রাজনৈতিক তৃতীয় শক্তি by লুৎফর রহমান রনো

তৃতীয় বিশ্বের ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতিকরা কোনো আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনীতি করেন না। বাংলাদেশের বেলায়ও এর কোনো হেরফের নেই। প্রশ্ন আসে, ধনী দেশগুলো বা পশ্চিমের রাজনীতির কোনো আদর্শ আছে কি? তাদের আদর্শ হোক আর রাষ্ট্রীয় নীতি হোক, তা হলো সাম্রাজ্যবাদ। পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর হলো সাম্রাজ্যবাদ। পাশাপাশি তাদের রাজনীতি-রণাঙ্গনের একটি নূ্যনতম আদর্শ_আভিজাত্য ও জাতীয় কমিটমেন্টের সঙ্গে গণতান্ত্রিক সহনশীলতার বাহ্যিক


চেহারা থাকে। তাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা আসেন, তাঁদের শিক্ষা-দীক্ষা ও রাজনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উতরাতে হয় নেতৃত্বে আসতে হলে। তারপর প্রতিদ্বন্দ্বী দল ও নির্বাচন_সব ক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতার স্বাক্ষর অপরিহার্য। এ জায়গায়ই ওদের সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বের তফাত। আমাদের দেশে যেমন নির্বাচিত সরকার প্রধানকে হটিয়ে দিয়ে ক্যান্টনমেন্টের অফিসাররা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিয়েছেন একাধিকবার। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অনেক দেশই সেনাশাসন ও স্বৈরশাসনের নাগপাশ থেকে বেরিয়ে এসেও গণতন্ত্রের পথে যে ক্ষমতা চর্চা করছে, তা খুব সুখকর নয়। এর কারণ সুস্পষ্ট, দরিদ্র দেশগুলো নতজানু থাকে বাইরের সাম্রাজ্যবাদী দেশ ও সংস্থাগুলোর কাছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের কাছে ঋণ বাড়তে থাকে আর সমান্তরালরূপে সংশ্লিষ্ট দেশের ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে সর্বস্তরে দুর্নীতি বিস্তারলাভ করে। দুর্নীতি অবাধকরণের প্রয়োজনে নিরবচ্ছিন্নভাবে অপরাধ, অন্যায়, অনৈতিক কর্ম সংঘটিত হতে থাকে। এমন নিরুপায় রাজনৈতক পরিস্থিতির মধ্যে অতিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর উদাহরণ হয়ে আছে এই বাংলাদেশের মানুষ।
২৯ অক্টোবর 'প্রগতিশীল কর্মী সম্মেলন' নামে একটি জমায়েত হয়ে গেল রাজধানীর মহানগর নাট্যমঞ্চের মিলনায়তনে। বাম রাজনীতি-ধারার নেতৃস্থানীয় সবাই ছিলেন, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, রাশেদ খান মেনন, প্রবীণ নেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্য, হাসানুল হক ইনু এবং সন্তু লারমা, সঞ্জীব দ্রংসহ অনেকেই। পরিচিত কলামিস্ট, গবেষক আবুল মকসুদও ছিলেন। না, তাঁরা নতুন কিছু বলেননি। তবে নতুন কিছু করতে চান। হ্যাঁ, তাঁদের কথায় আমরাও একমত। বর্তমান সরকারের এ পর্যন্ত নানা ব্যর্থতা বা দুর্নীতি ও দলের ক্যাডারদের টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্নভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি কারণে জনগণ মহাজোট সরকারের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলতে বসেছে। নিঃসন্দেহে সত্য তাঁদের অবলোকন। জনগণ আস্থা রাখার জায়গা পাচ্ছে না। সম্মেলনের প্রস্তুতি পরিষদের আহ্বায়ক পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের ধারায় দেশকে ফিরিয়ে আনতে হলে জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন। সম্মেলনে দরিদ্রদের জন্য রেশনিং এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও দাবি করা হয়। তাঁরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বলয়ের বাইরে প্রগতিশীল মানুষকে নিয়ে রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন।
উলি্লখিত নেতাদের অনেকেই মহাজোটের শরিক দলের নেতা ও এমপি। অতীতে ১৪ দলের জোটেও তাঁরা ছিলেন। তাঁদের আজকের এই আহ্বান সত্যিই সময়ের অবধারিত দাবি বলে আমরা মনে করি। অন্তত সরকারকে সতর্ক করে দেওয়াটা তাঁদের দায়িত্বও। আওয়ামী লীগ নির্বাচনের প্রাক্কালে যেমন খোলামেলা মন নিয়ে দেশ ও জাতির ভাগ্য বদলানোর প্রতিজ্ঞায় তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে, জঙ্গি-মৌলবাদ ঠেকানোর কথা বলে, দরিদ্র মানুষের কথা বলে_সরকার গঠনের পর এসব আলোচনা তাঁদের সঙ্গে চালিয়ে যাওয়া বা জোটের শরিকদের সঙ্গে বসে কথা বলার অবসর পায় না। সত্যি বলতে কী, দলের ছোট-মাঝারি কর্মী, ক্যাডার, নেতা থেকে সংসদ সদস্য-মন্ত্রীরা সবাই তাঁদের ক্ষমতার পরিসীমায় সীমাহীন বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করা ও যেভাবে হোক অর্থস্বার্থ উদ্ধার করে সম্পদশালী হয়ে ওঠার ক্ষুধায় নিজেদের অতীত-বর্তমান ও দায়দায়িত্বের কথা বেমালুম ভুলে বসেন। বিএনপির কথা এ ক্ষেত্রে উচ্চারণযোগ্য নয় মনে করি। কারণ, তাদের দলের বা নেতা-নেত্রীর লক্ষ্য-আদর্শ অস্পষ্ট, মুক্তিযুদ্ধের মতো জাতীয় ঐতিহাসিক ও আস্তিতি্বক ইস্যুতে পর্যন্ত তাদের অবস্থান রহস্যাবৃত; কিন্তু দুঃখজনক ও হতাশার কথা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে কেন আজ পর্যন্ত নিজেদের শোধরানোর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারল না!
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে যদি সত্যি বোধসম্পন্ন কিছু লোক অন্তত থাকেন, আর তাঁরা যদি নিঃস্বার্থ দৃষ্টিতে এ দেশের দুরবস্থা ও রাজনৈতিক (ডানপন্থী) দুর্যোগের আশঙ্কাটা অনুমান করে থাকেন, তাহলে তো এমন না-শোনা একরোখা হওয়ার কথা নয়। তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার আহ্বান জানানোর কথা নয় এসব নেতার। তাহলে আমাদের তথা সাধারণ মানুষকে একেবারে নিশ্চিত ভেবে নিতে হবে যে আওয়ামী লীগের ভেতরে গণতান্ত্রিক মুক্ত বাতাস তো নেই-ই, মহাজোটের মধ্যেও কি গণতান্ত্রিক সম্পর্ক সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাঙ্গ হয়ে গেছে? যদি তা-ই হয়, তবে আওয়ামী লীগের কোনো ক্ষতি হোক বা না হোক, দেশের মানুষের মহাদুর্দিন সম্মুখে। আর সে জন্য মহাজোট সরকারই দায়ী থাকবে। আর এ কারণেই মহাজোটের শরিকদের এই উদ্যোগ। হয়তো দেশের মানুষের কাছে তাদের অবস্থান ও উদ্দেশ্য স্পষ্ট করা। আওয়ামী ও বিএনপি বলয়ের বাইরে রাজনৈতিক শক্তি গড়ে উঠুক, তা খুবই জরুরি। কারণ এই দুই দলের দু-দুবারের শাসনকালের অভিজ্ঞতা আমাদের দুর্গতির ইতিহাসে লেখা আছে। তবুও এ সময় কিঞ্চিৎ আশা রাখতে চাই, দেশের কথা ভেবে আওয়ামী লীগ তার চিরাচরিত বলয় ভেঙে জনগণের দলে রূপান্তরিত হবে। জনগণের দল নয় শুধু, নির্বাচন-পূর্ব সময়ে, বিজয়োত্তর সময়ে শুধু দলের লোকের দেখভাল ছেড়ে দৃষ্টি ও মন প্রসারিত করার প্রয়োজন ছিল। কঠোর হাতে দুর্নীতি ও দলীয় সন্ত্রাস দমন করা সরকারের প্রাথমিক ও প্রধান দায়িত্বের মধ্যে অন্যতম বলে ভাবা উচিত ছিল।
এখনো সময় আছে, দল ও দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরে জোট ও ক্ষমতাকেন্দ্রে গণতান্ত্রিক পরিবেশ স্থাপন করে দেশের সংকটকালে ঐকমত্যের ভিত্তিতে লক্ষ্যে পেঁৗছানোর। এ ছাড়া আদৌ সম্ভব নয় রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও প্রতিকূলতা কাটিয়ে ওঠা। ২০০১-এর দিকে দেশের পশ্চাৎমুখী পুনর্যাত্রা রুখতে হবে যেকোনো মূল্যে।

লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.