যৌতুক নির্মূল করতে চাই আইনের যথাযথ প্রয়োগ by লুৎফর রহমান রনো

বাংলা কবিতার ইতিহাসে কবি সমর সেনের নাম উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা আছে, তা অনেকেই জানেন। দশকওয়ারি হিসাবে তিনি চলি্লশের দশকের কবি। বিষ্ণু দে ও সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁদের সমকালীন। এই লেখায় কবিতা নয়, ওই কবির একটি কথা মনে পড়ছে যৌতুক সম্পর্কে লিখতে গিয়ে। সমর সেন এমএ পাস করে তখন কাজ খুঁজছেন। একদিন তাঁর দাদু (পিতামহ) তাঁকে বললেন, বেকার সময় কাটাচ্ছ, বিলেতে চলে যাও, উচ্চতর শিক্ষার ডিগ্রিটা নিয়ে নাও।


সমর সেন বিস্মিত! বললেন, 'এত টাকা কোথায় পাব দাদু?' 'টাকার কথা তোমার ভাবতে হবে না। পাত্রী আছে হাতে, বিয়ে করে ফেল, বিলেত যাওয়ার টাকা পেয়ে যাবে।' উত্তরে সমর সেন বলেছিলেন, 'দাদু, ... বন্ধক দিয়ে বিলেত যাব না পড়তে।'
যৌতুক নিয়ে সে সময়ের সমাজ এত সরব ছিল না নৈতিকতার প্রশ্নে। আর না চাইতে যা পাওয়া যায়, তার তো কোনো খুঁতই যেন ছিল না। কিন্তু নৈতিকতা, ন্যায্যতা_এসবের খুঁতটুত তো ব্যক্তির শিক্ষা-বীক্ষা, আদর্শ ও আত্মমর্যাদার নিরিখে নির্ধারিত হয়। অথচ আজ আইন প্রণয়ন করে যৌতুক প্রদান ও গ্রহণ অপরাধ এবং শাস্তিযোগ্য বলে প্রচার করা হচ্ছে। অজস্র গণমাধ্যমের সৌজন্যে যৌতুকের হেতু যে ভয়াবহ চিত্র তা প্রতিফলিত হচ্ছে, পাশাপাশি নিন্দার ঝড় উঠছে। কিন্তু কই, কোনো কিছুই যৌতুকলোভী তরুণ-যুবকদের রুখতে পারছে না।
১৯৭৮ সালের ১৮ এপ্রিল স্বামীর হাতে নিহত হন সালেহা। যৌতুকের নির্মমতার ইতিহাসে সালেহা ও তাঁর স্বামী ডা. ইকবালের নাম মনে পড়লে আজও মানুষের অনুভূতি ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। সালেহার ধনাঢ্য বাবা মেয়ের শিক্ষার্জনের বিষয়টি অবহেলাই করেছিলেন। ভেবেছিলেন, মেয়েকে সুখী করার সঠিক উপায় শিক্ষিত জামাই কিনে নিতে পারা। তিনি তা-ই করেছিলেন। সালেহার বাবার টাকায় ইকবালের ডাক্তারি পড়া হয়েছিল। কিন্তু তার পরের বৃত্তান্ত বড়ই মর্মান্তিক। অনৈতিক কাজের বিরোধিতা করেছিলেন সালেহা। প্রতিবাদ করেছিলেন স্বামীর দুশ্চরিত্রের বিরুদ্ধে। সে জন্য প্রাণ দিতে হলো তাঁকে। এ ঘটনায় দেশের মানুষ নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশে সোচ্চার হয়েছিল। যার সুফল হিসেবে ১৯৮০ সালে যৌতুকবিরোধী আইন প্রণীত হয়। হ্যাঁ, ডা. ইকবালের ফাঁসি হয়েছিল। তারপর ওই রকম করে আর সামাজিক সোচ্চারের ঘটনা খুব একটা দেখা যায়নি। এখন আইন আছে, আইন প্রয়োগকারী একাধিক সংস্থা রয়েছে। নিয়মতান্ত্রিক মামলা হবে, বিচার হবে_এমন প্রত্যাশা মানুষের হয়তো রয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত জনগণ একপ্রকার হতাশ হয়ে পড়েছে, আস্থা হারিয়ে বসেছে। অপরাধী ধরা পড়ে না, ধরা পড়লেও সাজা হয় না। নির্যাতিতা ও ভুক্তভোগী মানুষের ভোগান্তি শুধু বাড়ে। আর এ জন্য দিন দিন যৌতুকের কারণে নারী নির্যাতনের মাত্রা বেড়েই চলেছে।
১৯৯৬ সালের ইউএনডিপির (জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যৌতুকের কারণে নারী নির্যাতন বৃদ্ধি অব্যাহত। নারীরা শারীরিক-মানসিক নির্যাতন ও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। সমাজে যৌতুকের বিরূপ প্রভাব পড়ছে নানা রূপে, স্ত্রীরা তালাকপ্রাপ্ত হচ্ছেন, স্বামীরা একাধিক বিয়ে করছেন, স্ত্রী হত্যা, আত্মহত্যা ও স্বামী পরিত্যক্তা নারীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। গরিব কন্যাদায়গ্রস্ত মা-বাবা নিঃস্ব হচ্ছেন, ঋণের বোঝা বইছেন_যৌতুক বা নারীজীবনের নারকীয় পরিস্থিতি বোঝার জন্য ইউএনডিপির প্রতিবেদন ছাড়াও আজকাল নারী নির্যাতনের দৈনন্দিনের যে চিত্র গণমাধ্যমে আসে, তা যদি সরকারি সংশ্লিষ্ট মহল গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করত, তাহলে চিত্রটা কিছুটা হলেও পাল্টাত। দেশের প্রচলিত আইন নারীকে কতটুকু সহায়তা বা সুরক্ষা দিচ্ছে, তার একটি উদাহরণ দ্রষ্টব্য। ২০০১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বরের (১১ মাস) মধ্যে নথিভুক্ত হিসাব অনুসারে নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে ১১ হাজার ৯৭৭, যৌতুকের কারণে নির্যাতনে মামলা দুই হাজার ৭৬১। মোট আসামির সংখ্যা ৩৮ হাজার ১১৭। এর মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে মাত্র চার হাজার ৮২৯ আসামিকে। আর এদের মধ্যে সাজা হয়েছে কয়জনের তা পুলিশের নথিতে থাকার কথা নয়। তবে সে হিসাব যে আরো নৈরাশ্যকর তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত গোটা এক দশকে এসব পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন আসেনি। কারণ পরিবর্তনের লক্ষ্যে কোনো বিশেষ চিন্তা-পরিকল্পনা কেউ করেনি। নারী সুরক্ষার জন্য আইন বা আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে কোনো সময়োপযোগী দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়নি। বিশেষজ্ঞরা প্রায়ই বলেন সামাজিকভাবে মোকাবিলা করার কথা। এটি নিছক কথার কথায় পরিণত হয়েছে। সমাজ প্রভাবিত হয় সাধারণত দুইভাবে। শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রসার_ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে গণমুখী শিক্ষা-সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারলে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আসতে পারত। সে ক্ষেত্রেও সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা প্রয়োজন। আর দ্বিতীয় উপায় হলো, আইনের প্রতি জনগণের আস্থা অর্জন। সে জন্য নির্যাতিতার মামলা গ্রহণে অবহেলা না করা বা তথাকথিত প্রভাবশালীদের প্ররোচনায় নৈতিকতা বিসর্জন না দিয়ে মামলা গ্রহণ, আসামিকে গ্রেপ্তার ও বিচারের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা। এসব সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সততা ও নিষ্ঠা অব্যাহত থাকলে এর প্রভাব সমাজের ওপর ইতিবাচক হতে বাধ্য। কারণ রাষ্ট্র যদি নারীকে সম্মান ও সুরক্ষা দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকে, তাহলে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাবেই। সমাজ নির্যাতিতার পক্ষে দাঁড়াবে তখন। পরিবারও আর নিজের মেয়েদের বোঝা হিসেবে মনে করবে না।
কিন্তু আমাদের দেশে কোনো আইন, কোনো শিক্ষা কিংবা নীতি-আদর্শ তার বৈশিষ্ট্য নিয়ে টিকে থাকতে পারে না। এর কারণ, এ দেশে যখন যে দল সরকার গঠন করে, সে দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত শ্রেণীর স্বার্থ শুধু দেখা হয়। বাদবাকি নিরীহ মানুষের দায়িত্ব যেন সরকারের নয়, আইন ও নীতির অন্তর্ভুক্ত নয়। অথচ দলীয় একটি খুনি, মাস্তান, ধর্ষক, ইভ টিজারকে পর্যন্ত সমাজের রোষ ও আইনের বিধিবন্ধন থেকে মুক্ত করে রাখার চেষ্টা করা হয়।
তাহলে অস্বীকার করার উপায় নেই, গোটা ব্যাপারটা রাজনৈতিকও বটে। তাই আমাদের ঘুরেফিরে গোড়ায় যেতেই হবে। আইনবিদ, শিক্ষাবিদ ও সমাজসংস্কারকদের এ ব্যাপারে ভাবনার অবকাশ রয়েছে।
'যৌতুক : বাস্তবতা ও নির্মূলের কৌশল' শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকায় ২০০৩ সালের ৩০ ও ৩১ জানুয়ারি। সেই সম্মেলনে মালেকা বেগম 'যৌতুক বন্ধের পথ অনুসন্ধান : বাংলাদেশ প্রেক্ষিত' শিরোনামে যে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছিলেন, তাতে কিছু সুপারিশও সনি্নবেশিত ছিল। এসবের মধ্যে একটি, যেমন_'আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে দরিদ্র, অনুন্নত, পশ্চাৎপদ পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে যৌতুকপ্রথা লালিত ও প্রসারিত হওয়ার সুযোগ থাকছে। তাই একে নির্মূল ও নিঃশেষ করার কাজটি মূলত আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক শক্তির সক্রিয় উদ্যোগে হতে হবে। ইতিবাচক ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের দ্বারা এর বিকাশ ঘটাতে হবে।' এ ছাড়া আরো অনেক পয়েন্ট আকারে যেসব বিষয় বলেছেন, সেগুলো মূলত উদ্ধৃত অংশটির অন্তর্গত কথার মধ্যেই এসে গেছে। আসল কথা দাঁড়াচ্ছে, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক বিকাশের মাধ্যমে মেয়েদের আত্মমর্যাদাসম্পন্ন করা ও তাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ম্ভর করা। নারীকে বুঝে নিতে হবে, সে অর্ধাঙ্গী বা অসম্পূর্ণ মানুষ নয়। নিছক সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র বা ভোগের বস্তু নয়। পুরুষাধিপত্যের সুদীর্ঘকালের সংস্কার স্রেফ লৈঙ্গিক কারণে তাদের 'নারী' করে রেখেছে, মানুষ হতে বা মানুষ হিসেবে ভাবতেই শেখায়নি। এই সুপ্রাচীন বাধা ভাঙতে হলে চিন্তায়-ভাবনায় অগ্রসর হতে হবে। নিজের ভাবনার যুক্তি-শৃঙ্খলার সঙ্গে পরিবার-সমাজকে পরিচিত করে তুলতে হবে ধীরে ধীরে।
লেখক : সাংবাদিক
ronokk1969@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.