নিত্যজাতম্-আমাজনের জঙ্গলেও কাজ খুঁজছে বাংলাদেশের মানুষ! by মহসীন হাবিব
সংবাদটি কালের কণ্ঠেও বেরিয়েছে। শিরোনাম ছিল 'কাজের সন্ধানে আমাজন জঙ্গলে দুই বাংলাদেশি'। অর্থাৎ ভাগ্যান্বেষণে বের হয়ে ভাগ্যবিড়ম্বনায় এখন বাংলাদেশের দুই হতভাগ্য এ এইচ এম সুলতান আহমেদ এবং আবদুল আউয়াল সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার বিশাল-বিস্তৃত আমাজন জঙ্গলের ব্রাজিলিয়া অংশে ক্ষুধা আর পদে পদে ভয়াবহ বিপদ মুঠোবন্দি করে অপেক্ষা করছেন।
দালালের খপ্পরে পড়ে প্রায় এক মাস ধরে তাঁরা দুইজন এ দেশ-ও দেশ করে ব্রাজিলের ওই অচেনা জায়গায় গিয়ে পড়েছেন। সুলতান আগে গ্রিসে ছিলেন এবং আউয়াল ছিলেন মালয়েশিয়ায়। তাঁরা কর্মসংস্থানের জন্য ঢাকা থেকে দালালের হাতে ৯ হাজার ডলার দিয়ে ব্রাজিলে কাজের জন্য ছুটে যেতে চেয়েছিলেন। দালাল তাঁদের দক্ষিণ আমেরিকার আরেক দেশ ইকুয়েডরে ভালো কাজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ দুই কর্মসংস্থানে ছোটা মানুষ টাকা পরিশোধ করে তবেই প্লেনে উঠেছিলেন। তার পর জীবন-মরণ সন্ধিক্ষণে কাটছে দিন। ইকুয়েডর, পেরুর পাহাড়ি অঞ্চল হয়ে জায়গায় জায়গায় দালালের খপ্পরে পড়ে এখন রয়েছেন ব্রাজিলের আমাজন অঞ্চলের ওই এলাকায়।
আমরা কেউই তাঁদের কথা জানতে পারতাম না। আল জাজিরার একজন সাংবাদিক গ্যাব্রিয়েল সন্তোর কল্যাণে উঠে এসেছে এই দুই বাংলাদেশির কাহিনী। তিনি না জানালে কেউ আদৌ জানতেন না বাংলাদেশের দুইজন মানুষ এখন জীবন-সংগ্রামের চরম পরীক্ষা দিচ্ছেন হাজার হাজার মাইল দূরের আটলান্টিক সাগরের ওপারে সম্পূর্ণ অচেনা এক স্থানে। এমন অসংখ্য বাংলাদেশি রয়েছেন আফ্রিকা, পূর্ব ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন জেলখানায়। রয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রায় বন্দি অবস্থায়। ভাগ্যক্রমে যাঁরা চোখে পড়েন অথবা মুক্ত হন_তাঁদের কথাই কেবল আমরা জানতে পারি। এই জীবন্মৃত্যুর সংগ্রাম করে একসময় যাঁরা বেঁচে যান তাঁরাই বাংলাদেশে টাকা পাঠান। তাঁদের সেই পাঠানো অর্থকেই আমরা গর্বের সঙ্গে বলি রেমিট্যান্স। এভাবেই বাংলাদেশি মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কর্মসংস্থানের জন্য ছুটে বেড়াচ্ছেন দেশ থেকে দেশান্তরে। দেশ থেকে বের হয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতাও তাঁদের ভালো নয়। প্লেনে ওঠা পর্যন্ত কোথাও তাঁরা ভালো আচরণ পান না। ইমিগ্রেশন পার হওয়া তাঁদের কাছে পুলসিরাত পার হওয়ার শামিল। এই মানুষগুলোই নিজেদের গাঁটের টাকা খরচ করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গত বছর দেশে ১২ বিলিয়ন ডলার প্রেরণ করেছেন, যে অর্থ না হলে এই বাংলাদেশ প্রায় দেউলিয়া হয়ে যেত।
দুঃখের জায়গাটি একটু ভিন্ন। বাংলাদেশের বাইরে যে মিশনগুলো রয়েছে, অর্থাৎ হাইকমিশন, দূতাবাস ও কনস্যুলেট_সেগুলোতে নিয়োগ পেয়ে যাঁরা কাজ করছেন তাঁরা এই শ্রমিক শ্রেণীকে চরম অবহেলা করেন। নিজেদের পশ-উন্নত মানুষ ঠাওরে এই শ্রমিকদের সঙ্গে বিদেশ বিভুঁইয়ে কথা পর্যন্ত বলেন না_এমন অভিযোগ আছে বিস্তর। প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনগুলোর বাইরের দেশে কাজ কী? আমরা মনে করি, তাঁদের প্রধান কাজ প্রবাসে যেসব বাংলাদেশি রয়েছেন, তাদের স্বার্থ দেখা। তাঁদের কাজ মার্কিন অ্যাম্বাসাডর ড্যান মজিনার মতো কূটনীতি করা নয়। সে প্রয়োজন বাংলাদেশের যতটুকু আছে তা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা সেরে থাকেন। রাষ্ট্রদূতরা এমন কোনো হাতি-ঘোড়া মেরে আনেন না। কোনো দিন বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রদূতের কথা শোনা যায়নি, যিনি দেশের জন্য বড় ধরনের কিছু ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় অর্জন করে এনেছেন। বরং বদনাম কুড়িয়েছেন অনেকেই। কেউ কেউ ব্রুনাই দারুসসালামে পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশের অ্যাম্বাসাডর হয়ে সবচেয়ে দামি গাড়ি চালিয়ে সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন, কেউ কাঠমান্ডুতে বলিউড নায়িকার বাড়ির পাশ দিয়ে ঘুরঘুর করে লজ্জাজনক খবর বয়ে আনেন। পানীয় পানবিষয়ক বহু লজ্জাজনক কাহিনী পশ্চিমা দেশগুলো থেকে ভেসে আসে। থাক সেসব কথা। আমরা চাই কূটনৈতিক মিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রবাসী বাংলাদেশিদের কল্যাণে, বিশেষ করে তাদের কাগজপত্রের জটিলতা নিরসন, বাড়ি ফেরা, চিকিৎসা বিষয়ে, ভাষাগত ঝামেলা বিষয়ে সহায়তা দিন। তাহলেই মিশনকে সফল বলতে আমাদের দ্বিধা থাকবে না। আরো দু-একটি কাজ কূটনৈতিক মিশনের গুরুদায়িত্ব হিসেবে করা উচিত। যেমন_নতুন নতুন কর্মস্থল খুঁজে বের করা। কর্মরত দেশে ব্যাপকভাবে পর্যটকদের বাংলাদেশ ভ্রমণ করতে উৎসাহী করা। দুঃখের বিষয়, এ দুটোর কোনোটিই তাঁরা করেন না। বেশির ভাগ হাইকমিশনার এবং রাষ্ট্রদূত পার্টিতে অ্যাটেন্ড করে বেড়ান। সামান্য একটু দেশ বা ওই দেশে থাকা সাধারণ মানুষের দিকে মনোযোগী হন না। এটি দীর্ঘদিনের একটি সংস্কৃতি হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে মন্ত্রিপরিষদেও অবশেষে একটি পরিবর্তন এসেছে। এখানে অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র মন্ত্রী আছেন বেশ কয়েকজন। কোনো কোনো মন্ত্রী রাস্তায় হেঁটে হেঁটে পাবলিকের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন। কিন্তু পরিবর্তন নেই আমলা মানসিকতার দূতাবাসগুলোর। একটি দূতাবাসের পেছনে সরকারের কত অর্থ ব্যয় হয়, তা ধারণা করাও সাধারণ মানুষের পক্ষে দুঃসাধ্য। সময় এসেছে কোন দূতাবাস কোন দেশে কী করছে, সে সম্পর্কে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঠিকভাবে হিসাব নেওয়া।
এতক্ষণ যা বললাম তা একটু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বর্ণনা করলে আরো পরিষ্কার হতে পারে। কয়েক বছর আগে ইউরোপের একটি বিশাল বড় মার্কেটে ঢুকে দেখা গেল সেখানে বিভিন্ন দেশের পর্যটন গাইড বিক্রি হচ্ছে। চোখে পড়ল ভুটান, নেপাল, মালদ্বীপসহ প্রায় সব দেশেরই চমৎকার আকর্ষণীয় মলাটের ছোট ছোট গাইড বুক রয়েছে। শুধু বাংলাদেশের গাইড বুক খুঁজে পাওয়া গেল না। নেই তো নেই-ই। তারপর মার্কেট কর্তৃপক্ষের একজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, এগুলো দূতাবাস কর্তৃপক্ষ করে থাকে এবং তারা বিভিন্ন চেইনশপে বিতরণের ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এমন কিছু কখনোই দেওয়া হয়নি! জানতে ইচ্ছা করে, ইউরোপের ওই ব্যয়বহুল দেশগুলোতে বসে বাংলাদেশের দূতাবাস কর্তারা কী করেন? তাদের কাজ কী? একবার পকেটে যে টাকা-পয়সা ছিল তা পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে পিকপকেট হয়ে গেল। কোনো উপায় নেই। সে দেশে বাঙালি খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর। ট্রামে চড়ে কোনোক্রমে বিনা পয়সায় ১৫ নম্বর রাইতানা স্ট্রিটে বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে হাজির হলাম। কে কী চায়, তা জানার পর্যন্ত আগ্রহ হলো না তৎকালীন রাষ্ট্রদূতের। ইন্টারকমে বহু অনুরোধে তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হলো। তিনি কথা শেষ না করেই ধমকের সুরে ফোন রেখে দিলেন। পোলিশ রিসিপশনিস্ট মেয়েটি দুঃখজড়িত কণ্ঠে বারবার বলতে থাকলেন সরি, সরি। এমন সব দেশ রয়েছে, যেখানে লাখ লাখ বাংলাদেশি বাস করছেন। তাঁদের বেশির ভাগই কোনো না কোনো জটিলতায় পড়ে এমন আচরণের সম্মুখীন হচ্ছেন। লক্ষ করলেই দেখা যাবে, পুলিশকে গালি দেওয়ার মতোই প্রবাসীরা দূতাবাসগুলোকে গালি দিয়ে থাকেন। কেন?
পুনশ্চ : ইন্টারনেট ঘেঁটে ব্রাজিলের বাংলাদেশের দুটি কনস্যুলেটের ঠিকানা পাওয়া গেল। ইমেইল ঠিকানাও আছে। সুলতান আহমেদ এবং আবদুল কাইউমকে প্রয়োজনীয় সাহায্য করতে বিনীত অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লিখেছি সে ঠিকানায়। জানি না আদৌ কেউ খুলে দেখবেন কি না। নাকি শুধু আনুষ্ঠানিকতাই পালন করা হয়েছে। কারণ, অভিজ্ঞতা ভালো নয়। বাংলাদেশের মন্ত্রণালয়গুলোর প্রতিটির ওয়েব পেইজ আছে। দেখলেই বোঝা যায় এগুলো করতে হয়েছে, তাই করা। এর একটিতেও আপগ্রেড কোনো ইনফরমেশন মিলবে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যাঁরা এই ওয়েব পেইজ আপগ্রেড করার দায়িত্বে তাঁরা পদ-পদবিতে ছোট। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আপগ্রেডের জন্য অনুমতি না দিলে তাঁরা আপগ্রেড করতে পারেন না। আর উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত কর্মকর্তাদের সময় কোথায় এ ছোটখাটো বিষয়ে নাক গলানোর?
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com
আমরা কেউই তাঁদের কথা জানতে পারতাম না। আল জাজিরার একজন সাংবাদিক গ্যাব্রিয়েল সন্তোর কল্যাণে উঠে এসেছে এই দুই বাংলাদেশির কাহিনী। তিনি না জানালে কেউ আদৌ জানতেন না বাংলাদেশের দুইজন মানুষ এখন জীবন-সংগ্রামের চরম পরীক্ষা দিচ্ছেন হাজার হাজার মাইল দূরের আটলান্টিক সাগরের ওপারে সম্পূর্ণ অচেনা এক স্থানে। এমন অসংখ্য বাংলাদেশি রয়েছেন আফ্রিকা, পূর্ব ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন জেলখানায়। রয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রায় বন্দি অবস্থায়। ভাগ্যক্রমে যাঁরা চোখে পড়েন অথবা মুক্ত হন_তাঁদের কথাই কেবল আমরা জানতে পারি। এই জীবন্মৃত্যুর সংগ্রাম করে একসময় যাঁরা বেঁচে যান তাঁরাই বাংলাদেশে টাকা পাঠান। তাঁদের সেই পাঠানো অর্থকেই আমরা গর্বের সঙ্গে বলি রেমিট্যান্স। এভাবেই বাংলাদেশি মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কর্মসংস্থানের জন্য ছুটে বেড়াচ্ছেন দেশ থেকে দেশান্তরে। দেশ থেকে বের হয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতাও তাঁদের ভালো নয়। প্লেনে ওঠা পর্যন্ত কোথাও তাঁরা ভালো আচরণ পান না। ইমিগ্রেশন পার হওয়া তাঁদের কাছে পুলসিরাত পার হওয়ার শামিল। এই মানুষগুলোই নিজেদের গাঁটের টাকা খরচ করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গত বছর দেশে ১২ বিলিয়ন ডলার প্রেরণ করেছেন, যে অর্থ না হলে এই বাংলাদেশ প্রায় দেউলিয়া হয়ে যেত।
দুঃখের জায়গাটি একটু ভিন্ন। বাংলাদেশের বাইরে যে মিশনগুলো রয়েছে, অর্থাৎ হাইকমিশন, দূতাবাস ও কনস্যুলেট_সেগুলোতে নিয়োগ পেয়ে যাঁরা কাজ করছেন তাঁরা এই শ্রমিক শ্রেণীকে চরম অবহেলা করেন। নিজেদের পশ-উন্নত মানুষ ঠাওরে এই শ্রমিকদের সঙ্গে বিদেশ বিভুঁইয়ে কথা পর্যন্ত বলেন না_এমন অভিযোগ আছে বিস্তর। প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনগুলোর বাইরের দেশে কাজ কী? আমরা মনে করি, তাঁদের প্রধান কাজ প্রবাসে যেসব বাংলাদেশি রয়েছেন, তাদের স্বার্থ দেখা। তাঁদের কাজ মার্কিন অ্যাম্বাসাডর ড্যান মজিনার মতো কূটনীতি করা নয়। সে প্রয়োজন বাংলাদেশের যতটুকু আছে তা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা সেরে থাকেন। রাষ্ট্রদূতরা এমন কোনো হাতি-ঘোড়া মেরে আনেন না। কোনো দিন বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রদূতের কথা শোনা যায়নি, যিনি দেশের জন্য বড় ধরনের কিছু ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় অর্জন করে এনেছেন। বরং বদনাম কুড়িয়েছেন অনেকেই। কেউ কেউ ব্রুনাই দারুসসালামে পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশের অ্যাম্বাসাডর হয়ে সবচেয়ে দামি গাড়ি চালিয়ে সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন, কেউ কাঠমান্ডুতে বলিউড নায়িকার বাড়ির পাশ দিয়ে ঘুরঘুর করে লজ্জাজনক খবর বয়ে আনেন। পানীয় পানবিষয়ক বহু লজ্জাজনক কাহিনী পশ্চিমা দেশগুলো থেকে ভেসে আসে। থাক সেসব কথা। আমরা চাই কূটনৈতিক মিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রবাসী বাংলাদেশিদের কল্যাণে, বিশেষ করে তাদের কাগজপত্রের জটিলতা নিরসন, বাড়ি ফেরা, চিকিৎসা বিষয়ে, ভাষাগত ঝামেলা বিষয়ে সহায়তা দিন। তাহলেই মিশনকে সফল বলতে আমাদের দ্বিধা থাকবে না। আরো দু-একটি কাজ কূটনৈতিক মিশনের গুরুদায়িত্ব হিসেবে করা উচিত। যেমন_নতুন নতুন কর্মস্থল খুঁজে বের করা। কর্মরত দেশে ব্যাপকভাবে পর্যটকদের বাংলাদেশ ভ্রমণ করতে উৎসাহী করা। দুঃখের বিষয়, এ দুটোর কোনোটিই তাঁরা করেন না। বেশির ভাগ হাইকমিশনার এবং রাষ্ট্রদূত পার্টিতে অ্যাটেন্ড করে বেড়ান। সামান্য একটু দেশ বা ওই দেশে থাকা সাধারণ মানুষের দিকে মনোযোগী হন না। এটি দীর্ঘদিনের একটি সংস্কৃতি হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে মন্ত্রিপরিষদেও অবশেষে একটি পরিবর্তন এসেছে। এখানে অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র মন্ত্রী আছেন বেশ কয়েকজন। কোনো কোনো মন্ত্রী রাস্তায় হেঁটে হেঁটে পাবলিকের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন। কিন্তু পরিবর্তন নেই আমলা মানসিকতার দূতাবাসগুলোর। একটি দূতাবাসের পেছনে সরকারের কত অর্থ ব্যয় হয়, তা ধারণা করাও সাধারণ মানুষের পক্ষে দুঃসাধ্য। সময় এসেছে কোন দূতাবাস কোন দেশে কী করছে, সে সম্পর্কে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঠিকভাবে হিসাব নেওয়া।
এতক্ষণ যা বললাম তা একটু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বর্ণনা করলে আরো পরিষ্কার হতে পারে। কয়েক বছর আগে ইউরোপের একটি বিশাল বড় মার্কেটে ঢুকে দেখা গেল সেখানে বিভিন্ন দেশের পর্যটন গাইড বিক্রি হচ্ছে। চোখে পড়ল ভুটান, নেপাল, মালদ্বীপসহ প্রায় সব দেশেরই চমৎকার আকর্ষণীয় মলাটের ছোট ছোট গাইড বুক রয়েছে। শুধু বাংলাদেশের গাইড বুক খুঁজে পাওয়া গেল না। নেই তো নেই-ই। তারপর মার্কেট কর্তৃপক্ষের একজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, এগুলো দূতাবাস কর্তৃপক্ষ করে থাকে এবং তারা বিভিন্ন চেইনশপে বিতরণের ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এমন কিছু কখনোই দেওয়া হয়নি! জানতে ইচ্ছা করে, ইউরোপের ওই ব্যয়বহুল দেশগুলোতে বসে বাংলাদেশের দূতাবাস কর্তারা কী করেন? তাদের কাজ কী? একবার পকেটে যে টাকা-পয়সা ছিল তা পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে পিকপকেট হয়ে গেল। কোনো উপায় নেই। সে দেশে বাঙালি খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর। ট্রামে চড়ে কোনোক্রমে বিনা পয়সায় ১৫ নম্বর রাইতানা স্ট্রিটে বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে হাজির হলাম। কে কী চায়, তা জানার পর্যন্ত আগ্রহ হলো না তৎকালীন রাষ্ট্রদূতের। ইন্টারকমে বহু অনুরোধে তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হলো। তিনি কথা শেষ না করেই ধমকের সুরে ফোন রেখে দিলেন। পোলিশ রিসিপশনিস্ট মেয়েটি দুঃখজড়িত কণ্ঠে বারবার বলতে থাকলেন সরি, সরি। এমন সব দেশ রয়েছে, যেখানে লাখ লাখ বাংলাদেশি বাস করছেন। তাঁদের বেশির ভাগই কোনো না কোনো জটিলতায় পড়ে এমন আচরণের সম্মুখীন হচ্ছেন। লক্ষ করলেই দেখা যাবে, পুলিশকে গালি দেওয়ার মতোই প্রবাসীরা দূতাবাসগুলোকে গালি দিয়ে থাকেন। কেন?
পুনশ্চ : ইন্টারনেট ঘেঁটে ব্রাজিলের বাংলাদেশের দুটি কনস্যুলেটের ঠিকানা পাওয়া গেল। ইমেইল ঠিকানাও আছে। সুলতান আহমেদ এবং আবদুল কাইউমকে প্রয়োজনীয় সাহায্য করতে বিনীত অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লিখেছি সে ঠিকানায়। জানি না আদৌ কেউ খুলে দেখবেন কি না। নাকি শুধু আনুষ্ঠানিকতাই পালন করা হয়েছে। কারণ, অভিজ্ঞতা ভালো নয়। বাংলাদেশের মন্ত্রণালয়গুলোর প্রতিটির ওয়েব পেইজ আছে। দেখলেই বোঝা যায় এগুলো করতে হয়েছে, তাই করা। এর একটিতেও আপগ্রেড কোনো ইনফরমেশন মিলবে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যাঁরা এই ওয়েব পেইজ আপগ্রেড করার দায়িত্বে তাঁরা পদ-পদবিতে ছোট। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আপগ্রেডের জন্য অনুমতি না দিলে তাঁরা আপগ্রেড করতে পারেন না। আর উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত কর্মকর্তাদের সময় কোথায় এ ছোটখাটো বিষয়ে নাক গলানোর?
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com
No comments