বাজার ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণের সীমাবদ্ধতা by এ এম এম শওকত আলী
অভিজ্ঞতায় দৃশ্যমান হয় যে বাজার ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণের যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ বিষয়টি খাদ্যশস্য বা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্য যেমন প্রযোজ্য, তেমনি শেয়ারবাজার সম্পর্কেও প্রযোজ্য। খাদ্যশস্য বা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঊর্ধ্বগতির বিষয় গত কয়েক বছর ধরেই সবাই জানে ও সহ্য করে আসছে।
বাজার ব্যবস্থাপনার জন্য পেশাদারিত্বের প্রয়োজন। কেবল রাজনৈতিক বুলি দিয়ে প্রয়োজনীয় পেশাদারিত্ব অর্জন করা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক আইনকানুন করেও বাজার সব সময় স্থিতিশীল রাখা সম্ভব নয়। শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতার জন্য সাধারণ অর্থে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা সিকিউরিটি এঙ্চেঞ্জ কমিশন নামে পরিচিত। সাম্প্রতিককালে শেয়ারবাজারে ধসের জন্য সরকার ভবিষ্যতে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা চিহ্নিত করার লক্ষ্যে একটি তদন্ত কমিটি তিন মাস আগে গঠন করেছিল। কমিটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করার পর প্রতিদিনই মিডিয়া বিভিন্ন ধরনের সংবাদ প্রচারে ব্যস্ত। যেকোনো বাজার সহজে ও সূক্ষ্মভাবে প্রতিক্রিয়াশীল। বাজারদরের পতন বা বৃদ্ধি যে কেবল সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্যের ওপরই নির্ভরশীল, তা সম্পূর্ণরূপে সত্য নয়।
প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ ও বাজারের বড় বড় খেলোয়াড়রা (গধৎশবঃ চষধুবৎ) এ কথাটি প্রচার করেন। তাঁদের মতে, বাজারে নতুন নতুন শেয়ার না এলে বাজার স্থিতিশীল হবে না। এ কারণেই কিছু সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ওপর সরকার প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ করেছিল। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে হুঁশিয়ার-বাণীও উচ্চারণ করা হয়েছিল যে ওই সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বাজারে শেয়ার উন্মুক্ত করতে ব্যর্থ হলেও তাঁরা পদচ্যুত হবেন। এর জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমাও সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছিল। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি কী, তা জানা নেই। এ ক্ষেত্রে যা বলা যায় তা হলো, সরকারি শেয়ার এ মুহূর্তেই বাজারে ছাড়া সঠিক হবে না। কারণ বাজারে ধস নেমেছে। আরো উল্লেখ করা যায়, ১৯৯৬-পরবর্তী সময়ে সরকারের অভ্যন্তরের কিছু ব্যক্তি এ ধরনের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীকে আলোচনাক্রমে দিয়েছিলেন। আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল সার বিপণন ব্যবস্থা। হঠাৎ করে অপ্রাসঙ্গিক একটি বিষয় কেন প্রস্তাব আকারে দেওয়া হয়েছিল তা জানা নেই। তবে উপস্থিত মাত্র দুজন সচিবই এর বিপক্ষে মত প্রদান করেন। একজন বলেছিলেন, শেয়ারের দরের বিষয়ে আইসিবির মতামত প্রয়োজন, যা সময়সাপেক্ষ। অন্যজন বলেছিলেন, বাজারের দর স্থিতিশীল নয় বরং অস্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করছে। উপযুক্ত সময়ে এ বিষয়ে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই বাঞ্ছনীয় হবে। ওই পর্যায়েই বিষয়টির সমাপ্তি ঘটে।
১২ এপ্রিল একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রধান সংবাদ ছিল শেয়ারবাজার-সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদনের ফলে বাজারের দরপতন অব্যাহত ও অধিকতর নিম্নমুখী। অথচ স্বচ্ছতার জন্য তদন্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করা বাঞ্ছনীয়। আর্থিক বাজার কাঠামো অযাচিত আলোচনার বিষয়বস্তু হলে বাজার অস্থিতিশীল বা পতনমুখী হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা অবশ্যই থাকে। সংবাদে বলা হয়েছে, বর্তমানে এক. বাজারে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে; দুই. আর্থিক প্রতিষ্ঠান-সংক্রান্ত আইন সংশোধনের যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, এর ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংশয় রয়েছে এবং তিন. বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে শেয়ার লেনদেনে নিরুৎসাহিত। তারা বাজার থেকে দূরে সরে এসেছে। তাদের ভীতির কারণ মামলা-মোকদ্দমা ও শাস্তির সম্ভাবনা।
শেয়ারবাজারে বিভ্রান্তির কারণ কেবল তদন্ত প্রতিবেদনই হতে পারে না। শেয়ারবাজারে দর ওঠানামা করাই স্বাভাবিক। তবে অস্বাভাবিক মাত্রায় দর বৃদ্ধি বা পতন হলেই আশঙ্কার কারণ হয়। স্মরণ করা যেতে পারে যে ১৯৯৬ সালে যখন দর অস্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করেছিল, তখন বিশেষজ্ঞসহ অর্থ মন্ত্রণালয় থেকেও বলা হয়েছিল যে এ ধারা বাজার সংশোধনই (গধৎশবঃ ঈড়ৎৎবপঃরড়হ) মাত্র। এসব যুক্তি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বোধগম্য হওয়ার কথা নয়। ১৩ এপ্রিল একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদটি শুভ সংবাদ ছিল। শেয়ারবাজার পুনরায় চাঙ্গা হয়েছে। সর্বদাই যে শেয়ারবাজারে তেজিভাব বিরাজ করবে, এটা আশা করা বৃথা।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যে সংশয়ের কথা বলা হয়েছে তা অর্ধমৃত। মিডিয়া কর্তৃক প্রকাশিত সংবাদে বাজারে কয়েকটি ব্যাংকের শেয়ার অস্বাভাবিক লেনদেনের বিষয়ও প্রকাশ করা হয়েছে। শেয়ারবাজারে লেনদেন করার জন্যই মার্চেন্ট ব্যাংকিং নামে কিছু অর্থলগি্ন প্রতিষ্ঠান জন্মলাভ করে। ধারণা করা হয়, মূল আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সক্ষম বিনিয়োগকারীরাই এর অন্তত সিংহভাগের মালিক। এ বিষয়টি অনুসন্ধানযোগ্য। কারণ এর ফলে অর্থ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একচেটিয়া ব্যবসার সম্ভাবনাই অধিকতর। বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণ করার কোনো এখতিয়ার নেই। তবে মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রণ করার একচেটিয়া অধিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। শেয়ারবাজার অস্বাভাবিকভাবে অস্থিতিশীল হওয়ার বিতর্কে এ কথাও অনেকে বলেছেন যে কিছু সিদ্ধান্ত এ অবস্থা সৃষ্টির জন্য দায়ী। ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের বিষয়টিও ছিল এর অন্য একটি কারণ। অবশ্য এ যুক্তি সিকিউরিটি এঙ্চেঞ্জ কমিশনের জন্যই অধিকতর প্রযোজ্য। ব্যাংক আমানতকারীদের অর্থেই এ ব্যবসা করে থাকে। আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তা বিধান ব্যাংকের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। এদের গচ্ছিত আমানত অধিকমাত্রায় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ প্রশ্নাতীত হতে পারে না। কারণ স্বাভাবিকভাবে শেয়ারবাজারে লেনদেনের মধ্যে ঝুঁকি থাকে। অস্বাভাবিক বিনিয়োগের ফলে ব্যাংকগুলো তাদের আমানতকারীদের গচ্ছিত অর্থ বাজারে বিনিয়োগ করলে আমানতকারীদের গচ্ছিত অর্থই ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। এ ছাড়া শিল্পসহ অন্যান্য উৎপাদনশীল খাতে ব্যাংকের বিনিয়োগের সক্ষমতা হ্রাস পাবে।
ব্যাংক, শেয়ার বিনিয়োগকারী সংস্থা ও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা একটি জটিল চক্রে আবদ্ধ। এ কারণেই শেয়ারবাজার ব্যবস্থাপনার বিষয়টি জটিল। নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে রয়েছে সিকিউরিটি এঙ্চেঞ্জ কমিশন। তবে শেয়ারবাজারে লেনদেনের সঙ্গে সম্পৃক্ত যেকোনো একটি প্রতিষ্ঠান স্ব স্ব ক্ষেত্রে সঠিক এবং সময়োচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হলে বাজার অস্বাভাবিক হতে বাধ্য। এ জন্য প্রয়োজন বাজার নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডে সমন্বয়। এসব বিষয় অনুধাবন করেই তদন্ত কমিটি সিকিউরিটি এঙ্চেঞ্জ কমিশনের কাঠামোগত সংস্কারের বিষয়টির ওপরও গুরুত্বারোপ করেছে। প্রস্তাবিত সংস্কারের রূপরেখা এখনো প্রকাশিত হয়নি। প্রকাশিত হওয়ার পর বিষয়টি আরো আলোচিত হবে বলে আশা করা যায়। আলোচনার ক্ষেত্র সরকারি গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ না হওয়াই ভালো হবে। তবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে বিষয়টি মিডিয়ায়ও আলোচনা হবে। বিক্ষিপ্তভাবে আলোচনা না করাই শ্রেয়।
আলোচনার জন্য সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বেসরকারি ও সংশ্লিষ্ট শেয়ারবাজারে লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিরাই এতে অংশগ্রহণ করবেন বলে আশা করা যায়। ব্যাংকসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অবশ্যই স্বীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য নানা ধরনের প্রস্তাব পেশ করবেন। ফলে সৃষ্টি হবে নানা মুনির নানা মত। এ বিষয়ে জনস্বার্থকেই অধিকতর প্রাধান্য দিতে হবে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ-ভিন্নতা থাকাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করাও সমীচীন হবে না। বিষয়টি নিঃসন্দেহে জটিল। এ জন্য যথেষ্ট সতর্কভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
ভবিষ্যতে আইনসহ কাঠামোগত সংস্কারের বিষয়ে বলা যায়, একমাত্র সংস্কারের ফলেই যে বাজার সচল হবে তা আশা করা যায় না। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে সিকিউরিটি এঙ্চেঞ্জ কমিশনের কর্মকর্তাদের শেয়ারবাজার ব্যবস্থাপনার বিষয়ে জ্ঞানসম্পন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বৃদ্ধিরও প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। যেকোনো সংস্থার প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা নির্ভর করে কর্মরত ব্যক্তিদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে পেশাগত দক্ষতা। এ ছাড়া প্রয়োজন রয়েছে তাঁদের প্রশ্নাতীত সততা ও নিরপেক্ষতা। তদন্ত প্রতিবেদনে এ কমিশনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিষয়ে কিছু ধারণা দেওয়া হয়েছে। সুতরাং ভবিষ্যতে এ বিষয় দুটি নিশ্চিত হওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ ও বাজারের বড় বড় খেলোয়াড়রা (গধৎশবঃ চষধুবৎ) এ কথাটি প্রচার করেন। তাঁদের মতে, বাজারে নতুন নতুন শেয়ার না এলে বাজার স্থিতিশীল হবে না। এ কারণেই কিছু সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ওপর সরকার প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ করেছিল। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে হুঁশিয়ার-বাণীও উচ্চারণ করা হয়েছিল যে ওই সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বাজারে শেয়ার উন্মুক্ত করতে ব্যর্থ হলেও তাঁরা পদচ্যুত হবেন। এর জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমাও সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছিল। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি কী, তা জানা নেই। এ ক্ষেত্রে যা বলা যায় তা হলো, সরকারি শেয়ার এ মুহূর্তেই বাজারে ছাড়া সঠিক হবে না। কারণ বাজারে ধস নেমেছে। আরো উল্লেখ করা যায়, ১৯৯৬-পরবর্তী সময়ে সরকারের অভ্যন্তরের কিছু ব্যক্তি এ ধরনের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীকে আলোচনাক্রমে দিয়েছিলেন। আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল সার বিপণন ব্যবস্থা। হঠাৎ করে অপ্রাসঙ্গিক একটি বিষয় কেন প্রস্তাব আকারে দেওয়া হয়েছিল তা জানা নেই। তবে উপস্থিত মাত্র দুজন সচিবই এর বিপক্ষে মত প্রদান করেন। একজন বলেছিলেন, শেয়ারের দরের বিষয়ে আইসিবির মতামত প্রয়োজন, যা সময়সাপেক্ষ। অন্যজন বলেছিলেন, বাজারের দর স্থিতিশীল নয় বরং অস্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করছে। উপযুক্ত সময়ে এ বিষয়ে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই বাঞ্ছনীয় হবে। ওই পর্যায়েই বিষয়টির সমাপ্তি ঘটে।
১২ এপ্রিল একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রধান সংবাদ ছিল শেয়ারবাজার-সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদনের ফলে বাজারের দরপতন অব্যাহত ও অধিকতর নিম্নমুখী। অথচ স্বচ্ছতার জন্য তদন্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করা বাঞ্ছনীয়। আর্থিক বাজার কাঠামো অযাচিত আলোচনার বিষয়বস্তু হলে বাজার অস্থিতিশীল বা পতনমুখী হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা অবশ্যই থাকে। সংবাদে বলা হয়েছে, বর্তমানে এক. বাজারে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে; দুই. আর্থিক প্রতিষ্ঠান-সংক্রান্ত আইন সংশোধনের যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, এর ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংশয় রয়েছে এবং তিন. বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে শেয়ার লেনদেনে নিরুৎসাহিত। তারা বাজার থেকে দূরে সরে এসেছে। তাদের ভীতির কারণ মামলা-মোকদ্দমা ও শাস্তির সম্ভাবনা।
শেয়ারবাজারে বিভ্রান্তির কারণ কেবল তদন্ত প্রতিবেদনই হতে পারে না। শেয়ারবাজারে দর ওঠানামা করাই স্বাভাবিক। তবে অস্বাভাবিক মাত্রায় দর বৃদ্ধি বা পতন হলেই আশঙ্কার কারণ হয়। স্মরণ করা যেতে পারে যে ১৯৯৬ সালে যখন দর অস্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করেছিল, তখন বিশেষজ্ঞসহ অর্থ মন্ত্রণালয় থেকেও বলা হয়েছিল যে এ ধারা বাজার সংশোধনই (গধৎশবঃ ঈড়ৎৎবপঃরড়হ) মাত্র। এসব যুক্তি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বোধগম্য হওয়ার কথা নয়। ১৩ এপ্রিল একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদটি শুভ সংবাদ ছিল। শেয়ারবাজার পুনরায় চাঙ্গা হয়েছে। সর্বদাই যে শেয়ারবাজারে তেজিভাব বিরাজ করবে, এটা আশা করা বৃথা।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যে সংশয়ের কথা বলা হয়েছে তা অর্ধমৃত। মিডিয়া কর্তৃক প্রকাশিত সংবাদে বাজারে কয়েকটি ব্যাংকের শেয়ার অস্বাভাবিক লেনদেনের বিষয়ও প্রকাশ করা হয়েছে। শেয়ারবাজারে লেনদেন করার জন্যই মার্চেন্ট ব্যাংকিং নামে কিছু অর্থলগি্ন প্রতিষ্ঠান জন্মলাভ করে। ধারণা করা হয়, মূল আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সক্ষম বিনিয়োগকারীরাই এর অন্তত সিংহভাগের মালিক। এ বিষয়টি অনুসন্ধানযোগ্য। কারণ এর ফলে অর্থ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একচেটিয়া ব্যবসার সম্ভাবনাই অধিকতর। বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণ করার কোনো এখতিয়ার নেই। তবে মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রণ করার একচেটিয়া অধিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। শেয়ারবাজার অস্বাভাবিকভাবে অস্থিতিশীল হওয়ার বিতর্কে এ কথাও অনেকে বলেছেন যে কিছু সিদ্ধান্ত এ অবস্থা সৃষ্টির জন্য দায়ী। ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের বিষয়টিও ছিল এর অন্য একটি কারণ। অবশ্য এ যুক্তি সিকিউরিটি এঙ্চেঞ্জ কমিশনের জন্যই অধিকতর প্রযোজ্য। ব্যাংক আমানতকারীদের অর্থেই এ ব্যবসা করে থাকে। আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তা বিধান ব্যাংকের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। এদের গচ্ছিত আমানত অধিকমাত্রায় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ প্রশ্নাতীত হতে পারে না। কারণ স্বাভাবিকভাবে শেয়ারবাজারে লেনদেনের মধ্যে ঝুঁকি থাকে। অস্বাভাবিক বিনিয়োগের ফলে ব্যাংকগুলো তাদের আমানতকারীদের গচ্ছিত অর্থ বাজারে বিনিয়োগ করলে আমানতকারীদের গচ্ছিত অর্থই ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। এ ছাড়া শিল্পসহ অন্যান্য উৎপাদনশীল খাতে ব্যাংকের বিনিয়োগের সক্ষমতা হ্রাস পাবে।
ব্যাংক, শেয়ার বিনিয়োগকারী সংস্থা ও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা একটি জটিল চক্রে আবদ্ধ। এ কারণেই শেয়ারবাজার ব্যবস্থাপনার বিষয়টি জটিল। নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে রয়েছে সিকিউরিটি এঙ্চেঞ্জ কমিশন। তবে শেয়ারবাজারে লেনদেনের সঙ্গে সম্পৃক্ত যেকোনো একটি প্রতিষ্ঠান স্ব স্ব ক্ষেত্রে সঠিক এবং সময়োচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হলে বাজার অস্বাভাবিক হতে বাধ্য। এ জন্য প্রয়োজন বাজার নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডে সমন্বয়। এসব বিষয় অনুধাবন করেই তদন্ত কমিটি সিকিউরিটি এঙ্চেঞ্জ কমিশনের কাঠামোগত সংস্কারের বিষয়টির ওপরও গুরুত্বারোপ করেছে। প্রস্তাবিত সংস্কারের রূপরেখা এখনো প্রকাশিত হয়নি। প্রকাশিত হওয়ার পর বিষয়টি আরো আলোচিত হবে বলে আশা করা যায়। আলোচনার ক্ষেত্র সরকারি গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ না হওয়াই ভালো হবে। তবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে বিষয়টি মিডিয়ায়ও আলোচনা হবে। বিক্ষিপ্তভাবে আলোচনা না করাই শ্রেয়।
আলোচনার জন্য সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বেসরকারি ও সংশ্লিষ্ট শেয়ারবাজারে লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিরাই এতে অংশগ্রহণ করবেন বলে আশা করা যায়। ব্যাংকসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অবশ্যই স্বীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য নানা ধরনের প্রস্তাব পেশ করবেন। ফলে সৃষ্টি হবে নানা মুনির নানা মত। এ বিষয়ে জনস্বার্থকেই অধিকতর প্রাধান্য দিতে হবে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ-ভিন্নতা থাকাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করাও সমীচীন হবে না। বিষয়টি নিঃসন্দেহে জটিল। এ জন্য যথেষ্ট সতর্কভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
ভবিষ্যতে আইনসহ কাঠামোগত সংস্কারের বিষয়ে বলা যায়, একমাত্র সংস্কারের ফলেই যে বাজার সচল হবে তা আশা করা যায় না। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে সিকিউরিটি এঙ্চেঞ্জ কমিশনের কর্মকর্তাদের শেয়ারবাজার ব্যবস্থাপনার বিষয়ে জ্ঞানসম্পন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বৃদ্ধিরও প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। যেকোনো সংস্থার প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা নির্ভর করে কর্মরত ব্যক্তিদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে পেশাগত দক্ষতা। এ ছাড়া প্রয়োজন রয়েছে তাঁদের প্রশ্নাতীত সততা ও নিরপেক্ষতা। তদন্ত প্রতিবেদনে এ কমিশনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিষয়ে কিছু ধারণা দেওয়া হয়েছে। সুতরাং ভবিষ্যতে এ বিষয় দুটি নিশ্চিত হওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments