চরাচর-সূর্যদী গণহত্যা দিবস
স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় এ গ্রামটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন আস্তানা। মাঝেমধ্যেই তাঁরা বিচ্ছিন্ন অপারেশন শেষে এখানে আত্মগোপন করে থাকতেন। আর এটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় এ গ্রামবাসীর জন্য। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এ দেশীয় দোসর আলবদর, রাজাকারদের মাধ্যমে খবর পেয়ে হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধা ও আশ্রয়দাতা গ্রামবাসীকে শায়েস্তা করতে ছুটে যায় সেই গ্রামে। বলছিলাম শেরপুর সদর উপজেলার কৃষিসমৃদ্ধ গ্রাম সূর্যদীর কথা।
বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে প্রাণ হারান এক মুক্তিযোদ্ধাসহ ৬২ নিরীহ গ্রামবাসী। পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল প্রায় ৩০০ ঘরবাড়ি। দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে শেরপুরের সূর্যদী গ্রাম ও আশপাশের এলাকা ভেসেছিল রক্তের বন্যায়। বছর ঘুরে আসে ২৪ নভেম্বর। গ্রামবাসী আজও ভোলেননি পাশবিকতার সেই ভয়াল স্মৃতি। বছর ঘুরে দিনটি এলেই স্বজন হারানোর বেদনায় ভারাক্রান্ত হন তাঁরা। সেদিন সকাল ৭টা। গ্রামবাসীর কেউ বাড়ির উঠানে শীতের মিঠা রোদ পোহাচ্ছেন, আবার কেউবা কৃষিকাজে ব্যস্ত। এমন সময় জিপ আর ট্রাকবোঝাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গ্রামটিতে হামলে পড়ে। লোকজন কিছু বুঝে ওঠার আগেই হানাদার বাহিনী ছুড়তে থাকে এলোপাতাড়ি গুলি। বিকট গর্জন আর ভাঙচুরের শব্দে গ্রামের মানুষ বাঁচার জন্য আশ্রয় নেন ঝোপ-জঙ্গল, ধানর ক্ষেত ও পানের বরজে। কিন্তু তারা কাউকেই ক্ষমা করেনি। একই সময়ে গানপাউডার ছিটিয়ে এ গ্রামের দেওয়ানবাড়ি, কিরসাবাড়ি ও বড়বাড়ির প্রতিটি ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। আর গ্রামের যুবক-কিশোর যাদের পেয়েছে তাদেরই ধরে এনে ব্রাশফায়ারে হত্যা করার জন্য দাঁড় করায় স্থানীয় সরকারি প্রাইমারি স্কুল মাঠে। রক্তের নেশায় উন্মুখ হিংস্র হায়েনাদের হাত থেকে তাদের রক্ষা করতে এ সময় নিজেদের নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও সামনে এগিয়ে আসেন ছয় বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা হলেন ওই দিন আত্মগোপন করে থাকা এ গ্রামেরই বাসিন্দা গিয়াস কম্পানির মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব আলী, আবদুল খালেক, ফজলুর রহমান, হাবিবুর রহমান, মমতাজ উদ্দিন ও আবুল হোসেন। মাত্র ৪৫ রাউন্ড গুলি, এসএমজি আর কয়েকটি গ্রেনেড নিয়ে তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েন হানাদারদের ওপর। অবশ্য একটু পরই তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয় অন্য গ্রামে আত্মগোপন করে থাকা কম্পানি কমান্ডার গিয়াস উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের আরো দুটি দল। সম্মিলিত আক্রমণের মুখে হানাদাররা দ্রুত পিছু হটে। এ যুদ্ধেই শহীদ হন খুনুয়া চরপাড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মো. আফসার আলী। এ দিন আরো শহীদ হন আইজ উদ্দিনসহ ৬১ জন নিরীহ গ্রামবাসী। একদিকে দাউ দাউ আগুন, অন্যদিকে এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লাশ। এর মধ্যেই একজন-দুজন করে গ্রামবাসী গ্রামে ঢুকে কোনোমতে লাশগুলো দাফনের ব্যবস্থা করে। স্বাধীনতার ৩৭ বছরেও গণহত্যার স্মৃতি ধরে রাখতে সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ-আয়োজন চোখে পড়েনি কিংবা মুক্তিযোদ্ধা সংসদও কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। তবে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. হেফজুল বারী খান খুনুয়া চরপাড়া গ্রামে ব্যক্তিগত উদ্যোগে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আফসারের কবর সংরক্ষণ ও স্মৃতি কমপ্লেঙ্ নির্মাণ করেছেন। শহীদ আইজ উদ্দিনের পরিবার এলাকায় তাঁর নামে একটি মাদ্রাসা ও স্মৃতি সংসদ প্রতিষ্ঠা করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের প্রচেষ্টায় দুই বছর আগে ট্রাস্ট ব্যাংক তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতায় সূর্যদী গণহত্যায় শহীদ পরিবারগুলোর সদস্যদের জন্য অল্প হলেও আজীবন আর্থিক সম্মাননার ব্যবস্থা করেছে। বর্তমান জেলা প্রশাসক মো. নাসিরুজ্জামান উদ্যোগ নিয়ে ওই সব শহীদ পরিবারের বিধবাদের জন্য বয়স্কভাতা এবং বিধবাভাতার কার্ড করে দিয়েছেন। সূর্যদী গণহত্যার শহীদদের স্মরণে সূর্যদী প্রাইমারি স্কুল চত্বরে স্থানীয় উদ্যোগে একটি শহীদ মিনার স্বাধীনতার পরপরই নির্মাণ করা হলেও এখন সেটির খুবই হতশ্রী অবস্থা।
হাকিম বাবুল
No comments