স্মৃতির পাতা by কে জি মোস্তফা
পরাণের কথা পুরনো কথা সময়ের সঙ্গে ঘুরতে থাকে জীবনচক্রে। জীবনের সব কথা মনে থাকে না, বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। যদি সব ঘটনা মনে থাকত, তাহলে আমরা পাগল হয়ে যেতাম। তা যাতে না হয়, সেজন্যই বিস্মৃতির কবচ। আমার এ লেখা টান-টান কোনো স্মৃতিকথা নয়, বহমান দিনলিপি নয়, আপাতত অকিঞ্চিত্কর কিছু ভাঙা টুকরোর বিন্যাস।
বলাবাহুল্য, আমার প্রিয় ভাবনা-চিন্তা কবিতা বা গানকে ঘিরে। সম্প্রতি প্রয়াত হলেন বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী প্রবাল চৌধুরী। তার ছিল সুরেলা দরাজ কণ্ঠ। তারই গাওয়া একটি গান—‘কোথায় গেলো হারিয়ে আমার বাঁশির দেশের মন, আহা আমার বেতসবনের লুকিয়ে থাকা ক্ষণ’। বিটিভিতে একক গীতিকারের অনুষ্ঠানে আমার লেখা ৬টি গানের মধ্যে একটি। গানের কথা বড়ই কাতর, সুর বড়ই স্পর্শী। সুরকার ছিলেন স্বনামধন্য মরহুম আনোয়ার উদ্দিন খান। সিডিতে ধারণকৃত ওই গানটি আমার স্ত্রী প্রায়ই শুনতে ইচ্ছে করেন। গানটি ছোটবেলার স্মৃতিকে উদ্বেল করে তোলে। শুনতে শুনতে আমরা দুজন পলকে স্মৃতির মৃদু টোকা অনুভব করি। পাখির পালকের মতো ভাসতে থাকি স্মৃতির উত্সবে। কত ভয় লজ্জা শিহরণ পুরনো বইয়ের মতো এখনও সাজিয়ে রেখেছি মনের মধ্যে।
সে যাই হোক, আমাদের মহান নেতা একে ফজলুল হক এবং আরও অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের জন্ম মাতুলালয়ে। এ তথ্য আমাকে বেশ উদ্দীপিত করে। কেননা আমারও জন্ম মাতুলালয়ে। গ্রামের নাম ছনুয়া, ভূঞা বাড়ি। ডাকঘর বজরা, থানা বেগমগঞ্জ, জেলা নোয়াখালী। সময় ব্রিটিশ আমল। সবুজ বনানী ঝোপজঙ্গলে ঘেরা বিশাল মামাবাড়ি। শৈশব থেকে কৈশোর, হেলেদুলে ভেসে যাওয়া এক জীবন। মনে পড়ে জঙ্গলে-জঙ্গলে বুনোফল খোঁজার স্মৃতি। কত রকমের ফলের গাছ, রং-বেরংয়ের ফুল। কিচির-মিচির চড়ুই, পাখ-পাখালির নিত্য কূজন, পোকামাকড়ের বিচিত্র ধ্বনি। কত সব দৃশ্য, গন্ধ, শব্দের পারম্পর্যহীন যাতায়াত। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তটিনী, প্রান্তজুড়ে আদিগন্ত ফসলের ক্ষেত। পূর্বপাশে বিখ্যাত জৈনপুরী মাওলানা কেরামত আলী সাহেবের সুদৃশ্য বাড়ি, অন্যপাশে একাধিক হিন্দু সম্প্রদায়ের বসতি। সারা বছরই পূজা-পার্বণ, ঢাক-ঢোলের নিত্য আওয়াজ। মুসলমানদের বার্ষিক ঈদ ও অন্যান্য সামাজিক উত্সব। হিন্দু-মুসলমানের নিরবচ্ছিন্ন মহামিলনের সে এক ইতিহাস। সব মিলিয়ে সত্যিকারের গানের দেশ, ধানের দেশ, জন্মভূমি আমার বাংলাদেশ!
যাই হোক, মামাবাড়িতে যাদের জন্ম তাদের স্নেহ-প্রশ্রয় অনেক বেশি। সেই সুবাদে অনেক দুরন্তপনা ও দুষ্কর্মের হোতা ছিলাম আমি। প্রতিবেশীদের নিত্য অভিযোগ। বাবা-মায়ের শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র আশ্রয় নানির অকাতর আদর। নাতি-নাতনি চিরকাল নানিদের প্রাণভোমরা! নানাবাড়ি, সম্পন্ন পরিবার। গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, পুকুরভরা মাছ আর পরিচ্ছন্ন ঢেঁকিঘর। এগুলো সেকালের গৃহস্থঘরের লক্ষ্মীচিহ্ন। প্রসঙ্গত আমার নানা মৌলবী ফজলুর রহমান কোনো এক মরমী আহ্বানে দীর্ঘকাল নিখোঁজ ছিলেন। মামাবাড়িতে মক্তবপাঠ শেষে আমাকে বজরা এম.ই. স্কুলের প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেয়া হলো। রেললাইন ও রেলস্টেশন পার হয়ে যেতে হবে বলে নানির ঘুম হারাম। দোয়া-কালাম পড়ে প্রতিদিনই আল্লাহর ওপর ভরসা করে ছেড়ে দিতেন। হাতে থাকত বর্ণশিক্ষা, ধারাপাত ও শ্লেটপেন্সিল। ২/১ বছর পর কাগজ, বাঁশের কঞ্চির কলম ও দোয়াত-কালি। ছাত্র হিসেবে আমি অভাজনদের দলে, ব্যাকবেঞ্চার। কপালে নিত্য বেত্রাঘাত। সেবার তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র, ক্লাস টিচার শচীন স্যার। ভীষণ মেজাজি। পরদিন ইংরেজি টেন্সের ১২টি বাক্য একনাগাড়ে বলতে না পারলে কঠিনতর শাস্তি। শাস্তির ধরন শুনে রীতিমত ঘাবড়ে গেলাম। সেদিন ঘুম হলো হারাম। রাতভর জেগে পড়া-পড়া-পড়া। মুখস্ত নয় শুধু, কণ্ঠস্থ করতে লাগলাম। ভুলে যাতে না যাই, সারাক্ষণ মনে মনে আওড়াই। ক্লাসে ব্যর্থ অনেকেই। স্যারের জিজ্ঞাসা, আর কেউ পারবে কিনা। পেছন থেকে কম্পিতপদে উঠে দাঁড়ালাম। পারব কি পারব না ভাবতে-ভাবতে—না, আমি পেরেছি! কেমন করে যেন অসাধ্য সাধিত হলো। শচীন স্যার কাছে ডাকলেন। ভয়ে-ভয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি সস্নেহে আমার মাথার ওপর হাত রেখে বললেন, তুই মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করলে অনেক ভালো করতিস্। কী যে হলো, মুহূর্তে আমার শরীরে বিদ্যুত্স্পৃষ্টের মতো শিহরণ বয়ে গেল! আমি মুগ্ধ, আমি ভীষণভাবে স্যারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়লাম। শুরু হলো আমার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়। অভাবনীয় পরিবর্তন। রোল নং ৩০/৩২ থেকে ক্রমশ উপরে ওঠার পালা। স্কুলের শেষ বর্ষ অর্থাত্ ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে আমি পঞ্চম স্থানে গিয়ে পৌঁছলাম। দ্বিতীয় স্থানে আজকের বিশিষ্ট সাংবাদিক আহমদ নজির। নোয়াখালী জেলার মধ্যে বজরা এম.ই. স্কুলের একটা আলাদা সুনাম ছিল। প্রতি বছর এখান থেকে কেউ-না-কেউ মহসীন বৃত্তি লাভ করে। সাধারণত ফার্স্ট বয় এবং সেকেন্ড বয় বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়। সেবার নানান বিবেচনায় আমাকেসহ ৫ জনকে মনোনীত করা হলো। কী আশ্চর্য! সবাইকে তাক্ লাগিয়ে দিয়ে আমি আর ফার্স্ট বয় নাদেরুজ্জামান বৃত্তি পেয়ে গেলাম।স্মৃতির বুঝি নানাবিধ আরম্ভ আছে, সমাপ্তিও আছে। স্মৃতির বহু মুহূর্ত আছে যেখানে স্বর্ণালি ভবিষ্যতের ইঙ্গিত আছে, আবার অতীতকে নিয়ে অবসেশন্ও আছে। আমার অনাড়ম্বর জীবনে শচীন স্যারের স্নেহসিক্ত আশীর্বাদ ছিল এক সাড়ম্বর উপস্থিতি!
লেখক : কবি, গীতিকার ও সাংবাদিক
সে যাই হোক, আমাদের মহান নেতা একে ফজলুল হক এবং আরও অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের জন্ম মাতুলালয়ে। এ তথ্য আমাকে বেশ উদ্দীপিত করে। কেননা আমারও জন্ম মাতুলালয়ে। গ্রামের নাম ছনুয়া, ভূঞা বাড়ি। ডাকঘর বজরা, থানা বেগমগঞ্জ, জেলা নোয়াখালী। সময় ব্রিটিশ আমল। সবুজ বনানী ঝোপজঙ্গলে ঘেরা বিশাল মামাবাড়ি। শৈশব থেকে কৈশোর, হেলেদুলে ভেসে যাওয়া এক জীবন। মনে পড়ে জঙ্গলে-জঙ্গলে বুনোফল খোঁজার স্মৃতি। কত রকমের ফলের গাছ, রং-বেরংয়ের ফুল। কিচির-মিচির চড়ুই, পাখ-পাখালির নিত্য কূজন, পোকামাকড়ের বিচিত্র ধ্বনি। কত সব দৃশ্য, গন্ধ, শব্দের পারম্পর্যহীন যাতায়াত। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তটিনী, প্রান্তজুড়ে আদিগন্ত ফসলের ক্ষেত। পূর্বপাশে বিখ্যাত জৈনপুরী মাওলানা কেরামত আলী সাহেবের সুদৃশ্য বাড়ি, অন্যপাশে একাধিক হিন্দু সম্প্রদায়ের বসতি। সারা বছরই পূজা-পার্বণ, ঢাক-ঢোলের নিত্য আওয়াজ। মুসলমানদের বার্ষিক ঈদ ও অন্যান্য সামাজিক উত্সব। হিন্দু-মুসলমানের নিরবচ্ছিন্ন মহামিলনের সে এক ইতিহাস। সব মিলিয়ে সত্যিকারের গানের দেশ, ধানের দেশ, জন্মভূমি আমার বাংলাদেশ!
যাই হোক, মামাবাড়িতে যাদের জন্ম তাদের স্নেহ-প্রশ্রয় অনেক বেশি। সেই সুবাদে অনেক দুরন্তপনা ও দুষ্কর্মের হোতা ছিলাম আমি। প্রতিবেশীদের নিত্য অভিযোগ। বাবা-মায়ের শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র আশ্রয় নানির অকাতর আদর। নাতি-নাতনি চিরকাল নানিদের প্রাণভোমরা! নানাবাড়ি, সম্পন্ন পরিবার। গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, পুকুরভরা মাছ আর পরিচ্ছন্ন ঢেঁকিঘর। এগুলো সেকালের গৃহস্থঘরের লক্ষ্মীচিহ্ন। প্রসঙ্গত আমার নানা মৌলবী ফজলুর রহমান কোনো এক মরমী আহ্বানে দীর্ঘকাল নিখোঁজ ছিলেন। মামাবাড়িতে মক্তবপাঠ শেষে আমাকে বজরা এম.ই. স্কুলের প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেয়া হলো। রেললাইন ও রেলস্টেশন পার হয়ে যেতে হবে বলে নানির ঘুম হারাম। দোয়া-কালাম পড়ে প্রতিদিনই আল্লাহর ওপর ভরসা করে ছেড়ে দিতেন। হাতে থাকত বর্ণশিক্ষা, ধারাপাত ও শ্লেটপেন্সিল। ২/১ বছর পর কাগজ, বাঁশের কঞ্চির কলম ও দোয়াত-কালি। ছাত্র হিসেবে আমি অভাজনদের দলে, ব্যাকবেঞ্চার। কপালে নিত্য বেত্রাঘাত। সেবার তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র, ক্লাস টিচার শচীন স্যার। ভীষণ মেজাজি। পরদিন ইংরেজি টেন্সের ১২টি বাক্য একনাগাড়ে বলতে না পারলে কঠিনতর শাস্তি। শাস্তির ধরন শুনে রীতিমত ঘাবড়ে গেলাম। সেদিন ঘুম হলো হারাম। রাতভর জেগে পড়া-পড়া-পড়া। মুখস্ত নয় শুধু, কণ্ঠস্থ করতে লাগলাম। ভুলে যাতে না যাই, সারাক্ষণ মনে মনে আওড়াই। ক্লাসে ব্যর্থ অনেকেই। স্যারের জিজ্ঞাসা, আর কেউ পারবে কিনা। পেছন থেকে কম্পিতপদে উঠে দাঁড়ালাম। পারব কি পারব না ভাবতে-ভাবতে—না, আমি পেরেছি! কেমন করে যেন অসাধ্য সাধিত হলো। শচীন স্যার কাছে ডাকলেন। ভয়ে-ভয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি সস্নেহে আমার মাথার ওপর হাত রেখে বললেন, তুই মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করলে অনেক ভালো করতিস্। কী যে হলো, মুহূর্তে আমার শরীরে বিদ্যুত্স্পৃষ্টের মতো শিহরণ বয়ে গেল! আমি মুগ্ধ, আমি ভীষণভাবে স্যারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়লাম। শুরু হলো আমার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়। অভাবনীয় পরিবর্তন। রোল নং ৩০/৩২ থেকে ক্রমশ উপরে ওঠার পালা। স্কুলের শেষ বর্ষ অর্থাত্ ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে আমি পঞ্চম স্থানে গিয়ে পৌঁছলাম। দ্বিতীয় স্থানে আজকের বিশিষ্ট সাংবাদিক আহমদ নজির। নোয়াখালী জেলার মধ্যে বজরা এম.ই. স্কুলের একটা আলাদা সুনাম ছিল। প্রতি বছর এখান থেকে কেউ-না-কেউ মহসীন বৃত্তি লাভ করে। সাধারণত ফার্স্ট বয় এবং সেকেন্ড বয় বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়। সেবার নানান বিবেচনায় আমাকেসহ ৫ জনকে মনোনীত করা হলো। কী আশ্চর্য! সবাইকে তাক্ লাগিয়ে দিয়ে আমি আর ফার্স্ট বয় নাদেরুজ্জামান বৃত্তি পেয়ে গেলাম।স্মৃতির বুঝি নানাবিধ আরম্ভ আছে, সমাপ্তিও আছে। স্মৃতির বহু মুহূর্ত আছে যেখানে স্বর্ণালি ভবিষ্যতের ইঙ্গিত আছে, আবার অতীতকে নিয়ে অবসেশন্ও আছে। আমার অনাড়ম্বর জীবনে শচীন স্যারের স্নেহসিক্ত আশীর্বাদ ছিল এক সাড়ম্বর উপস্থিতি!
লেখক : কবি, গীতিকার ও সাংবাদিক
No comments