জমজমাট পশুর হাট দাম কিছুটা কম-রাজধানীতে গাবতলীর স্থায়ী হাটসহ ২১টি কোরবানির পশুর হাট বসেছে by আলতাব হোসেন ও সোহেল মামুন

কদিন বাদেই ঈদ। পছন্দ করে কোরবানির পশু কিনতে হাটে হাটে ক্রেতাদের ভিড়। একই পরিবারের কয়েকজন করে সদস্য দল বেঁধে যাচ্ছেন হাটে। ঘুরে ঘুরে বাজেটের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পছন্দ করছেন কোরবানির পশু। দামে হয়ে গেলেই পশুর রশি ধরে ছুটছেন বাড়ির পানে। এ যেন ধর্মপ্রাণ মানুষের অন্যরকম এক আনন্দ।শেষ মুহূর্তে এসে জমজমাট হয়ে উঠেছে কোরবানির পশুর হাট। ঈদের সময় ঘনিয়ে আসায় ক্রেতাসাধারণ দরদাম নিয়ে বেশি ভাবছেন না। বাজেটের কাছাকাছি কিংবা একটু বেশি হলেও কিনে নিচ্ছেন পছন্দের গরু। বিক্রেতারাও দাম হেঁকে আগের মতো বসে নেই। তারাও তাদের টার্গেট অনুযায়ী দাম না পেলেও একটু কমেই গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন।


এ বছর রাজধানীতে গাবতলীর স্থায়ী হাটসহ ২১টি কোরবানির পশুর হাট বসেছে। এর মধ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) তত্ত্বাবধানে ১৫টি হাট ও ঢাকা জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে ৬টি হাট পরিচালিত হচ্ছে। এসব হাটে ঈদের দিন দুপুরের আগ পর্যন্ত চলবে কেনাবেচা। দেশের বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরগুলোর কোরবানির পশুর হাটগুলো শেষ মুহূর্তে এসে ব্যাপক জমজমাট হয়ে উঠেছে। ঈদের আগমুহূর্তে গতকাল রাজধানীর ধানমণ্ডি, বারিধারার মতো অভিজাত এলাকাসহ অলি-গলিতেও গরু-ছাগল নিয়ে বসে যান পাইকাররা। এ ছাড়া রয়েছে বেশ কয়েকটি অবৈধ হাট। আর যারা কিনে এনেছেন তারাও বাড়ির সামনে বেঁধে রেখেছেন পছন্দের পশুটি। সারাদেশে এখন আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু কোরবানির পশুকে ঘিরে। তুলনামূলক এবার গরুর দাম কিছুটা কম।
সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর কোরবানির পশুর হাটগুলোতে গতকাল শনিবার ছিল উপচেপড়া ভিড়। বিশেষ করে গাবতলী, আরমানিটোলা, আগারগাঁও, তালতলা, ব্রাদার্স ইউনিয়ন সংলগ্ন বালুর মাঠ ও মেরাদিয়া মাঠের মতো বড় হাটগুলোতে সকাল থেকেই কোরবানির পশু বিক্রি শুরু হয়। বেশির ভাগ হাটেই দেশি ষাঁড় গরুর চাহিদা ছিল বেশি। হাটে উঠেছে পর্যাপ্ত সংখ্যক ছাগল, ভেড়া ও মহিষ। এসব পশুর মধ্যে ছাগল বিক্রি হচ্ছে বেশি। গাবতলী হাটে গতকাল পাঁচটি উট দেখা গেছে। বিকেলে
বিক্রি হয়ে যায় একটি উট। গতকাল গভীর রাত পর্যন্ত চলে পশু বিক্রি। আজও ভোর থেকেই শুরু হবে কেনাবেচা। গাবতলী হাটের পরিচালক সোহেল সমকালকে বলেন, হাট এখন বেশ জমজমাট। বেচাকেনাও ভালো। তবে গত বছরের অর্ধেক পশুও এখন পর্যন্ত (শনিবার ২টা) বিক্রি হয়নি। তিনি আশা করেন, রোববার বিক্রি আরও অনেক বাড়বে।
গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন হাটে ছোট থেকে মাঝারি আকারের একেকটি গরু বিক্রি হয়েছে ৪০ থেকে ৬০ হাজার টাকায়। বড় আকারের গরু ৬০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা মূল্যে বেশ কিছু গরু বিক্রি হয়েছে গতকাল। তবে বড় গরুর চাহিদা এবার কম। এ হাটে গরুর দাম শুরু ২০ হাজার টাকা থেকে। ভুট্টু বেপারী একটি গরুর দাম ১৮ লাখ টাকা হাঁকেন শুক্রবার। শনিবার পর্যন্ত এ গরুটিই ছিল সবচেয়ে বড় আকৃতির গরু।
এ বছর ছোট থেকে মাঝারি আকারের ছাগলের দাম ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা। মাঝারি থেকে বড় ছাগলের দাম ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। গাবতলী হাটে ফরিদপুরের বাবলু বেপারী গতকাল একটি ছাগলের দাম হাঁকেন ১ লাখ টাকা। এটি হাটের সবচেয়ে বড় ছাগল। আনোয়ার মণ্ডল বেপারীর উটগুলো হাটের ক্রেতাদের মন কেড়েছে। সবচেয়ে বড় উটটির দাম চাওয়া হয়েছে ১২ লাখ টাকা।
হাটের পরিচালক ও পাইকারদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, গতকাল সকাল থেকে গরুর হাটে উপচে পড়া ভিড় শুরু হয়। সেই সঙ্গে বেড়ে যায় গরু ও ছাগল বিক্রি। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দামও বাড়তে থাকে। গাবতলী হাটের কামাল বেপারী জানান, সকালে দাম স্বাভাবিকই ছিল। তবে বিকেলে দাম বেড়ে যায়। গরুর চাহিদা বেশি দেখে পাইকাররা ট্রাকে করে আরও গরু আনার উদ্যোগ নিয়েছেন। গাবতলী হাটের পাইকার সমিতির সাধারণ সম্পাদক বাদল হোসেন জানালেন, গতকাল সন্ধ্যা থেকে আজ বিকেল পর্যন্ত হাটে গরু আনবেন পাইকাররা। হঠাৎ ভারতীয় গরু আনা সহজ হয়ে যাওয়ায় ঝাঁকে ঝাঁকে ভারতীয় গরু হাটে তুলছেন পাইকাররা। এ পরিস্থিতিতে আজ রোববার গরুর দাম কমে যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
গাবতলী হাট :ঘরমুখী মানুষের বাসের জন্য প্রতীক্ষা, বাস এলে ছোটাছুটি করে বাসে ওঠা আর কোরবানির পশু হাটে আনা-নেওয়া ইত্যাদি মিলেয়ে গাবতলী রাজধানীর সবচেয়ে ব্যস্ত এলাকায় পরিণত হয়েছে। হাটের প্রধান গেটও এখন কোরবানির গরুর দখলে। মূল হাট ছাড়িয়ে বালুর মাঠ ও বেড়িবাঁধ এলাকার এক কিলোমিটার রাস্তায় বসেছে কোরবানির পশুর হাট। ফলে গাবতলীর বিস্তীর্ণ এলাকা এখন কোরবানির পশুর বাজার। গতকাল হাটে গিয়ে দেখা গেছে, দেশি ষাঁড় গরু ক্রেতাদের প্রথম পছন্দ। ধানমণ্ডি থেকে গতকাল গাবতলী হাটে আসেন ব্যবসায়ী সাইফুল ও তার ভাগ্নে আরমান। তারা জানালেন, এক জোড়া গরু পছন্দ করেছেন। তবে দামে বনছে না। মাঝারি আকারের গরু দুটি ১ লাখ ২০ হাজার টাকা বললেও বিক্রি করতে রাজি হননি আওলাদ। তিনি সর্বশেষ দেড় লাখ টাকা দিলে গরু দুটি বিক্রি করবেন বলে জানিয়ে দেন। কয়েক ক্রেতা জানান, সকালের দিকে অনেকে কম দামে গরু নিয়ে গেছেন। দুপুরের পর মানুষের ভিড় দেখে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন পাইকাররা। লাল রঙের দুটি গরু দামাদামি করেন তারা। গাবতলী হাটের চার নম্বর কাউন্টারের হাসিল গ্রহীতা আব্বাস জানালেন, ৪০ থেকে ৬০ হাজার টাকা দামের গরু বেশি বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতারা বেশি কিনছেন ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা দামের খাসি।
গাবতলী হাটের ভিটির পাশে বসেছে ছাগল ও ভেড়ার হাট। হাটের ভিতরে পাইকার সমিতির অফিসের সামনে জায়গাটুকু মহিষের দখলে। দেশের সবচেয়ে বড় ছাগলটি রয়েছে গাবতলী হাটেই। ছাগলটির মালিক বাবুল বেপারী জানালেন, তিনটি ছাগল এনেছেন তিনি। একটির দাম ১ লাখ টাকা। অন্য দুটি যথাক্রমে ৬০ ও ৫০ হাজার টাকা।
ব্রাদার্স ইউনিয়ন সংলগ্ন বালুর মাঠ :রাজধানীর কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে টিটি রেল ক্রসিং পর্যন্ত প্রধান রাস্তায়ও বসেছে কোরবানির পশুর হাট। রেল স্টেশন থেকে প্রায় এক কিলোমিটার এগিয়ে গেলে চোখে পড়বে বালুর মাঠ কোরবানির পশুর হাটের গেট। এ হাটে গতকাল ক্রেতাদের ভিড়ে তিল ধারণেই ঠাঁই ছিল না। পাইকাররা জানান, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এ হাটে কোনো পশু বিক্রি হয়নি। শুক্রবার সকালেও ছিল একই অবস্থা। এতে পাইকারা হতাশ হয়ে গিয়েছিলেন। তবে শুক্রবার বিকেলে তাদের আশার সঞ্চার হয়। শনিবার সকাল থেকে ক্রেতাদের ভিড়ে বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে বাড়ে বেচাকেনাও।
মেরাদিয়া ও কাকলী-বনানী মাঠ :রামপুরা ব্রিজ থেকে বনশ্রী এলাকার শেষ প্রান্তে মেরাদিয়া বাজার ও রামপুরা খালের দু'পাশে বসেছে কোরবানির পশুর বিশাল হাট। তবে হাটের ভিতরে অভিজাত বাসাবাড়ি থাকায় এ হাটে স্থানীয় লোকজন ও পাইকার উভয়েই অসুবিধায় পড়েছেন। এসব সমস্যা অতিক্রম করে গতকাল জমে ওঠে মেরাদিয়া বাজার পশুর হাট। এ হাটে গতকাল পাইকাররা আশানুরূপ সাড়া পাননি। ফলে হাট জমলেও বিক্রি কিছুটা কম।
আরমানিটোলা পশুর হাট :ডিসিসি থেকে ইজারা নেওয়া সীমানা মানছেন না আরমানিটোলা পশুর হাটের ইজারাদাররা। পুলিশ প্রশাসনের সামনেই তারা অবৈধভাবে রাস্তা ও গলিপথ দখল করে কোরবানির পশুর হাট বসিয়েছেন। আরমানিটোলা পশুর হাটের ১ নম্বর কাউন্টারের বাম পাশে ভিড় করে আছেন উৎসুক অনেক মানুষ। সবার দৃষ্টি পাবনা থেকে আনা বিশাল দেহের একটি গরুর প্রতি। সাদা-কালো রঙের মিশ্রণে এই গরুটির দাম হাঁকা হয়েছে ১৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। এর পাশে প্রায় একই ধরন ও গড়নের দুটি গরু রাখা হয়েছে। দাম হাঁকা হয়েছে ১২ ও ১০ লাখ টাকা। গরুগুলোর মালিক সালাউদ্দিন জানান, তিনি দোহারে থাকেন। প্রতি বছরই এ হাটে গুরু নিয়ে আসেন বিক্রি করার জন্য। এবার পাবনা থেকে মোট ৪০টি গরু এনেছেন। তার কাছে থাকা গরুর সর্বনিম্ন মূল্য ৩২ হাজার টাকা। ১৪ লাখ ২০ হাজার টাকা দাম হাঁকানো গরুটি ক্রেতারা এ পর্যন্ত সাড়ে ৬ লাখ টাকা বলেছেন বলে তিনি জানান।
শেষ মুহূর্তের কেনাকাটায় জমজমাট চট্টগ্রাম
চট্টগ্রাম ব্যুরো :এবার চট্টগ্রাম নগরীতে সিটি করপোরেশনের সাতটি পশুর হাট রয়েছে। এর সঙ্গে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষেরও রয়েছে দু'টি পশুর হাট। এ ছাড়াও কোরবানির ঈদ উপলক্ষে নগরীর অলি-গলিতে গড়ে উঠেছে আরও ৬৪টি অস্থায়ী পশুর হাট। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় পশুর হাট হচ্ছে সাগরিকা গরুর বাজার। চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বৃহত্তম পশুর হাট হচ্ছে বিবিরহাট গরুর বাজার। এ দুটি বাজারসহ নগরীর অলি-গলির পশুর হাটগুলোতে দেশি-বিদেশি গরুর সমাগম ঘটেছে। এবার এমনিতেই দেশি গরুতে সয়লাব চট্টগ্রামের পশুর হাট। এর মধ্যে ভারতীয় ও মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে প্রচুর গরু এসেছে চট্টগ্রামে। সেই সঙ্গে ভারত, মিয়ানমার, নেপাল ও পাকিস্তান থেকেও গরু আমদানি করা হয়েছে। এর পাশাপাশি যশোর, কুষ্টিয়া, মাগুরা, পাবনা, রংপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, বগুড়া, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে চট্টগ্রামের পশুর হাটগুলোতে বিক্রির জন্য প্রচুর গরু আনা হয়েছে। এ কারণে সর্বনিম্ন ২০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ সাত লাখ টাকার গরুও পাওয়া যাচ্ছে বন্দর নগরীর পশুর হাটগুলোতে।
গরুর দাম চড়া, কমেছে ছাগলের
রাজশাহী ব্যুরো :রাজশাহী মহানগরীর সিটি বাইপাস হাটে গরু কিনতে আসা নগরীর আমবাগান এলাকার ইসমাইল হোসেন বলেন, 'ভাই, গত কয়েক দিনে তিনটা হাট ঘুরেছি শুধু দাম যাচাইয়ের জন্য। এখন তো আর সময় নেই। হাতে মাত্র একদিন। গরু না কিনে আর কোনো উপায় নেই। একটু দাম বেশি তবু গরু কিনতেই হবে।'
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত হাট ঘুরে অনেকে জানিয়েছেন, দাম কিছুটা হলেও বেশি। কোরবানির ঈদের শেষ মুহূর্তে জমে উঠেছে কোরবানির হাট। প্রথমদিকে কোরবানির হাটে গরুর দাম কিছুটা কম থাকলেও সময় যত কাছে আসছে তত বেশি বাজার গরম হয়ে উঠছে। গতকাল নগরীর সিটি বাইপাস হাট ও নওহাটায় গরুর দাম চড়া ছিল।
খুলনায় কোরবানির পশুর হাটে উপচে পড়া ভিড়
খুলনা ব্যুরো : ঈদুল আজহার আগে শেষ সময়ে খুলনা মহানগরী ও জেলার ২৪টি কোরবানির পশুর হাট জমজমাট হয়ে উঠেছে। গতকাল শনিবার হাটগুলোতে ছিল উপচে পড়া ভিড়। নগরীর জোড়াগেট পাইকারি কাঁচাবাজারে সিটি করপোরেশনের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় গত ৩১ অক্টোবর থেকে কোরবানির পশুর হাট শুরু হয়। গতকাল শনিবার হাটে ছিল ব্যাপক ভিড়। খুলনার সর্ববৃহৎ এই হাটে বিভিন্ন উপজেলার পাশাপাশি অন্যান্য জেলা থেকেও গরু এসেছে।

No comments

Powered by Blogger.