেন আমাদের মধ্যে যুগ-যুগান্তের আত্মীয়তার বন্ধন বিরাজমান। মা তেনের সরল ব্যবহারে জাতি-ধর্ম-বর্ণভেদের ভ্রান্ত দূরত্ব দূর হলো নিমিষেই। আমরা মেতে উঠলাম কথোপকথনে। দীর্ঘ এই কথোপকথনের ফাঁকে ফাঁকে কতবার যে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো মহামতি বুদ্ধের মুখশ্রীতে! মহামূল্যবান এক মুগ্ধতা, পরার্থকাতর এক স্নিগ্ধতা বিরাজমান সেখানে! বিরাজমান দুঃখবিনাশী আশ্বাস, বিরাজমান নির্বাণের নিশ্চয়তাও!
No comments