আচরণের মনস্তাত্তি্বকতা ও গণতান্ত্রিক শাসনের মধ্যে সম্পর্ক by ফরিদ আহমেদ

জীবন্ত প্রাণী যা কিছু করে তা-ই আচরণ। আচরণের বিভিন্ন ধরন আছে, যেমন_খণ্ডিত আচরণ, সামগ্রিক আচরণ, ঐচ্ছিক আচরণ, অনৈচ্ছিক আচরণ, বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ আচরণ। এ ছাড়া কিছু আচরণ আছে, সেগুলোকে আমরা ত্রুটিপূর্ণ আচরণ বলি। ত্রুটিপূর্ণ আচরণ অজ্ঞতা বা আবেগবশত হয়ে থাকে।


যেমন_গ্যাসের চুলা বন্ধ না করা, পানির ট্যাপ খুলে রাখা, টয়লেট ব্যবহার করার পর পরিষ্কার না করা ইত্যাদি। এর পাশাপাশি অস্বাভাবিক আচরণের কথাও এসে যায়। এ আচরণ মানসিক প্রক্রিয়া ও মানসিক অসুস্থতার কারণে সৃষ্টি হয়। অস্বাভাবিক আচরণ দুই ধরনের_সাইকোসিস ও নিউরোসিস। তীব্র মনোবিকৃতি আর নিউরোসিস অল্পমাত্রায় ব্যক্তিত্বের বিপর্যয়। ব্যক্তির আচরণে ত্রুটি দেখা যায় ব্যক্তিত্বের অল্প বিপর্যয়ের কারণেই, ফলে আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। মানুষ জন্মগতভাবে অপরাধী নয়। বিভিন্ন কারণে অপরাধী হয়। এর পেছনে বংশগত ও পরিবেশগত কারণও থাকে বলে মনোবিজ্ঞানীরা অভিমত দিয়েছেন।
বংশগত কারণ : মানব শিশুর আচরণের ওপর বংশগত না পরিবেশের প্রভাব বেশি_এ বিতর্ক বহু দিনের। ম্যান্ডেলের মতে, 'যে প্রক্রিয়ায় জীবের বৈশিষ্ট্যগুলো মা-বাবা থেকে সন্তান-সন্ততিতে আসে, তাকে বংশগতি বলে।' তাই মা-বাবার আচরণ ত্রুটিপূর্ণ হলে সন্তানদেরও সেরূপ হওয়ার কথা; কিন্তু অনেক সময় এর ব্যতিক্রমও দেখা যায়। তখন তাকে পরিবেশের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অভিন্ন যমজদের নিয়ে মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ঐ. ঐ. ঘবসিধহ, ঋ. ঘ. ঋৎবসধহ এবং ক. ঔ. ঐড়ষুরহমবৎ (১৯৩৭) গবেষণা করে দেখেন, আচার-আচরণে বংশগত প্রভাব থাকে। তাঁরা ১৯ জোড়া অভিন্ন যমজ শিশুকে পরীক্ষার জন্য বেছে নেন। তাদের মধ্যে রিচার্ড এবং রেমন্ড বিশেষ খ্যাতি লাভ করে। রিচার্ডকে এক মাস বয়সে এক দরিদ্র ট্রাক ড্রাইভার পালক পুত্ররূপে গ্রহণ করেন। অন্যদিকে ২৩ মাস বয়সী রেমন্ডকে এক ধনী চিকিৎসক পালক পুত্ররূপে গ্রহণ করেন। রিচার্ড বস্তি এলাকায় বসবাস করে এবং নিম্নমানের বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে থাকে। অপরদিকে রেমন্ড উন্নত পরিবেশে বসবাস করে এবং উন্নত বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। গবেষকদ্বয় ১০ বছর বয়সে রিচার্ড এবং রেমন্ডকে পরীক্ষা করে দেখতে পান, সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে লালিত-পালিত হলেও তারা প্রায় একই ধরনের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে। একইভাবে বাকি ১৮ জোড়া অভিন্ন যমজকে তাঁরা পরীক্ষা করে দেখেন, পরিবেশের ভিন্নতা থাকলেও তাঁদের মধ্যে বুদ্ধাঙ্কের ওপর বেশি প্রভাব বিস্তার করেনি।
প্রেষণাজনিত কারণ : প্রেষণা হলো এমন অবস্থা বা শক্তি, যা মানুষ বা প্রাণীকে কোনো কাজে প্রবৃত্ত করায় বা কোনো আচরণের সূত্রপাত ঘটায়। প্রেষিত আচরণের বৈশিষ্ট্যগুলো হলো_নির্বাচনমূলক, উদ্দেশ্যমূলক, ভারসাম্য, সংস্থাপন, অভ্যন্তরীণভাবে সৃষ্ট দীর্ঘস্থায়ী, পারিবারিক-সামাজিক ও জৈবিক। যেকোনো অভাববোধ থেকে যখন প্রেষণার উদ্ভব ঘটে, তখনই প্রাণীর মধ্যে প্রেষিত আচরণগুলো দেখা যায়। যতক্ষণ তৃপ্তি বা অভাব দূরীভূত না হয়, তখন পর্যন্ত এ আচরণ চলতে থাকে।
আবেগজনিত কারণ : আবেগ হলো, ব্যক্তির একটি আলোড়িত অবস্থা, যা বাহ্যিক নানাবিধ আচরণের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। প্রাক-শৈশবকাল, শৈশবকাল, বয়োসন্ধিকাল_বয়সের এ রকম বিভিন্ন ধাপে আবেগের ক্রমবিকাশ ঘটে। আর আবেগের বিকাশ সঠিকভাবে না হলে আচরণ ও ব্যক্তিত্বে চরম বিপর্যয় ঘটে।
শিক্ষণের অভাবে : অতীত অভিজ্ঞতা ও অনুশীলনের ফলে আচরণের কম-বেশি স্থায়ী পরিবর্তনকে শিক্ষণ বলে। শিক্ষণের প্রকারভেদ : ক. সহায়ক শিক্ষণ, খ. করণ শিক্ষণ, গ. সাপেক্ষীকরণ, ঘ. প্রচেষ্টা ও ভুল সংশোধনের মাধ্যমে শিক্ষণ, ঙ. সুপ্ত শিক্ষণ, চ. অন্তর্দৃষ্টিমূলক শিক্ষণ ও ছ. প্রাথমিক শিক্ষণ। মূলত শিক্ষার অভাবেই সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আচরণের অস্বাভাবিকতা দেখা যায়।
বিস্মৃতির কারণে : কখন, কোথায়, কিভাবে, কী ঘটেছিল তা যথাসম্ভব পুনরুৎপাদনের অক্ষমতাকে বিস্মৃতি বলা যায়। বিস্মৃতির কারণে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো স্মৃতির পাতা থেকে বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যায়। ধরা যাক, স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা যতটুকু আমাদের মনে আছে, তা হলো স্মৃতি আর যতটুকু মনে নেই তা হলো বিস্মৃতি। বিস্মৃতির কারণে সঠিক তথ্য ভুলে কাল্পনিক তথ্য মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করে এবং আচরণে দেখা যায় বৈচিত্র্য। আচরণজনিত সমস্যার আরেকটি বিষয় হচ্ছে ব্যক্তিত্ব। 'চবৎংড়হধষরঃু' শব্দটি লাতিন শব্দ 'চবৎংড়হধ' থেকে এসেছে। যার অর্থ 'মুখোশ'। প্রাচীন রোমে মঞ্চাভিনেতারা যে মুখোশ ব্যবহার করতেন, তাকে 'চবৎংড়হধ' বলা হতো, অর্থাৎ ব্যক্তিত্ব বলতে ব্যক্তির বাহ্যিক রূপ বোঝানো হতো। তবে আধুনিক মনোবিজ্ঞানীদের মতে, 'ব্যক্তিত্বকে আচরণ ও মানসিক প্রক্রিয়ার অনবদ্য ধরন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে এবং ব্যক্তির সঙ্গে পরিবেশের সম্পর্ক চিহ্নিত করে।'
ব্যক্তিত্বের সংরক্ষণ : ব্যক্তিত্বের সংরক্ষণ হলো এমন কতগুলো গুণ বা বৈশিষ্ট্য, যার সাহায্যে এক ব্যক্তিকে অন্য ব্যক্তি থেকে পৃথক করা যায়। এটি ব্যক্তির আচরণকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে পরিবার, সমাজ, বিদ্যালয়, সংস্কৃতি, সামাজিক সত্তা, সত্যবাদিতা, আক্রমণাত্মক মনোভাব, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি।
লেখক : কলেজ শিক্ষক

No comments

Powered by Blogger.