কোনো আসামিকে খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ-প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন মন্ত্রী রাজু by শাহেদ চৌধুরী ও প্রীতিরঞ্জন সাহা

পাঁচ দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরও নরসিংদী পৌরসভার মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। এ নিয়ে জনমনে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।পুলিশের দাবি, তারা খুনিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছে। এ জন্য চিরুনি অভিযান চালানোরও পরিকল্পনা রয়েছে। তবে লোকমান হোসেনের ঘনিষ্ঠ নরসিংদী সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি ও ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি এসএম কাইয়ুমসহ লোকমান পরিবারের সদস্যরা আসামিদের গ্রেফতারে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন। তাদের মতে, প্রশাসন ভালোই জানে আসামিরা কে কোথায় আছে।


প্রভাবশালীদের চাপে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করছে না।এদিকে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু গতকাল শনিবার গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছেন। এ সময় নরসিংদী-১ আসনের সাংসদ লে. কর্নেল (অব.) নজরুল ইসলাম হিরু বীরপ্রতীক, নরসিংদী-২ আসনের সাংসদ ডা. আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলীপ ও নরসিংদী-৩ আসনের সাংসদ জহিরুল হক ভূঁইয়া মোহন উপস্থিত ছিলেন। নরসিংদী-৪ আসনের সাংসদ অ্যাডভোকেট নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না।
নরসিংদী পৌরসভার মেয়র লোকমান হোসেন ১ নভেম্বর নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের অস্থায়ী কার্যালয়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হওয়ার সময় বিদেশে ছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু। তিনি শুক্রবার রাতে দেশে ফিরেছেন।
ঈদুল আজহার ছুটিতে তার নরসিংদী যাওয়ার কথা রয়েছে। ঈদের পর তিনি সংবাদ সম্মেলন করবেন। লোকমান হোসেন হত্যা মামলায় তার ছোট ভাই সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুকে এক নম্বর আসামি করা হয়েছে। শনিবার সংবাদপত্রে পাঠানো এক বিবৃতির মাধ্যমে সালাহউদ্দিন মেয়র লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন বলে দাবি করেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া নরসিংদীর তিন সাংসদের দু'জন সমকালকে জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আলহাজ লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত চেয়েছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, 'আপনি মেয়র লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জেনেছেন। আমার সম্পর্কেও সব কিছু জানেন আপনি। এ অবস্থায় আপনি যা বলবেন, তাই হবে।' প্রধানমন্ত্রী অবশ্য এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি মেয়র লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
নরসিংদীর তিন সাংসদ লে. কর্নেল (অব.) নজরুল ইসলাম হিরু বীরপ্রতীক, ডা. আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলীপ ও জহিরুল হক ভূঁইয়া মোহন এর আগে ২ নভেম্বর লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডের পর গোটা পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ বৈঠক প্রসঙ্গে লে. কর্নেল (অব.) নজরুল ইসলাম হিরু বীরপ্রতীক ও জহিরুল হক ভূঁইয়া মোহন বৃহস্পতিবার লোকমান হোসেন হত্যার প্রতিবাদে নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ সমাবেশে বলেছিলেন, নরসিংদী জেলার সাংসদরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করছেন। এ বৈঠকে খুনিদের গ্রেফতার ও শাস্তি দেওয়ার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।
আসামি গ্রেফতারে গড়িমসি : এ হত্যা মামলায় এজাহারভুক্ত ১৪ আসামির মধ্যে ১১ জনই স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। স্থানীয় বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন জেলা আওয়ামী লীগের অস্থায়ী কার্যালয়ে গুলিতে নিহত মেয়র লোকমান হোসেনের পরিবার, জেলা আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও সাধারণ নাগরিকরা বলেছেন, কর্তৃপক্ষের এক ধরনের অনীহার কারণে লোকমান হোসেন হত্যা মামলার সুষ্ঠু তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিশেষ করে হত্যাকা ের পর মামলা দায়েরের একদিনের মাথায়ও কোনো আসামি গ্রেফতার না হওয়ায় এবং স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনে আকস্মিক রদবদলের কারণে তাদের এ আশঙ্কা আরও ঘনীভূত হয়েছে। এ অবস্থায় অনেকেই মনে করছেন আসামি গ্রেফতারে গড়িমসি করা হচ্ছে।
লোকমান হোসেন হত্যা মামলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা শাখার পরিদর্শক মামুনুর রশিদ মণ্ডল জানিয়েছেন, মামলার দায়িত্ব বুঝে পাওয়ার পর থেকেই আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। এ ব্যাপারে গোয়েন্দা ও থানা পুলিশের পাঁচটি টিম গঠন করা হয়েছে। টিমগুলো ইতিমধ্যে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আসামিদের ধরতে অভিযান শুরু করেছে। আসামিরা কে কোন দলের সেটা বিবেচনায় আনা হচ্ছে না। আসামিদের গ্রেফতারে কোথায় অভিযান চালানো হয়েছে জানতে চাইলে মামুনুর রশিদ মণ্ডলের উত্তর ছিল এ রকমের_ 'গোপনীয়তার স্বার্থে অভিযানের স্থান বলা যাবে না।'
ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল খুনিদের সোর্স : লোকমান হত্যা মামলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তদন্ত করলেও র‌্যাবও জড়িতদের শনাক্তে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখা সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার সময় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন খুনিদের মোবাইল ফোনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করে। সে ব্যক্তি ঘটনাস্থলে লোকমানের উপস্থিতি নিশ্চিত করার পরপরই সেখানে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। তবে সেই তথ্যদাতাকে এখনও শনাক্ত করতে পারেনি র‌্যাব। মোবাইল ফোন প্রযুক্তির সাহায্যে তাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি পেশাদার খুনিদের হাতেই লোকমান খুন হন_ এতে নিশ্চিত হয়েছে র‌্যাব। তাদের সম্পর্কে প্রয়োজনীয় অনেক তথ্যই মিলেছে। শিগগিরই তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্ট র‌্যাব কর্মকর্তারা।
লোকমান পরিবারের ক্ষোভ : লোকমান হোসেন পরিবারের একাধিক সদস্য বলেছেন, একজন জনপ্রিয় মেয়র খুন হলেন। তিনি সরকারি দলেরও নেতা। অথচ হত্যাকাণ্ডের পাঁচ দিন পেরিয়ে গেলেও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কোনো ব্যক্তি তাদের পরিবারকে সান্ত্বনা জানাতে আসেননি। এমনকি দায়িত্বশীলদের কেউ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থলও পরিদর্শন করেননি।
পুলিশ প্রশাসনে রদবদল : মেয়র লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডসহ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির জন্য পুলিশ সুপার ড. আক্কাছ উদ্দিন ভূঁইয়া ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এনামুল কবিরকে পুলিশ সদর দফতরে ক্লোজ করা হয়েছে। অপর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিজয় বসাককে ফরিদপুরে বদলি করা হয়েছে। নরসিংদীর পুলিশ সুপারের চলতি দায়িত্বে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুব্রত কুমার হালদারকে। তিনি শনিবার রাতে যোগদান করেছেন।
এদিকে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনে রদবদলের ঘটনায় লোকমান হোসেন হত্যা মামলার তদন্ত কাজে ভাটা পড়ার আশঙ্কা করছেন অনেকেই। জেলার তিন পুলিশ কর্মকর্তা প্রত্যাহারের কারণে মামলার তদন্ত কাজে কোনো বিঘ্ন ঘটবে না বলে জানিয়েছেন পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আসাদুজ্জামান মিয়া। তিনি পুলিশ কর্মকর্তার রদবদল প্রসঙ্গে বলেছেন, হেডকোয়ার্টার্স মনে করেছে তাদের প্রত্যাহার করা প্রয়োজন, তাই প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে মামলার তদন্ত দ্রুত এগিয়ে চলছে। এ নিয়ে কোনো ধরনের গাফিলতি হচ্ছে না।
থামেনি শোকের মাতম : মেয়র লোকমান হোসেনের বাড়িতে শোকের মাতম এখনও কাটেনি। পবিত্র ঈদুল আজহার দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শোকতাপ বেড়ে চলছে। পুরনো স্মৃতি মনে আসায় বিলাপ করে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মেয়র লোকমান হোসেনের স্ত্রী তামান্না বুগলি ও বয়োবৃদ্ধ মা মাজেদা বেগম।
লোকমান হোসেনের ছোট ভাই ও নরসিংদী সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি শামীম নেওয়াজ বলেছেন, 'গেল ঈদুল ফিতরের দিনগুলোর কথা বারবার মনে পড়ছে। নরসিংদী পৌরবাসীর মতো লোকমান হোসেন আমাদেরও নির্ভরশীল অভিভাবক ছিলেন। সেই অভিভাবকের শূন্যতা নরসিংদী পৌরবাসীর মতো আমরাও অনুভব করছি।'
সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুর বিবৃতি
মন্ত্রীর ভাই সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু এক বিবৃতিতে মেয়র লোকমান হোসেনকে হত্যার তীব্র নিন্দা, প্রতিবাদ, খুনিদের শাস্তি ও ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ খুলে দেওয়ার দাবি করে বলেছেন, এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাকে জড়িয়ে ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, 'লোকমান হোসেন হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে আমি কোনোভাবেই জড়িত নই। আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে লোকমান হোসেনের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হওয়া দূরে থাক, আমি আনন্দিত ও গর্বিত বোধ করতাম। লোকমানের সঙ্গে আসন্ন জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিল নির্বাচনে আমি সেক্রেটারি জেনারেলের পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দূরে থাক, এ রকম কোনো ইচ্ছাও প্রকাশ করিনি। লোকমান হোসেনের সঙ্গে এ বিষয়ে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের গল্প সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসূত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।'
সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু আরও বলেছেন, একটি নির্মম হত্যাকাণ্ডকে পুঁজি করে প্রকৃত খুনিদের আড়াল করতে আমাকে এবং আরও অনেক নেতাকর্মীকে জড়িয়ে একটি ষড়যন্ত্রমূলক মামলা করা হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা। এটি আওয়ামী লীগের স্থানীয় সাংগঠনিক শক্তির বিরুদ্ধে একটি আক্রমণ। একটি শোকসন্তপ্ত পরিবারের সেন্টিমেন্টকে ব্যবহার করে একটি বিশেষ মহল ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করে যাচ্ছে। দেশব্যাপী যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে, তখন এ ধরনের আক্রমণের একটাই উদ্দেশ্য হতে পারে। সেটা হচ্ছে, দেশের মূল রাজনৈতিক ইস্যু থেকে মানুষের চোখ সরিয়ে নেওয়া। তিনি লোকমান হোসেনের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা ও তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন।
ছাত্রদলের প্রতিবাদ সভা : বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ও নরসিংদী জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবীর খোকনের নিঃশর্ত মুক্তি ও পৌর মেয়র লোকমান হোসেনের হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে জেলা ছাত্রদল গতকাল শনিবার শহরের জেলখানা মোড়ে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। জেলা ছাত্রদল সভাপতি নজরুল ইসলাম ভূঁইয়ার সভাপতিত্বে প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা, সাবেক সাংসদ রোকেয়া আহমেদ লাকী, জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি সুলতান উদ্দিন মোল্লা, মীর ফজলুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মাস্টার, গোলাম কবির কামাল, হারুন-অর-রশিদ হারুন, দীন মোহাম্মদ দীপু ও সমীর ভূঁইয়া। বক্তারা খায়রুল কবীর খোকনকে রাজনৈতিক কারণে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন।

 

No comments

Powered by Blogger.