যুক্তি তর্ক গল্প-রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক বিতর্ক-বিভ্রান্তি ঘোচাতেই হবে by আবুল মোমেন
কে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবে? কোন দল পারবে সুশাসন নিশ্চিত করে দেশকে এগিয়ে নিতে? মানুষের মনে এসব প্রশ্ন বারবার উদয় হচ্ছে। কিন্তু জবাব পেতে পেতেও যেন অধরা থেকে যাচ্ছে। আশায় বুক বাঁধা আর আশা-নিরাশার দোলাচলের পরে পুনরায় আশাভঙ্গের বেদনা ও ক্ষোভে জ্বলতে হয় মানুষকে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে হলে একটি দেশপ্রেমিক সরকারকে মোটা দাগে তিনটি ফ্রন্টে কাজ করতে হবে। এগুলো হলো—ক. সুশাসন
প্রতিষ্ঠা-দুর্নীতি, অদক্ষতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার ঘুচিয়ে জনমুখী দক্ষ সক্রিয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করা, খ. অর্থনৈতিক অগ্রগতি—সুষ্ঠু পরিকল্পনা, দক্ষ ব্যবস্থাপনা, প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দুর্নীতি ও ক্ষমতার হস্তক্ষেপমুক্ত গতিশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করা; এবং গ. ইতিহাসের দায় পূরণ—রাজনৈতিক লক্ষ্যাদর্শ ঠিক রেখে জাতির মানসযাত্রা বাধামুক্তভাবে সচল করার ব্যবস্থা গ্রহণ।
দলীয় কর্মসূচির ক্ষেত্রে প্রথম দুটিতে বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে তেমন পার্থক্য নেই। আর দুর্নীতি বা ক্ষমতার অপব্যবহার করা এবং এ দুই ক্ষেত্রে ব্যর্থতায়ও দুই বড় দলে অমিল তেমন নেই। তাদের অমিল রয়েছে রাজনীতিতে—রাজনৈতিক লক্ষ্যাদর্শের ক্ষেত্রে। আওয়ামী লীগ বায়ান্ন থেকে সূচিত জনজাগরণের সাথি হয়ে ধাপে ধাপে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতি করেছে। এটি ছিল এ দেশের সিংহভাগ মানুষেরই চাওয়া। আর তাই জনগণ ঊনসত্তর সালে গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নেতা বঙ্গবন্ধুকে ষড়যন্ত্র মামলা ও কারাগার থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসে। তারপর ১৯৭০-এর নির্বাচনে প্রথম সুযোগেই তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে গণরায় দিয়েছে। এভাবে সেদিন বঙ্গবন্ধু বাঙালির অবিসংবাদী নেতা হয়ে ওঠেন আর আওয়ামী লীগ দলীয় গণ্ডি ছাপিয়ে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্ল্যাটফরম হয়ে ওঠে। আর তাই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু কারান্তরালে থেকেও ছিলেন জাতির নেতা, আওয়ামী লীগ ছিল প্রবাসী সরকার ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল। আর এই সময় আওয়ামী লীগের দলীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা’ হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী মানুষের রণধ্বনি।
পুরো পাকিস্তান আমলে পিছু হটতে হটতেও মুসলিম লীগ তার ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিকে সরকারের সহায়তায় জবরদস্তি চালিয়ে বহাল রাখার চেষ্টা করেছে। মুসলিম লীগের সঙ্গে এ বিষয়ে জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো সহযোগিতা করেছিল। দেখা যায়, একাত্তর সালে যখন পুরো জাতি পাকিস্তানি দুঃশাসন ও অমানবিক নির্যাতনের ভেতর থেকে বেরিয়ে স্বাধীন স্বদেশ প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক গৌরবময় যুদ্ধে লিপ্ত, তখনো এই শক্তি দখলদার পাকিস্তান সরকারের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও জাতীয় জীবনে তার তাৎপর্য সবারই জানা আছে। সেদিন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পুরো জাতি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল আর বিপরীতে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী প্রভৃতি দলের মুষ্টিমেয় কিছু নেতা-কর্মী স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী শক্তির ভূমিকা নিয়েছিল। তারাই শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আল-শামস বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানি বাহিনীর পাশে থেকে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসজুড়ে হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে অংশ নিয়েছে। তারা যুদ্ধাপরাধী নিঃসন্দেহে।
পঁচাত্তরের পরে যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া দাঁড় করানো হয়েছিল ক্ষমতায় থেকে, তাতে নেতৃত্ব দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান। কিন্তু তিনি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রাজনীতি দাঁড় করাতে গিয়ে কেবল সে রাজনীতির বিরোধিতা করলেন না, গ্রহণ করলেন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যাত মুসলিম লীগের রাজনীতি ও আদর্শ। এমনকি খুঁজে নিলেন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী মানুষজনকেই। নিজেকে দেশের ইতিহাসের মুখ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে দাঁড় করাতে গিয়ে অস্বীকার করলেন বঙ্গবন্ধুকে, নিজের সৃষ্ট সেই শূন্যতা পূরণের জন্য নিজেকেই সামনে নিয়ে এলেন। খানিকটা পাকিস্তানের মতোই অবস্থাটা দাঁড়াল। কেননা কেবল রাজনীতি ও সরকার দিয়ে তো একটি দেশ চলে না। জাতির জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলো সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিষয়গুলো। এ দেশের মানুষ নিজের ভাষা, সাহিত্য, সংগীত এবং মনীষীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই করতে করতেই যেমন নিজের জাতীয়তাবাদী চেতনায় জেগে উঠেছে, তেমনি চাপিয়ে দেওয়া পাকিস্তানি তামুুদ্দুনিক প্রয়াস থেকে কেবলই দূরে সরেছে। ফলে শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনেও বড় অংশ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়
উজ্জীবিত হয়ে আন্দোলন, সংগ্রাম ও যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। বিপরীতে মুষ্টিমেয় অংশ সরকারি সুযোগ নিয়ে ও মদদে সেদিন দালালের ভূমিকা নিয়েছিল।
আমরা লক্ষ করি, বিএনপির রাজনীতিতে একুশে ফেব্রুয়ারি, এমনকি বিজয় দিবস, পয়লা বৈশাখ, রবীন্দ্রনাথ, নবান্ন ইত্যাদি আমাদের সাংস্কৃতিক ও সংগ্রামী ঐতিহ্যের উপলক্ষগুলোর তেমন গুরুত্ব নেই। কিছু দিবস দায়সারা গোছেরভাবে পালন করে যাওয়ার বেশি কিছু তারা করে না। তারা জাতীয় পর্যায়ের বুদ্ধিজীবী-লেখক-সাহিত্যিক-শিল্পী, যেমন বেগম সুফিয়া কামাল, কাজী মোতাহার হোসেন, কুদরাত-ই খুদা, আবুল ফজল, শওকত ওসমান, জয়নুল আবেদিন, আব্বাসউদ্দীন, কামরুল হাসান কারও সম্পর্কেই উৎসাহী নয়। জিয়ার আমলে কীভাবে এ দেশে জামায়াতে ইসলামীর উত্থান ও পুনর্বাসন হয়েছে, কীভাবে একাত্তরের চিহ্নিত ঘাতক দালালদের ক্ষমতায় বসানো হয়েছে, কীভাবে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের হত্যাকারী এবং জেল হত্যার আসামিদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে বিচারের বাইরে রাখা হয়েছিল—সবই বিস্ময়ের সঙ্গে মানুষ দেখেছে।
এই রাজনীতির ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দীর্ঘকাল জুড়ে জাতির ত্যাগ ও ভালোবাসায় গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক লক্ষ্যাদর্শ থেকে বিচ্যুতি এবং সরে যাওয়ার লক্ষণই ফুটে ওঠে। কিন্তু এই রাস্তায় চলে পাকিস্তান কেবল ব্যর্থ হয়েছে তা নয়, আজ অবধি ব্যর্থতা ও অস্থিরতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।
একটি জাতির রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আদর্শ, চেতনা ও লক্ষ্য নিয়ে যদি স্থিরতা না আসে, তবে সেখানে অস্থিরতা বিরাজ করবেই। ইতিহাসে আমরা এর বহু দৃষ্টান্ত দেখেছি। আমাদের তো অস্থিরতার ৪০ বছর চলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অস্থিরতা, হানাহানি, গৃহযুদ্ধ চলেছে ১০০ বছর ধরে। ইউরোপে জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভবের আগে কয়েক শতাব্দী ধরে ধর্ম, রাজনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে বিবাদ চলেছে, যুদ্ধবিগ্রহ ও হানাহানি হয়েছে।
জাতি গঠন, জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও জাতির অগ্রগতির জন্য আদর্শিক ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি ও বিতর্কের অবসান চাই। সেটা না হওয়া পর্যন্ত কোনো জাতি সামনে এগোতে পারে না। কেবল অর্থনৈতিক কর্মসূচি সফল করে, এমনকি সম্পদ দিয়েও এগোনো সম্ভব নয়।
এ ক্ষেত্রে বিএনপিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কি পাকিস্তানি ধারার রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়েই চলবে? তারা কি অসাম্প্রদায়িক বাঙালি
ও আদিবাসীদের সংস্কৃতির বিরুদ্ধেই থাকবে? যদি তারা এই অবস্থানেই চলতে চায়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই স্বাধীন দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলবেই।
আমি মনে করি, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও বাঙালি ঐতিহ্যকে ধারণ করেও আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল করা সম্ভব। বিশেষত পুঁজিবাদী বিশ্বের সাম্প্রতিক সংকট আর স্বদেশে দুর্নীতি-অদক্ষতার যে ব্যাপকতা চলছে, তা শক্তিশালী রাজনৈতিক দল গঠন করার ও জনসমর্থন পাওয়ার ভিত্তি দিতে পারে।
আপনি ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান যা-ই হোন আপনাকে, জর্জ ওয়াশিংটন-জেফারসন-লিংকনদের, হুইটম্যান-হেমিংওয়ে-স্টেইনব্যাকদের, চ্যাপলিন-ডিজনি-রোবসনদের দেশের বরণীয় মানুষ হিসেবে মানতেই হবে। এখানেও বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দীন-ভাসানী-মণি সিংহকে, সুফিয়া কামাল-জসীমউদ্দীন-আবুল ফজলদের, জয়নুল-আব্বাসউদ্দীন-কামরুলদের না-মানার রাজনীতি সংকট তৈরি করবেই। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিবাদ-বিতর্কের অবসান ব্যতীত রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটবে না, দেশের অগ্রগতিও সম্ভব হবে না।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
দলীয় কর্মসূচির ক্ষেত্রে প্রথম দুটিতে বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে তেমন পার্থক্য নেই। আর দুর্নীতি বা ক্ষমতার অপব্যবহার করা এবং এ দুই ক্ষেত্রে ব্যর্থতায়ও দুই বড় দলে অমিল তেমন নেই। তাদের অমিল রয়েছে রাজনীতিতে—রাজনৈতিক লক্ষ্যাদর্শের ক্ষেত্রে। আওয়ামী লীগ বায়ান্ন থেকে সূচিত জনজাগরণের সাথি হয়ে ধাপে ধাপে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতি করেছে। এটি ছিল এ দেশের সিংহভাগ মানুষেরই চাওয়া। আর তাই জনগণ ঊনসত্তর সালে গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নেতা বঙ্গবন্ধুকে ষড়যন্ত্র মামলা ও কারাগার থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসে। তারপর ১৯৭০-এর নির্বাচনে প্রথম সুযোগেই তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে গণরায় দিয়েছে। এভাবে সেদিন বঙ্গবন্ধু বাঙালির অবিসংবাদী নেতা হয়ে ওঠেন আর আওয়ামী লীগ দলীয় গণ্ডি ছাপিয়ে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্ল্যাটফরম হয়ে ওঠে। আর তাই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু কারান্তরালে থেকেও ছিলেন জাতির নেতা, আওয়ামী লীগ ছিল প্রবাসী সরকার ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল। আর এই সময় আওয়ামী লীগের দলীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা’ হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী মানুষের রণধ্বনি।
পুরো পাকিস্তান আমলে পিছু হটতে হটতেও মুসলিম লীগ তার ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিকে সরকারের সহায়তায় জবরদস্তি চালিয়ে বহাল রাখার চেষ্টা করেছে। মুসলিম লীগের সঙ্গে এ বিষয়ে জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো সহযোগিতা করেছিল। দেখা যায়, একাত্তর সালে যখন পুরো জাতি পাকিস্তানি দুঃশাসন ও অমানবিক নির্যাতনের ভেতর থেকে বেরিয়ে স্বাধীন স্বদেশ প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক গৌরবময় যুদ্ধে লিপ্ত, তখনো এই শক্তি দখলদার পাকিস্তান সরকারের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও জাতীয় জীবনে তার তাৎপর্য সবারই জানা আছে। সেদিন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পুরো জাতি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল আর বিপরীতে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী প্রভৃতি দলের মুষ্টিমেয় কিছু নেতা-কর্মী স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী শক্তির ভূমিকা নিয়েছিল। তারাই শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আল-শামস বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানি বাহিনীর পাশে থেকে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসজুড়ে হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে অংশ নিয়েছে। তারা যুদ্ধাপরাধী নিঃসন্দেহে।
পঁচাত্তরের পরে যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া দাঁড় করানো হয়েছিল ক্ষমতায় থেকে, তাতে নেতৃত্ব দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান। কিন্তু তিনি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রাজনীতি দাঁড় করাতে গিয়ে কেবল সে রাজনীতির বিরোধিতা করলেন না, গ্রহণ করলেন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যাত মুসলিম লীগের রাজনীতি ও আদর্শ। এমনকি খুঁজে নিলেন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী মানুষজনকেই। নিজেকে দেশের ইতিহাসের মুখ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে দাঁড় করাতে গিয়ে অস্বীকার করলেন বঙ্গবন্ধুকে, নিজের সৃষ্ট সেই শূন্যতা পূরণের জন্য নিজেকেই সামনে নিয়ে এলেন। খানিকটা পাকিস্তানের মতোই অবস্থাটা দাঁড়াল। কেননা কেবল রাজনীতি ও সরকার দিয়ে তো একটি দেশ চলে না। জাতির জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলো সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিষয়গুলো। এ দেশের মানুষ নিজের ভাষা, সাহিত্য, সংগীত এবং মনীষীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই করতে করতেই যেমন নিজের জাতীয়তাবাদী চেতনায় জেগে উঠেছে, তেমনি চাপিয়ে দেওয়া পাকিস্তানি তামুুদ্দুনিক প্রয়াস থেকে কেবলই দূরে সরেছে। ফলে শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনেও বড় অংশ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়
উজ্জীবিত হয়ে আন্দোলন, সংগ্রাম ও যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। বিপরীতে মুষ্টিমেয় অংশ সরকারি সুযোগ নিয়ে ও মদদে সেদিন দালালের ভূমিকা নিয়েছিল।
আমরা লক্ষ করি, বিএনপির রাজনীতিতে একুশে ফেব্রুয়ারি, এমনকি বিজয় দিবস, পয়লা বৈশাখ, রবীন্দ্রনাথ, নবান্ন ইত্যাদি আমাদের সাংস্কৃতিক ও সংগ্রামী ঐতিহ্যের উপলক্ষগুলোর তেমন গুরুত্ব নেই। কিছু দিবস দায়সারা গোছেরভাবে পালন করে যাওয়ার বেশি কিছু তারা করে না। তারা জাতীয় পর্যায়ের বুদ্ধিজীবী-লেখক-সাহিত্যিক-শিল্পী, যেমন বেগম সুফিয়া কামাল, কাজী মোতাহার হোসেন, কুদরাত-ই খুদা, আবুল ফজল, শওকত ওসমান, জয়নুল আবেদিন, আব্বাসউদ্দীন, কামরুল হাসান কারও সম্পর্কেই উৎসাহী নয়। জিয়ার আমলে কীভাবে এ দেশে জামায়াতে ইসলামীর উত্থান ও পুনর্বাসন হয়েছে, কীভাবে একাত্তরের চিহ্নিত ঘাতক দালালদের ক্ষমতায় বসানো হয়েছে, কীভাবে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের হত্যাকারী এবং জেল হত্যার আসামিদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে বিচারের বাইরে রাখা হয়েছিল—সবই বিস্ময়ের সঙ্গে মানুষ দেখেছে।
এই রাজনীতির ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দীর্ঘকাল জুড়ে জাতির ত্যাগ ও ভালোবাসায় গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক লক্ষ্যাদর্শ থেকে বিচ্যুতি এবং সরে যাওয়ার লক্ষণই ফুটে ওঠে। কিন্তু এই রাস্তায় চলে পাকিস্তান কেবল ব্যর্থ হয়েছে তা নয়, আজ অবধি ব্যর্থতা ও অস্থিরতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।
একটি জাতির রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আদর্শ, চেতনা ও লক্ষ্য নিয়ে যদি স্থিরতা না আসে, তবে সেখানে অস্থিরতা বিরাজ করবেই। ইতিহাসে আমরা এর বহু দৃষ্টান্ত দেখেছি। আমাদের তো অস্থিরতার ৪০ বছর চলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অস্থিরতা, হানাহানি, গৃহযুদ্ধ চলেছে ১০০ বছর ধরে। ইউরোপে জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভবের আগে কয়েক শতাব্দী ধরে ধর্ম, রাজনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে বিবাদ চলেছে, যুদ্ধবিগ্রহ ও হানাহানি হয়েছে।
জাতি গঠন, জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও জাতির অগ্রগতির জন্য আদর্শিক ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি ও বিতর্কের অবসান চাই। সেটা না হওয়া পর্যন্ত কোনো জাতি সামনে এগোতে পারে না। কেবল অর্থনৈতিক কর্মসূচি সফল করে, এমনকি সম্পদ দিয়েও এগোনো সম্ভব নয়।
এ ক্ষেত্রে বিএনপিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কি পাকিস্তানি ধারার রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়েই চলবে? তারা কি অসাম্প্রদায়িক বাঙালি
ও আদিবাসীদের সংস্কৃতির বিরুদ্ধেই থাকবে? যদি তারা এই অবস্থানেই চলতে চায়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই স্বাধীন দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলবেই।
আমি মনে করি, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও বাঙালি ঐতিহ্যকে ধারণ করেও আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল করা সম্ভব। বিশেষত পুঁজিবাদী বিশ্বের সাম্প্রতিক সংকট আর স্বদেশে দুর্নীতি-অদক্ষতার যে ব্যাপকতা চলছে, তা শক্তিশালী রাজনৈতিক দল গঠন করার ও জনসমর্থন পাওয়ার ভিত্তি দিতে পারে।
আপনি ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান যা-ই হোন আপনাকে, জর্জ ওয়াশিংটন-জেফারসন-লিংকনদের, হুইটম্যান-হেমিংওয়ে-স্টেইনব্যাকদের, চ্যাপলিন-ডিজনি-রোবসনদের দেশের বরণীয় মানুষ হিসেবে মানতেই হবে। এখানেও বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দীন-ভাসানী-মণি সিংহকে, সুফিয়া কামাল-জসীমউদ্দীন-আবুল ফজলদের, জয়নুল-আব্বাসউদ্দীন-কামরুলদের না-মানার রাজনীতি সংকট তৈরি করবেই। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিবাদ-বিতর্কের অবসান ব্যতীত রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটবে না, দেশের অগ্রগতিও সম্ভব হবে না।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments