চালচিত্র-যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আরো সতর্কতা জরুরি by শুভ রহমান

দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এখন দ্রুত এগোচ্ছে। এখন প্রায় ডিসাইসিভ তথা চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত এ বিচার কার্যক্রমকে বানচাল করার জন্য ঘরে-বাইরে এর বিরুদ্ধে অপপ্রচার তীব্র হয়ে উঠেছে। দেশের ভেতরে মরিয়া হয়ে উঠেছে বিএনপি-জামায়াত_এ বিচারকে ভণ্ডুল করতে সরাসরি আটক শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তিই দাবি করছে তারা। অন্যদিকে বিদেশে মিডিয়ায় জামায়াত-সংশ্লিষ্ট বিদেশি আইনজীবীরা নানা রকম বিভ্রান্তি ও অপপ্রচার চালিয়ে বিশ্ববাসীর


মনে এ বিচার সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে বলেও মনে করার মতো কারণ ঘটছে।
সম্প্রতি বহুল প্রচারিত একটি মার্কিন দৈনিকে জন ক্যামে নামের এক লন্ডনভিত্তিক ব্যারিস্টার এক নিবন্ধে মারাত্মক সব অপপ্রচার চালিয়েছেন। এর শিরোনাম : 'ইন বাংলাদেশ : রিকনসিলিয়েশন অর রিভেঞ্জ' (বাংলাদেশে : মীমাংসা, না প্রতিহিংসা?)।
এই আইনজীবী একদিকে হেগ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এবং সিয়েরা লিওন থেকে কম্বোডিয়া অবধি অস্থায়ী ট্রাইব্যুনালগুলোর রাজনীতিক ও ওয়ার লর্ডদের মানবতাবিরোধী ভয়াবহ অপরাধের ত্রুটিপূর্ণ হলেও বিচার অনুষ্ঠানের আপাতদৃষ্টিতে একরকম প্রশংসাই করেছেন। কিন্তু অন্যদিকে বাংলাদেশে একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের বিচারকে প্রহসন বা তামাশা বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বাংলাদেশের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে সিভিল ওয়ার তথা গৃহযুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন এবং গৃহযুদ্ধের ভেতর দিয়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয় বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর বক্তব্য : পশ্চিম পাকিস্তানের অধীনে সামরিক বাহিনী প্রধানত হিন্দুদের বিরুদ্ধে জাতিগত নির্মূল অভিযান চালায় বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয় এবং তাতে লাখ লাখ মানুষ মারা যায়। কিন্তু তাতে অবশ্যই স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দল জামায়াত যে দোষী, তা প্রমাণিত হয় না। নিবন্ধটিতে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে চলমান আন্তর্জাতিক বিচার ট্রাইব্যুনালকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি এ ট্রাইব্যুনালের আন্তর্জাতিক মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
আমরা মনে করি, এসব প্রশ্নের মীমাংসা ইতিমধ্যে হয়ে গেছে এবং ট্রাইব্যুনাল প্রশ্নাতীতভাবেই তাঁর আন্তর্জাতিক মান সমুন্নত রেখে বিচারকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তবু ইতিমধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল, পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল প্রভৃতি দাবিতে বিএনপি-জামায়াতের তথাকথিত রাজপথের আন্দোলন যে স্পষ্টতই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রমের বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছে, এ বিষয়টি ভালোভাবে অনুধাবন করে এবং বিদেশে বিভিন্ন অপপ্রচার ও মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আরো সতর্কতা অবলম্বন করে বিচার কার্যক্রম সর্বতোভাবে ত্রুটিমুক্ত করা জরুরি বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
ইতিমধ্যে ১৯ নভেম্বর ঢাকায় 'পঞ্চদশ সংশোধনীর আলোকে বাংলাদেশের সংবিধান' শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তারা মহাজোট সরকারকে সতর্ক করে দেন যে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যু থেকে মহাজোট সরকারের পিছু হটার কোনো রাস্তা নেই। চলতি মেয়াদের মধ্যেই যুদ্ধাপরাধের বিচার না হলে আগামী নির্বাচনে মহাজোট সরকারের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা নেই। আর সরকার এই মেয়াদে এ বিচারকাজ শেষ করতে না পারলে দেশে গণ-আন্দোলন শুরু হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তাঁরা।
বক্তারা বলেছেন, বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দলের পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনীর বিরোধিতা করার একটাই কারণ, যাতে যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়াকে ধীরগতি করে দেওয়া যায়। এ সরকারের সামান্যতম ভুল পদক্ষেপ দেশ-জাতির জন্য বিশাল সমস্যা বয়ে নিয়ে আসবে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করে বক্তারা পঞ্চদশ সংশোধনী পুনর্মূল্যায়নের দাবিও জানান।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত ওই আলোচনা সভায় আইনমন্ত্রী অবশ্য বলেন, সংবিধানে এখনো কিছু সাংঘর্ষিক ধারা রয়ে গেছে, এগুলো বিরোধী দল, আইন-বিশেষজ্ঞ এবং সাধারণ জনমতের ভিত্তিতে সংশোধন করা যেতে পারে। আর সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাখার প্রসঙ্গটি এখন আদালতে আছে, রায় অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম ও অপরাধীদের আইনত শাস্তি প্রদান যাতে মহাজোট সরকারের চলতি মেয়াদের মধ্যেই শেষ হয়, সে জন্য বিচারপ্রক্রিয়ার পথে পঞ্চদশ সংশোধনী সংক্রান্ত সব ধরনের ত্রুটি ও জটিলতা দ্রুত দূর করা দরকার। এরই ফাঁক দিয়ে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া বানচালের জন্য জনমত সংগঠিত করে সরকার পতনের আন্দোলনের সুযোগ করে নিচ্ছে।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ট্রাইব্যুনালে ইতিমধ্যে জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচার শুরু হয়েছে। এবং তাঁর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের প্রারম্ভিক বক্তব্য শেষ হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটসহ মানবতাবিরোধী ২০ অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। আগামী ৭ ডিসেম্বর তাঁর মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য হয়েছে। এরপর বিএনপির সাংসদ সালাহউদ্দীন কাদের চৌধুরীকে বিচারের মুখোমুখি করে তাঁর বিরুদ্ধে ৪৩৭ জনকে হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়েছে।
প্রথমে উলি্লখিত ব্রিটিশ আইনজীবী জন ক্যামে, যিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে 'গৃহযুদ্ধ' বলে উল্লেখ করেছেন, তিনি মার্কিন মিডিয়ায় তাঁর নিবন্ধটিতে তাঁকেসহ তিন ব্রিটিশ আইনজীবীকে ট্রাইব্যুনালের বিচারে অংশ নিতে কিংবা বাংলাদেশে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের পুনরুজ্জীবিত সংস্করণের সমালোচনা করে আন্তর্জাতিক মানের অনুরূপ আইন থেকে তা অনেক তফাত বলে মন্তব্য করেছেন। অসদুদ্দেশ্যপ্রণোদিত এসব মন্তব্য স্বভাবতই বিশ্ববাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
বস্তুত, বিদেশি প্রচারমাধ্যমে বিদেশিদের এসব পর্যবেক্ষণ ও অপপ্রচার এবং বর্তমান ট্রাইব্যুনালের বিচার পরিশেষে মীমাংসা নয়, প্রতিহিংসা বলেই প্রমাণিত হবে_এমন অযৌক্তিক মন্তব্য একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধের প্রামাণ্য দলিল ও সাক্ষ্যকে তথা ইতিহাসকে কোনো ক্রমেই ম্লান করতে পারবে না। বিশ্লেষকদের অভিমত, দেশের সর্বত্র মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমান্ডাররাসহ গোটা জাতি দৃঢ়ভাবেই মহাজোট সরকারের এই ঐতিহাসিক উদ্যোগের পেছনে রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার জাতিকে শুধু দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদমুক্তই করবে না, '৭৫-পরবর্তী যে ভয়াবহ দুষ্টচক্র দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছে, তাদের সম্পূর্ণ উৎখাত করার পথ রচনা করে জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে বাধামুক্ত করবে। মহাজোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দৃঢ়ভাবে অনুরূপ ধারণাই ব্যক্ত করেছেন। মহাজোট সরকারের গণম্যান্ডেটের ভিত্তিই হচ্ছে দেশকে যুদ্ধাপরাধীমুক্ত করার অঙ্গীকার। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের মতোই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও মহাজোটের একটি ঐতিহাসিক দায়। দ্রুত বিচারকাজ শেষ করে দোষী সাব্যস্তদের আইনত যথাযোগ্য শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে ইতিহাসের অমোঘ সত্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করাই হবে এ বিচারের উদ্যোক্তা মহাজোট সরকারের জরুরি করণীয়।
২২.১১.২০১১

No comments

Powered by Blogger.