দুঃসাহসিক অভিযান by মাসুম মিজান

'গাজীপুরের গহিন জঙ্গলে লুকিয়ে রাখা হয়েছে গোলা-বারুদের বিশাল একটি চালান।' নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ তথ্য জানতে পারে র‌্যাব সদর দফতর। বিশাল বনের কোথায় গোলা-বারুদগুলো লুকানো তা সুনির্দিষ্টভাবে জানানো যায়নি। তাই অভিযানিক দলের সঙ্গে যুক্ত করা হয় র‌্যাব ডগ স্কোয়াড। নিয়ে যাওয়া হয় তুফান, সম্রাট, হান্টার ও রানী নামের চারটি অস্ত্র বিশেষজ্ঞ কুকুরকে।


ল্যাবরেটর প্রজাতির কুকুর তুফানের হ্যান্ডলার মিজানুর রহমান জানান, গত ২৭ জুলাই রাত ১টায় গোলাবারুদ উদ্ধারের জন্য গাজীপুর-কালিয়াকৈরের গভীর জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হয় কুকুর চারটি। ভোর ৪টা পর্যন্ত চলে তল্লাশি। এ সময়ের মধ্যে গুলিভর্তি তিনটি বস্তা ও এক ট্রাঙ্ক বিস্ফোরক দ্রব্য খুঁজে বের করে কুকুরগুলো। প্রতিটি ক্ষেত্রেই যন্ত্রের চেয়ে কুকুরগুলো অধিক কর্মক্ষমতা প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়। একইভাবে ডগ স্কোয়াডের মাদক বিশেষজ্ঞ কুকুর বুটি গত ৩
জুলাই পোস্তগোলা ব্রিজের ওপর থেকে নিজের চেষ্টায় ইয়াবার বড় একটি চালান বাস থেকে খুঁজে বের করে।
র‌্যাব হেড কোয়ার্টার্স জানায়, ঢাকা মহানগর পুলিশের জন্য ১৯৯৮ সালে ব্রিটেন থেকে ২৫টি প্রশিক্ষিত কুকুর আনা হয়। প্রাণিগুলোর আবাসন ব্যবস্থা করা হয় মিরপুর ১৪ নম্বর পুলিশ ব্যারাকের মধ্যে। সে সময় ব্রিটেনের চার ভেটেরিনারি ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এসে ডিএমপির সংশ্লিষ্ট ইউনিটের সদস্যদের চার মাসের প্রশিক্ষণ দেন। নানা সংকটের কারণে ডগ স্কোয়াড গঠনই যেন ডিএমপির গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, একে একে মারা যেতে থাকে কোটি টাকার প্রশিক্ষিত কুকুরগুলো।
২০০৪ সালের আগস্টে ডগ স্কোয়াডের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) হাতে। বর্তমানে র‌্যাবের ডগ স্কোয়াডে কুকুরের সংখ্যা ৭৪টি। এই কুকুরগুলোর মধ্যে ৩৯টি পুরুষ ও ৩৫টি মহিলা। এসব কুকুরের মধ্যে কয়েকটি প্রতি বছর বাচ্চা প্রসব করছে। নবাগত কুকুর ছানাগুলো দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে একেকটি নতুন দল। জার্মান শেফার্ড প্রজাতির ৮টি কুকুর প্রাপ্তবয়স্ক। আরও ৯টি বাচ্চাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ল্যাবরেটর প্রজাতির ৪৫টি কুকুর প্রশিক্ষিত এবং আরও ১২টি বাচ্চার প্রশিক্ষণ চলছে।
র‌্যাব ডগ স্কোয়াডে কর্মরত পশু চিকিৎসক ডা. মোঃ আফাজ উদ্দিন সমকালকে জানান, বিদেশ থেকে আনা কুকুরগুলো বাংলাদেশের আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খেতে পারেনি। পাশাপাশি ওদের পরিচর্যা ও পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষিত জনবল ছিল না আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীতে। ওই বিদেশি কুকুরগুলো বেশকিছু বাচ্চা প্রসব করেছিল। এদেশে জন্মানোর ফলে সে বাচ্চাগুলো আবহাওয়া ও পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করে।
ছয় মাস বয়স থেকে প্রতিটি বাচ্চা কুকুরকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়। এর পর থেকে ৮ বছর পর্যন্ত কুকুরগুলোকে কর্মক্ষম বিবেচনা করা হয়। র‌্যাব ডগ স্কোয়াডের কুকুরগুলোর গড় আয়ু ১০ বছর। প্রতিটি কুকুরের জন্য একজন করে কনস্টেবল হ্যান্ডলার হিসেবে কাজ করেন। তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ কুকুরের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলেন। খাওয়া, গোসল, প্রশিক্ষণ ও কর্মক্ষেত্রে নির্ধারিত হ্যান্ডলার কুকুরগুলোর পরিচর্যা ও পরিচালনার কাজে নিয়োজিত থাকেন। তাদের নির্দেশ ছাড়া কুকুরগুলো অন্য কারও পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তাই হ্যান্ডলারদেরও দীর্ঘ প্রশিক্ষণের দরকার হয়। প্রশিক্ষিত কুকুরগুলোর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন পারদর্শিতা।
র‌্যাব স্কোয়াডের প্রধান ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, প্রবল ঘ্রাণ, শ্রবণশক্তি ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কুকুর এমন কিছু কাজ করতে পারে, যা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। উন্নত বিশ্বে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর রুটিন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয় কুকুরের ব্যবহার। মনিবভক্ত কুকুর নিজের জীবনকে বিসর্জন দিতেও ভয় পায় না।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু রুটিন ওয়ার্ক পরিচালনার জন্য ডগ স্কোয়াডের উপস্থিতি অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিডিআর বিদ্রোহের মতো ঘটনাস্থল থেকেও এই প্রাণীগুলো উদ্ধার করেছে বেশকিছু মারণাস্ত্র। অস্ত্র-মাদকবিরোধী অভিযান, চেকপোস্টে দায়িত্ব পালন ও অপরাধী ধরার কাজেও পেশাদার হয়ে উঠেছে প্রাণীগুলো। এ ছাড়া ভিভিআইপি, ভিআইপি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আয়োজনে ডগ স্কোয়াডের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক মনে করা হচ্ছে।
র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংপ্রধান কমান্ডার এম সোহায়েল সমকালকে বলেন, পর্যায়ক্রমে ডগ স্কোয়াডের পরিধি বাড়ছে।

No comments

Powered by Blogger.