উন্নয়ন ভাবনা-এগিয়ে যাওয়ার অর্থনীতি by মামুন রশীদ
গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের একটি বছর পার হয়েছে। জনমত জরিপে মোটামুটি সঠিক পথেই সরকার এগোচ্ছে বলে জানা গেছে। বৈশ্বিক মন্দা, বিদ্যুত্ ও গ্যাসের সংকট সত্ত্বেও বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি ছয় শতাংশের মতো হবে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
বেশ বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। বিদেশি বিনিয়োগ বেশ কিছুটা কমে গেলেও রপ্তানি খাত কিছুটা এগিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বেড়েছে। জাপান, চীন, ভারতে রপ্তানির সম্ভাবনা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ আরও ভালো হতে পারত বলে নীতিনির্ধারকেরাও মনে করছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পেতে টিফা চুক্তি সই কিংবা জাতীয় কয়লানীতি প্রণয়ন ও অনুমোদনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নির্বাচিত সরকারও কেমন যেন থমকে আছে বলে মনে হয়েছে। রাজনৈতিক জঞ্জাল পরিষ্কার করায় সরকার যতটা তত্পর ছিল, অর্থনীতির এগিয়ে যাওয়ার পথকে কণ্টকমুক্ত করার ক্ষেত্রে সরকারকে আরও দৃঢ় দেখতে চেয়েছিল অনেকেই।
বাংলাদেশের উন্নয়নের সম্ভাবনা বিশ্বজুড়ে মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। তবে একটি বড় সত্য হচ্ছে, এই সাফল্য আমাদের অমিত সম্ভাবনার তুলনায় যথেষ্ট কম। সম্পদ সৃষ্টির প্রচেষ্টায় আমরা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ধীরে ধীরে বিভিন্ন বাজারশক্তি বা উপকরণ প্রবর্তনের পদ্ধতি গ্রহণ করেছি, যা আবার আমাদের সাময়িক ভুলের জন্য থেমেও গেছে। এর মধ্যে প্রতিটি ভুলই আমাদের সম্পদ সৃষ্টির প্রয়াসকে শুধু বিঘ্নিতই করেনি, বরং এর পাশাপাশি পশ্চাত্মুখী পদক্ষেপ গ্রহণেও বাধ্য করেছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভাবনার প্রতি যেভাবে বিশ্বের মনোযোগ বাড়ছে, তা কাজে লাগানো উচিত। উন্নয়ন সম্ভাবনার তুল্যমূল্য বিচার এবং সেটি কাজে লাগাতে হলে আমাদের অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার নতুন মডেল বা নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রচলনের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সম্পদ সৃষ্টি ও বণ্টন প্রক্রিয়ার মধ্যে দৃশ্যমান দ্বন্দ্বকে কীভাবে দেখা ও সামলানো হবে, সেটির একটি পরিষ্কার ব্যাখ্যাও থাকতে হবে। আমরা ইতিমধ্যে উন্নয়নের লক্ষ্য ত্বরান্বিত করতে প্রতিযোগিতামূলক বাজারভিত্তিক অর্থনৈতিক মডেল গ্রহণ করেছি। এ অবস্থান থেকে আমাদের যেন পশ্চাত্মুখী হতে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রতিবারই আমরা দেখেছি, বাজারের আচরণে অকার্যকরতার লক্ষণ থাকলে বা এতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে আমাদের সামনে যেন উন্নয়ন-প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার মতো আর কোনো ভালো বিকল্প নেই। সুতরাং কোনোভাবেই যাতে সম্পদ সৃষ্টির প্রক্রিয়া ব্যাহত না হয়, তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের এটাও বোঝা দরকার—সম্পদ সৃষ্টির ধারা তখনই টেকসই হবে, যখন বিতরণ প্রক্রিয়ার কার্যকরতা জোরালো থাকবে। আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে, সুশাসন শুধু একটি নৈতিক মূল্যবোধই নয়, বরং এটি দেশের প্রবৃদ্ধি অর্জনে একটি পুঁজিও বটে। সুশাসনের অনুপস্থিতি বা এর প্রায়োগিক মাত্রা কম হলে তাতে কতিপয় ব্যক্তি বা কোনো গোষ্ঠীর জন্য স্বল্পমেয়াদে কিছু ফায়দা লোটার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু তা দীর্ঘমেয়াদে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের সুফল পাওয়া থেকে বঞ্চিত করবে।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বেসরকারি খাতই হবে দেশের প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রধান চালিকাশক্তি। এ ব্যবস্থা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে অবশ্য বেসরকারি খাতের কাঁধে বড় ধরনের দায়িত্ব বর্তাবে। তখন বেসরকারি খাতকে স্বপ্রণোদিত হয়ে সৃজনশীল ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রূপকল্প অনুযায়ী এগোতে হবে। একই সঙ্গে তারা মুক্তবাজার ব্যবস্থা থেকে সুবিধা পাওয়া আর অন্যদিকে নিজেদের স্বার্থরক্ষায় সরকারের কাছে সহায়তার দাবি তুলতে পারবে না। মুক্তবাজারের সুবিধা নিতে হলে তাদের নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানো ও সুশাসনের বিষয়ে জোর দিতে হবে, যাতে বিশ্বের যে কারও সঙ্গেই প্রতিযোগিতা করা যায়। সরকার কেবল তাদের আনুষঙ্গিক সুবিধাসহ কৌশলগত সহায়তা দিতে পারে। কিন্তু ভবিষ্যতে প্রবৃদ্ধি অর্জনের রূপকল্পটি বেসরকারি খাতকেই এগিয়ে নিতে হবে। তারা যদি সরকারকে অবকাঠামো উন্নয়নসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়ে সহায়তা বাবদ অর্থ ব্যয় করার ভূমিকায় দেখতে চায়, তাহলে বেসরকারি খাতকে এ কথাও মনে রাখতে হবে, এ জন্য তহবিলের প্রয়োজন আছে। বেসরকারি খাত সার্বিকভাবে তাদের অভ্যন্তরীণ সুশাসন জোরদার ও যথাযথভাবে কর পরিশোধ না করলে সরকারের পক্ষে এসব প্রকল্পে অর্থায়ন করা অসম্ভব। শুধু এ জন্যই কিন্তু করপোরেট সুশাসনের প্রয়োজনীয়তা সীমাবদ্ধ নয়। বেসরকারি খাতের প্রতিযোগিতাশীলতা ও সক্ষমতা বাড়ানোর জন্যও কিন্তু করপোরেট সুশাসন জোরদার করা জরুরি।
এ ক্ষেত্রে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। সেগুলো হলো—ভর্তুকি, বেসরকারিকরণ ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান। সম্পৃক্ততার কারণে বিষয়গুলো নিয়ে একযোগে কাজ করা অপরিহার্য। তবে যেখানে সম্পদ বা অর্থ বিনিয়োগ বা ব্যয় করলে সবচেয়ে বেশি সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে, সেখানেই অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে। এই ব্যবস্থার আওতায় পরিচালিত উত্তরণ প্রক্রিয়ায় উত্পাদনশীল খাতের সঙ্গে অদক্ষ খাতগুলোকে হয়তো সম্পৃক্ত করার পদক্ষেপ নেওয়ার প্রবণতাও দেখা যেতে পারে। কিন্তু করদাতাদের অর্থ অদক্ষ খাতের পেছনে ব্যয় করাটাও যে গ্রহণযোগ্য নয়, সেটিও বিবেচনায় রাখতে হবে। আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি তখনই মেনে নেওয়া যেতে পারে, যখন সরকারের দেওয়া ভর্তুকিটা হবে যৌক্তিক এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সম্পদ বিতরণের সুবাদে সুফল পাওয়া যাবে। এমন ক্ষেত্রেও কিন্তু ভর্তুকির অর্থ বাজারব্যবস্থায় কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি করবে না, সেই নিশ্চয়তা নিয়েই এগোতে হবে। সরকারকে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকা থেকে বিরত থাকতে হবে। যদি সরকার তা করেও, সে ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ব্যয়ের বদৌলতে যেন সমাজের উপকারটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। এ ছাড়া সুসমন্বিত নীতিমালার ভিত্তিতে বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়াকে জোর গতিতে এগিয়ে নিতে হবে।
সার্বিকভাবে দেশের আর্থিক বাজারের গভীরতা বাড়াতে হবে। নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাংক খাতের মাধ্যমে অর্থায়নের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের বিষয়টি জোর বিবেচনায় রাখা দরকার। পুঁজিবাজারে উপকরণের জোগান বাড়ানোও জরুরি। পুঁজিবাজারে শুধু মূলধনের পর্যাপ্ততাই নয়, বরং সেই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি বন্ডের প্রচলনও দাবি করে। আবার পুঁজিবাজারে সেকেন্ডারি মার্কেটের মাধ্যমে সরকারি সিকিউরিটিজ ও বিভিন্ন ধরনের ঋণ উপকরণও (ডেট ইন্সট্রুমেন্ট) বাড়াতে হবে। তবে সবকিছুই কার্যকরভাবে পরিচালনা করাটা নির্ভর করে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার ওপর। এ ছাড়া আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্রেডিট রেটিং বা ঋণ-মান নির্ণয়ের প্রক্রিয়া আরও জোরালো এবং স্বাধীন হওয়া বাঞ্ছনীয়।
নয়া আর্থিক ব্যবস্থা সফলভাবে বাস্তবায়নে নিয়ন্ত্রকগোষ্ঠী এবং জনপ্রশাসনকেও অধিকতর সক্রিয় হতে হবে, যাতে বেসরকারি খাতকে দ্রুততার সঙ্গে সর্বোচ্চ সেবা-সহায়তা দেওয়া যায়। সর্বোচ্চ প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাব্যতার নিরিখেই ‘লাইসেন্স’ ও ‘অনুমোদন’ দিতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা যদি কোনো কিছুর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চান, তাহলে তাঁদের প্রতিটি পদক্ষেপই হতে হবে যৌক্তিক, স্বচ্ছ ও কার্যকর। আমাদের দীর্ঘমেয়াদে উন্নয়ন রূপকল্প তৈরি করার মতো পরিকল্পনাকারী, নিয়ন্ত্রক ও জনপ্রশাসন তৈরি করতে হবে। তবে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে না পারলে তাঁরা কিন্তু সঠিকভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবণতা ও বিভিন্ন ইস্যু ভালো করে বুঝতে পারবেন না। আর যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা হলে তাঁদের সক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়বে। বদৌলতে তাঁরা কৃষি, উত্পাদন এবং সেবাসহ বিভিন্ন খাত সংক্রান্ত নীতি-পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে পারদর্শিতা দেখাতে পারবেন। পাশাপাশি তাঁরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং প্রতিপক্ষ বা প্রতিযোগী পক্ষগুলোর সঙ্গে সমঝোতা বা দরকষাকষি করে দেশের সার্বিক স্বার্থ সমুন্নত রাখতেও সক্ষম হবেন। এ ছাড়া তাঁরা অর্থনীতির আরও দুটি স্তম্ভ বহিঃ খাত এবং রেমিট্যান্স বা অন্তর্মুখী প্রবাসী-আয়ের প্রবাহ বাড়ানোর ক্ষেত্রেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন। বেসরকারি খাতকেও তাঁদের অভ্যন্তরীণ মানবসম্পদ উন্নয়নে গভীর মনোযোগ দিতে হবে। সেই সঙ্গে, দেশের উন্নয়ন সম্ভাবনা সর্বতোভাবে কাজে লাগাতে হলে বহুল আলোচিত ‘বাজার প্রবেশাধিকার’ পাওয়ার চেয়েও সংকল্পবদ্ধভাবে দেশের অবকাঠামো ও জ্বালানি খাতে প্রচুর প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে।
স্বচ্ছতা এবং সুশাসনের ওপরই যে নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাফল্য নির্ভর করবে, সেটি ভুললে চলবে না। স্বচ্ছতা নিশ্চিত হলে দ্রততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা বাড়বে এবং কোনো ভুল থাকলে তাও স্বল্পতম সময়ে শোধরানো হবে। আর সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে সরকার, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ও সুশীল সমাজসহ সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা ও ঐকমত্য থাকতে হবে।
নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব
মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।
বাংলাদেশের উন্নয়নের সম্ভাবনা বিশ্বজুড়ে মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। তবে একটি বড় সত্য হচ্ছে, এই সাফল্য আমাদের অমিত সম্ভাবনার তুলনায় যথেষ্ট কম। সম্পদ সৃষ্টির প্রচেষ্টায় আমরা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ধীরে ধীরে বিভিন্ন বাজারশক্তি বা উপকরণ প্রবর্তনের পদ্ধতি গ্রহণ করেছি, যা আবার আমাদের সাময়িক ভুলের জন্য থেমেও গেছে। এর মধ্যে প্রতিটি ভুলই আমাদের সম্পদ সৃষ্টির প্রয়াসকে শুধু বিঘ্নিতই করেনি, বরং এর পাশাপাশি পশ্চাত্মুখী পদক্ষেপ গ্রহণেও বাধ্য করেছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভাবনার প্রতি যেভাবে বিশ্বের মনোযোগ বাড়ছে, তা কাজে লাগানো উচিত। উন্নয়ন সম্ভাবনার তুল্যমূল্য বিচার এবং সেটি কাজে লাগাতে হলে আমাদের অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার নতুন মডেল বা নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রচলনের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সম্পদ সৃষ্টি ও বণ্টন প্রক্রিয়ার মধ্যে দৃশ্যমান দ্বন্দ্বকে কীভাবে দেখা ও সামলানো হবে, সেটির একটি পরিষ্কার ব্যাখ্যাও থাকতে হবে। আমরা ইতিমধ্যে উন্নয়নের লক্ষ্য ত্বরান্বিত করতে প্রতিযোগিতামূলক বাজারভিত্তিক অর্থনৈতিক মডেল গ্রহণ করেছি। এ অবস্থান থেকে আমাদের যেন পশ্চাত্মুখী হতে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রতিবারই আমরা দেখেছি, বাজারের আচরণে অকার্যকরতার লক্ষণ থাকলে বা এতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে আমাদের সামনে যেন উন্নয়ন-প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার মতো আর কোনো ভালো বিকল্প নেই। সুতরাং কোনোভাবেই যাতে সম্পদ সৃষ্টির প্রক্রিয়া ব্যাহত না হয়, তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের এটাও বোঝা দরকার—সম্পদ সৃষ্টির ধারা তখনই টেকসই হবে, যখন বিতরণ প্রক্রিয়ার কার্যকরতা জোরালো থাকবে। আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে, সুশাসন শুধু একটি নৈতিক মূল্যবোধই নয়, বরং এটি দেশের প্রবৃদ্ধি অর্জনে একটি পুঁজিও বটে। সুশাসনের অনুপস্থিতি বা এর প্রায়োগিক মাত্রা কম হলে তাতে কতিপয় ব্যক্তি বা কোনো গোষ্ঠীর জন্য স্বল্পমেয়াদে কিছু ফায়দা লোটার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু তা দীর্ঘমেয়াদে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের সুফল পাওয়া থেকে বঞ্চিত করবে।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বেসরকারি খাতই হবে দেশের প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রধান চালিকাশক্তি। এ ব্যবস্থা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে অবশ্য বেসরকারি খাতের কাঁধে বড় ধরনের দায়িত্ব বর্তাবে। তখন বেসরকারি খাতকে স্বপ্রণোদিত হয়ে সৃজনশীল ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রূপকল্প অনুযায়ী এগোতে হবে। একই সঙ্গে তারা মুক্তবাজার ব্যবস্থা থেকে সুবিধা পাওয়া আর অন্যদিকে নিজেদের স্বার্থরক্ষায় সরকারের কাছে সহায়তার দাবি তুলতে পারবে না। মুক্তবাজারের সুবিধা নিতে হলে তাদের নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানো ও সুশাসনের বিষয়ে জোর দিতে হবে, যাতে বিশ্বের যে কারও সঙ্গেই প্রতিযোগিতা করা যায়। সরকার কেবল তাদের আনুষঙ্গিক সুবিধাসহ কৌশলগত সহায়তা দিতে পারে। কিন্তু ভবিষ্যতে প্রবৃদ্ধি অর্জনের রূপকল্পটি বেসরকারি খাতকেই এগিয়ে নিতে হবে। তারা যদি সরকারকে অবকাঠামো উন্নয়নসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়ে সহায়তা বাবদ অর্থ ব্যয় করার ভূমিকায় দেখতে চায়, তাহলে বেসরকারি খাতকে এ কথাও মনে রাখতে হবে, এ জন্য তহবিলের প্রয়োজন আছে। বেসরকারি খাত সার্বিকভাবে তাদের অভ্যন্তরীণ সুশাসন জোরদার ও যথাযথভাবে কর পরিশোধ না করলে সরকারের পক্ষে এসব প্রকল্পে অর্থায়ন করা অসম্ভব। শুধু এ জন্যই কিন্তু করপোরেট সুশাসনের প্রয়োজনীয়তা সীমাবদ্ধ নয়। বেসরকারি খাতের প্রতিযোগিতাশীলতা ও সক্ষমতা বাড়ানোর জন্যও কিন্তু করপোরেট সুশাসন জোরদার করা জরুরি।
এ ক্ষেত্রে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। সেগুলো হলো—ভর্তুকি, বেসরকারিকরণ ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান। সম্পৃক্ততার কারণে বিষয়গুলো নিয়ে একযোগে কাজ করা অপরিহার্য। তবে যেখানে সম্পদ বা অর্থ বিনিয়োগ বা ব্যয় করলে সবচেয়ে বেশি সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে, সেখানেই অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে। এই ব্যবস্থার আওতায় পরিচালিত উত্তরণ প্রক্রিয়ায় উত্পাদনশীল খাতের সঙ্গে অদক্ষ খাতগুলোকে হয়তো সম্পৃক্ত করার পদক্ষেপ নেওয়ার প্রবণতাও দেখা যেতে পারে। কিন্তু করদাতাদের অর্থ অদক্ষ খাতের পেছনে ব্যয় করাটাও যে গ্রহণযোগ্য নয়, সেটিও বিবেচনায় রাখতে হবে। আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি তখনই মেনে নেওয়া যেতে পারে, যখন সরকারের দেওয়া ভর্তুকিটা হবে যৌক্তিক এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সম্পদ বিতরণের সুবাদে সুফল পাওয়া যাবে। এমন ক্ষেত্রেও কিন্তু ভর্তুকির অর্থ বাজারব্যবস্থায় কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি করবে না, সেই নিশ্চয়তা নিয়েই এগোতে হবে। সরকারকে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকা থেকে বিরত থাকতে হবে। যদি সরকার তা করেও, সে ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ব্যয়ের বদৌলতে যেন সমাজের উপকারটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। এ ছাড়া সুসমন্বিত নীতিমালার ভিত্তিতে বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়াকে জোর গতিতে এগিয়ে নিতে হবে।
সার্বিকভাবে দেশের আর্থিক বাজারের গভীরতা বাড়াতে হবে। নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাংক খাতের মাধ্যমে অর্থায়নের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের বিষয়টি জোর বিবেচনায় রাখা দরকার। পুঁজিবাজারে উপকরণের জোগান বাড়ানোও জরুরি। পুঁজিবাজারে শুধু মূলধনের পর্যাপ্ততাই নয়, বরং সেই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি বন্ডের প্রচলনও দাবি করে। আবার পুঁজিবাজারে সেকেন্ডারি মার্কেটের মাধ্যমে সরকারি সিকিউরিটিজ ও বিভিন্ন ধরনের ঋণ উপকরণও (ডেট ইন্সট্রুমেন্ট) বাড়াতে হবে। তবে সবকিছুই কার্যকরভাবে পরিচালনা করাটা নির্ভর করে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার ওপর। এ ছাড়া আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্রেডিট রেটিং বা ঋণ-মান নির্ণয়ের প্রক্রিয়া আরও জোরালো এবং স্বাধীন হওয়া বাঞ্ছনীয়।
নয়া আর্থিক ব্যবস্থা সফলভাবে বাস্তবায়নে নিয়ন্ত্রকগোষ্ঠী এবং জনপ্রশাসনকেও অধিকতর সক্রিয় হতে হবে, যাতে বেসরকারি খাতকে দ্রুততার সঙ্গে সর্বোচ্চ সেবা-সহায়তা দেওয়া যায়। সর্বোচ্চ প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাব্যতার নিরিখেই ‘লাইসেন্স’ ও ‘অনুমোদন’ দিতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা যদি কোনো কিছুর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চান, তাহলে তাঁদের প্রতিটি পদক্ষেপই হতে হবে যৌক্তিক, স্বচ্ছ ও কার্যকর। আমাদের দীর্ঘমেয়াদে উন্নয়ন রূপকল্প তৈরি করার মতো পরিকল্পনাকারী, নিয়ন্ত্রক ও জনপ্রশাসন তৈরি করতে হবে। তবে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে না পারলে তাঁরা কিন্তু সঠিকভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবণতা ও বিভিন্ন ইস্যু ভালো করে বুঝতে পারবেন না। আর যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা হলে তাঁদের সক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়বে। বদৌলতে তাঁরা কৃষি, উত্পাদন এবং সেবাসহ বিভিন্ন খাত সংক্রান্ত নীতি-পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে পারদর্শিতা দেখাতে পারবেন। পাশাপাশি তাঁরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং প্রতিপক্ষ বা প্রতিযোগী পক্ষগুলোর সঙ্গে সমঝোতা বা দরকষাকষি করে দেশের সার্বিক স্বার্থ সমুন্নত রাখতেও সক্ষম হবেন। এ ছাড়া তাঁরা অর্থনীতির আরও দুটি স্তম্ভ বহিঃ খাত এবং রেমিট্যান্স বা অন্তর্মুখী প্রবাসী-আয়ের প্রবাহ বাড়ানোর ক্ষেত্রেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন। বেসরকারি খাতকেও তাঁদের অভ্যন্তরীণ মানবসম্পদ উন্নয়নে গভীর মনোযোগ দিতে হবে। সেই সঙ্গে, দেশের উন্নয়ন সম্ভাবনা সর্বতোভাবে কাজে লাগাতে হলে বহুল আলোচিত ‘বাজার প্রবেশাধিকার’ পাওয়ার চেয়েও সংকল্পবদ্ধভাবে দেশের অবকাঠামো ও জ্বালানি খাতে প্রচুর প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে।
স্বচ্ছতা এবং সুশাসনের ওপরই যে নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাফল্য নির্ভর করবে, সেটি ভুললে চলবে না। স্বচ্ছতা নিশ্চিত হলে দ্রততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা বাড়বে এবং কোনো ভুল থাকলে তাও স্বল্পতম সময়ে শোধরানো হবে। আর সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে সরকার, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ও সুশীল সমাজসহ সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা ও ঐকমত্য থাকতে হবে।
নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব
মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।
No comments