সময়ের কথা-'শিক্ষক নিয়োগ ও ঢেউ গুনে রোজগার' by অজয় দাশগুপ্ত
কেন্দ্রীয় বা জেলা-উপজেলা কিংবা পাড়া-মহল্লা কোথাও কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হলেই পদপ্রার্থীর শেষ নেই। 'ত্যাগী-রাজপথের অক্লান্ত সৈনিক-বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী'_ কতই না তাদের বিশেষণ। স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য বই বহন করা গাড়ি যখন হাজির হয় স্কুলে স্কুলে তখন এসব ত্যাগীর কেউ হাজির হন না বিতরণ কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য। ছাত্রলীগ নেতৃত্ব কখনও এ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছে বলেও মনে হয় না।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলও বড় সংগঠন। বিএনপি ক্ষমতায় ফিরে এলে এ কর্মসূচি বাদ দিতে পারবে না। ছাত্রদলও কিন্তু গত দু'বছর স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের হাতে বিনামূল্যের পাঠ্যবই সুষ্ঠুভাবে পেঁৗছে দেওয়ার জন্য কোনো তৎপরতা দেখায়নি
বরিশালের একটি গ্রামের স্কুলে পাঁচজন শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি সংবাদপত্রে এসেছে একাধিকবার। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি এমপিভুক্ত। অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন, যার পরিমাণ তেমন বেশি না হলেও সরকারের ভাণ্ডার থেকে মেলে নিয়মিত। দেশে এ ধরনের শত শত এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা রয়েছে এবং এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলে আবেদন জমা পড়ে অনেক। যে প্রতিষ্ঠানটির কথা বলছি সেখানেও বারবার আবেদন জমা পড়েছে; কিন্তু ম্যানেজিং কমিটির 'বিরোধে'র কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যায়নি। সেরা শিক্ষক বাছাই নিয়ে বিরোধ নয়, বরং বিরোধের কারণ 'কার লোক নিয়োগ পাবে' সেটা নিয়ে। আর 'নিজের লোক' নির্বাচনের জন্য দলীয় আনুগত্য নয়, বরং প্রধান বিবেচনা থাকে কার কাছ থেকে 'কত নগদ নিয়ে' কথা দেওয়া হয়েছে। ম্যানেজিং কমিটি ও নির্বাচকমণ্ডলীর প্রভাবশালী সদস্যরা এভাবে নানাজনকে কথা দিয়েছেন। অবশেষে ইন্টারভিউ শেষে ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাঁচজন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। কিন্তু প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যাদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদানের আশ্বাস দিয়ে নগদ অর্থ নিয়েছেন তারা শোরগোল তুললেন। এখন যে ঘুষের টাকা ফেরত দিতে হয়!
তবে কথায় বলে, দুর্জনের ছলের অভাব হয় না। আরও প্রবাদ আছে_ বুদ্ধি থাকলে ঢেউ গুনেও টাকা কামানো যায়। এ নিয়ে একটি গল্পও আছে, যা এ রকম। এক রাজার কাছে অভিযোগ গেল, তার দরবারের এক লোক ঘুষ নিয়ে বিভিন্ন লোককে রাজদরবারে প্রবেশ করতে দেয়। শাস্তি হিসেবে তাকে বদলি করা হলো প্রথমে গেটে এবং পরে দরবার থেকে অনেক দূরে। সর্বত্রই দুর্নীতির অভিযোগ_ খাসলত খারাপ থাকলে যা হয়। রাজা খেপে দিয়ে তাকে বরখাস্ত করতে চাইলেন। কিন্তু হাতে-পায়ে ধরাধরি করার পর পোস্টিং দেওয়া হলো_ নদীতীরে সকাল-সন্ধ্যা বসে থেকে ঢেউ গুনবে। নদীতে যেমন ঢেউ থাকে, তেমনি চলে নৌকা। রাজার সাবেক পারিষদ যথেষ্ট বুদ্ধি রাখে_ সে ঢেউ গোনা বাদ দিয়ে নদীতে চলা নৌকার মাঝিদের কাছ থেকে রাজার দোহাই দিয়ে ঘুষ আদায় করতে থাকল। লেখার শুরুতে যে স্কুলটির কথা বলছিলাম তার সঙ্গে যুক্ত অসৎ লোকেরাও যথেষ্ট বুদ্ধি রাখেন। তারা ইন্টারভিউতে সফল হয়ে নিয়োগ পাওয়া পাঁচজনকে জানিয়ে দিলেন, আপনাদের নিয়োগ হয়েছে এবং জয়েন করতে হলে জনপ্রতি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিতে হবে। তাদের বুদ্ধি এতই বেশি যে, আগে যাদের কাছ থেকে যে পরিমাণ ঘুষ নিয়েছেন তার চেয়েও বেশি নিয়োগপ্রাপ্তদের কাছ থেকে টাকা চেয়েছেন। এ অর্থ আদায় হলে তা থেকে একটি অংশ 'ঘুষের দেনা' শোধ করবেন, বাকি অংশ বাড়তি লাভ!
একটি স্কুলের কথা বললাম, কিন্তু নাম বলিনি। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি অথবা সংশ্লিষ্ট কেউ চাইলে সেটা প্রকাশ করাই যায়। কিংবা গোয়েন্দা লাগিয়েও বের করা যায়_ কার কাছ থেকে কে কত অর্থ নিয়েছেন। তবে সমস্যা হচ্ছে, এ ধরনের দুর্নীতি ঘটছে শত শত প্রতিষ্ঠানে। এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে হলে ঘুষ প্রদান যেন বাধ্যতামূলক। এইচএম এরশাদের জাতীয় পার্টির আমলে এটা ঘটেছে। বিএনপি আমলে এটা ঘটেছে। আওয়ামী লীগের আমলে এটা ঘটেছে ও ঘটছে। কেন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্লোগান দেওয়া সরকারের আমলে এ মন্দ ট্রাডিশন চলতে পারছে, সেটা বিস্ময়ের। সরকার ম্যানেজিং কমিটিগুলোকে ঠিক করায় মোটেই যত্নবান হয়নি। কমিটিতে নির্বাচিত ও মনোনীত উভয় ধরনের সদস্য রয়েছেন। বিদ্যায় উৎসাহী হিসেবে যাদের কমিটির সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তাদের বেশিরভাগ রাজনৈতিক সুবিধাবাদী কিংবা টাউট প্রকৃতির লোক। অনেক স্থানে এমপিরা কমিটির সভাপতি হয়েছেন। কোথাও এমপির স্ত্রী কিংবা দলীয় লোককে সভাপতি করা হয়েছে। এর ফল মোটেই ভালো হয়নি এবং হওয়ার কথাও নয়। স্কুলে শুধু শিক্ষক নিয়োগ করেই টাকা কামানো যায় না, সরকার স্কুলের ভবন তৈরি করে দেয়। লাইব্রেরিতে বই কেনার টাকা দেয়, বিজ্ঞানের যন্ত্রপাতির জন্য বরাদ্দ দেয়। সবকিছুতেই বখরা আদায়ের সুযোগ রয়েছে। দুর্ভাগ্য যে, আওয়ামী লীগ সরকার এ সমস্যা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে যেসব অনিয়ম চলছে, সেগুলোই চলতে দিয়েছে। এতে দলীয় স্বার্থ হাসিল হয় না, কারণ যারা ঢেউ গুনেও টাকা আয় করতে জানে তারা ঘুষ নিয়ে নিজের পকেটে জমা করে। অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে যাদের নিয়োগ দেয়, তারা কোন দলের লোক সেটা নিয়েও মাথাব্যথা তাদের থাকে না। যাদের কাছ থেকে বেশি অর্থ মিলবে, তারাই ভালো লোক ও সেরা শিক্ষক।
বর্তমান সরকার স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বিনামূল্যে বই দিয়েছে। শিক্ষার প্রসারে এর চেয়ে বড় উদ্যোগ এ দেশে কমই নেওয়া হয়েছে। রাজধানী ঢাকা থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম, সর্বত্র লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী বছরের প্রথম দিনে ক্লাস শুরুর আগেই নতুন বই হাতে পায়। এ কাজে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা খুব বেশি সহযোগিতা সরকারকে করছেন, এখন পর্যন্ত এমন প্রমাণ মিলছে কম। ছাত্রলীগের সংগঠন আছে দেশজুড়ে। কেন্দ্রীয় বা জেলা-উপজেলা কিংবা পাড়া-মহল্লা কোথাও কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হলেই পদপ্রার্থীর শেষ নেই। 'ত্যাগী-রাজপথের অক্লান্ত সৈনিক-বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী'_ কতই না তাদের বিশেষণ। স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য বই বহন করা গাড়ি যখন হাজির হয় স্কুলে স্কুলে তখন এসব ত্যাগীর কেউ হাজির হন না বিতরণ কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য। ছাত্রলীগ নেতৃত্ব কখনও এ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছে বলেও মনে হয় না। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলও বড় সংগঠন। বিএনপি ক্ষমতায় ফিরে এলে এ কর্মসূচি বাদ দিতে পারবে না। ছাত্রদলও কিন্তু গত দু'বছর স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের হাতে বিনামূল্যের পাঠ্যবই সুষ্ঠুভাবে পেঁৗছে দেওয়ার জন্য কোনো তৎপরতা দেখায়নি। আমাদের চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, বই বিতরণ কাজ সুষ্ঠুভাবে যেন না হয়, এমনকি ছাপার কাজও যাতে বিঘি্নত হয় সে জন্য কারসাজিও করা হতে পারে। দুর্ভাগ্য যে, আওয়ামী লীগ সমর্থক যারা প্রেসের মালিক কিংবা বাইন্ডিং সমিতির কর্মকর্তা কিংবা কাগজের ব্যবসায়ী, তারাও এ ধরনের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। এমন অভিযোগও রয়েছে, বই ছাপার জন্য যে বিপুল পরিমাণ কাগজ দরকার তা বাজারদরের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যে সরকারকে কিনতে বাধ্য করার জন্য সরকারি দলের সঙ্গে যুক্তরাও তৎপর।
ফিরে আসি শিক্ষক নিয়োগের কথায়। যোগ্য শিক্ষক না হলে পড়াশোনার মান কোনোভাবেই বাড়ানো সম্ভব নয়। এটা মানতে হবে যে, যোগ্য শিক্ষক পেতে হলে ভালো বেতন দিতে হবে। বর্তমানে বেসরকারি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেতন দেয় সরকার। কোনো প্রতিষ্ঠান চাইলে তাদের বাড়তি বেতন-ভাতা দিতেই পারে; কিন্তু ঢাকা বা চট্টগ্রামের হাতেগোনা কিছু প্রতিষ্ঠান ব্যতিরেকে এমন বাড়তি উপার্জন করা শিক্ষকের দেখা মেলে কম। শিক্ষকদের একটি অংশ টিউশনি করে প্রচুর উপার্জন করে। কেউ কেউ হয়তো মাসে লাখ টাকা কামান। এ ধরনের উপার্জন কতটা নৈতিক সে প্রশ্ন রয়েছে। আইন লঙ্ঘনের অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এ প্রসঙ্গ থাক আপাতত। কিন্তু বিএ-বিএসসি-বিকম পাস করে স্কুলের চাকরিতে যোগদানের সময় যদি ৬০০০-৭০০০ টাকা (বিএড ট্রেনিং থাকলে ৮০০০ টাকা) বেতন মেলে তাহলে মেধাবী কেউ শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহ দেখাবে কেন? কমপক্ষে টানা ১২ বছর শিক্ষকতা করার পর (এর মধ্যে অন্তত তিন বছর সহকারী প্রধান শিক্ষক থাকা বাধ্যতামূলক) প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ পেলে বেতন-ভাতা মেলে মাসে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা (সরকারি অফিসের পিওন-নিম্নমান কেরানি ১৫ বছর চাকরি করার পর কত পায়?)। তারপরও স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ পেলেই প্রচুর আবেদন পড়ে। এর বড় কারণ শিক্ষিতদের কাজের সুযোগের অভাব। অনেকে বলেন, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়ানো চলবে না। এ ক্ষেত্রে যুক্তি হচ্ছে : বেতন মাসে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা হয়ে গেলে (যা অবিলম্বে করা উচিত) শিক্ষকতার চাকরিতে জয়েন করতে হলে ঘুষের অঙ্ক লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। ম্যানেজিং কমিটি গঠনের ধারায় বদল না এলে প্রকৃতই গুরুতর সমস্যা দেখা দেবে। তবে বর্তমানে সরকারের ফান্ডের যা হাল তাতে এ ধরনের বেতনের প্রত্যাশা আপাতত স্বপ্ন বলেই মনে হয়। এমপিওভুক্ত করার কাজ স্থগিত রাখা হয়েছে কেবল অর্থের অভাবে। নতুন কোনো স্কুল-কলেজ এ তালিকায় তুলতে হলে ঘুষের অঙ্ক নাকি আকাশছোঁয়া হয়ে যায়। এমপিদের জন্য বিপদ আসে দু'দিক থেকে_ তাদের অনেকেই 'ফুয়েল ছাড়া ফাইল নড়ে না' নীতিতে বিশ্বাসী, অন্যদিকে রয়েছে নির্বাচনী এলাকার বাধ্যবাধকতা। সরকারের সততা না এলে অর্থাৎ সুশাসন নিশ্চিত না হলে শিক্ষা খাতে ব্যয় বাড়বে, পাসের হার বাড়তে বাড়তে শতকরা ১০০ পার্সেন্টে পেঁৗছবে; কিন্তু মান বাড়ার বিষয়টি সোনার হরিণ হয়েই থাকবে।
ধনী-গরিব সব শিক্ষার্থী কেন বিনামূল্যের বই পাবে, সচ্ছল পরিবারের মেয়েরা কেন বিনা বেতনে পড়বে_ সেটাও কিন্তু প্রশ্ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পরিবারের সন্তানরা গাড়ি নিয়ে আসে (এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে চান্স না পেলে যারা বছরে এক বা দেড় লাখ টাকা ব্যয় করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে কিংবা বিদেশে পাড়ি জমায় আরও বেশি টাকা ব্যয় করে) তারা কেন মাসে ২০-২৫ টাকা বেতনে পড়ার সুযোগ পাবে? স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়াতে হলে সরকারের পাশাপাশি সচ্ছল জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে অর্থ আদায় করতেই হবে এবং এ ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া প্রকৃতই অন্যায় কাজ। শিক্ষানুরাগীদের কাছ থেকেও অর্থ আদায় করার কৌশল বের করতে হবে এবং এ কাজে সাফল্যের প্রধান শর্ত হচ্ছে, ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের সততা। সরকার কি তাতে আদৌ আগ্রহী?
অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
বরিশালের একটি গ্রামের স্কুলে পাঁচজন শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি সংবাদপত্রে এসেছে একাধিকবার। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি এমপিভুক্ত। অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন, যার পরিমাণ তেমন বেশি না হলেও সরকারের ভাণ্ডার থেকে মেলে নিয়মিত। দেশে এ ধরনের শত শত এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা রয়েছে এবং এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলে আবেদন জমা পড়ে অনেক। যে প্রতিষ্ঠানটির কথা বলছি সেখানেও বারবার আবেদন জমা পড়েছে; কিন্তু ম্যানেজিং কমিটির 'বিরোধে'র কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যায়নি। সেরা শিক্ষক বাছাই নিয়ে বিরোধ নয়, বরং বিরোধের কারণ 'কার লোক নিয়োগ পাবে' সেটা নিয়ে। আর 'নিজের লোক' নির্বাচনের জন্য দলীয় আনুগত্য নয়, বরং প্রধান বিবেচনা থাকে কার কাছ থেকে 'কত নগদ নিয়ে' কথা দেওয়া হয়েছে। ম্যানেজিং কমিটি ও নির্বাচকমণ্ডলীর প্রভাবশালী সদস্যরা এভাবে নানাজনকে কথা দিয়েছেন। অবশেষে ইন্টারভিউ শেষে ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাঁচজন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। কিন্তু প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যাদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদানের আশ্বাস দিয়ে নগদ অর্থ নিয়েছেন তারা শোরগোল তুললেন। এখন যে ঘুষের টাকা ফেরত দিতে হয়!
তবে কথায় বলে, দুর্জনের ছলের অভাব হয় না। আরও প্রবাদ আছে_ বুদ্ধি থাকলে ঢেউ গুনেও টাকা কামানো যায়। এ নিয়ে একটি গল্পও আছে, যা এ রকম। এক রাজার কাছে অভিযোগ গেল, তার দরবারের এক লোক ঘুষ নিয়ে বিভিন্ন লোককে রাজদরবারে প্রবেশ করতে দেয়। শাস্তি হিসেবে তাকে বদলি করা হলো প্রথমে গেটে এবং পরে দরবার থেকে অনেক দূরে। সর্বত্রই দুর্নীতির অভিযোগ_ খাসলত খারাপ থাকলে যা হয়। রাজা খেপে দিয়ে তাকে বরখাস্ত করতে চাইলেন। কিন্তু হাতে-পায়ে ধরাধরি করার পর পোস্টিং দেওয়া হলো_ নদীতীরে সকাল-সন্ধ্যা বসে থেকে ঢেউ গুনবে। নদীতে যেমন ঢেউ থাকে, তেমনি চলে নৌকা। রাজার সাবেক পারিষদ যথেষ্ট বুদ্ধি রাখে_ সে ঢেউ গোনা বাদ দিয়ে নদীতে চলা নৌকার মাঝিদের কাছ থেকে রাজার দোহাই দিয়ে ঘুষ আদায় করতে থাকল। লেখার শুরুতে যে স্কুলটির কথা বলছিলাম তার সঙ্গে যুক্ত অসৎ লোকেরাও যথেষ্ট বুদ্ধি রাখেন। তারা ইন্টারভিউতে সফল হয়ে নিয়োগ পাওয়া পাঁচজনকে জানিয়ে দিলেন, আপনাদের নিয়োগ হয়েছে এবং জয়েন করতে হলে জনপ্রতি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিতে হবে। তাদের বুদ্ধি এতই বেশি যে, আগে যাদের কাছ থেকে যে পরিমাণ ঘুষ নিয়েছেন তার চেয়েও বেশি নিয়োগপ্রাপ্তদের কাছ থেকে টাকা চেয়েছেন। এ অর্থ আদায় হলে তা থেকে একটি অংশ 'ঘুষের দেনা' শোধ করবেন, বাকি অংশ বাড়তি লাভ!
একটি স্কুলের কথা বললাম, কিন্তু নাম বলিনি। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি অথবা সংশ্লিষ্ট কেউ চাইলে সেটা প্রকাশ করাই যায়। কিংবা গোয়েন্দা লাগিয়েও বের করা যায়_ কার কাছ থেকে কে কত অর্থ নিয়েছেন। তবে সমস্যা হচ্ছে, এ ধরনের দুর্নীতি ঘটছে শত শত প্রতিষ্ঠানে। এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে হলে ঘুষ প্রদান যেন বাধ্যতামূলক। এইচএম এরশাদের জাতীয় পার্টির আমলে এটা ঘটেছে। বিএনপি আমলে এটা ঘটেছে। আওয়ামী লীগের আমলে এটা ঘটেছে ও ঘটছে। কেন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্লোগান দেওয়া সরকারের আমলে এ মন্দ ট্রাডিশন চলতে পারছে, সেটা বিস্ময়ের। সরকার ম্যানেজিং কমিটিগুলোকে ঠিক করায় মোটেই যত্নবান হয়নি। কমিটিতে নির্বাচিত ও মনোনীত উভয় ধরনের সদস্য রয়েছেন। বিদ্যায় উৎসাহী হিসেবে যাদের কমিটির সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তাদের বেশিরভাগ রাজনৈতিক সুবিধাবাদী কিংবা টাউট প্রকৃতির লোক। অনেক স্থানে এমপিরা কমিটির সভাপতি হয়েছেন। কোথাও এমপির স্ত্রী কিংবা দলীয় লোককে সভাপতি করা হয়েছে। এর ফল মোটেই ভালো হয়নি এবং হওয়ার কথাও নয়। স্কুলে শুধু শিক্ষক নিয়োগ করেই টাকা কামানো যায় না, সরকার স্কুলের ভবন তৈরি করে দেয়। লাইব্রেরিতে বই কেনার টাকা দেয়, বিজ্ঞানের যন্ত্রপাতির জন্য বরাদ্দ দেয়। সবকিছুতেই বখরা আদায়ের সুযোগ রয়েছে। দুর্ভাগ্য যে, আওয়ামী লীগ সরকার এ সমস্যা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে যেসব অনিয়ম চলছে, সেগুলোই চলতে দিয়েছে। এতে দলীয় স্বার্থ হাসিল হয় না, কারণ যারা ঢেউ গুনেও টাকা আয় করতে জানে তারা ঘুষ নিয়ে নিজের পকেটে জমা করে। অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে যাদের নিয়োগ দেয়, তারা কোন দলের লোক সেটা নিয়েও মাথাব্যথা তাদের থাকে না। যাদের কাছ থেকে বেশি অর্থ মিলবে, তারাই ভালো লোক ও সেরা শিক্ষক।
বর্তমান সরকার স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বিনামূল্যে বই দিয়েছে। শিক্ষার প্রসারে এর চেয়ে বড় উদ্যোগ এ দেশে কমই নেওয়া হয়েছে। রাজধানী ঢাকা থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম, সর্বত্র লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী বছরের প্রথম দিনে ক্লাস শুরুর আগেই নতুন বই হাতে পায়। এ কাজে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা খুব বেশি সহযোগিতা সরকারকে করছেন, এখন পর্যন্ত এমন প্রমাণ মিলছে কম। ছাত্রলীগের সংগঠন আছে দেশজুড়ে। কেন্দ্রীয় বা জেলা-উপজেলা কিংবা পাড়া-মহল্লা কোথাও কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হলেই পদপ্রার্থীর শেষ নেই। 'ত্যাগী-রাজপথের অক্লান্ত সৈনিক-বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী'_ কতই না তাদের বিশেষণ। স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য বই বহন করা গাড়ি যখন হাজির হয় স্কুলে স্কুলে তখন এসব ত্যাগীর কেউ হাজির হন না বিতরণ কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য। ছাত্রলীগ নেতৃত্ব কখনও এ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছে বলেও মনে হয় না। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলও বড় সংগঠন। বিএনপি ক্ষমতায় ফিরে এলে এ কর্মসূচি বাদ দিতে পারবে না। ছাত্রদলও কিন্তু গত দু'বছর স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের হাতে বিনামূল্যের পাঠ্যবই সুষ্ঠুভাবে পেঁৗছে দেওয়ার জন্য কোনো তৎপরতা দেখায়নি। আমাদের চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, বই বিতরণ কাজ সুষ্ঠুভাবে যেন না হয়, এমনকি ছাপার কাজও যাতে বিঘি্নত হয় সে জন্য কারসাজিও করা হতে পারে। দুর্ভাগ্য যে, আওয়ামী লীগ সমর্থক যারা প্রেসের মালিক কিংবা বাইন্ডিং সমিতির কর্মকর্তা কিংবা কাগজের ব্যবসায়ী, তারাও এ ধরনের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। এমন অভিযোগও রয়েছে, বই ছাপার জন্য যে বিপুল পরিমাণ কাগজ দরকার তা বাজারদরের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যে সরকারকে কিনতে বাধ্য করার জন্য সরকারি দলের সঙ্গে যুক্তরাও তৎপর।
ফিরে আসি শিক্ষক নিয়োগের কথায়। যোগ্য শিক্ষক না হলে পড়াশোনার মান কোনোভাবেই বাড়ানো সম্ভব নয়। এটা মানতে হবে যে, যোগ্য শিক্ষক পেতে হলে ভালো বেতন দিতে হবে। বর্তমানে বেসরকারি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেতন দেয় সরকার। কোনো প্রতিষ্ঠান চাইলে তাদের বাড়তি বেতন-ভাতা দিতেই পারে; কিন্তু ঢাকা বা চট্টগ্রামের হাতেগোনা কিছু প্রতিষ্ঠান ব্যতিরেকে এমন বাড়তি উপার্জন করা শিক্ষকের দেখা মেলে কম। শিক্ষকদের একটি অংশ টিউশনি করে প্রচুর উপার্জন করে। কেউ কেউ হয়তো মাসে লাখ টাকা কামান। এ ধরনের উপার্জন কতটা নৈতিক সে প্রশ্ন রয়েছে। আইন লঙ্ঘনের অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এ প্রসঙ্গ থাক আপাতত। কিন্তু বিএ-বিএসসি-বিকম পাস করে স্কুলের চাকরিতে যোগদানের সময় যদি ৬০০০-৭০০০ টাকা (বিএড ট্রেনিং থাকলে ৮০০০ টাকা) বেতন মেলে তাহলে মেধাবী কেউ শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহ দেখাবে কেন? কমপক্ষে টানা ১২ বছর শিক্ষকতা করার পর (এর মধ্যে অন্তত তিন বছর সহকারী প্রধান শিক্ষক থাকা বাধ্যতামূলক) প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ পেলে বেতন-ভাতা মেলে মাসে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা (সরকারি অফিসের পিওন-নিম্নমান কেরানি ১৫ বছর চাকরি করার পর কত পায়?)। তারপরও স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ পেলেই প্রচুর আবেদন পড়ে। এর বড় কারণ শিক্ষিতদের কাজের সুযোগের অভাব। অনেকে বলেন, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়ানো চলবে না। এ ক্ষেত্রে যুক্তি হচ্ছে : বেতন মাসে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা হয়ে গেলে (যা অবিলম্বে করা উচিত) শিক্ষকতার চাকরিতে জয়েন করতে হলে ঘুষের অঙ্ক লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। ম্যানেজিং কমিটি গঠনের ধারায় বদল না এলে প্রকৃতই গুরুতর সমস্যা দেখা দেবে। তবে বর্তমানে সরকারের ফান্ডের যা হাল তাতে এ ধরনের বেতনের প্রত্যাশা আপাতত স্বপ্ন বলেই মনে হয়। এমপিওভুক্ত করার কাজ স্থগিত রাখা হয়েছে কেবল অর্থের অভাবে। নতুন কোনো স্কুল-কলেজ এ তালিকায় তুলতে হলে ঘুষের অঙ্ক নাকি আকাশছোঁয়া হয়ে যায়। এমপিদের জন্য বিপদ আসে দু'দিক থেকে_ তাদের অনেকেই 'ফুয়েল ছাড়া ফাইল নড়ে না' নীতিতে বিশ্বাসী, অন্যদিকে রয়েছে নির্বাচনী এলাকার বাধ্যবাধকতা। সরকারের সততা না এলে অর্থাৎ সুশাসন নিশ্চিত না হলে শিক্ষা খাতে ব্যয় বাড়বে, পাসের হার বাড়তে বাড়তে শতকরা ১০০ পার্সেন্টে পেঁৗছবে; কিন্তু মান বাড়ার বিষয়টি সোনার হরিণ হয়েই থাকবে।
ধনী-গরিব সব শিক্ষার্থী কেন বিনামূল্যের বই পাবে, সচ্ছল পরিবারের মেয়েরা কেন বিনা বেতনে পড়বে_ সেটাও কিন্তু প্রশ্ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পরিবারের সন্তানরা গাড়ি নিয়ে আসে (এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে চান্স না পেলে যারা বছরে এক বা দেড় লাখ টাকা ব্যয় করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে কিংবা বিদেশে পাড়ি জমায় আরও বেশি টাকা ব্যয় করে) তারা কেন মাসে ২০-২৫ টাকা বেতনে পড়ার সুযোগ পাবে? স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়াতে হলে সরকারের পাশাপাশি সচ্ছল জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে অর্থ আদায় করতেই হবে এবং এ ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া প্রকৃতই অন্যায় কাজ। শিক্ষানুরাগীদের কাছ থেকেও অর্থ আদায় করার কৌশল বের করতে হবে এবং এ কাজে সাফল্যের প্রধান শর্ত হচ্ছে, ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের সততা। সরকার কি তাতে আদৌ আগ্রহী?
অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
No comments