ব্রান্ডেনবার্গ গেটঃ অনেক ইতিহাসের সাক্ষী by কাজী জহিরুল ইসলাম
সূর্য এখন মাথার ওপর। রোদের তীব্রতা বেড়েছে। আমি তীব্র রোদের ভেতর উটেন্ডে হেনরিকে হারিয়ে ফেললাম। হারিয়ে এদিক-ওদিক এলোপাথাড়ি তাকাচ্ছি। পার্কের ভেতরে, পাইন গাছগুলোর আড়ালেই আমার দৃষ্টি ঘুরপাক খাচ্ছে। একবার যেন ওকে দেখতেও পেলাম, কোনো এক পাইন গাছের ফাঁক থেকে বেরিয়ে আবার একদল গাছের আড়ালে হারিয়ে গেল।
ও কি আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে? আমি দাঁড়িয়ে আছি ফুটপাতের ওপর। পার্কের দিকে মুখ ফেরানো। পেছন দিক দিয়ে হুশহাশ করে দ্রুতগামী গাড়িগুলো ছুটে যাচ্ছে। হঠাত্ আমার কাঁধে কারও হাত। আমি চমকে উঠি। তাকিয়ে দেখি বোখারি।
ওই মিয়া পাগল হৈছেন নি? দৌড় মারলেন ক্যা?
জানি না। আমি মনে হয় পাগলই হয়ে গেছি। বার্লিন আমাকে পাগল করে দিয়েছে। হেনরি গেল কোথায়?
আরে এটা একটা পাগল। আগে সাংবাদিক ছিল, দাউদ ভাই চিনে তো অরে। ভালো বিপদেই পড়লাম আপনেগোরে লৈয়া। একজন টেকা হারায়া খালি পোলাপাইনের মতো কান্দে। আরেকজন পাগলের পিছে দৌড়ায়। চলেন যাই।
কোথায় যাব?
আমি জানিনি? ওই যে ওরা, খাড়ায়া রৈছে। দাউদ ভাই যেহানে লৈয়া যায়, ওইহানেই যামু। আমি কি আগে বার্লিন আইছিনি?
কয়েকজন যুবক কোত্থেকে বালতি, ব্রাশ নিয়ে এসে চৌরাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে পড়ে। লাল বাতির অনুশাসনে যে গাড়িগুলো থেমে পড়ছে, ওরা সেই গাড়িগুলোতে অতি দ্রুত বাসান মেখে ব্রাশ চালিয়ে সাফ করতে লগে যাচ্ছে। লম্বা লম্বা প্লাস্টিকের লাঠির মাথায় লাগানো ব্রাশ। ওরা চার/পাঁচজন, উদোম গা, শর্টস পরা, পায়ে স্পোর্টস সু। স্টুডেন্ট সন্দেহ নেই এবং ওরা জার্মান স্টুডেন্ট এটাও বেশ পরিষ্কার। ওদের এই গাড়ি সাফ করার বিষয়টাতে তেমন কোনো বিনয় নেই, যেন খানিকটা উদ্ধত। অনেকেই পয়সা দিচ্ছে, যারা দিচ্ছে না, ওদের ছেলেগুলো গালাগাল দিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের পুলিশে ধরবে। সভ্য দেশে এই অসভ্যতা নিশ্চয়ই বরদাশত করা হবে না।
খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে উদ্ধত শ্বেতবর্ণের যুবকদের কাণ্ডকারখানা দেখে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। একটি কারাভ্যান আমাদের পাশ কেটে ধীরে ধীরে চলে গেল। সামারে ইউরোপ-আমেরিকায় এরকম অনেক কারাভ্যান দেখা যায়। গাড়িতো নয় যেন আস্ত এটি বাড়ি ছুটে চলেছে। মাসের খাবার-দাবার, ঘুমানোর আয়োজন সব থাকে এই কারাভ্যানগুলোতে। পুরো একটি পরিবার কারাভ্যান ভাড়া করে বেরিয়ে পড়ে লম্বা সফরে। অনেক পরিবারের নিজস্ব কারাভ্যানও থাকে। হোটেল-ফোটেল খোঁজার কোনো ঝামেলা নেই। চলতে চলতে রাত নেমে গেলে নিরাপদ কোনো জায়গা খুঁজে ভ্যান থামিয়ে দিলেই হলো। কারাভ্যানগুলোর সঙ্গে মানুষের জীবনের একটা দারুণ সাযুজ্য আছে। আমাদের প্রত্যেকের জীবনই কী একেকটি কারাভ্যান নয়? ছুটছি তো ছুটছিই, কোথাও খানিক সময়ের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ছি সুন্দর কিছু দেখতে পেয়ে, আবার ছুটছি। এই তো জীবন। উইনস্টোন গ্রুমের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত পরিচালক রবার্ট জেমেকিসের অস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্র ফরেস্ট গাম্পের কথা মনে পড়ে গেল। ভোরে ঘুম থেকে ওঠে যখন ফরেস্ট দেখে তার প্রেমিকা জেনি নেই, তাকে কিছু না বলেই চলে গেছে, তখন সে দৌড়াতে শুরু করে। একটানা ৩ বছর ৫ মাস ১৪ দিন ৮ ঘণ্টা সে দৌড়ায়। এই সময়ে শুধু ঘুম পেলে ঘুমাত, ক্ষিদে পেলে খেত। তাছাড়া সারাক্ষণ শুধু দৌড়াত। ফরেস্ট গাম্পের মতো আক্ষরিক অর্থে না দৌড়ালেও আমরা তো আসলে উটেন্ডে হেনরির মতো সারাক্ষণ কোনো না কোনোভাবে দৌড়াচ্ছিই।
দৌড়াতে দৌড়াতে এক সুবিশাল এভেনিউতে উঠে এলাম আমরা। এভেনিউটি অভিনব এ জন্য যে, এর মাঝখানে প্রায় দেড়শ’ ফুট প্রশস্ত ফুটপাত আর দু’পাশে দু’মুখী চলা গাড়ির রাস্তা। ফুটপাতের মাঝখানে আবার সবুজ বৃক্ষের বাগান। সেসব বৃক্ষের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট কিয়স্ক। এগুলোতে স্যুভেনির, নানা দেশের হস্তশিল্প, সিগারেট, চকলেট, মৃদু পানীয় পাওয়া যাচ্ছে। আমি হুমড়ি খেয়ে পড়লাম এক জার্মান সুন্দরীর ওপর। ইচ্ছে করে না, হোচট খেয়ে। পুরো পেরিজার প্লাতজ গিজগিজ করছে হাজার হাজার পর্যটকের পদচারণায়। কেউ একজন এক সুবিশাল হলুদ বেলুন উড়িয়ে দিয়েছে আকাশে। এর ভেতর কী মানুষ আছে? হ্যাঁ, আছে তো, ওই তো নড়ছে। আমি হা করে আকাশের দিকে তাকিয়ে উড়ন্ত বেলুনের ভেতর ম্রিয়মাণ মানুষ দেখতে দেখতে এগুচ্ছিলাম, তখনি হুড়মুড়িয়ে পড়ি মেয়েটির ওপর। আমি তৃতীয় বিশ্বের মানুষ। অত ভদ্রতা জানি না। মুখে শুধু দুঃখিত বলেই সরে যাচ্ছিলাম। দাউদ ভাই মেয়েটিকে হাত ধরে টেনে তুললেন এবং জার্মান ভাষায় অনেকক্ষণ ধরে কীসব বললেন। বোধহয় আমার গ্রাম্যতার জন্য ডয়েচ সভ্যতার বই থেকে একটি ক্ষমামন্ত্র পাঠ করে শোনালেন মেয়েটিকে। মেয়েটি খুব মিষ্টি করে হাসল।
পেরিজার প্লাতজ শুধু বার্লিন কিংবা জার্মানির নয়, পুরো ইউরোপের মধ্যেই একটি উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান। পৃথিবীর অনেক বড় বড় ঘটনাই এখানে ঘটেছে। ব্রান্ডেনবার্গ গেট বা বার্লিন গেট এখানেই অবস্থিত। যার একদিকে পূর্ব জার্মানি আর অন্যদিকে পশ্চিম জার্মানি। ১৯৮৭ সালের ১২ জুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান এখানে দাঁড়িয়েই বার্লিন প্রাচীর ভেঙে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি তত্কালীন সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘সাধারণ সম্পাদক গর্বাচেভ, আপনি যদি শান্তি চান, পূর্ব ইউরোপ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের উন্নয়ন চান, যদি মানুষের মুক্তি চান তাহলে এই গেটে আসুন! জনাব গর্বাচেভ, এই গেট খুলেদিন, ভেঙে দিন এই প্রাচীর।’ ১৯৯৪ সালের ১২ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনও এখানে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি ঠাণ্ডা-লড়াই পরবর্তী বিশ্ব শান্তি নিয়ে কথা বলেন।
অবশেষে সেই শুভদিন আসে। ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর পেরিজার প্লাতসে ঢল নামে জার্মানবাসীর। ১৯৬১ সালে সমাজতান্ত্রিক পূর্ব জার্মানি বার্লিনের বুকে এক নির্মম দেয়াল তুলে দেয়। বিভক্তির পর থেকে মাত্র ১২/১৩ বছরে প্রায় আড়াই মিলিয়ন পূর্ব জার্মান পাড়ি জমায় পশ্চিমে। নিজেদের দীনতা ঢাকতেই পূর্ব জার্মানি এই দেয়াল তুলে দেয়, যাতে আর কেউ বিনা অনুমতিতে পশ্চিমে পাড়ি জমাতে না পারে। এই দেয়াল হাজার হাজার বার্লিনবাসীকে তাদের প্রিয়জনের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর অবশেষ দুই জার্মানি একমত হয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় এই বিভক্তির দেয়াল। খুলে দেয়া হয় ব্রান্ডেনবার্গ গেট। জার্মান চ্যান্সেলর হেলমুট কুহলই সর্বপ্রথম ব্রান্ডেনবার্গ গেট পেরিয়ে প্রবেশ করেন পূর্ব জার্মানিতে, তাকে স্বাগত জানান পূর্ব জার্মানির প্রধানমন্ত্রী হ্যান্স মড্রো। এর মধ্য দিয়েই দুই জার্মানির একত্রায়ন ঘটে। পৃথিবীর নানা দেশে এখনও এমনি অনেক অহেতুক বিভক্তির দেয়াল সাপের মতো ফণা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। পৃথিবীর বুক থেকে এমনি করে সব বিভক্তির দেয়াল তুলে দেয়ার জন্য প্রয়োজন সাহসী ও আলোকিত নেতৃত্ব।
লেখক : কবি, জাতিসঙ্ঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা
ওই মিয়া পাগল হৈছেন নি? দৌড় মারলেন ক্যা?
জানি না। আমি মনে হয় পাগলই হয়ে গেছি। বার্লিন আমাকে পাগল করে দিয়েছে। হেনরি গেল কোথায়?
আরে এটা একটা পাগল। আগে সাংবাদিক ছিল, দাউদ ভাই চিনে তো অরে। ভালো বিপদেই পড়লাম আপনেগোরে লৈয়া। একজন টেকা হারায়া খালি পোলাপাইনের মতো কান্দে। আরেকজন পাগলের পিছে দৌড়ায়। চলেন যাই।
কোথায় যাব?
আমি জানিনি? ওই যে ওরা, খাড়ায়া রৈছে। দাউদ ভাই যেহানে লৈয়া যায়, ওইহানেই যামু। আমি কি আগে বার্লিন আইছিনি?
কয়েকজন যুবক কোত্থেকে বালতি, ব্রাশ নিয়ে এসে চৌরাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে পড়ে। লাল বাতির অনুশাসনে যে গাড়িগুলো থেমে পড়ছে, ওরা সেই গাড়িগুলোতে অতি দ্রুত বাসান মেখে ব্রাশ চালিয়ে সাফ করতে লগে যাচ্ছে। লম্বা লম্বা প্লাস্টিকের লাঠির মাথায় লাগানো ব্রাশ। ওরা চার/পাঁচজন, উদোম গা, শর্টস পরা, পায়ে স্পোর্টস সু। স্টুডেন্ট সন্দেহ নেই এবং ওরা জার্মান স্টুডেন্ট এটাও বেশ পরিষ্কার। ওদের এই গাড়ি সাফ করার বিষয়টাতে তেমন কোনো বিনয় নেই, যেন খানিকটা উদ্ধত। অনেকেই পয়সা দিচ্ছে, যারা দিচ্ছে না, ওদের ছেলেগুলো গালাগাল দিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের পুলিশে ধরবে। সভ্য দেশে এই অসভ্যতা নিশ্চয়ই বরদাশত করা হবে না।
খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে উদ্ধত শ্বেতবর্ণের যুবকদের কাণ্ডকারখানা দেখে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। একটি কারাভ্যান আমাদের পাশ কেটে ধীরে ধীরে চলে গেল। সামারে ইউরোপ-আমেরিকায় এরকম অনেক কারাভ্যান দেখা যায়। গাড়িতো নয় যেন আস্ত এটি বাড়ি ছুটে চলেছে। মাসের খাবার-দাবার, ঘুমানোর আয়োজন সব থাকে এই কারাভ্যানগুলোতে। পুরো একটি পরিবার কারাভ্যান ভাড়া করে বেরিয়ে পড়ে লম্বা সফরে। অনেক পরিবারের নিজস্ব কারাভ্যানও থাকে। হোটেল-ফোটেল খোঁজার কোনো ঝামেলা নেই। চলতে চলতে রাত নেমে গেলে নিরাপদ কোনো জায়গা খুঁজে ভ্যান থামিয়ে দিলেই হলো। কারাভ্যানগুলোর সঙ্গে মানুষের জীবনের একটা দারুণ সাযুজ্য আছে। আমাদের প্রত্যেকের জীবনই কী একেকটি কারাভ্যান নয়? ছুটছি তো ছুটছিই, কোথাও খানিক সময়ের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ছি সুন্দর কিছু দেখতে পেয়ে, আবার ছুটছি। এই তো জীবন। উইনস্টোন গ্রুমের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত পরিচালক রবার্ট জেমেকিসের অস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্র ফরেস্ট গাম্পের কথা মনে পড়ে গেল। ভোরে ঘুম থেকে ওঠে যখন ফরেস্ট দেখে তার প্রেমিকা জেনি নেই, তাকে কিছু না বলেই চলে গেছে, তখন সে দৌড়াতে শুরু করে। একটানা ৩ বছর ৫ মাস ১৪ দিন ৮ ঘণ্টা সে দৌড়ায়। এই সময়ে শুধু ঘুম পেলে ঘুমাত, ক্ষিদে পেলে খেত। তাছাড়া সারাক্ষণ শুধু দৌড়াত। ফরেস্ট গাম্পের মতো আক্ষরিক অর্থে না দৌড়ালেও আমরা তো আসলে উটেন্ডে হেনরির মতো সারাক্ষণ কোনো না কোনোভাবে দৌড়াচ্ছিই।
দৌড়াতে দৌড়াতে এক সুবিশাল এভেনিউতে উঠে এলাম আমরা। এভেনিউটি অভিনব এ জন্য যে, এর মাঝখানে প্রায় দেড়শ’ ফুট প্রশস্ত ফুটপাত আর দু’পাশে দু’মুখী চলা গাড়ির রাস্তা। ফুটপাতের মাঝখানে আবার সবুজ বৃক্ষের বাগান। সেসব বৃক্ষের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট কিয়স্ক। এগুলোতে স্যুভেনির, নানা দেশের হস্তশিল্প, সিগারেট, চকলেট, মৃদু পানীয় পাওয়া যাচ্ছে। আমি হুমড়ি খেয়ে পড়লাম এক জার্মান সুন্দরীর ওপর। ইচ্ছে করে না, হোচট খেয়ে। পুরো পেরিজার প্লাতজ গিজগিজ করছে হাজার হাজার পর্যটকের পদচারণায়। কেউ একজন এক সুবিশাল হলুদ বেলুন উড়িয়ে দিয়েছে আকাশে। এর ভেতর কী মানুষ আছে? হ্যাঁ, আছে তো, ওই তো নড়ছে। আমি হা করে আকাশের দিকে তাকিয়ে উড়ন্ত বেলুনের ভেতর ম্রিয়মাণ মানুষ দেখতে দেখতে এগুচ্ছিলাম, তখনি হুড়মুড়িয়ে পড়ি মেয়েটির ওপর। আমি তৃতীয় বিশ্বের মানুষ। অত ভদ্রতা জানি না। মুখে শুধু দুঃখিত বলেই সরে যাচ্ছিলাম। দাউদ ভাই মেয়েটিকে হাত ধরে টেনে তুললেন এবং জার্মান ভাষায় অনেকক্ষণ ধরে কীসব বললেন। বোধহয় আমার গ্রাম্যতার জন্য ডয়েচ সভ্যতার বই থেকে একটি ক্ষমামন্ত্র পাঠ করে শোনালেন মেয়েটিকে। মেয়েটি খুব মিষ্টি করে হাসল।
পেরিজার প্লাতজ শুধু বার্লিন কিংবা জার্মানির নয়, পুরো ইউরোপের মধ্যেই একটি উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান। পৃথিবীর অনেক বড় বড় ঘটনাই এখানে ঘটেছে। ব্রান্ডেনবার্গ গেট বা বার্লিন গেট এখানেই অবস্থিত। যার একদিকে পূর্ব জার্মানি আর অন্যদিকে পশ্চিম জার্মানি। ১৯৮৭ সালের ১২ জুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান এখানে দাঁড়িয়েই বার্লিন প্রাচীর ভেঙে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি তত্কালীন সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘সাধারণ সম্পাদক গর্বাচেভ, আপনি যদি শান্তি চান, পূর্ব ইউরোপ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের উন্নয়ন চান, যদি মানুষের মুক্তি চান তাহলে এই গেটে আসুন! জনাব গর্বাচেভ, এই গেট খুলেদিন, ভেঙে দিন এই প্রাচীর।’ ১৯৯৪ সালের ১২ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনও এখানে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি ঠাণ্ডা-লড়াই পরবর্তী বিশ্ব শান্তি নিয়ে কথা বলেন।
অবশেষে সেই শুভদিন আসে। ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর পেরিজার প্লাতসে ঢল নামে জার্মানবাসীর। ১৯৬১ সালে সমাজতান্ত্রিক পূর্ব জার্মানি বার্লিনের বুকে এক নির্মম দেয়াল তুলে দেয়। বিভক্তির পর থেকে মাত্র ১২/১৩ বছরে প্রায় আড়াই মিলিয়ন পূর্ব জার্মান পাড়ি জমায় পশ্চিমে। নিজেদের দীনতা ঢাকতেই পূর্ব জার্মানি এই দেয়াল তুলে দেয়, যাতে আর কেউ বিনা অনুমতিতে পশ্চিমে পাড়ি জমাতে না পারে। এই দেয়াল হাজার হাজার বার্লিনবাসীকে তাদের প্রিয়জনের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর অবশেষ দুই জার্মানি একমত হয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় এই বিভক্তির দেয়াল। খুলে দেয়া হয় ব্রান্ডেনবার্গ গেট। জার্মান চ্যান্সেলর হেলমুট কুহলই সর্বপ্রথম ব্রান্ডেনবার্গ গেট পেরিয়ে প্রবেশ করেন পূর্ব জার্মানিতে, তাকে স্বাগত জানান পূর্ব জার্মানির প্রধানমন্ত্রী হ্যান্স মড্রো। এর মধ্য দিয়েই দুই জার্মানির একত্রায়ন ঘটে। পৃথিবীর নানা দেশে এখনও এমনি অনেক অহেতুক বিভক্তির দেয়াল সাপের মতো ফণা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। পৃথিবীর বুক থেকে এমনি করে সব বিভক্তির দেয়াল তুলে দেয়ার জন্য প্রয়োজন সাহসী ও আলোকিত নেতৃত্ব।
লেখক : কবি, জাতিসঙ্ঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা
No comments