কিংবদন্তির গায়ক ভূপেন হাজারিকা পরলোকে
উপমহাদেশের কিংবদন্তির গায়ক ভূপেন হাজারিকা আর নেই। দরদমাখা কণ্ঠে তিনি আর গান গাইবেন না। গতকাল সন্ধ্যায় ভারতে মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে এই গানের পাখি পরলোকগমন করেছেন। তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। মৃত্যুর আগে তার দুটি কিডনিই বিকল হয়ে পড়েছিল।‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না, ও বন্ধু’; ‘বিস্তীর্ণ দু’পারের অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও নিঃশব্দে নীরবে ও গঙ্গা তুমি বইছ কেন’; ‘দোলা হে দোলা হে দোলা হে দোলা’; ‘শরত্ বাবু, খোলা চিঠি দিলাম তোমার কাছে, তোমার গফুর মহেশ এখন কোথায় কেমন আছে’, ‘আমি এক যাযাবর’— এসব কালজয়ী গানের শিল্পী ও স্রষ্টা ভূপেন হাজারিকা।
তার গাওয়া বাংলা গানের এই অসাধারণ পঙিক্তগুলো বাংলাদেশ ও ভারতের মানুষের মনে জীবন্ত হয়ে আছে।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত এই সঙ্গীতশিল্পী ভারতে মুম্বাইয়ের আন্ধেরিতে কোকিলাবেন ধীরুভাই আম্বানি হাসপাতালে যখন শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, তখন তার পাশে ছিলেন দীর্ঘদিনের সঙ্গিনী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা কল্পনা লাজমি।
‘ব্রহ্মপুত্রের চারণকবি’ নামে তাকে অভিহিত করা হতো। ব্রহ্মপুত্র বহমান থাকলেও ভূপেন হাজারিকার জীবন থেকে গেছে। পাঁচ মাস ধরে তিনি মুম্বাইয়ের হাসপাতালে কিডনি রোগের চিকিত্সা নিচ্ছিলেন। গত মঙ্গলবার তার ডায়ালাইসিস হলেও লাভ হয়নি। ডায়ালাইসিসেও সাড়া দিচ্ছিল না তার শরীর। তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছিল। আইসিইউতেই তিনি গত ৮ সেপ্টেম্বর তার ৮৫তম জন্মদিন পালন করেন। খুব কষ্টে একটু কেক খান।
১৯২৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর এ কণ্ঠশিল্পী ভারতের আসাম রাজ্যের সাদিয়া জেলায় জন্ম নেন। দরাজ গলার এ শিল্পীর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া। তিনি প্রথম গান গেয়েছিলেন অসমিয়া চলচ্চিত্রে। পরে বাংলা ও হিন্দি ভাষায় গান গেয়ে ভারত ও বাংলাদেশে প্রবাদতুল্য জনপ্রিয়তা পান। তবে পড়ন্ত বেলায় এসে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল বিজেপিতে যোগ দিয়ে তিনি চরম বিতর্কিতও হন।
মাত্র ১০ বছর বয়স থেকে গান লিখে সুর দিতে থাকেন হাজারিকা। ১২ বছর বয়সে ‘তালকি’ ও ‘ইন্দ্রমালতী’ নামে দুটি অসমিয়া ছবিতে গান গেয়ে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান। ১৯৪২ সালে গৌহাটির কটন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। পরে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ (১৯৪৪) ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ (১৯৪৬) পাস করেন। আর ১৯৫৬ সালে আমেরিকার কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি নেন।
১৯৯২ সালে ভারতীয় চলচ্চিত্রে আজীবন অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তিনি পদ্মভূষণ পদকও পেয়েছেন। আর ৮৩তম জন্মদিনে তিনি জীবনের সবচেয়ে বড় উপহারগুলোর একটি পেয়েছেন। এটি হচ্ছে আসামের রাজ্য সরকারের কাছ থেকে পাওয়া ‘আসামরত্ন’ পুরস্কার। তিনিই প্রথম এ পুরস্কার পান।
তার গাওয়া ‘মানুষ মানুষের জন্য’ গানটি শুনলে তা এক মানুষকে সত্যিকার অর্থে মানুষ বানাতে সহায়তা করতে পারে। সঙ্গীতবিশেষজ্ঞরা বলেন, পৃথিবীর সব গান মানুষকে ভাবায় না, জাগিয়ে তোলে না। তারপরও কিছু গান মানুষকে মানুষ বানাতে সহায়তা করে, মানুষ হিসেবে চিন্তা-বিবেচনা করাতে শেখায় এবং মানবিকতার যে মূল্যবোধ থাকা উচিত, সেই চেতনা জাগাতে পারে। ভূপেন হাজারিকার অধিকাংশ গানই মানুষকে ভাবায়। মানুষ হতে প্রেরণা জোগায়। কারণ ভূপেনের অধিকাংশ গানের পঙিক্তর ভাবার্থ অনেক গভীর এবং দর্শনতত্ত্বসমৃদ্ধ।
দুটি কিডনিই অকেজো হয়ে যাওয়ায় চলতি বছরের ৩০ জুন থেকে ভূপেন হাজারিকা হাসপাতালে চিকিত্সাধীন ছিলেন। চিকিত্সকরা জানান, কিডনি ও বার্ধক্যজনিত জটিলতাই তার মৃত্যুর কারণ।
প্রায় চার দশক ধরে চুুটিয়ে প্রেম করেছেন উপমহাদেশের অন্যতম সেরা সুরস্রষ্টা, কবি ও পরিব্রাজক ভূপেন হাজারিকা। চলচ্চিত্র নির্মাতা কল্পনা লাজমি তার থেকে ২৮ বছরের ছোট হলেও প্রেমে তা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। কল্পনার বয়স যখন মাত্র ১৭ বছর, তখন ভূপেন হাজারিকার ৪৫। ওই বয়সেই প্রথম তারা প্রেমে পড়েন। একসময় ভূপেন হাজারিকা আর কল্পনা একত্রে বসবাস করতে থাকেন তাদের মুম্বাইয়ের বাড়িতে।
ভূপেন বলতেন, ১৯৭৭ সাল থেকে কল্পনা লাজমি আমার ব্যবসার অংশীদার। আমার যে ক্যারিয়ার গড়ে উঠেছে, তার পেছনে পুরো কৃতিত্ব তার। তার সঙ্গে যখন আমার যোগাযোগ হয়, তখন আমি ছিলাম কপর্দকশূন্য। আমার হাতে ছিল মাত্র ৩৫ রুপি। সে সময় থেকে তিনি আমাকে যত্ন সহকারে দেখাশোনা করেছেন। এমনকি যখন আমি প্রচণ্ড আর্থিক দৈন্যে পড়েছি, মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি, তখন কল্পনা ছাড়া কেউই আমার কাছে এগিয়ে আসেননি।
ভূপেন হাজারিকা গত ১২ ডিসেম্বর একটি বিশেষ উইলে স্বাক্ষর করেন। এ উইলের বলে কল্পনা লাজমি পেয়েছেন হাজারিকার যাবতীয় চলচ্চিত্র ও সঙ্গীতের স্বত্ব, মুম্বাইয়ের আন্ধেরিতে অবস্থিত একটি ফ্ল্যাট, কলকাতার ৭৭বি, গোল্ডক্লাব রোডের একটি ফ্ল্যাট, পুনেতে ১২৪০ দশমিক ১ বর্গমিটারের দুটি প্লট, হাজারিকার পেনশন, গাড়ি, বিদ্যমান ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ছবি ও টেলিভিশন সফটওয়্যারের নগদ অর্থ এবং চেক ভাঙানোর অধিকার। কিছু সম্পদ তিনি দিয়েছেন নিউইয়র্কে বসবাসরত ছেলে পুনাং তেজ হাজারিকাকে (৫৯)। উল্লেখ্য, ভূপেন হাজারিকার স্ত্রী প্রিয়ংবদা প্যাটেল হাজারিকা বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করছেন কানাডায়।
তার অসংখ্য গান এখনও শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখে। তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ বলিউডের দিকপাল সঙ্গীতশিল্পীরা। আর কল্পনা লাজমি শোক জানিয়ে বলেছেন, ‘তিনি ছিলেন অসাধারণ। ভারত আর একটা ভূপেন হাজারিকা কখনোই পাবে না।’
বাংলাদেশের খ্যাতিমান গীতিকার গাজী মাযহারুল আনোয়ার বলেন, ভূপেন হাজারিকা ছিলেন শিক্ষিত শিল্পী। তার চর্চা ছিল। আর চর্চা, সাধনা ও যোগ্যতার কারণে তিনি শুদ্ধ শিল্পী হতে পেরেছেন। পণ্ডিততুল্য এই সঙ্গীতগুরু অন্যদের চেয়ে একটু ব্যতিক্রম ছিলেন। তাকে বাংলাদেশ ও ভারতের মানুষের পাশাপাশি হিন্দি ভাষাভাষী জনগণও মনে রাখবে।
তার গান মানুষকে উদ্দীপ্ত করেছে - প্রধানমন্ত্রী : বিডিনিউজ জানায়, ভূপেন হাজারিকার গান মানুষকে উদ্দীপ্ত করেছে। প্রখ্যাত এই শিল্পীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে একথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ একথা জানিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই শিল্পীর সঙ্গীত স্বাধীনতাকামী জনগণকে যে আশা জুগিয়েছিল, তা চিরস্মরণীয় থাকার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ভূপেন হাজারিকার গণসঙ্গীত বিভিন্ন সময়ে মানুষের মনে উদ্দীপনা জুগিয়েছে। তিনি ভূপেন হাজারিকার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতিও সমবেদনা প্রকাশ করেন।
ভূপেন হাজারিকার প্রয়াণে খালেদা জিয়ার শোক : উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ও সুরকার ভূপেন হাজারিকার প্রয়াণে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন, জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। গতকাল এক শোকবার্তায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, গণমানুষের শিল্পী ভূপেন হাজারিকার মৃত্যুতে উপমহাদেশে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সঙ্গীতাঙ্গনে তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।
খালেদা জিয়া বলেন, বাংলাভাষাসহ উপমহাদেশের অন্যান্য ভাষায়ও গান গেয়ে এ অঞ্চলের মানুষের মনে চিরজাগরূক থাকবেন এ শিল্পী। বাংলাদেশের প্রখ্যাত গীতিকার ও বিএনপির সাবেক সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক মরহুম লোকমান হোসেন ফকিরের লেখা একটি জীবনধর্মী গান ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠে সুরের মূর্ছনায় বাংলাভাষী মানুষকে আজও মুগ্ধ করে রেখেছে। গানটি হলো— ‘আমায় একটি সাদা মানুষ দাও যার রক্ত সাদা, আমারে একটি কালো মানুষ দাও, যার রক্ত কালো।’ সমাজে যতদিন অত্যাচার, অবিচার, শোষণ-নিপীড়নের অস্তিত্ব থাকবে ততদিন তা প্রতিরোধে অসহায় নিপীড়িত মানুষকে প্রেরণা জোগাবে ভূপেন হাজারিকার অবিনাশী গান। অমর এই শিল্পীর পরলোকগমনে উপমহাদেশের সঙ্গীতজগতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হলো, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত এই সঙ্গীতশিল্পী ভারতে মুম্বাইয়ের আন্ধেরিতে কোকিলাবেন ধীরুভাই আম্বানি হাসপাতালে যখন শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, তখন তার পাশে ছিলেন দীর্ঘদিনের সঙ্গিনী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা কল্পনা লাজমি।
‘ব্রহ্মপুত্রের চারণকবি’ নামে তাকে অভিহিত করা হতো। ব্রহ্মপুত্র বহমান থাকলেও ভূপেন হাজারিকার জীবন থেকে গেছে। পাঁচ মাস ধরে তিনি মুম্বাইয়ের হাসপাতালে কিডনি রোগের চিকিত্সা নিচ্ছিলেন। গত মঙ্গলবার তার ডায়ালাইসিস হলেও লাভ হয়নি। ডায়ালাইসিসেও সাড়া দিচ্ছিল না তার শরীর। তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছিল। আইসিইউতেই তিনি গত ৮ সেপ্টেম্বর তার ৮৫তম জন্মদিন পালন করেন। খুব কষ্টে একটু কেক খান।
১৯২৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর এ কণ্ঠশিল্পী ভারতের আসাম রাজ্যের সাদিয়া জেলায় জন্ম নেন। দরাজ গলার এ শিল্পীর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া। তিনি প্রথম গান গেয়েছিলেন অসমিয়া চলচ্চিত্রে। পরে বাংলা ও হিন্দি ভাষায় গান গেয়ে ভারত ও বাংলাদেশে প্রবাদতুল্য জনপ্রিয়তা পান। তবে পড়ন্ত বেলায় এসে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল বিজেপিতে যোগ দিয়ে তিনি চরম বিতর্কিতও হন।
মাত্র ১০ বছর বয়স থেকে গান লিখে সুর দিতে থাকেন হাজারিকা। ১২ বছর বয়সে ‘তালকি’ ও ‘ইন্দ্রমালতী’ নামে দুটি অসমিয়া ছবিতে গান গেয়ে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান। ১৯৪২ সালে গৌহাটির কটন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। পরে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ (১৯৪৪) ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ (১৯৪৬) পাস করেন। আর ১৯৫৬ সালে আমেরিকার কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি নেন।
১৯৯২ সালে ভারতীয় চলচ্চিত্রে আজীবন অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তিনি পদ্মভূষণ পদকও পেয়েছেন। আর ৮৩তম জন্মদিনে তিনি জীবনের সবচেয়ে বড় উপহারগুলোর একটি পেয়েছেন। এটি হচ্ছে আসামের রাজ্য সরকারের কাছ থেকে পাওয়া ‘আসামরত্ন’ পুরস্কার। তিনিই প্রথম এ পুরস্কার পান।
তার গাওয়া ‘মানুষ মানুষের জন্য’ গানটি শুনলে তা এক মানুষকে সত্যিকার অর্থে মানুষ বানাতে সহায়তা করতে পারে। সঙ্গীতবিশেষজ্ঞরা বলেন, পৃথিবীর সব গান মানুষকে ভাবায় না, জাগিয়ে তোলে না। তারপরও কিছু গান মানুষকে মানুষ বানাতে সহায়তা করে, মানুষ হিসেবে চিন্তা-বিবেচনা করাতে শেখায় এবং মানবিকতার যে মূল্যবোধ থাকা উচিত, সেই চেতনা জাগাতে পারে। ভূপেন হাজারিকার অধিকাংশ গানই মানুষকে ভাবায়। মানুষ হতে প্রেরণা জোগায়। কারণ ভূপেনের অধিকাংশ গানের পঙিক্তর ভাবার্থ অনেক গভীর এবং দর্শনতত্ত্বসমৃদ্ধ।
দুটি কিডনিই অকেজো হয়ে যাওয়ায় চলতি বছরের ৩০ জুন থেকে ভূপেন হাজারিকা হাসপাতালে চিকিত্সাধীন ছিলেন। চিকিত্সকরা জানান, কিডনি ও বার্ধক্যজনিত জটিলতাই তার মৃত্যুর কারণ।
প্রায় চার দশক ধরে চুুটিয়ে প্রেম করেছেন উপমহাদেশের অন্যতম সেরা সুরস্রষ্টা, কবি ও পরিব্রাজক ভূপেন হাজারিকা। চলচ্চিত্র নির্মাতা কল্পনা লাজমি তার থেকে ২৮ বছরের ছোট হলেও প্রেমে তা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। কল্পনার বয়স যখন মাত্র ১৭ বছর, তখন ভূপেন হাজারিকার ৪৫। ওই বয়সেই প্রথম তারা প্রেমে পড়েন। একসময় ভূপেন হাজারিকা আর কল্পনা একত্রে বসবাস করতে থাকেন তাদের মুম্বাইয়ের বাড়িতে।
ভূপেন বলতেন, ১৯৭৭ সাল থেকে কল্পনা লাজমি আমার ব্যবসার অংশীদার। আমার যে ক্যারিয়ার গড়ে উঠেছে, তার পেছনে পুরো কৃতিত্ব তার। তার সঙ্গে যখন আমার যোগাযোগ হয়, তখন আমি ছিলাম কপর্দকশূন্য। আমার হাতে ছিল মাত্র ৩৫ রুপি। সে সময় থেকে তিনি আমাকে যত্ন সহকারে দেখাশোনা করেছেন। এমনকি যখন আমি প্রচণ্ড আর্থিক দৈন্যে পড়েছি, মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি, তখন কল্পনা ছাড়া কেউই আমার কাছে এগিয়ে আসেননি।
ভূপেন হাজারিকা গত ১২ ডিসেম্বর একটি বিশেষ উইলে স্বাক্ষর করেন। এ উইলের বলে কল্পনা লাজমি পেয়েছেন হাজারিকার যাবতীয় চলচ্চিত্র ও সঙ্গীতের স্বত্ব, মুম্বাইয়ের আন্ধেরিতে অবস্থিত একটি ফ্ল্যাট, কলকাতার ৭৭বি, গোল্ডক্লাব রোডের একটি ফ্ল্যাট, পুনেতে ১২৪০ দশমিক ১ বর্গমিটারের দুটি প্লট, হাজারিকার পেনশন, গাড়ি, বিদ্যমান ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ছবি ও টেলিভিশন সফটওয়্যারের নগদ অর্থ এবং চেক ভাঙানোর অধিকার। কিছু সম্পদ তিনি দিয়েছেন নিউইয়র্কে বসবাসরত ছেলে পুনাং তেজ হাজারিকাকে (৫৯)। উল্লেখ্য, ভূপেন হাজারিকার স্ত্রী প্রিয়ংবদা প্যাটেল হাজারিকা বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করছেন কানাডায়।
তার অসংখ্য গান এখনও শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখে। তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ বলিউডের দিকপাল সঙ্গীতশিল্পীরা। আর কল্পনা লাজমি শোক জানিয়ে বলেছেন, ‘তিনি ছিলেন অসাধারণ। ভারত আর একটা ভূপেন হাজারিকা কখনোই পাবে না।’
বাংলাদেশের খ্যাতিমান গীতিকার গাজী মাযহারুল আনোয়ার বলেন, ভূপেন হাজারিকা ছিলেন শিক্ষিত শিল্পী। তার চর্চা ছিল। আর চর্চা, সাধনা ও যোগ্যতার কারণে তিনি শুদ্ধ শিল্পী হতে পেরেছেন। পণ্ডিততুল্য এই সঙ্গীতগুরু অন্যদের চেয়ে একটু ব্যতিক্রম ছিলেন। তাকে বাংলাদেশ ও ভারতের মানুষের পাশাপাশি হিন্দি ভাষাভাষী জনগণও মনে রাখবে।
তার গান মানুষকে উদ্দীপ্ত করেছে - প্রধানমন্ত্রী : বিডিনিউজ জানায়, ভূপেন হাজারিকার গান মানুষকে উদ্দীপ্ত করেছে। প্রখ্যাত এই শিল্পীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে একথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ একথা জানিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই শিল্পীর সঙ্গীত স্বাধীনতাকামী জনগণকে যে আশা জুগিয়েছিল, তা চিরস্মরণীয় থাকার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ভূপেন হাজারিকার গণসঙ্গীত বিভিন্ন সময়ে মানুষের মনে উদ্দীপনা জুগিয়েছে। তিনি ভূপেন হাজারিকার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতিও সমবেদনা প্রকাশ করেন।
ভূপেন হাজারিকার প্রয়াণে খালেদা জিয়ার শোক : উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ও সুরকার ভূপেন হাজারিকার প্রয়াণে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন, জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। গতকাল এক শোকবার্তায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, গণমানুষের শিল্পী ভূপেন হাজারিকার মৃত্যুতে উপমহাদেশে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সঙ্গীতাঙ্গনে তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।
খালেদা জিয়া বলেন, বাংলাভাষাসহ উপমহাদেশের অন্যান্য ভাষায়ও গান গেয়ে এ অঞ্চলের মানুষের মনে চিরজাগরূক থাকবেন এ শিল্পী। বাংলাদেশের প্রখ্যাত গীতিকার ও বিএনপির সাবেক সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক মরহুম লোকমান হোসেন ফকিরের লেখা একটি জীবনধর্মী গান ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠে সুরের মূর্ছনায় বাংলাভাষী মানুষকে আজও মুগ্ধ করে রেখেছে। গানটি হলো— ‘আমায় একটি সাদা মানুষ দাও যার রক্ত সাদা, আমারে একটি কালো মানুষ দাও, যার রক্ত কালো।’ সমাজে যতদিন অত্যাচার, অবিচার, শোষণ-নিপীড়নের অস্তিত্ব থাকবে ততদিন তা প্রতিরোধে অসহায় নিপীড়িত মানুষকে প্রেরণা জোগাবে ভূপেন হাজারিকার অবিনাশী গান। অমর এই শিল্পীর পরলোকগমনে উপমহাদেশের সঙ্গীতজগতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হলো, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়।
No comments