গাড়ির কদর by মোহাম্মদ নূরল হক
সত্তর দশকের শেষ প্রান্তে তদানীন্তন সরকার প্রতি জেলায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) নামে একটি পদ ও প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিল। যতদূর মনে পড়ে, আসাদুজ্জামান নামে এক ভদ্রলোক এই দায়িত্বে ছিলেন। মূল লক্ষ্য ছিল সর্বস্তরে নিরক্ষরতা দূর করা। আমি তখন রাজশাহী টেক্সটাইল মিলে শ্রম ও কল্যাণ বিভাগে একমাত্র কর্মকর্তা এবং বিভাগীয় প্রধান। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) এ প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করার জন্য একটি কমিটি গঠন করলে আমাকেও তাতে সদস্য করা হয়।
প্রথমদিকে এক মিটিংয়ে যাচ্ছি। কালেকটরেটের বারান্দায় পা রেখে ভাবলাম, মহকুমা প্রশাসক সাহেবের সঙ্গে দেখা করে যাই। তিনি আমার পূর্বপরিচিত। নাম আবদুুর রহিম। তার কক্ষে ঢুকতে যাব, আরদালি আমাকে কোনোমতেই ঢুকতে দেবে না। আপনার পরিচয় কী, কোথা থেকে এসেছেন, কী জন্য দেখা করবেন এমন হাজারো প্রশ্ন এবং রুদ্রমূর্তি। আমি তখন ২৫-২৬ বছরের টগবগে তরুণ। গতি সবসময় দুর্বার। কিন্তু সবকিছু ছেয়ে আরদালির রুদ্রমূর্তি আমার দুর্বার তারুণ্যকে সেদিন দারুণ আঘাত করেছিল। শুধু রক্তচক্ষু প্রদর্শনমাত্র বিনা বাধায় এসডিও সাহেবের কক্ষে প্রবেশ করলাম। মনে হলো, আমার রক্তচক্ষুতে আরদালি তার সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়েছে। কর্মস্থলে ফিরে গিয়ে অনুষ্ঠিত নিরক্ষতা দূরীকরণ কার্যক্রমের জন্য গৃহীত পদক্ষেপ এবং মিল-কারখানায় করণীয় সম্পর্কে জেনারেল ম্যানেজার মেজর (অব.) আজগার আলী খানের কাছে রিপোর্ট করছিলাম। কথাচ্ছলে সেই আরদালির পথ রোধ করার বিবরণ দিলে তিনি আমাকে মৃদু ভর্ৎসনা করে বললেন, গাড়ি নিয়ে যাওনি কেন? এরপর কখনও গাড়ি ছাড়া যাবে না। আরদালির ওই আচরণের সঙ্গে গাড়ির কী সম্পর্ক_ তৎক্ষণাৎ ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। যা হোক, এক মাস পর আবার সেই নিরক্ষতা বিষয়ক জেলা কমিটির মিটিং। এসডিও সাহেবের চেম্বারের সামনে গাড়ি থেকে নামছি, দেখছি এসডিও সাহেবের আরদালি, আমার পা মাটি ছোঁয়ার আগেই তার সাহেবের দরজা আমার জন্য খুলে মেলে ধরে আছে। লক্ষ্য করলাম, সেদিন আর এদিনের কী পার্থক্য। সেদিন নেমেছিলাম রিকশা থেকে, আর আজ গাড়ি থেকে।
ইদানীং ছোটরা আমাকে প্রায় জিজ্ঞাসা করে, মহকুমা কী? সহজ কথায়, কয়েকটা থানা নিয়ে একটি মহকুমা এবং কয়েকটি মহকুমা নিয়ে একটি জেলা হতো। মহকুমা প্রশাসকের পদবি ছিল সাব-ডিভিশনাল অফিসার_ সংক্ষেপে এসডিও। তখন রাজশাহী জেলায় চারটি মহকুমা ছিল। নাটোর, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং রাজশাহী। ১৯৮২ সালের পর থেকে দেশের প্রতিটি মহকুমা এখন জেলা। এখন আর কোনো মহকুমা নেই। রাজশাহীর চারটি মহকুমায় বাংলাদেশ বস্ত্রকল করপোরেশনের উৎপাদিত দ্রব্যের বিক্রয় ও প্রদর্শনী কেন্দ্র ছিল। তখন বিটিএমসির উৎপাদিত দ্রব্যের যথেষ্ট চাহিদা ও আকর্ষণ ছিল। দাম ছিল অপেক্ষাকৃত কম। ফলে পূজা-পার্বণে বেশ ভিড় হতো। তাই ক্রেতাসাধারণের ভোগান্তি নিরসন এবং ক্লান্ত কর্মচারীদের প্রণোদনা দেওয়ার জন্য এই বিশেষ ইন্সপেকশন ব্যবস্থা। একবার আমার দায়িত্বে পড়েছে নাটোর। ভেবে দেখলাম, অফিসে কাজের চাপে যদি রওনা দিতে দেরি হয় তাহলে বদরুলের আর আমার সঙ্গে নিয়ে কোনো লাভ হবে না। তার সেই কাঙ্ক্ষিত খুলনা মেইল দুপুর ১টার দিকে নাটোর স্টেশন ত্যাগ করে চলে যাবে। রাজশাহী থেকে নাটোরের দূরত্ব ৩০ মাইল। গাড়িতে এক ঘণ্টার পথ। বললাম, তুমি আমার গাড়ি নিয়ে নাটোর রওনা দাও। আমার তাড়া নেই। পরে আমি বাসে যাব। গাড়ি যেন নাটোরেই থাকে। শুনে বদরুল আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। বদরুল তার পরিচিত মহলে এমন ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে এ ঘটনার কথা বলেছে যে, আমার মতো লোক হয় না ইত্যাদি। নিজে বাসে গিয়ে, তাদের গাড়ি দিয়েছি ট্রেন ধরার জন্য। আমি যতবার ভুলে যাই, বদরুলের কোনো ওই রকম পরিচিতের সঙ্গে দেখা হলে তারাই আমাকে সেদিনের ঘটনাটির কথা মনে করিয়ে দেয়।
এখন ২০১১ সাল। সেই ১৯৭৮ সালের পর প্রায় ৩৩ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। অনেক ঝড়-জলোচ্ছ্বাস দেখেছি। স্বৈরতন্ত্র, রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, মিটিং, আন্দোলন এবং লাশের মিছিল দেখেছি। নিজ কাঁধে বয়ে কত স্বজনের লাশ দাফন করে এসেছি! একটু আশা বারবার মনের কোণে উঁকি দিত। হয়তো আগামীকালের ভোর আসবে এক নির্মল হাসি নিয়ে, অসীম সম্ভাবনা নিয়ে। ভেসে যাবে সব কালিমা। বুকে বুক, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সব ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এগিয়ে চলছি। কী দারুণ দেখতে! অবসর গ্রহণের পর একটি ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের আইন উপদেষ্টা হিসেবে হেড অফিস দিলকুশায় বসি। আসা-যাওয়া ব্যাংকের মাইক্রোতে। যাদের আমি সহযাত্রী তারা সবাই বয়সে আমার ছোট। আমার মেহেদি রাঙানো পকস্ফ কেশ আরও স্পষ্ট বলে দেয় যে, আমি এই রথে বয়োজ্যেষ্ঠ। খেয়াল করি, মাইক্রো হেড অফিসের সদর দরজায় পেঁৗছামাত্র দায়িত্বরত দারোয়ান-কর্মচারী দৌড়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে লম্বা সালাম দেয়। কিন্তু যেদিন অন্য গাড়িতে বা বাসে নেমে একাই আসি, সেদিন সেসব চেনা কর্মচারীর কাউকে সালাম তো দূরের কথা, একটু নড়াচড়াও করতে দেখি না। '৭৮ থেকে ২০১১। সেদিনের সেই আমলানির্ভর আরদালির আচরণ আর আজকের এই অবস্থার মধ্যে ফারাক কোথায়?
মোহাম্মদ নূরল হক :অবসরপ্রাপ্ত
জেলা ও দায়রা জজ
ইদানীং ছোটরা আমাকে প্রায় জিজ্ঞাসা করে, মহকুমা কী? সহজ কথায়, কয়েকটা থানা নিয়ে একটি মহকুমা এবং কয়েকটি মহকুমা নিয়ে একটি জেলা হতো। মহকুমা প্রশাসকের পদবি ছিল সাব-ডিভিশনাল অফিসার_ সংক্ষেপে এসডিও। তখন রাজশাহী জেলায় চারটি মহকুমা ছিল। নাটোর, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং রাজশাহী। ১৯৮২ সালের পর থেকে দেশের প্রতিটি মহকুমা এখন জেলা। এখন আর কোনো মহকুমা নেই। রাজশাহীর চারটি মহকুমায় বাংলাদেশ বস্ত্রকল করপোরেশনের উৎপাদিত দ্রব্যের বিক্রয় ও প্রদর্শনী কেন্দ্র ছিল। তখন বিটিএমসির উৎপাদিত দ্রব্যের যথেষ্ট চাহিদা ও আকর্ষণ ছিল। দাম ছিল অপেক্ষাকৃত কম। ফলে পূজা-পার্বণে বেশ ভিড় হতো। তাই ক্রেতাসাধারণের ভোগান্তি নিরসন এবং ক্লান্ত কর্মচারীদের প্রণোদনা দেওয়ার জন্য এই বিশেষ ইন্সপেকশন ব্যবস্থা। একবার আমার দায়িত্বে পড়েছে নাটোর। ভেবে দেখলাম, অফিসে কাজের চাপে যদি রওনা দিতে দেরি হয় তাহলে বদরুলের আর আমার সঙ্গে নিয়ে কোনো লাভ হবে না। তার সেই কাঙ্ক্ষিত খুলনা মেইল দুপুর ১টার দিকে নাটোর স্টেশন ত্যাগ করে চলে যাবে। রাজশাহী থেকে নাটোরের দূরত্ব ৩০ মাইল। গাড়িতে এক ঘণ্টার পথ। বললাম, তুমি আমার গাড়ি নিয়ে নাটোর রওনা দাও। আমার তাড়া নেই। পরে আমি বাসে যাব। গাড়ি যেন নাটোরেই থাকে। শুনে বদরুল আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। বদরুল তার পরিচিত মহলে এমন ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে এ ঘটনার কথা বলেছে যে, আমার মতো লোক হয় না ইত্যাদি। নিজে বাসে গিয়ে, তাদের গাড়ি দিয়েছি ট্রেন ধরার জন্য। আমি যতবার ভুলে যাই, বদরুলের কোনো ওই রকম পরিচিতের সঙ্গে দেখা হলে তারাই আমাকে সেদিনের ঘটনাটির কথা মনে করিয়ে দেয়।
এখন ২০১১ সাল। সেই ১৯৭৮ সালের পর প্রায় ৩৩ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। অনেক ঝড়-জলোচ্ছ্বাস দেখেছি। স্বৈরতন্ত্র, রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, মিটিং, আন্দোলন এবং লাশের মিছিল দেখেছি। নিজ কাঁধে বয়ে কত স্বজনের লাশ দাফন করে এসেছি! একটু আশা বারবার মনের কোণে উঁকি দিত। হয়তো আগামীকালের ভোর আসবে এক নির্মল হাসি নিয়ে, অসীম সম্ভাবনা নিয়ে। ভেসে যাবে সব কালিমা। বুকে বুক, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সব ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এগিয়ে চলছি। কী দারুণ দেখতে! অবসর গ্রহণের পর একটি ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের আইন উপদেষ্টা হিসেবে হেড অফিস দিলকুশায় বসি। আসা-যাওয়া ব্যাংকের মাইক্রোতে। যাদের আমি সহযাত্রী তারা সবাই বয়সে আমার ছোট। আমার মেহেদি রাঙানো পকস্ফ কেশ আরও স্পষ্ট বলে দেয় যে, আমি এই রথে বয়োজ্যেষ্ঠ। খেয়াল করি, মাইক্রো হেড অফিসের সদর দরজায় পেঁৗছামাত্র দায়িত্বরত দারোয়ান-কর্মচারী দৌড়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে লম্বা সালাম দেয়। কিন্তু যেদিন অন্য গাড়িতে বা বাসে নেমে একাই আসি, সেদিন সেসব চেনা কর্মচারীর কাউকে সালাম তো দূরের কথা, একটু নড়াচড়াও করতে দেখি না। '৭৮ থেকে ২০১১। সেদিনের সেই আমলানির্ভর আরদালির আচরণ আর আজকের এই অবস্থার মধ্যে ফারাক কোথায়?
মোহাম্মদ নূরল হক :অবসরপ্রাপ্ত
জেলা ও দায়রা জজ
No comments