চার মিনিটে বিল পাস-উত্তর-দক্ষিণে খণ্ডিত হলো ঢাকা নগরী

শেষ পর্যন্ত পাস হয়ে গেল ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করতে সংসদে আনীত স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) সংশোধন বিল-২০১১। দ্বিখণ্ডিত হলো ঢাকা সিটি করপোরেশন। মাত্র চার মিনিটেই গতকাল মঙ্গলবার সংসদ অধিবেশনে বিলটি পাস হয়। বিলটি পাসের মাধ্যমে ডিসিসি বিলুপ্ত হয়ে 'ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন' ও 'ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন' নামে দুটি আলাদা করপোরেশনে উন্নীত হলো। আর পদ হারালেন ৯ বছর ধরে মেয়রের


পদে থাকা বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা ও ডিসিসির বর্তমান কাউন্সিলররা। আগামী তিন মাসের মধ্যে এ দুটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হবে।স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদেরসভাপতিত্বে শুরু হওয়া সংসদ অধিবেশনে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বিলটি উত্থাপন করেন। বিরোধী দলের ১১ জন, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদের মইনুদ্দীন খান বাদল, শাহ জিকরুল আহমেদ ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ফজলুল আজিম বিলের ওপর জনমত যাচাই-বাছাই ও সংশোধনী আনলেও তাঁদের অনুপস্থিতির কারণে তা নাকচ হয়ে যায়। পরে কণ্ঠভোটে বিলটি পাস হয়। এ সময় টেবিল চাপড়ে উপস্থিত সদস্যরা অভিনন্দন জানান।
পাস করা বিলে মেয়াদ শেষে সব সিটি করপোরেশনে প্রশাসক নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে ২০০৯ সালের আইনে বিদ্যমান ৬ অনুচ্ছেদে সংশোধনী এনে নির্বাচিত প্রতিনিধি না হওয়া পর্যন্ত মেয়রের দায়িত্ব পালনের বিধান বাতিল করা হয়েছে। সিটি করপোরেশন বিভক্তির পরবর্তী ৯০ দিন অর্থাৎ আগামী তিন মাসের মধ্যে ওই দুটি করপোরেশনের নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে।

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বিলটি পাসের আগে বলেন, 'বিএনপির সংসদ সদস্যরা সংশোধনী এনেছেন, তা উপস্থাপিত হলে একটি ভালো বিতর্ক হতে পারত। সিটি করপোরেশন বিল নিয়ে যেসব কথাবার্তা হচ্ছে, গণমাধ্যম ও বিভিন্ন টক শোতে যেসব আলোচনা হয়েছে তার একটি সুস্পষ্ট জবাব দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। তবে সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন না হওয়ায় মন্ত্রী হিসেবে আমার বক্তব্য দেওয়ার রেওয়াজ নেই। তাই কিছু বলতে পারছি না।'
মন্ত্রী আরো বলেন, 'পৃথিবীর কোন কোন দেশে কয়টি সিটি করপোরেশন রয়েছে, কিভাবে ভাগ করা হয়েছে, একটি সিটির মধ্যে দুটি সিটি করপোরেশন কিভাবে কাজ করছে, দায়-দায়িত্ব কী_সে বিষয়ে কথা বলার জন্য ভালো প্রস্তুতি ছিল। তবে সংসদে না বলতে পারলেও সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে জবাব দেওয়ার জন্য আমি প্রস্তুত রয়েছি।' বিলের উদ্দেশ্যসংবলিত বিবৃতিতে তিনি দাবি করেন নাগরিক সেবা সুদৃঢ় এবং যথাযথ মানে উন্নীত করতেই ডিসিসিকে বিভক্তির এই বিল আনা হয়েছে।
দেশের সব সিটি করপোরেশনের জন্য অভিন্ন বিধান করে প্রণীত ২০০৯ সালের স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধন ও কয়েকটি নতুন ধারা সংযোজন করে এই সংশোধনী বিল তৈরি করা হয়। এই সংশোধনের ফলে নির্বাচনকাজে সহায়তার জন্য সেনা মোতায়েনের বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে।
বিলটি গত ৩১ অক্টোবর মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। তার আগে ১৭ অক্টোবরের বৈঠকে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন দেওয়া না দেওয়া নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই হঠাৎ করে সরকার এই সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করার বিলটি মন্ত্রিসভায় নিয়ে আসে।
পাসকৃত বিলে ২৫(১) অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সব সিটি করপোরেশনে মেয়াদ শেষে পছন্দমতো যেকোনো ব্যক্তিকে প্রশাসক নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। নতুন সিটি করপোরেশনে প্রশাসকের মেয়াদ হবে ১৮০ দিন আর পুরনো বা বিভক্ত করা সিটি করপোরেশনে মেয়াদ হবে ৯০ দিন। এ সময়ের মধ্যেই নির্বাচন করতে হবে। বিলে এ বিধানটি সংযুক্তির ফলে প্রশাসক নিয়োগের ৯০ দিনের মধ্যে বিভক্ত হওয়া ঢাকা উত্তর এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করতে হবে। আইনটি পাসের পর গ্রেজেট প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা সিটি করপোরেশন বিলুপ্ত হবে।
বিলে উপযুক্ত কর্মকর্তা নিয়োগের বিধান বহাল রেখে শুধু 'প্রথম শ্রেণী' শব্দটি তুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে যেকোনো সরকারি কর্মকর্তাকেই প্রশাসক নিয়োগ করা যাবে। এ ছাড়া পাস হওয়া বিলে ২০০৯ সালের আইনের ৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয়েছে। ৬ অনুচ্ছেদের 'সিটি করপোরেশনের মেয়াদ শেষ হওয়া সত্ত্বেও উহা পুনর্গঠিত সিটি করপোরেশনের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করিয়া যাইবে' এ অংশটুকু বিলুপ্ত করা হয়েছে। ফলে নির্বাচিত প্রতিনিধির আর পরবর্তী নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সুযোগ থাকল না।
আইনের ২৫(১) অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বলা হয়েছে, 'এ আইনের অধীন কোনো নতুন সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠা করা হলে অথবা বিভক্ত করা হলে অথবা কোনো সিটি করপোরেশন মেয়াদোত্তীর্ণ হলে সরকার, সিটি করপোরেশন গঠিত না হওয়া পর্যন্ত উহার উপযুক্ত কার্যাবলী সম্পাদনের উদ্দেশ্যে, একজন উপযুক্ত ব্যক্তি বা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কর্মকর্তাকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করতে পারবে।' এ অনুচ্ছেদ অনুসারে সব সিটি করপোরেশনেই প্রশাসক নিয়োগের বিধান করা হলেও মেয়াদ ভিন্ন রাখা হয়েছে। আইনের ২৫(৪) অনুচ্ছেদ সংশোধন করে প্রশাসকের মেয়াদ নতুন সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে ১৮০ দিন রাখা হয়েছে। মেয়াদোত্তীর্ণ এবং ভেঙে দেওয়ার সিটি করপোরেশনে প্রশাসকের মেয়াদ রাখা হয়েছে ৯০ দিন।
বিলের উদ্দেশ্য ও কারণসংবলিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বর্তমান ঢাকা সিটি করপোরেশনের জনসংখ্যা এক কোটির ওপর। আয়তন প্রায় ১৫০ বর্গকিলোমিটার। এই বৃহৎ মহানগরীর বিপুল জনসংখ্যার কাছে একটি কেন্দ্র থেকে সেবা প্রদান অত্যন্ত কঠিন। ফলে জনসাধারণের কাঙ্ক্ষিত নাগরিকসেবা পাচ্ছেন না। ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকার রাস্তাঘাট মেরামত, সংরক্ষণ, ভোত অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে বহুবিদ সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। বর্জ্যব্যবস্থাপনা, ড্রেনেজ, জলাবদ্ধতা ইত্যাদির ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের বর্তমান কার্যক্রম আশানুরূপ নয়।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ঢাকা সিটি করপোরেশনের মোট ওয়ার্ড ৯২টি এবং মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৩১টি নিয়ে মোট কাউন্সিলর সংখ্যা ১২৩ জন। নাগরিকসেবা কার্যক্রম আরো সুদৃঢ় ও যথাযথ পর্যায়ে উন্নীত করতে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুটি সিটি করপোরেশনে বিভক্ত করা আবশ্যক। বিবৃতিতে বলা হয়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গঠিত হলে নাগরিক সেবার মান বৃদ্ধি পাবে এবং জনগণের কাছে দ্রুত সেবা পেঁৗছানো, পরিকল্পনা গ্রহণ ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সহজতর হবে।

No comments

Powered by Blogger.