আইওয়াশ নয় মেয়র হত্যাকারীদের গ্রেফতার দাবি নরসিংদীবাসীর by মাজহারুল পারভেজ
এসপি, এএসপি বদল ও ঢাকায় তলবে মোটেই খুশি নন নরসিংদীর সাধারণ মানুষ। তাদের মতে এটা কেবলই আই ওয়াশ। মূল হত্যাকারীদের রক্ষা করার অপকৌশল মাত্র। নিহত মেয়র লোকমানের কবরে শোকার্ত নগরবাসীর অজস্র ফুল। শুকিয়ে যাচ্ছে ফুলগুলো। কিন্তু শুকাচ্ছে না লোকমানের স্বজনের চোখের পানি। লোকমান হত্যার আসামিরা বীরদর্পে প্রকাশ্যে। হত্যাকাণ্ডকে আড়াল করতে, মামলাকে ভিন্নখাতে নিতে নানা প্রচার চালাচ্ছে তারা। লোকমানের সমর্থকরা বলেন, এ হত্যাকাণ্ডকে নিয়ে নোংরা রাজনীতি শুরু হয়েছে।
কেউ নিরপরাধ ব্যক্তিকে জড়িয়ে, কেউ যুদ্ধাপরাধ বিচার ইস্যুকে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর অপচেষ্টা করছে।
তারা বলেন, এসপিকে তলব করে কি হবে! বরং তলব করা দরকার হত্যাকারীদের পৃষ্ঠপোষকদের। অবিলম্বে গ্রেফতার করে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা দরকার। অন্যথায় নষ্ট রাজনীতির স্রোতে হরিয়ে যাবে এ মামলা। গতকালও টনক নড়েনি
স্থানীয় প্রশাসনের। হত্যার চার দিন অতিবাহিত হলেও আটক করতে পারেনি কোনো খুনিকে। এতে করে শোকার্তদের আহাজারি যেন দিন দিন বেড়েই চলছে।
পুলিশের উল্লেখযোগ্য কোনো তত্পরতাও চোখে পড়েনি। তবে এসপি ও দুই অ্যাডিশনাল এসপিসহ তিনজনকে একযোগে রদবদল করায় গত দুদিন ধরে পুলিশের চেইন অব কমান্ড প্রায় ভেঙে পড়েছে। এদিকে প্রশাসনের রদবদল নয়, শোকাহত মানুষ চায় খুনিদের পাকড়াও অভিযান।
এরই মধ্যে অভিযোগ উঠেছে, আসামিরা মন্ত্রীর ছত্রছায়ায় থাকায় পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে পারছে না। চাঞ্চল্যকর এ মামলার আসামি আটক না হওয়ায় শহরবাসীর মধ্যেও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ছে। আতঙ্কিত নিহতের পরিবারও। তবে সহসাই ধরা পড়ছে না কোনো আসামি। এমন আভাসই পাওয়া গেল মামলার তদন্দকারী কর্মকর্তার কাছ থেকে।
তদন্তকারী কর্মকর্তা : মামলার অগ্রগতি ও আসামি গ্রেফতার না হওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর মামুনর রশীদ বলেন, অনেক দূর এগিয়েছি কিছু তথ্য প্রমাণও আমাদের হাতে এসছে তাই তদন্তের পরই আসামি ধরা হবে বলে জানান তিনি।
যেখানে মামলা হওয়ার আগেই জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবীর খোকনসহ আরও ৫ জনকে আটক করা হয়েছে অথচ মামলার পর কেন এই ঢিলেঢালা ভাব এ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তবে আসামি ধরার ক্ষেতে যে তাউর চাপ রয়েছে তা তার চেহারা দেখেই বোঝা গেছে। কিন্তু তিনি কোনো চাপের কথা স্বীকার করেননি।
পুলিশে রদবদল : এসপিসহ পুলিশের তিন কর্মকর্তার রদবদল হলেও মামলার কোনো অগ্রগতি হয়নি। বরং জেলায় ইনঅ্যাকটিভ হয়ে পড়েছে পুলিশ প্রশাসন। এসপি ও দুই অ্যাডিশনাল এসপিকে একযোগে জেলা থেকে প্রত্যাহার করে নেয়ায় পুলিশের অন্য কর্মকর্তারা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। স্থবির হয়ে পড়েছে গোটা পুলিশ প্রশাসন। এদিকে রাতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুব্রত হালদার যোগদান করার কথা রয়েছে। যোগদান করেই পাবেন এসপির দায়িত্ব। নবাগত ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপারের দিকে চেয়ে আছে গোটা প্রশাসন।
জনপ্রতিনিধিরা যা বললেন : শিবপুর থেকে নির্বাচিত সরকারদলীয় সংসদ সদস্য জহিরুল হক মোহন বলেন, খুনিদের কোনো দল নেই। তারা যে দলের হোক তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন তিনি। সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মনজুর এলাহী, মাধবদী পৌরসভার মেয়র ও বিএনপি নেতা হাজী ইলিয়াস ও শিবপুরের চক্রধা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলাম মৃধা বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে থানায় মামলা হয়েছে। এছাড়া যারা এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, এরই মধ্যে তাদের নাম পরিচয় পত্র-পত্রিকায় এসেছে কিন্তু তারপরও পুলিশ তাদের গ্রেফতার না করে প্রতারণা করছে। অবিলম্বে আসামিদের গ্রেফতারের দাবি জানান এ জনপ্রতিনিধিরা।
সুশীল সমাজের বক্তব্য : নরসিংদী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা মিয়া ও দেশ সেরা আবদুল কাদির মোল্লা সিটি কলেজের অধ্যক্ষ ড. মশিউর রহমান মৃধা বলেন, যারা নরসিংদীর উন্নয়ন, শান্তি ও নিরাপত্তা চায়নি তারাই এ খুনের সঙ্গে জড়িত। তরুণ জনপ্রতিনিধি লোকমান হোসেনকে হত্যা করে তারা জেলাবাসীকে অভিভাবকশূন্য করতে চেয়েছে। দ্রুত এ হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে তারা আরও বলেন, গত ৫০ বছরে নরসিংদী পৌর এলাকায় যে উন্নয়ন হয়নি, লোকমান গত কয়েক বছরে তার চেয়ে বেশি উন্নয়ন করেছেন। এ হত্যাকাণ্ডের বিচার বিলম্ব হলে মেধাবীরা আর রাজনীতিতে আসবেন না।
যে কারণে এ হত্যাকাণ্ড : জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর থেকে রাতারাতি শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও দুই দুই বার মেয়র এবং দলের সিনিয়র নেতাদের বিরোধিতার পরও তার একক সমর্থনে সংসদ নির্বাচনে বিজয় লাভ করেন একজন অপরিচিত সেনা কর্মকর্তা। নেতাকর্মীদের দাবির প্রেক্ষিতে তাই এবার তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে লড়ার কথা ভাবছিলেন। আর এ পদ পেতে আকস্মিকভাবে মাঠে নেমেছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর ছোট ভাই সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু। এছাড়া আগামী সংসদ নির্বাচনে তাকে ঘিরে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করার কথাও ভাবছিল সদরবাসী। তাকে কোনোভাবেই প্রতিহত করার যোগ্যতা রাখে না কেউ। আর সে কারণেই শত্রুরা গুলি করে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে লোকমান হোসেনের বুক।
অবুঝ এতিম সন্তানরা শুধু বাবাকে চায় : মেয়রের অবুঝ মেয়ে নাজা আর অপেক্ষায় থাকতে চায় না। তার আর মাল্টার দরকার নেই। কিন্তু বাবা যে চলে গেছেন ফিরে না আসার দেশে সে কথা সে ভাবতেই পারছে না। গতকাল পর্যন্ত তেমন বিরক্তি না করলেও আজ সে শুধু বাবার জন্য বায়না করছে। বাবা নাজাকে বলেছিল মাল্টা ও কোরবানির জন্য একটা লাল গরু নিয়ে আসবে। কিন্তু লাল গরু বা মাল্টা কোনোটাই নিয়ে আসছে না বাবা। বাবা কেন আসছে না এ বলেই শুধু কান্নাকাটি করছে সারাদিন। কেউ তাকে সান্ত্বনাও দিতে পারছে না। এদিকে তার ভাই এক বছরের শিশু ছেলে সালফিও ঘুরে ফিরে বাবাকেই খুঁজছে। কথা বলতে না পারলেও সে যেন শুধু বাবার কথাই ভাবছে।
স্ত্রীর বক্তব্য : স্ত্রী তামান্না নুছরাত বুবলি কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার কান্নায় কি প্রধানমন্ত্রীর মনে একটু মায়াও হয় না? আমার জন্য মায়া না হলেও আমার এ শিশু সন্তানের জন্য কি তার কোনো সান্ত্বনা নেই। আমি তো আর কাঁদতে পারছি না ভাই। আমার চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। স্বজনহারা এ মানুষটি কি আমার স্বামী হত্যার বিচার করবেন না। আমাকে কোনো সান্ত্বনা দেবেন না, বলতে বলতে অচেতন হয়ে পড়েন। এ সময় মেয়রের ছোট বোন রোজি তার মাথায় পানি দিতে দিতে অসহায়ের মতো তিনিও কাঁদতে থাকেন।
মেয়রের মায়ের বক্তব্য : বাসায় গিয়ে দেখা যায় মেয়রের মা মজিদা বেগম ঘরের কোণে বসে বোবাকান্না কাঁদছেন। ছেলেকে হারিয়ে যেন পাগলপ্রায়। তারপরও মিডিয়ার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে বলেন, আমি আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার চাই। এ সময় তিনি আরও বলেন, আমার ছেলের খুনিদের ফাঁসি দেখে যেতে চাই। আর পুলিশ যেন কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে অহেতুক হয়রানি না করে।
মামলার বাদী : মামলার বাদী নিহতের ছোট ভাই কামরুজ্জামান বলেন, আমি আমার পরিবার নিয়ে আতঙ্কে দিনাতিপাত করছি। কোনোভাবেই এ শোক কেউ কাটিয়ে উঠতে পারছে না । বৃদ্ধা মা, ভাবী ও অবুঝ দুই সন্তানকে কোনোভাবেই বোঝানো যাচ্ছে না। এ অবস্থায় একমাত্র প্রধানমন্ত্রীই পারেন আমাদের একটু আশার আলো দেখাতে।
পৌর কবরস্থানে মানুষের ঢল : লোকমান হোসেনের হাতে গড়া এ কবরস্থান। নতুন এ কবরস্থানে তিনি প্রায়ই যেতেন। ঘটনার দিনও সেখানে গিয়েছিলেন। কবরের কেয়ারটেকার আলতাফ হোসেন জানান, ঘটনার দিন সকাল ৯টায় তিনি কবরস্থানে আসেন। সকাল ১১টা পর্যন্ত এখানে অবস্থান করেন। এরই মধ্যে নাস্তাও করেন এখানে। নাস্তার ফাঁকে আলতাফ হোসেনকে বলেন, বুধবার থেকে এখানে পৌর আদালত বসাবেন। কবরের পাশে বসে মানুষ মিথ্যা কথা বলতে ভয় পাবে। আর এতে করে কম সময়ে অনেকগুলো বিচার করা যাবে। কিন্তু বুধবার সকালে পৌর আদালত সেখানে না বসলেও সন্ধ্যায় তিনি ঠিকই লাশ হয়ে কবরস্থানে এসেছেন।
এ কবরের পাশে এখন নারী, শিশু ও সব বয়সী শোকার্ত মানুষের ঢল কবর দেয়ার পর থেকেই। এ সংখ্যা যেন দিন দিন বেড়েই চলছে। গতকাল সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায় কবরের পাশে বসে হাত তুলে দোয়া করছেন অনেকে।
এদিকে ছাত্রনেতারা বললেন, পৌর সভার জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হোসেন হত্যা মামলার আসামিরা ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর আশ্রয় প্রশ্রয়ে থাকার কারণে পুলিশ আসামিদের গ্রেফতার করতে সাহস পাচ্ছে না।
প্রতিবাদ সভা : এদিকে ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সভাপতি সুলতান উদ্দিন টুকু বলেন, আওয়ামী লীগ এ নির্দয় হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে না পারলেও আমরা এ জননন্দিত নেতার হত্যাকাণ্ডের বিচার করব।
আজ দুপুরে খায়রুল কবীর খোকনকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে ও মুক্তির দাবিতে জেলা ছাত্রদল আয়োজিত এক সভায় তিনি এসব কথা বলেন। অবিলম্বে খোকনের মুক্তির দাবি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আগামী ৯ নভেম্বরে খোকনের মুক্তি না হলে নরসিংদী থেকে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আন্দোলনের ডাক দেয়া হবে।
এর আগে সকালে শিবপুর কলেজ গেট চত্বরে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মাস্টারের নেতৃত্বে খায়রুল কবীর খোকনের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ও মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে শিবপুর উপজেলা বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
তারা বলেন, এসপিকে তলব করে কি হবে! বরং তলব করা দরকার হত্যাকারীদের পৃষ্ঠপোষকদের। অবিলম্বে গ্রেফতার করে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা দরকার। অন্যথায় নষ্ট রাজনীতির স্রোতে হরিয়ে যাবে এ মামলা। গতকালও টনক নড়েনি
স্থানীয় প্রশাসনের। হত্যার চার দিন অতিবাহিত হলেও আটক করতে পারেনি কোনো খুনিকে। এতে করে শোকার্তদের আহাজারি যেন দিন দিন বেড়েই চলছে।
পুলিশের উল্লেখযোগ্য কোনো তত্পরতাও চোখে পড়েনি। তবে এসপি ও দুই অ্যাডিশনাল এসপিসহ তিনজনকে একযোগে রদবদল করায় গত দুদিন ধরে পুলিশের চেইন অব কমান্ড প্রায় ভেঙে পড়েছে। এদিকে প্রশাসনের রদবদল নয়, শোকাহত মানুষ চায় খুনিদের পাকড়াও অভিযান।
এরই মধ্যে অভিযোগ উঠেছে, আসামিরা মন্ত্রীর ছত্রছায়ায় থাকায় পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে পারছে না। চাঞ্চল্যকর এ মামলার আসামি আটক না হওয়ায় শহরবাসীর মধ্যেও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ছে। আতঙ্কিত নিহতের পরিবারও। তবে সহসাই ধরা পড়ছে না কোনো আসামি। এমন আভাসই পাওয়া গেল মামলার তদন্দকারী কর্মকর্তার কাছ থেকে।
তদন্তকারী কর্মকর্তা : মামলার অগ্রগতি ও আসামি গ্রেফতার না হওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর মামুনর রশীদ বলেন, অনেক দূর এগিয়েছি কিছু তথ্য প্রমাণও আমাদের হাতে এসছে তাই তদন্তের পরই আসামি ধরা হবে বলে জানান তিনি।
যেখানে মামলা হওয়ার আগেই জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবীর খোকনসহ আরও ৫ জনকে আটক করা হয়েছে অথচ মামলার পর কেন এই ঢিলেঢালা ভাব এ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তবে আসামি ধরার ক্ষেতে যে তাউর চাপ রয়েছে তা তার চেহারা দেখেই বোঝা গেছে। কিন্তু তিনি কোনো চাপের কথা স্বীকার করেননি।
পুলিশে রদবদল : এসপিসহ পুলিশের তিন কর্মকর্তার রদবদল হলেও মামলার কোনো অগ্রগতি হয়নি। বরং জেলায় ইনঅ্যাকটিভ হয়ে পড়েছে পুলিশ প্রশাসন। এসপি ও দুই অ্যাডিশনাল এসপিকে একযোগে জেলা থেকে প্রত্যাহার করে নেয়ায় পুলিশের অন্য কর্মকর্তারা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। স্থবির হয়ে পড়েছে গোটা পুলিশ প্রশাসন। এদিকে রাতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুব্রত হালদার যোগদান করার কথা রয়েছে। যোগদান করেই পাবেন এসপির দায়িত্ব। নবাগত ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপারের দিকে চেয়ে আছে গোটা প্রশাসন।
জনপ্রতিনিধিরা যা বললেন : শিবপুর থেকে নির্বাচিত সরকারদলীয় সংসদ সদস্য জহিরুল হক মোহন বলেন, খুনিদের কোনো দল নেই। তারা যে দলের হোক তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন তিনি। সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মনজুর এলাহী, মাধবদী পৌরসভার মেয়র ও বিএনপি নেতা হাজী ইলিয়াস ও শিবপুরের চক্রধা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলাম মৃধা বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে থানায় মামলা হয়েছে। এছাড়া যারা এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, এরই মধ্যে তাদের নাম পরিচয় পত্র-পত্রিকায় এসেছে কিন্তু তারপরও পুলিশ তাদের গ্রেফতার না করে প্রতারণা করছে। অবিলম্বে আসামিদের গ্রেফতারের দাবি জানান এ জনপ্রতিনিধিরা।
সুশীল সমাজের বক্তব্য : নরসিংদী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা মিয়া ও দেশ সেরা আবদুল কাদির মোল্লা সিটি কলেজের অধ্যক্ষ ড. মশিউর রহমান মৃধা বলেন, যারা নরসিংদীর উন্নয়ন, শান্তি ও নিরাপত্তা চায়নি তারাই এ খুনের সঙ্গে জড়িত। তরুণ জনপ্রতিনিধি লোকমান হোসেনকে হত্যা করে তারা জেলাবাসীকে অভিভাবকশূন্য করতে চেয়েছে। দ্রুত এ হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে তারা আরও বলেন, গত ৫০ বছরে নরসিংদী পৌর এলাকায় যে উন্নয়ন হয়নি, লোকমান গত কয়েক বছরে তার চেয়ে বেশি উন্নয়ন করেছেন। এ হত্যাকাণ্ডের বিচার বিলম্ব হলে মেধাবীরা আর রাজনীতিতে আসবেন না।
যে কারণে এ হত্যাকাণ্ড : জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর থেকে রাতারাতি শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও দুই দুই বার মেয়র এবং দলের সিনিয়র নেতাদের বিরোধিতার পরও তার একক সমর্থনে সংসদ নির্বাচনে বিজয় লাভ করেন একজন অপরিচিত সেনা কর্মকর্তা। নেতাকর্মীদের দাবির প্রেক্ষিতে তাই এবার তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে লড়ার কথা ভাবছিলেন। আর এ পদ পেতে আকস্মিকভাবে মাঠে নেমেছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর ছোট ভাই সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু। এছাড়া আগামী সংসদ নির্বাচনে তাকে ঘিরে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করার কথাও ভাবছিল সদরবাসী। তাকে কোনোভাবেই প্রতিহত করার যোগ্যতা রাখে না কেউ। আর সে কারণেই শত্রুরা গুলি করে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে লোকমান হোসেনের বুক।
অবুঝ এতিম সন্তানরা শুধু বাবাকে চায় : মেয়রের অবুঝ মেয়ে নাজা আর অপেক্ষায় থাকতে চায় না। তার আর মাল্টার দরকার নেই। কিন্তু বাবা যে চলে গেছেন ফিরে না আসার দেশে সে কথা সে ভাবতেই পারছে না। গতকাল পর্যন্ত তেমন বিরক্তি না করলেও আজ সে শুধু বাবার জন্য বায়না করছে। বাবা নাজাকে বলেছিল মাল্টা ও কোরবানির জন্য একটা লাল গরু নিয়ে আসবে। কিন্তু লাল গরু বা মাল্টা কোনোটাই নিয়ে আসছে না বাবা। বাবা কেন আসছে না এ বলেই শুধু কান্নাকাটি করছে সারাদিন। কেউ তাকে সান্ত্বনাও দিতে পারছে না। এদিকে তার ভাই এক বছরের শিশু ছেলে সালফিও ঘুরে ফিরে বাবাকেই খুঁজছে। কথা বলতে না পারলেও সে যেন শুধু বাবার কথাই ভাবছে।
স্ত্রীর বক্তব্য : স্ত্রী তামান্না নুছরাত বুবলি কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার কান্নায় কি প্রধানমন্ত্রীর মনে একটু মায়াও হয় না? আমার জন্য মায়া না হলেও আমার এ শিশু সন্তানের জন্য কি তার কোনো সান্ত্বনা নেই। আমি তো আর কাঁদতে পারছি না ভাই। আমার চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। স্বজনহারা এ মানুষটি কি আমার স্বামী হত্যার বিচার করবেন না। আমাকে কোনো সান্ত্বনা দেবেন না, বলতে বলতে অচেতন হয়ে পড়েন। এ সময় মেয়রের ছোট বোন রোজি তার মাথায় পানি দিতে দিতে অসহায়ের মতো তিনিও কাঁদতে থাকেন।
মেয়রের মায়ের বক্তব্য : বাসায় গিয়ে দেখা যায় মেয়রের মা মজিদা বেগম ঘরের কোণে বসে বোবাকান্না কাঁদছেন। ছেলেকে হারিয়ে যেন পাগলপ্রায়। তারপরও মিডিয়ার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে বলেন, আমি আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার চাই। এ সময় তিনি আরও বলেন, আমার ছেলের খুনিদের ফাঁসি দেখে যেতে চাই। আর পুলিশ যেন কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে অহেতুক হয়রানি না করে।
মামলার বাদী : মামলার বাদী নিহতের ছোট ভাই কামরুজ্জামান বলেন, আমি আমার পরিবার নিয়ে আতঙ্কে দিনাতিপাত করছি। কোনোভাবেই এ শোক কেউ কাটিয়ে উঠতে পারছে না । বৃদ্ধা মা, ভাবী ও অবুঝ দুই সন্তানকে কোনোভাবেই বোঝানো যাচ্ছে না। এ অবস্থায় একমাত্র প্রধানমন্ত্রীই পারেন আমাদের একটু আশার আলো দেখাতে।
পৌর কবরস্থানে মানুষের ঢল : লোকমান হোসেনের হাতে গড়া এ কবরস্থান। নতুন এ কবরস্থানে তিনি প্রায়ই যেতেন। ঘটনার দিনও সেখানে গিয়েছিলেন। কবরের কেয়ারটেকার আলতাফ হোসেন জানান, ঘটনার দিন সকাল ৯টায় তিনি কবরস্থানে আসেন। সকাল ১১টা পর্যন্ত এখানে অবস্থান করেন। এরই মধ্যে নাস্তাও করেন এখানে। নাস্তার ফাঁকে আলতাফ হোসেনকে বলেন, বুধবার থেকে এখানে পৌর আদালত বসাবেন। কবরের পাশে বসে মানুষ মিথ্যা কথা বলতে ভয় পাবে। আর এতে করে কম সময়ে অনেকগুলো বিচার করা যাবে। কিন্তু বুধবার সকালে পৌর আদালত সেখানে না বসলেও সন্ধ্যায় তিনি ঠিকই লাশ হয়ে কবরস্থানে এসেছেন।
এ কবরের পাশে এখন নারী, শিশু ও সব বয়সী শোকার্ত মানুষের ঢল কবর দেয়ার পর থেকেই। এ সংখ্যা যেন দিন দিন বেড়েই চলছে। গতকাল সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায় কবরের পাশে বসে হাত তুলে দোয়া করছেন অনেকে।
এদিকে ছাত্রনেতারা বললেন, পৌর সভার জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হোসেন হত্যা মামলার আসামিরা ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর আশ্রয় প্রশ্রয়ে থাকার কারণে পুলিশ আসামিদের গ্রেফতার করতে সাহস পাচ্ছে না।
প্রতিবাদ সভা : এদিকে ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সভাপতি সুলতান উদ্দিন টুকু বলেন, আওয়ামী লীগ এ নির্দয় হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে না পারলেও আমরা এ জননন্দিত নেতার হত্যাকাণ্ডের বিচার করব।
আজ দুপুরে খায়রুল কবীর খোকনকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে ও মুক্তির দাবিতে জেলা ছাত্রদল আয়োজিত এক সভায় তিনি এসব কথা বলেন। অবিলম্বে খোকনের মুক্তির দাবি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আগামী ৯ নভেম্বরে খোকনের মুক্তি না হলে নরসিংদী থেকে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আন্দোলনের ডাক দেয়া হবে।
এর আগে সকালে শিবপুর কলেজ গেট চত্বরে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মাস্টারের নেতৃত্বে খায়রুল কবীর খোকনের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ও মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে শিবপুর উপজেলা বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
No comments