বৃত্তের ভেতর বৃ্ত্ত-নিষ্ঠুরতা-বর্বরতার সূচক এবং জনমনের শঙ্কা by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
খুন, অপহরণ, ধর্ষণ ইত্যাদি নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, পৈশাচিকতার চরম বহিঃপ্রকাশ। দেশের বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এসবের যে সূচক সামনে রয়েছে, তা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, শান্তিপ্রিয়দের স্বস্তি তো দিচ্ছেই না, বরং উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সীমাহীন মাত্রাও ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
১২ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অপরাধমূলক যেসব চিত্র পরিলক্ষিত হলো, এ থেকে পুনর্বার প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে_এ দেশটা কি শ্বাপদদের অভয়ারণ্যে পরিণত হলো? এমন প্রশ্ন গণতান্ত্রিকভাবে বিপুল ভোটে নির্বাচিত সরকারের জন্য যেমন সুখকর নয়, তেমনি নাগরিক সমাজের কাছেও বড় বেশি অপ্রীতিকর। ১২ এপ্রিল ২০১১, রাজশাহীতে অপহরণের তিন দিন পর ব্যবসায়ী আমিনুল হকের সন্ধান মিলল। তবে জীবিত নয়, মৃত। সেই মৃতদেহটি আবার ৯ টুকরো! অভিযোগ আছে, আমিনুল হককে জিম্মি করে তাঁর পরিবারের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করে অপহরণকারীরা; কিন্তু এর পরও তাঁর রেহাই মেলেনি, নৃশংসভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়। পূর্বাপর আরো ঘটনা ঘটেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এর মধ্যে খুনের মতো নৃশংসতা তো আছেই।
১৪ এপ্রিল ২০১১, মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলা শহরে প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাতে খুন হয় অন্যায়ের প্রতিবাদকারী এইচএসসি পরীক্ষার্থী শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজের মেধাবী ছাত্র পুলক পাল। ১৫ এপ্রিল রাতে বান্দরবানে একটি বেসরকারি অবকাশকেন্দ্রের এক কর্মকর্তাকে অপহরণ করে অস্ত্রধারীরা। এখন পর্যন্ত তাঁর সন্ধান মেলেনি। তাঁর ভাগ্যে কী আছে তা ভবিষ্যৎই জানে। তাঁর মুক্তির বিনিময়ে ৫০ লাখ টাকা দাবি করেছে অপহরণকারীরা। এ ঘটনার প্রায় ১৪ ঘণ্টার মাথায় আরেক ব্যবসায়ীকে অপহরণের চেষ্টা করে অপহরণকারীরা ব্যর্থ হয় স্থানীয়দের প্রতিরোধের মুখে। ১৬ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে মাদক ব্যবসায়ীর হাতে খুন হয়েছেন ওই থানার এএসআই বোরহানউদ্দিন। ১৮ এপ্রিল যুগান্তরে 'র্যাব-পুলিশের নামে অপহরণ-বাণিজ্য' শিরোনামের প্রতিবেদনে উপস্থাপিত হয়েছে আরো ভয়ংকর চিত্র। গত এক বছরে যাঁরা অপহৃত হয়েছেন, তাঁদের কারো কারো লাশ মিললেও অনেকেরই এখনো সন্ধান মেলেনি। একই দিন 'বাড়ছে ভয়ংকর অপহরণ' শিরোনামে বাংলাদেশ প্রতিদিনের একটি প্রতিবেদনে মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ঢাকা মহানগরেই এক বছরে ১৩৯ জনকে অপহরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া গত চার মাসে সারা দেশে ১৫০ জন অপহৃত হয়েছেন। এরই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চাঁদাবাজি। সাম্প্রতিক সময়ের এমন নাজুক পরিস্থিতি সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর সদস্যরা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন এবং হিমশিম খেলেও বিদ্যমান পরিস্থিতি স্বীকার করতে তারা নারাজ। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা যখন বাস্তবতা এড়িয়ে ভিন্ন বক্তব্য রাখেন, তখন সমাজবিরোধীরা এতে আরো উৎসাহ বোধ করে এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে নিজেদের সম্পৃক্ত করার অধিকতর সুযোগ নেয়। আরো উল্লেখ্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা যখন মানুষ খুন করে তা ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করেন, তখন সমাজবিরোধী শক্তিও উৎসাহ বোধ করে। তারা মনে করে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনের কাছে যা বৈধ তা অন্যের কাছে নয় কেন? র্যাবের হাতে পঙ্গু হয়ে যাওয়া লিমনের ঘটনাটি সর্বশেষ দুঃসহ স্মৃতি। পুলিশ লিমনের পরিবারের মামলা গ্রহণ করতে যে টালবাহানা ও সময়ক্ষেপণ করেছে, এটি তাদের আরো একটি ঘৃণ্য নজির এবং আইনের শাসনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের শামিল।
প্রশ্ন হচ্ছে, সমাজের আইন ও নৈতিকতার কোন গভীর অসুখের আলামত এসব? আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনের নিষ্ঠুরতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা-অস্থিতিশীলতা, সমাজবিরোধী শক্তির দাপাদাপি_সব মিলিয়ে যে চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা অবশ্যই গভীর অসুখের আলামত। এ অসুখ টোটকা-দাওয়াইয়ে সারবে বলে মনে হয় না। পেশাদার অপরাধী থেকে শুরু করে গৃহস্থ মানুষ, সরকারি সংস্থার কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মজীবীদের মধ্যেও নিষ্ঠুরতা প্রকাশ পাচ্ছে ক্রমবর্ধমান হারে। সরকারের, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক-পরিচালকদের নিশ্চয়ই এসব বিষয় অজানা নয়। তাঁদের এর পরও তাহলে নির্বিকারত্বের কারণ কী? শান্তিকামী মানুষ এরপর তাঁদের ওপর অন্তত নিরাপত্তার ভরসাটা রাখবে কী করে? একের পর এক বীভৎস ঘটনার মধ্য দিয়ে সমাজের যে কদর্য চিত্র ফুটে উঠছে, তা তাঁদের টনক এখনো নাড়াতে পারছে বলে বিদ্যমান পরিস্থিতি সাক্ষ্য দেয় না। বিস্ময়টা এখানেই। যে সমাজে নৃশংসতা-বর্বরতা অপরাধীদের নিত্যকর্মে পরিণত হয়, সে সমাজ যেকোনোভাবেই মনুষ্য বসবাসের উপযোগী সমাজ নয় এবং তা নির্ণয় করতে রাষ্ট্র কিংবা সমাজবিজ্ঞানের আশ্রয় নেওয়ার কোনো দরকার নেই। আরো বিস্ময়কর হলো, একের পর এক ঘটনা ঘটছে আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী দায়সারাগোছের কথা বলে চলেছেন! তাঁদের স্মৃতিতে আছে কি না জানি না, বিগত চারদলীয় জোট সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত বায়ুসেনাপ্রধান আলতাফ হোসেন চৌধুরী ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী (যিনি প্রতিনিয়ত হাস্যকর ইংরেজি-বাংলা মিলিয়ে অদ্ভুত অর্থহীন সব সংলাপ বলতেন এবং যিনি নিজেকে সব কিছুর ঊধর্ে্ব মহাক্ষমতাধর মনে করতেন, আর এখন যিনি রিমান্ডের পর রিমান্ডে যেতে যেতে ক্লান্ত) লুৎফুজ্জামান বাবরের কথা। ক্ষমতার চেয়ারটা বড় বেশি জাদুকরী চেয়ার। এ চেয়ারের মোহও অনেকেরই খুব বেশি। কিন্তু এ চেয়ারের অবমূল্যায়নের ফল কতটা ভয়ংকর হয় কিংবা হতে পারে, তা অনেক ক্ষমতাবানই মনে করতে চান না।
মানুষ চারদলীয় জোটকে প্রত্যাখ্যান করে মহাজোটকে বিপুল ভোটে ক্ষমতাসীন করার পথটা সুগম করে দেওয়ার অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম একটি কারণ ছিল অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়া। মানুষের অর্থাৎ ভোটারদের সে প্রত্যাশা হোঁচট খেয়েছে অনেক আগেই। একজন শেখ হাসিনা কিংবা একজন প্রধানমন্ত্রী এ দেশটাকে আমূল বদলে দিতে পারবেন না। এটি সম্ভবও নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন এই মন্ত্রিসভা গঠন করে এত বড় বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার যাত্রা শুরু করেন, তখনই তাঁর সহযোগী অনেকের যোগ্যতা-দক্ষতা-রাজনৈতিক দূরদর্শিতা-বিচক্ষণতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। এ প্রশ্নও উঠেছিল, তিনি এত বড় বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য রাজনৈতিকভাবে আনকোরা ব্যক্তিদের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দিয়ে (কারো কারো স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন আছে) কতদূর যেতে পারবেন? বলতে দ্বিধা নেই, নানা প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে এ সরকার এযাবৎ যা অর্জন করেছে, এর সিংহভাগই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজ প্রচেষ্টার ফসল। অর্জন এ সরকারের কম ছিল না, কিন্তু কিভাবে অর্জনের বিসর্জন ঘটছে তা খতিয়ে দেখা উচিত। সচেতন মানুষ তো দেখতেই পাচ্ছে, মন্ত্রিপরিষদের কে কতটা যোগ্যতা-দক্ষতা, দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার অধিকারী। প্রায় সব ব্যাপারেই তো প্রধানমন্ত্রীকে কথা বলতে হচ্ছে, দৃষ্টি রাখতে হচ্ছে, সতর্ক থাকতে হচ্ছে। মহাজোটের কিংবা আওয়ামী লীগের পোড়খাওয়া যেসব রাজনৈতিক নেতাকে এখনো দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তাঁদের প্রয়োজন ছিল কি না তা এখনই অনেকটা টের পাওয়া যাচ্ছে। কারণ দেশ-জাতি নানা জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলছে, যে পরিস্থিতি মোকাবিলায় বর্তমান মন্ত্রিপরিষদের অনেকেরই সফল হওয়ার দক্ষতা নেই। একটা কথা চালু আছে, আওয়ামী লীগ যখন জেতে তখন সে একা জেতে, যখন সে হারে তখন পুরো জাতি হারে। যতই দিন যাচ্ছে, এ কথার সত্যতা ক্রমপুষ্ট হচ্ছে।
সোজা কথা, মানুষ এত কিছু শুনতে চায় না, বুঝতে চায় না। জান-মালের নিরাপত্তাসহ স্বাভাবিক জীবনযাপনের খুব সংগত গ্যারান্টি চায়। এসব বিষয় নিশ্চিত করার দায় অবশ্যই সরকারের। এর বিকল্প কিছু বলার সরকারের কোনোই অবকাশ নেই। কিভাবে সরকার এসব নিশ্চিত করবে, তা সরকার ভাববে। গোপনে গোপনে নদীতে জল বাড়ছে তা মহাজোট নয়, আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক মহলের অনেকেই টের পাচ্ছেন না। তৃণমূলের পরিস্থিতি তাঁরা জানেন না। কারণ তাঁদের অনেকেই তৃণমূল-বিচ্ছিন্ন মানুষ। আর এ কারণেই পোড়খাওয়া রাজনীতিকদের প্রসঙ্গ আসে। রাজনীতি কখনোই রাজনীতিবিদ ভিন্ন সঠিক পথে চলতে পারে না। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা কি দলের কতিপয় স্বেচ্ছাচারী ও ক্ষমতাবানের অপকর্ম ঠেকাতে পেরেছেন? তাঁরা কি অস্বীকার করতে পারবেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতির পেছনে ওই স্বেচ্ছাচারী-ক্ষমতাবানদের নেতিবাচক কাজ সামান্যতম হলেও ভূমিকা রাখেনি? তাঁদের একটা কথা মনে রাখা খুবই দরকার, মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন_তাদের অচেতন করে রাখার সব রকম প্রচেষ্টা সত্ত্বেও। রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায়ও অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে এবং আওয়ামী লীগও এর বাইরে নয়। অনেক নেতাই পেশিশক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে রাজনীতি করেন। আওয়ামী লীগ থেকে যেসব নবীন সংসদ সদস্য গত নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন, (তাঁদের সিংহভাগই নিজেদের গুণে নয়, দলের বা মহাজোটের কারণে নির্বাচিত হয়েছেন) তাঁদের বড় একটা অংশ যে কী পরিমাণ অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত, নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত_তা যদি দলের নীতিনির্ধারকরা নির্ণয় করতে চান, তাহলে তাঁদের কোনোই বেগ পেতে হবে না। একটু গভীরভাবে সব কিছুর ঊধর্ে্ব উঠে বিভাগ, জেলা কিংবা উপজেলার দিকে যদি তাকান তাহলে খুব সহজেই এ চিত্র পেয়ে যাবেন। এসব কথা এযাবৎ বিস্তর হয়েছে। বকাউল্লারা বকছেন, আর শোনাউল্লারা শুনছেন। কোনো সমাধান মিলছে না। সরকারের নীতিনির্ধারকদের প্রতি আমাদের বিনীত অনুরোধ, সব কিছুকেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে প্রচার করার প্রবণতা পরিত্যাগ করুন। মানুষকে এখন আর বোকা ভাবার অবকাশ নেই। মানুষকে নূ্যনতম কিছু অন্তত আগে দিন, তারপর বাহবা কুড়ানোর চেষ্টা করুন।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
১৪ এপ্রিল ২০১১, মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলা শহরে প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাতে খুন হয় অন্যায়ের প্রতিবাদকারী এইচএসসি পরীক্ষার্থী শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজের মেধাবী ছাত্র পুলক পাল। ১৫ এপ্রিল রাতে বান্দরবানে একটি বেসরকারি অবকাশকেন্দ্রের এক কর্মকর্তাকে অপহরণ করে অস্ত্রধারীরা। এখন পর্যন্ত তাঁর সন্ধান মেলেনি। তাঁর ভাগ্যে কী আছে তা ভবিষ্যৎই জানে। তাঁর মুক্তির বিনিময়ে ৫০ লাখ টাকা দাবি করেছে অপহরণকারীরা। এ ঘটনার প্রায় ১৪ ঘণ্টার মাথায় আরেক ব্যবসায়ীকে অপহরণের চেষ্টা করে অপহরণকারীরা ব্যর্থ হয় স্থানীয়দের প্রতিরোধের মুখে। ১৬ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে মাদক ব্যবসায়ীর হাতে খুন হয়েছেন ওই থানার এএসআই বোরহানউদ্দিন। ১৮ এপ্রিল যুগান্তরে 'র্যাব-পুলিশের নামে অপহরণ-বাণিজ্য' শিরোনামের প্রতিবেদনে উপস্থাপিত হয়েছে আরো ভয়ংকর চিত্র। গত এক বছরে যাঁরা অপহৃত হয়েছেন, তাঁদের কারো কারো লাশ মিললেও অনেকেরই এখনো সন্ধান মেলেনি। একই দিন 'বাড়ছে ভয়ংকর অপহরণ' শিরোনামে বাংলাদেশ প্রতিদিনের একটি প্রতিবেদনে মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ঢাকা মহানগরেই এক বছরে ১৩৯ জনকে অপহরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া গত চার মাসে সারা দেশে ১৫০ জন অপহৃত হয়েছেন। এরই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চাঁদাবাজি। সাম্প্রতিক সময়ের এমন নাজুক পরিস্থিতি সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর সদস্যরা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন এবং হিমশিম খেলেও বিদ্যমান পরিস্থিতি স্বীকার করতে তারা নারাজ। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা যখন বাস্তবতা এড়িয়ে ভিন্ন বক্তব্য রাখেন, তখন সমাজবিরোধীরা এতে আরো উৎসাহ বোধ করে এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে নিজেদের সম্পৃক্ত করার অধিকতর সুযোগ নেয়। আরো উল্লেখ্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা যখন মানুষ খুন করে তা ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করেন, তখন সমাজবিরোধী শক্তিও উৎসাহ বোধ করে। তারা মনে করে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনের কাছে যা বৈধ তা অন্যের কাছে নয় কেন? র্যাবের হাতে পঙ্গু হয়ে যাওয়া লিমনের ঘটনাটি সর্বশেষ দুঃসহ স্মৃতি। পুলিশ লিমনের পরিবারের মামলা গ্রহণ করতে যে টালবাহানা ও সময়ক্ষেপণ করেছে, এটি তাদের আরো একটি ঘৃণ্য নজির এবং আইনের শাসনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের শামিল।
প্রশ্ন হচ্ছে, সমাজের আইন ও নৈতিকতার কোন গভীর অসুখের আলামত এসব? আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনের নিষ্ঠুরতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা-অস্থিতিশীলতা, সমাজবিরোধী শক্তির দাপাদাপি_সব মিলিয়ে যে চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা অবশ্যই গভীর অসুখের আলামত। এ অসুখ টোটকা-দাওয়াইয়ে সারবে বলে মনে হয় না। পেশাদার অপরাধী থেকে শুরু করে গৃহস্থ মানুষ, সরকারি সংস্থার কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মজীবীদের মধ্যেও নিষ্ঠুরতা প্রকাশ পাচ্ছে ক্রমবর্ধমান হারে। সরকারের, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক-পরিচালকদের নিশ্চয়ই এসব বিষয় অজানা নয়। তাঁদের এর পরও তাহলে নির্বিকারত্বের কারণ কী? শান্তিকামী মানুষ এরপর তাঁদের ওপর অন্তত নিরাপত্তার ভরসাটা রাখবে কী করে? একের পর এক বীভৎস ঘটনার মধ্য দিয়ে সমাজের যে কদর্য চিত্র ফুটে উঠছে, তা তাঁদের টনক এখনো নাড়াতে পারছে বলে বিদ্যমান পরিস্থিতি সাক্ষ্য দেয় না। বিস্ময়টা এখানেই। যে সমাজে নৃশংসতা-বর্বরতা অপরাধীদের নিত্যকর্মে পরিণত হয়, সে সমাজ যেকোনোভাবেই মনুষ্য বসবাসের উপযোগী সমাজ নয় এবং তা নির্ণয় করতে রাষ্ট্র কিংবা সমাজবিজ্ঞানের আশ্রয় নেওয়ার কোনো দরকার নেই। আরো বিস্ময়কর হলো, একের পর এক ঘটনা ঘটছে আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী দায়সারাগোছের কথা বলে চলেছেন! তাঁদের স্মৃতিতে আছে কি না জানি না, বিগত চারদলীয় জোট সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত বায়ুসেনাপ্রধান আলতাফ হোসেন চৌধুরী ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী (যিনি প্রতিনিয়ত হাস্যকর ইংরেজি-বাংলা মিলিয়ে অদ্ভুত অর্থহীন সব সংলাপ বলতেন এবং যিনি নিজেকে সব কিছুর ঊধর্ে্ব মহাক্ষমতাধর মনে করতেন, আর এখন যিনি রিমান্ডের পর রিমান্ডে যেতে যেতে ক্লান্ত) লুৎফুজ্জামান বাবরের কথা। ক্ষমতার চেয়ারটা বড় বেশি জাদুকরী চেয়ার। এ চেয়ারের মোহও অনেকেরই খুব বেশি। কিন্তু এ চেয়ারের অবমূল্যায়নের ফল কতটা ভয়ংকর হয় কিংবা হতে পারে, তা অনেক ক্ষমতাবানই মনে করতে চান না।
মানুষ চারদলীয় জোটকে প্রত্যাখ্যান করে মহাজোটকে বিপুল ভোটে ক্ষমতাসীন করার পথটা সুগম করে দেওয়ার অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম একটি কারণ ছিল অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়া। মানুষের অর্থাৎ ভোটারদের সে প্রত্যাশা হোঁচট খেয়েছে অনেক আগেই। একজন শেখ হাসিনা কিংবা একজন প্রধানমন্ত্রী এ দেশটাকে আমূল বদলে দিতে পারবেন না। এটি সম্ভবও নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন এই মন্ত্রিসভা গঠন করে এত বড় বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার যাত্রা শুরু করেন, তখনই তাঁর সহযোগী অনেকের যোগ্যতা-দক্ষতা-রাজনৈতিক দূরদর্শিতা-বিচক্ষণতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। এ প্রশ্নও উঠেছিল, তিনি এত বড় বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য রাজনৈতিকভাবে আনকোরা ব্যক্তিদের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দিয়ে (কারো কারো স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন আছে) কতদূর যেতে পারবেন? বলতে দ্বিধা নেই, নানা প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে এ সরকার এযাবৎ যা অর্জন করেছে, এর সিংহভাগই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজ প্রচেষ্টার ফসল। অর্জন এ সরকারের কম ছিল না, কিন্তু কিভাবে অর্জনের বিসর্জন ঘটছে তা খতিয়ে দেখা উচিত। সচেতন মানুষ তো দেখতেই পাচ্ছে, মন্ত্রিপরিষদের কে কতটা যোগ্যতা-দক্ষতা, দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার অধিকারী। প্রায় সব ব্যাপারেই তো প্রধানমন্ত্রীকে কথা বলতে হচ্ছে, দৃষ্টি রাখতে হচ্ছে, সতর্ক থাকতে হচ্ছে। মহাজোটের কিংবা আওয়ামী লীগের পোড়খাওয়া যেসব রাজনৈতিক নেতাকে এখনো দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তাঁদের প্রয়োজন ছিল কি না তা এখনই অনেকটা টের পাওয়া যাচ্ছে। কারণ দেশ-জাতি নানা জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলছে, যে পরিস্থিতি মোকাবিলায় বর্তমান মন্ত্রিপরিষদের অনেকেরই সফল হওয়ার দক্ষতা নেই। একটা কথা চালু আছে, আওয়ামী লীগ যখন জেতে তখন সে একা জেতে, যখন সে হারে তখন পুরো জাতি হারে। যতই দিন যাচ্ছে, এ কথার সত্যতা ক্রমপুষ্ট হচ্ছে।
সোজা কথা, মানুষ এত কিছু শুনতে চায় না, বুঝতে চায় না। জান-মালের নিরাপত্তাসহ স্বাভাবিক জীবনযাপনের খুব সংগত গ্যারান্টি চায়। এসব বিষয় নিশ্চিত করার দায় অবশ্যই সরকারের। এর বিকল্প কিছু বলার সরকারের কোনোই অবকাশ নেই। কিভাবে সরকার এসব নিশ্চিত করবে, তা সরকার ভাববে। গোপনে গোপনে নদীতে জল বাড়ছে তা মহাজোট নয়, আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক মহলের অনেকেই টের পাচ্ছেন না। তৃণমূলের পরিস্থিতি তাঁরা জানেন না। কারণ তাঁদের অনেকেই তৃণমূল-বিচ্ছিন্ন মানুষ। আর এ কারণেই পোড়খাওয়া রাজনীতিকদের প্রসঙ্গ আসে। রাজনীতি কখনোই রাজনীতিবিদ ভিন্ন সঠিক পথে চলতে পারে না। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা কি দলের কতিপয় স্বেচ্ছাচারী ও ক্ষমতাবানের অপকর্ম ঠেকাতে পেরেছেন? তাঁরা কি অস্বীকার করতে পারবেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতির পেছনে ওই স্বেচ্ছাচারী-ক্ষমতাবানদের নেতিবাচক কাজ সামান্যতম হলেও ভূমিকা রাখেনি? তাঁদের একটা কথা মনে রাখা খুবই দরকার, মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন_তাদের অচেতন করে রাখার সব রকম প্রচেষ্টা সত্ত্বেও। রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায়ও অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে এবং আওয়ামী লীগও এর বাইরে নয়। অনেক নেতাই পেশিশক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে রাজনীতি করেন। আওয়ামী লীগ থেকে যেসব নবীন সংসদ সদস্য গত নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন, (তাঁদের সিংহভাগই নিজেদের গুণে নয়, দলের বা মহাজোটের কারণে নির্বাচিত হয়েছেন) তাঁদের বড় একটা অংশ যে কী পরিমাণ অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত, নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত_তা যদি দলের নীতিনির্ধারকরা নির্ণয় করতে চান, তাহলে তাঁদের কোনোই বেগ পেতে হবে না। একটু গভীরভাবে সব কিছুর ঊধর্ে্ব উঠে বিভাগ, জেলা কিংবা উপজেলার দিকে যদি তাকান তাহলে খুব সহজেই এ চিত্র পেয়ে যাবেন। এসব কথা এযাবৎ বিস্তর হয়েছে। বকাউল্লারা বকছেন, আর শোনাউল্লারা শুনছেন। কোনো সমাধান মিলছে না। সরকারের নীতিনির্ধারকদের প্রতি আমাদের বিনীত অনুরোধ, সব কিছুকেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে প্রচার করার প্রবণতা পরিত্যাগ করুন। মানুষকে এখন আর বোকা ভাবার অবকাশ নেই। মানুষকে নূ্যনতম কিছু অন্তত আগে দিন, তারপর বাহবা কুড়ানোর চেষ্টা করুন।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
No comments