কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ-মানবেপাশবে পার্থক্য কতেক by রণজিৎ বিশ্বাস
পশু ও মানুষ তো একই রকম প্রাণী, নাকি?: একই রকম, আবার একই রকম নয়; অন্য রকম।: ব্যাখ্যা দেন।
: আগে একই রকমের ব্যাখ্যা। পশু ও মানুষ উভয়েরই জন্ম হয়, উভয়েরই মৃত্যু হয়। উভয়েরই ক্ষুধাতৃষ্ণা আছে, উভয়ের সন্তান হয়। উভয়েই দিনে দিনে বাড়ে। দুঃখবেদনায় উভয়ই কান্নাকাটি করে। উভয়েরই হার্টের রোগ ও ডায়াবেটিস আছে।: এবার পার্থক্যের কথা বলুন।
: আগে একই রকমের ব্যাখ্যা। পশু ও মানুষ উভয়েরই জন্ম হয়, উভয়েরই মৃত্যু হয়। উভয়েরই ক্ষুধাতৃষ্ণা আছে, উভয়ের সন্তান হয়। উভয়েই দিনে দিনে বাড়ে। দুঃখবেদনায় উভয়ই কান্নাকাটি করে। উভয়েরই হার্টের রোগ ও ডায়াবেটিস আছে।: এবার পার্থক্যের কথা বলুন।
সেটি একটু বিস্তৃত বলতে হবে। এক. মানুষ ও পশু উভয়েরই সন্তান হয় ঠিকই, তবে মানুষের পিতৃত্ব ও মাতৃত্বের ক্ষমতা বেশি। পশুর ঘরে পশু নামে, মানুষের ঘরে পশু ও মানুষ উভয়ই নামে। যেমন_বাঘ শুধু বাঘেরই জন্ম দেয়, সিংহ সিংহের, ভল্লুক ভল্লুকের, সাপ সাপের, বানর বানরের, হায়েনা হায়েনার। কিন্তু মানুষ তার নিজের অবয়বে সব প্রাণীর জন্ম দিতে পারে। মানুষের ঘরে সিংহশার্দূল_ মার্জারমূষিকবায়সজম্বুক হায়েনাভল্লুকঐরাবতউজবুক সব কিছুই জন্ম দিতে পারে।
দুই. মানুষ পলিটিঙ্ করে, পশু করে না। তিন. মানুষ মানুষকে অকারণ অপমান করে, বিনা কারণ হত্যা করে, পশু তা করে না। চার. মানুষ অন্যের দুঃখ বাড়াবার জন্য মজুদদারি করে, ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট করে, পশুদের ভুবনে এসব প্রচলিত বিষয় নয়। পাঁচ. মানুষ সাম্প্রদায়িক ও ছদ্মসাম্প্রদায়িক হয়, পশু হয় না। ছয়. মানুষ অন্যের আমানত মেরে খায়, এ রকম মেরে খাওয়ার বিদ্যাবুদ্ধি পশুদের নলেজে নেই। সাত. মানুষ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে, যুদ্ধ করে, রক্ত দেয়, প্রাণ দেয়, আবার স্বাধীনতার স্থপতিকে নির্মমভাবে হত্যাও করে। আট. মানুষের ভুবনে জাতির পিতাও আছে, জাতির পিতার সঙ্গে বেইমানিও আছে, পশুদের কোনো জাতির পিতা নেই, জাতির পিতার সঙ্গে বেইমানিও নেই। পশুদের ভুবনে কেউ তার জুনিয়রদের হত্যাপরাধে ইন্ধন জোগায় না, কেউ বলে না আমি আমার অবস্থানের কারণে সামনে আসছি না, তোমরা জুনিয়ররা যদি 'কাজটি' সমাধা করতে পারো, করে ফেলো, আমার নীরব সমর্থন আছে। নয়. পশুদের ভুবনে মুক্তিযুদ্ধ হয় না, মানুষের ভুবনে মুক্তিযুদ্ধ হয়, তার আদর্শের সঙ্গে বেইমানিও হয়। মুক্তিযুদ্ধের নামে একাট্টা জাতিকে মানুষই ধর্মের নামে ও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিতে কেটে দোফালা করে। মানুষই মুক্তিযুদ্ধের ফলে অর্জিত দেশের সবচেয়ে পবিত্র ও সর্বসেরা আইনের বইয়ের স্তম্ভ পাল্টায় ও তাতে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢোকায়। দশ. মানুষের পোশাকের প্রয়োজন হয়। কখনো নগ্নতাকে ঢাকার জন্য এবং কখনো তা আরো ইঙ্গিতময় ও প্রকট করার জন্য মানুষ পোশাকের ওপর নির্ভর করে, পশুর এসবের কোনো বালাই নেই। এগারো. মানুষের বুকের ভেতর ন্যায়ালয় আছে; সেই ন্যায়ালয়ের প্রধান বিচারপতির আসনে। 'বিবেক' বসে, পশুদের তেমন কোনো ঝামেলা নেই। বারো. পশুদের ভুবনে মিতাচার, অমিতাচার, দুরাচার, অজাচার ইত্যাদির দংশন নেই; মানুষের ভুবনে আছে_এ কথা যেমন সত্য, মানুষ আবার এসব বোধকে উপেক্ষা করে_এও তেমন সত্য।
: আর ক'টি?! বলতে বলতে তো বারোটি পার্থক্যের কথা বললেন। এখনো শেষ হয়নি?!
: না, শেষ হয়নি। শেষ হবেও না। আজ এ মুহূর্ত পর্যন্ত, ৮ নভেম্বর ২০১১-র এই সকাল সাড়ে ৭টা পর্যন্ত মানবেপাশবে পার্থক্যের সংখ্যা তিন লাখ ৩৭ হাজার ৫৬৫টি। মিনিটে মিনিটে এ পার্থক্য বাড়ছে। আমি আর কয়েকটি ভাইটাল পার্থক্যের কথা বলে শেষ করব।
: শেষ করুন। খুব বাড়বেন না।
: পার্থক্য নাম্বার তেরো হচ্ছে_ মানুষ তার ঈশ্বরের তুষ্টি ও সন্তুষ্টির জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করে, একসময় মানুষ বিধাতার নামে নরবলি পর্যন্ত দিত, পশুদের ভুবনে এমন কঠিন নৈষ্টিকতার পরিচয় পাওয়া যায় না। চৌদ্দ. পশু পশুকে পেছন থেকে ল্যাঙ মারে না, মানুষের মধ্যে কিছু কিছু নমুনা আছে, যারা শুধু পেছন থেকেই আঘাত করে ও তাতেই আনন্দ পায়। পনেরো. মানুষ মানুষের পিঠে 'আমাদের লোক' ও 'তাহাদের লোক' 'মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক' ও 'আমাদের ভবনের লোক' ইত্যাদি লেবেল লাগায় এবং জন্মপরিচয়, ধর্মপরিচয়, বিশ্বাস পরিচয়, আদর্শ পরিচয় ও উপাস্য পরিচয় ইত্যাদির সম্পর্কসূত্র নির্ণয় করে মানুষকে ভোগায়, বঞ্চিত করে ও 'মাহ্রুম' করে। পশুরা এসব ঝামেলায় যায়ও না, তাদের যেতেও হয় না। ষোলো. পশুরা তাদের ইতিহাস পাল্টায় না এবং নিজেদের সন্তানদের ব্যবস্থাপত্রের ইতিহাস পড়ায় না; মনুষ্যাবয়বের প্রাণীরাই শুধু এসব করে। সতেরো. পশু জন্মমাত্রই পশু, তাকে আবার পশু হওয়ার সাধনা করতে হয় না। মানুষ জন্মমাত্র মানুষ নয়, তাকে বহু সাধনায় মানুষ হতে হয়।
লেখক : রম্য লেখক
No comments