ভিন্নমত-ধনীরা গ্লোবাল সিটিজেন গরিবরা লোকাল সিটিজেন! by আবু আহমেদ
আমার ছাত্র আজমল কানাডায় ব্যবসা প্রশাসন পড়ে এখন সেখানেই একটি ব্যাংকে মাঝ স্তরের এঙ্িিকউটিভ হিসেবে চাকরি করে। থাকে মনট্রিলে। ১০ বছর পর দেশে এসেছে। একটি ব্রোকার হাউসে তার সঙ্গে আমার দেখা। এক আত্মীয়ের সঙ্গে ওই হাউসে এসেছিল। আমার সঙ্গে দেখা হতেই মনে হলো, সে অতিরিক্ত খুশি হলো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় আছো, কী করছ? সে বলল, ভালো আছে। তবে বাংলাদেশ নিয়ে হতাশ।
আমি বললাম, এই দেশ নিয়ে তোমাদের আশা-হতাশা আপেক্ষিক। সমস্যা বেশি হলো আমাদের। আমাদেরও না। আমরা তো আমাদের সময়টা ভালো-মন্দ মিলিয়ে প্রায় কাটিয়েই দিয়েছি। ভাবি বর্তমানে যাদের বয়স কম, তাদের নিয়ে। দেশ যদি ভালো না চলে, তাহলে তারাও ভালো থাকবে না। তারা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শুধু হতাশাগ্রস্তই থাকবে। আর তোমরা যখন কানাডার নাগরিক হয়েছ, তখন এ দেশের দরজাও তোমাদের জন্য খোলা, আর যেহেতু কানাডিয়ান ডিগ্রি আছে, সে জন্য ওই দেশের দরজাও খোলা। বলা চলে, তোমরা গ্লোবাল সিটিজেন, আমরা লোকাল সিটিজেন। আচ্ছা, বলো, কী দেখে তুমি বাংলাদেশ সম্পর্কে এত হতাশ? সে অকপটে বলেই ফেলল, দুই কারণে হতাশ। এক. এই দেশের মানুষ রাজনৈতিক ও সামাজিক কলহ-বিবাদে লিপ্ত। ১০ বছর আগে আমি যখন ঢাকা ছাড়ি, তার চেয়ে বর্তমানে কলহ-বিবাদ আরো পুষ্ট হয়েছে। দুই নম্বরের কারণ হলো, এত লোকসংখ্যা নিয়ে এই দেশ কিছুতেই সামনে এগোতে পারবে না। দুর্ভাগ্য হলো, এই দেশের শিক্ষিত লোকেরাও তাদের এক নম্বরের সমস্যা চিহ্নিত করতে পারেনি। পারলে তো জাতীয় বাজেটের এক বিরাট অঙ্ক লোকসংখ্যা বৃদ্ধির বিপরীতে প্রোগ্রামগুলোতে ব্যয় হতো। এনজিওগুলো এই দেশে ভালো ব্যবসা করছে বটে, কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির ব্যাপারটিতে একেবারে চুপ। কেন বলতে পারেন? এই ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকাটা মুখ্য হওয়া উচিত ছিল। সরকার যেন এই সমস্যা স্বীকারই করতে চায় না। সবাই যেন একটা ভুল আবহের মধ্যে ডুবে আছে। আপনি রাস্তাঘাটে চলতে পারেন কি? আপনার এয়ারপোর্টে দিনে কয়টি প্লেন ল্যান্ড করে? কিন্তু এয়ারপোর্টে এত লোক কেন? আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংখ্যা ৩০০। তবে তাঁরা অনেক বেশি প্রোগ্রাম চালান এবং অনেক বেশি পড়ান।
আমাদের এখানে মানুষ কেন যেন কর্তব্য থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। কাগজপত্র পড়লে দেখি, ধনী হওয়ার জন্য শুধু ফাঁক-ফোকর খুঁজছে। শিক্ষা নিয়ে এবং পরিশ্রম করে ধনী হওয়ার সেই সংস্কৃতি যেন বিলীন হতে বসেছে। বর্তমানের চেয়ে অতীতকে যেন বেশি মূল্য দেওয়া হয়। বাস-লঞ্চ-রেলে লোকের জায়গা হয় না। এসবের সমাধান কি বাস-লঞ্চ-ট্রেন বাড়িয়ে দেওয়া? মনে তো হয় না। বাস্তবতা হলো, এত অল্প জায়গা এত লোককে ধারণ করতে পারবে না। এমতাবস্থায় একজনের সম্পদ আরেকজন চুরি করবে, লুট করবে। চুরি-লুটেরও বিভিন্ন কৌশল আছে। সেই কৌশলের কাছে যারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল, তারা শুধুই মার খাবে। এর পর আমি আজমলকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা বলো তো তুমি কেন বিদেশে পড়ে আছো? তুমি যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়েছ, এই ডিগ্রি নিয়ে এই দেশেও একটা সম্মানজনক চাকরি অবশ্যই পেতে। আজমল বলল, পড়ে আছি বলছেন কেন? ওটা তো বাই অপশন, ইচ্ছা করে।
আমি এই দেশে এলে ভালো খাওয়া-পরাতে আমার হয়তো অসুবিধা হতো না। কিন্তু আমার ছেলে-মেয়েদের কী হতো? আমার স্ত্রী কিছুতেই কানাডা ছাড়বে না। সে যদিও অন্যত্র যেতে চায়, কিন্তু অতি অল্পদিনের জন্য। তাই অনেক চিন্তা-ভাবনা করে কানাডার নাগরিকত্ব নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আর যারা এই দেশে এসে পরে আবার কানাডা-যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গেছে তাদের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। আমার এক অনুজ আশরাফ যুক্তরাজ্যের একটি নামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাথমিটিক্যাল ফাইন্যান্স নিয়ে পিএইচডি করেছে। পাস করার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাজ্যের একটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয় তাকে লেকচারশিপ অফার দিয়েছে। কিন্তু তার প্রাণটা পড়ে ছিল বাংলাদেশে। বাংলাদেশে এসে সে তার পুরনো চাকরি থেকে বিনা বেতনে দুই বছরের ছুটি চেয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় তাকে 'পাওনা নেই' বলে সে ছুটি দেয়নি। আশরাফ মনের দুঃখে আবার যুক্তরাজ্যে ফেরত যাওয়ার কথা ভাবছে। হ্যাঁ, এই রকম কেস অনেক। ছুটি পাওনা না থাকলে দেওয়া হয় না। তবে সব সময় এই নিয়ম খাটে না। এখানে অনেক 'পলিটিঙ্ও' হয়। আজমল বলল, সরকারি চাকরিতে 'পলিটিঙ্'! আর প্রাইভেট জব এখনো পিএইচডিধারীদের জন্য মানানসই হয়নি। তাই বাইরে থেকে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিলাম। আর আপনি বলছেন, আমরা শিক্ষিত হয়ে দেশে আসছি না কেন। দেশ থেকেই তো অনেক লোক বাইরে গিয়ে সিটিজেনশিপ নিচ্ছে। তাদের মধ্যে শিক্ষিত লোকও আছে, আবার কমশিক্ষিত ধনী লোকও আছে। আপনাকে বলছি, কানাডাতে এমন বহু বাংলাদেশি সিটিজেন হিসেবে আছে, যারা সেখানে বা বিদেশে লেখাপড়া করেনি। কিন্তু তারা অনেক ধনী।
বাংলাদেশে আয় করে কানাডার সিটিজেনশিপ কিনেছে বলতে পারেন। আসলে আপনি যেটাকে দেশপ্রেম বলছেন, সেটা হলো কেবল গরিব লোকদের জন্য। বিশ্বের ধনী লোকদের জন্য কোনো ভৌগোলিক বাউন্ডারি নেই। তারা একটা জুঁতসই দেশের সিটিজেনশিপ নেয় বা থাকে বটে। তবে তারা হলো গ্লোবাল সিটিজেন। যেখানে যায় সেখানেই তারা ফাইভ স্টার হোটেলে ডিনার খাবে। চলেও এঙ্িিকউটিভ ক্লাসে। এই ধনী লোকদের কেউ বাংলাদেশ অরিজিনের হলে এই দেশে এসেও তারা সে রকমই থাকে, চড়ে প্রাডো-পাজেরোতে। এই দেশ থেকে বৈধভাবে আয় করে বিদেশে নেওয়া অনেক কঠিন। তবে আয় বিদেশে নেওয়ার জন্য সব চোরাই পথই খোলা। এই দেশে তারা আয় করছে বা করেছে, অর্থকড়ি নিয়ে গেছে বিদেশে। এরা এখন নিজেদের গর্ব করে বলে, গ্লোবাল সিটিজেন।
এসব বলে আজমল আমার থেকে কাছ বিদায় নিল। আমি তাকে দোয়া করতে বললাম। কিন্তু ভাবতে থাকলাম, তাহলে শেষ পর্যন্ত আমাদের পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকবে। এই বিষয়গুলো অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে ভাবনার দাবি রাখে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আমাদের এখানে মানুষ কেন যেন কর্তব্য থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। কাগজপত্র পড়লে দেখি, ধনী হওয়ার জন্য শুধু ফাঁক-ফোকর খুঁজছে। শিক্ষা নিয়ে এবং পরিশ্রম করে ধনী হওয়ার সেই সংস্কৃতি যেন বিলীন হতে বসেছে। বর্তমানের চেয়ে অতীতকে যেন বেশি মূল্য দেওয়া হয়। বাস-লঞ্চ-রেলে লোকের জায়গা হয় না। এসবের সমাধান কি বাস-লঞ্চ-ট্রেন বাড়িয়ে দেওয়া? মনে তো হয় না। বাস্তবতা হলো, এত অল্প জায়গা এত লোককে ধারণ করতে পারবে না। এমতাবস্থায় একজনের সম্পদ আরেকজন চুরি করবে, লুট করবে। চুরি-লুটেরও বিভিন্ন কৌশল আছে। সেই কৌশলের কাছে যারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল, তারা শুধুই মার খাবে। এর পর আমি আজমলকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা বলো তো তুমি কেন বিদেশে পড়ে আছো? তুমি যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়েছ, এই ডিগ্রি নিয়ে এই দেশেও একটা সম্মানজনক চাকরি অবশ্যই পেতে। আজমল বলল, পড়ে আছি বলছেন কেন? ওটা তো বাই অপশন, ইচ্ছা করে।
আমি এই দেশে এলে ভালো খাওয়া-পরাতে আমার হয়তো অসুবিধা হতো না। কিন্তু আমার ছেলে-মেয়েদের কী হতো? আমার স্ত্রী কিছুতেই কানাডা ছাড়বে না। সে যদিও অন্যত্র যেতে চায়, কিন্তু অতি অল্পদিনের জন্য। তাই অনেক চিন্তা-ভাবনা করে কানাডার নাগরিকত্ব নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আর যারা এই দেশে এসে পরে আবার কানাডা-যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গেছে তাদের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। আমার এক অনুজ আশরাফ যুক্তরাজ্যের একটি নামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাথমিটিক্যাল ফাইন্যান্স নিয়ে পিএইচডি করেছে। পাস করার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাজ্যের একটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয় তাকে লেকচারশিপ অফার দিয়েছে। কিন্তু তার প্রাণটা পড়ে ছিল বাংলাদেশে। বাংলাদেশে এসে সে তার পুরনো চাকরি থেকে বিনা বেতনে দুই বছরের ছুটি চেয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় তাকে 'পাওনা নেই' বলে সে ছুটি দেয়নি। আশরাফ মনের দুঃখে আবার যুক্তরাজ্যে ফেরত যাওয়ার কথা ভাবছে। হ্যাঁ, এই রকম কেস অনেক। ছুটি পাওনা না থাকলে দেওয়া হয় না। তবে সব সময় এই নিয়ম খাটে না। এখানে অনেক 'পলিটিঙ্ও' হয়। আজমল বলল, সরকারি চাকরিতে 'পলিটিঙ্'! আর প্রাইভেট জব এখনো পিএইচডিধারীদের জন্য মানানসই হয়নি। তাই বাইরে থেকে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিলাম। আর আপনি বলছেন, আমরা শিক্ষিত হয়ে দেশে আসছি না কেন। দেশ থেকেই তো অনেক লোক বাইরে গিয়ে সিটিজেনশিপ নিচ্ছে। তাদের মধ্যে শিক্ষিত লোকও আছে, আবার কমশিক্ষিত ধনী লোকও আছে। আপনাকে বলছি, কানাডাতে এমন বহু বাংলাদেশি সিটিজেন হিসেবে আছে, যারা সেখানে বা বিদেশে লেখাপড়া করেনি। কিন্তু তারা অনেক ধনী।
বাংলাদেশে আয় করে কানাডার সিটিজেনশিপ কিনেছে বলতে পারেন। আসলে আপনি যেটাকে দেশপ্রেম বলছেন, সেটা হলো কেবল গরিব লোকদের জন্য। বিশ্বের ধনী লোকদের জন্য কোনো ভৌগোলিক বাউন্ডারি নেই। তারা একটা জুঁতসই দেশের সিটিজেনশিপ নেয় বা থাকে বটে। তবে তারা হলো গ্লোবাল সিটিজেন। যেখানে যায় সেখানেই তারা ফাইভ স্টার হোটেলে ডিনার খাবে। চলেও এঙ্িিকউটিভ ক্লাসে। এই ধনী লোকদের কেউ বাংলাদেশ অরিজিনের হলে এই দেশে এসেও তারা সে রকমই থাকে, চড়ে প্রাডো-পাজেরোতে। এই দেশ থেকে বৈধভাবে আয় করে বিদেশে নেওয়া অনেক কঠিন। তবে আয় বিদেশে নেওয়ার জন্য সব চোরাই পথই খোলা। এই দেশে তারা আয় করছে বা করেছে, অর্থকড়ি নিয়ে গেছে বিদেশে। এরা এখন নিজেদের গর্ব করে বলে, গ্লোবাল সিটিজেন।
এসব বলে আজমল আমার থেকে কাছ বিদায় নিল। আমি তাকে দোয়া করতে বললাম। কিন্তু ভাবতে থাকলাম, তাহলে শেষ পর্যন্ত আমাদের পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকবে। এই বিষয়গুলো অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে ভাবনার দাবি রাখে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments