পাকিস্তানে ন্যাটো বিমান বাহিনীর হত্যাকাণ্ড-সমকালীন প্রসঙ্গ by বদরুদ্দীন উমর
বিগত ২৬ নভেম্বর শনিবার পাকিস্তান-আফগান সীমান্তে ন্যাটো বিমানবাহিনীর হামলায় পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ২৪ জন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য নিহত হয়েছে। এটাই এ ধরনের প্রথম ঘটনা নয়। এ রকম ঘটনা পাকিস্তানে প্রায়ই ঘটে চলেছে এবং তাতে শুধু সেনাসদস্যই নয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিরীহ বেসামরিক লোকজনই বেশি নিহত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পদলেহী ও সেবাদাস রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান নিজেকে নিযুক্ত রাখার ফলে এ ধরনের ঘটনা সেখানে ঘটা
স্বাভাবিক। ব্যক্তিগত সম্পর্কই হোক বা রাষ্ট্রীয় সম্পর্কই হোক, কেউ যদি অন্যের পদতলে নিজেকে সমর্পণ করে তাহলে মাঝে মধ্যে পদাঘাত খেতেই হয়। পাকিস্তানেরও হয়েছে সেই অবস্থা। প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক ক্ষমতায় থাকার সময় থেকে আফগান যুদ্ধে জড়িত হয়ে পাকিস্তান নিজেকে আমেরিকার কাছে যেভাবে খুলে দিয়েছে তাতে অল্পদিনের মধ্যে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব বলে আর কিছু থাকেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের প্রয়োজনে পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনীর কোনো অনুমতির অপেক্ষা না করে ইচ্ছামতো পাকিস্তানের বিমান ঘাঁটি থেকে অথবা আফগানিস্তান থেকে উড়ে এসে পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় হামলা করেছে। এই হামলা তারা শুধু পাক-আফগান সীমান্তই নয়, বেলুচিস্তানেও করেছে।
আশির দশক থেকে মার্কিনের আফগান যুদ্ধে জড়িত হওয়ার পর পাকিস্তান 'সন্ত্রাসবিরোধী' যুদ্ধ নামে যে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তাতে পাকিস্তানের কানাকড়ি লাভ তো হয়ইনি, উপরন্তু তাদের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়েছে। এই সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফগান যুদ্ধের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছে, যাতে এ দুটি বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোনো সুযোগ আর নেই।
২৬ নভেম্বর পাকিস্তানের অভ্যন্তরে আফগানিস্তান থেকে উড়ে আসা ন্যাটোর বিমান হামলায় ২৪ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হওয়ার ফলে সে দেশে এখন এক প্রবল মার্কিনবিরোধী বিক্ষোভ চলছে। ন্যাটো বিমানবাহিনীর নামে এই আক্রমণ পরিচালনা করা হলেও আসলে এ আক্রমণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই পরিচালনা করেছে। কারণ, মার্কিনের তুলনায় ন্যাটোভুক্ত অন্য সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর সামরিক উপস্থিতি আফগানিস্তানে সামান্য। তাছাড়া আমেরিকাই হলো তাদের ন্যাটো যুদ্ধ জোটের নেতা। কাজেই ন্যাটোর নামে যা কিছু হয় সেটা আসলে মার্কিন যুকরাষ্ট্রেরই কর্ম।
২৪ জন পাকিস্তানি সৈন্য শনিবার সকালে বিমান হামলায় নিহত হওয়ার পর পাকিস্তানজুড়ে ন্যাটো এবং বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জনগণের বিক্ষোভ হচ্ছে। চারদিকে মার্কিন পতাকায় আগুন দেওয়া হচ্ছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কছেদের আওয়াজ উঠছে। জনগণের ওই প্রতিক্রিয়ার মুখে সরকার আমেরিকার কাছে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করে উভয়ের সম্পর্ক পরিবর্তনের 'হুমকি' দিয়েছে। তাদের প্রধানমন্ত্রী গিলানি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হীনা রব্বানি বলেছেন, দুই দেশের সম্পর্ক এর ফলে দারুণ সংকটের মধ্যে নিমজ্জিত হয়েছে। তাদের এই প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। অন্য কিছু না করে এই প্রতিবাদটুকুও যদি না করা যায়, তাহলে শুধু বিশ্বের কাছে নয়, নিজেদের জনগণের কাছেও তাদের মুখ দেখানোর মতো কিছু থাকবে না। তবে এ ক্ষেত্রে বলা দরকার যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি জনগণের বিক্ষোভ এবং পাকিস্তান সরকারের প্রতিবাদ ও সম্পর্ক পুনর্নির্ধারণের কথা বলা এক অর্থ নয়। কারণ, পাকিস্তানের জনগণ এখন সত্য অর্থেই এ দুই দেশের বর্তমান সম্পর্কের পরিবর্তন চায়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার ও তাদের সেনাবাহিনী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও সেনাবাহিনীর দ্বারা উপেক্ষিত এবং অপমানিত হওয়ার পর এ সম্পর্ক পরিবর্তন এমনকি ছিন্ন করার 'হুমকি' দিলেও এটা এই মুহূর্তে ছিন্ন করার ক্ষমতা তাদের নেই। পাকিস্তানের অর্থনীতি এখন এমনভাবে দেউলিয়ায় পরিণত হয়েছে, যাতে সরকারের নানা ব্যয় এবং সে সঙ্গে সামরিক বাহিনীর ব্যয় স্বাধীনভাবে নির্বাহের অবস্থা তাদের নেই। এ কারণেই মার্কিন সিনেটর এবং সেনা কর্মকর্তারা পাকিস্তানে তাদের প্রকাশ্য দুর্বৃত্তগিরি সত্ত্বেও মার্কিন সরকারের বিরুদ্ধে জোরালো এবং দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করতে তারা অপারগ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক ও সামরিক সূত্রে এমনভাবে বাঁধা পড়ে আছে, যাতে এ সম্পর্ক ইচ্ছা থাকলেও হঠাৎ করে ছিন্ন করা সম্ভব নয়। এ বিষয়টি মার্কিনিদের ভালোভাবেই জানা। এ কারণে গত শনিবার ২৪ জন পাকিস্তানি সৈন্য ন্যাটোর বোমাবর্ষণে নিহত হওয়ার প্রতিবাদে পাকিস্তান তার আফগান সীমান্ত এবং আফগানিস্তানে ন্যাটোর সামরিক সরবরাহ লাইন বন্ধ করার পর একাধিক প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। এই 'কঠোর পদক্ষেপের' অর্থ হলো, পাকিস্তানে মার্কিন আর্থিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধ করা।
শনিবারের ঘটনার পর পাকিস্তান সরকার যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর। কারণ, ন্যাটোর আফগান বাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় সব রকম সরবরাহ করাচি হয়ে পাকিস্তানের তুরখাম সীমান্ত দিয়ে আফগানিস্তান যায়। এটাকেই বলা চলে আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর একমাত্র সরবরাহ লাইন। এ লাইন বন্ধ করলে তাদের আফগান যুদ্ধ এক চরম সংকটের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবে এবং আফগানিস্তান থেকে তাদের পাততাড়ি গুটাতে হবে। এটা মার্কিনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের এক শক্তিশালী হাতিয়ার। কিন্তু এ হাতিয়ার দীর্ঘদিন ব্যবহার করার মতো অবস্থা পাকিস্তানের নেই। ইতিপূর্বেও ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার পর পাকিস্তান দুই দেশের সীমান্ত বন্ধ রেখেছিল; কিন্তু কয়েকদিন পরই তা আবার খুলে দিতে তারা বাধ্য হয়েছিল। এবারও যে তার অন্যথা হবে এটা সম্ভব নয়। কিন্তু ত্রুক্রদ্ধ প্রতিবাদ সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো ঘটনার তদন্ত করবে_ এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে আর ঘটবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর এর দ্বারা পাকিস্তান সরকারের সন্তুষ্ট হওয়া ছাড়া উপায় নেই। কারণ এর আগেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ধরনের হামলার পর দুঃখ প্রকাশ করেছে এবং এর কোনো পুনরাবৃত্তি হবে না বলে আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও একই ধরনের ঘটনা আবার ঘটেছে। ২৪ জন সৈন্যের মৃত্যু একই ধরনের এক ঘটনা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন পাকিস্তানে যেভাবে ঢুকে পড়ে ঘাঁটি গেড়েছে তার সঙ্গে আফগানিস্তান ও ইরাকের বিশেষ তফাত নেই। যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ দখল করে সরাসরি নিজেদের তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা না করে রাজনৈতিক ও সামরিক কলকাঠি নেড়ে পাকিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে তারা আফগানিস্তানের সরকার থেকে বেশি স্বাধীন এটা মনে করা সঙ্গত নয়। আফগানিস্তানেও ন্যাটোর বিমানবাহিনী প্রায়ই বেসরকারি লোকজন হত্যা করে থাকে। আফগান প্রেসিডেন্ট কারজাই তার বিরুদ্ধে 'ত্রুক্রদ্ধ' প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। কিন্তু তারপর ন্যাটো বাহিনী নামমাত্র ক্ষমা চাইলেও কারজাইয়ের স্বাধীনতা কত, আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে তাদের মুরোদ কতখানি এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভালোভাবেই জানা আছে। কাজেই তারপর যা হয় তাকে ইংরেজিতে বলে 'নঁংরহবংং ধং ঁংঁধষ.' পাকিস্তানের অবস্থাও একই রকম। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী মার্কিন সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। এই সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ যে মার্কিনের আফগান যুদ্ধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত এ কথা আগেই বলা হয়েছে। এই যুদ্ধ থেকে সরে আসা পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনীর পক্ষে এখন সম্ভব নয়। জনগণের বিক্ষোভের মুখে এবং মার্কিনের দ্বারা অপমানিত হয়ে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কছেদের যতই প্রকাশ্য সংকল্প ব্যক্ত করুক, কার্যত তাদের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। তারা পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনীকে মার্কিনের আর্থিক ও সামরিক সাহায্যের ওপর এমনভাবে নির্ভরশীল করে রেখেছে, যাতে মার্কিনের সর্বশেষ ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ এবং পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের ওপর হামলার পর এখন মার্কিন সরকারের তথাকথিত দুঃখ প্রকাশ এবং কিছু তর্কবিতর্কের পর আবার অবস্থা কার্যত একই রকম হবে, যদিও এ দুই দেশের মধ্যে স্নায়বিক সম্পর্ক বেশি করে টানটান হবে, অস্বস্তি বেড়েই চলবে। যতদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফগান যুদ্ধ জারি থাকবে, ততদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কছেদ সম্ভব নয়। কাজেই সবকিছু সত্ত্বেও এ দুই দেশে Ôbusiness as usualচলতে থাকবে।
২৯.১১.২০১১
আশির দশক থেকে মার্কিনের আফগান যুদ্ধে জড়িত হওয়ার পর পাকিস্তান 'সন্ত্রাসবিরোধী' যুদ্ধ নামে যে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তাতে পাকিস্তানের কানাকড়ি লাভ তো হয়ইনি, উপরন্তু তাদের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়েছে। এই সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফগান যুদ্ধের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছে, যাতে এ দুটি বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোনো সুযোগ আর নেই।
২৬ নভেম্বর পাকিস্তানের অভ্যন্তরে আফগানিস্তান থেকে উড়ে আসা ন্যাটোর বিমান হামলায় ২৪ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হওয়ার ফলে সে দেশে এখন এক প্রবল মার্কিনবিরোধী বিক্ষোভ চলছে। ন্যাটো বিমানবাহিনীর নামে এই আক্রমণ পরিচালনা করা হলেও আসলে এ আক্রমণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই পরিচালনা করেছে। কারণ, মার্কিনের তুলনায় ন্যাটোভুক্ত অন্য সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর সামরিক উপস্থিতি আফগানিস্তানে সামান্য। তাছাড়া আমেরিকাই হলো তাদের ন্যাটো যুদ্ধ জোটের নেতা। কাজেই ন্যাটোর নামে যা কিছু হয় সেটা আসলে মার্কিন যুকরাষ্ট্রেরই কর্ম।
২৪ জন পাকিস্তানি সৈন্য শনিবার সকালে বিমান হামলায় নিহত হওয়ার পর পাকিস্তানজুড়ে ন্যাটো এবং বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জনগণের বিক্ষোভ হচ্ছে। চারদিকে মার্কিন পতাকায় আগুন দেওয়া হচ্ছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কছেদের আওয়াজ উঠছে। জনগণের ওই প্রতিক্রিয়ার মুখে সরকার আমেরিকার কাছে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করে উভয়ের সম্পর্ক পরিবর্তনের 'হুমকি' দিয়েছে। তাদের প্রধানমন্ত্রী গিলানি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হীনা রব্বানি বলেছেন, দুই দেশের সম্পর্ক এর ফলে দারুণ সংকটের মধ্যে নিমজ্জিত হয়েছে। তাদের এই প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। অন্য কিছু না করে এই প্রতিবাদটুকুও যদি না করা যায়, তাহলে শুধু বিশ্বের কাছে নয়, নিজেদের জনগণের কাছেও তাদের মুখ দেখানোর মতো কিছু থাকবে না। তবে এ ক্ষেত্রে বলা দরকার যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি জনগণের বিক্ষোভ এবং পাকিস্তান সরকারের প্রতিবাদ ও সম্পর্ক পুনর্নির্ধারণের কথা বলা এক অর্থ নয়। কারণ, পাকিস্তানের জনগণ এখন সত্য অর্থেই এ দুই দেশের বর্তমান সম্পর্কের পরিবর্তন চায়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার ও তাদের সেনাবাহিনী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও সেনাবাহিনীর দ্বারা উপেক্ষিত এবং অপমানিত হওয়ার পর এ সম্পর্ক পরিবর্তন এমনকি ছিন্ন করার 'হুমকি' দিলেও এটা এই মুহূর্তে ছিন্ন করার ক্ষমতা তাদের নেই। পাকিস্তানের অর্থনীতি এখন এমনভাবে দেউলিয়ায় পরিণত হয়েছে, যাতে সরকারের নানা ব্যয় এবং সে সঙ্গে সামরিক বাহিনীর ব্যয় স্বাধীনভাবে নির্বাহের অবস্থা তাদের নেই। এ কারণেই মার্কিন সিনেটর এবং সেনা কর্মকর্তারা পাকিস্তানে তাদের প্রকাশ্য দুর্বৃত্তগিরি সত্ত্বেও মার্কিন সরকারের বিরুদ্ধে জোরালো এবং দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করতে তারা অপারগ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক ও সামরিক সূত্রে এমনভাবে বাঁধা পড়ে আছে, যাতে এ সম্পর্ক ইচ্ছা থাকলেও হঠাৎ করে ছিন্ন করা সম্ভব নয়। এ বিষয়টি মার্কিনিদের ভালোভাবেই জানা। এ কারণে গত শনিবার ২৪ জন পাকিস্তানি সৈন্য ন্যাটোর বোমাবর্ষণে নিহত হওয়ার প্রতিবাদে পাকিস্তান তার আফগান সীমান্ত এবং আফগানিস্তানে ন্যাটোর সামরিক সরবরাহ লাইন বন্ধ করার পর একাধিক প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। এই 'কঠোর পদক্ষেপের' অর্থ হলো, পাকিস্তানে মার্কিন আর্থিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধ করা।
শনিবারের ঘটনার পর পাকিস্তান সরকার যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর। কারণ, ন্যাটোর আফগান বাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় সব রকম সরবরাহ করাচি হয়ে পাকিস্তানের তুরখাম সীমান্ত দিয়ে আফগানিস্তান যায়। এটাকেই বলা চলে আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর একমাত্র সরবরাহ লাইন। এ লাইন বন্ধ করলে তাদের আফগান যুদ্ধ এক চরম সংকটের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবে এবং আফগানিস্তান থেকে তাদের পাততাড়ি গুটাতে হবে। এটা মার্কিনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের এক শক্তিশালী হাতিয়ার। কিন্তু এ হাতিয়ার দীর্ঘদিন ব্যবহার করার মতো অবস্থা পাকিস্তানের নেই। ইতিপূর্বেও ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার পর পাকিস্তান দুই দেশের সীমান্ত বন্ধ রেখেছিল; কিন্তু কয়েকদিন পরই তা আবার খুলে দিতে তারা বাধ্য হয়েছিল। এবারও যে তার অন্যথা হবে এটা সম্ভব নয়। কিন্তু ত্রুক্রদ্ধ প্রতিবাদ সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো ঘটনার তদন্ত করবে_ এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে আর ঘটবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর এর দ্বারা পাকিস্তান সরকারের সন্তুষ্ট হওয়া ছাড়া উপায় নেই। কারণ এর আগেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ধরনের হামলার পর দুঃখ প্রকাশ করেছে এবং এর কোনো পুনরাবৃত্তি হবে না বলে আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও একই ধরনের ঘটনা আবার ঘটেছে। ২৪ জন সৈন্যের মৃত্যু একই ধরনের এক ঘটনা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন পাকিস্তানে যেভাবে ঢুকে পড়ে ঘাঁটি গেড়েছে তার সঙ্গে আফগানিস্তান ও ইরাকের বিশেষ তফাত নেই। যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ দখল করে সরাসরি নিজেদের তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা না করে রাজনৈতিক ও সামরিক কলকাঠি নেড়ে পাকিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে তারা আফগানিস্তানের সরকার থেকে বেশি স্বাধীন এটা মনে করা সঙ্গত নয়। আফগানিস্তানেও ন্যাটোর বিমানবাহিনী প্রায়ই বেসরকারি লোকজন হত্যা করে থাকে। আফগান প্রেসিডেন্ট কারজাই তার বিরুদ্ধে 'ত্রুক্রদ্ধ' প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। কিন্তু তারপর ন্যাটো বাহিনী নামমাত্র ক্ষমা চাইলেও কারজাইয়ের স্বাধীনতা কত, আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে তাদের মুরোদ কতখানি এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভালোভাবেই জানা আছে। কাজেই তারপর যা হয় তাকে ইংরেজিতে বলে 'নঁংরহবংং ধং ঁংঁধষ.' পাকিস্তানের অবস্থাও একই রকম। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী মার্কিন সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। এই সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ যে মার্কিনের আফগান যুদ্ধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত এ কথা আগেই বলা হয়েছে। এই যুদ্ধ থেকে সরে আসা পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনীর পক্ষে এখন সম্ভব নয়। জনগণের বিক্ষোভের মুখে এবং মার্কিনের দ্বারা অপমানিত হয়ে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কছেদের যতই প্রকাশ্য সংকল্প ব্যক্ত করুক, কার্যত তাদের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। তারা পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনীকে মার্কিনের আর্থিক ও সামরিক সাহায্যের ওপর এমনভাবে নির্ভরশীল করে রেখেছে, যাতে মার্কিনের সর্বশেষ ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ এবং পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের ওপর হামলার পর এখন মার্কিন সরকারের তথাকথিত দুঃখ প্রকাশ এবং কিছু তর্কবিতর্কের পর আবার অবস্থা কার্যত একই রকম হবে, যদিও এ দুই দেশের মধ্যে স্নায়বিক সম্পর্ক বেশি করে টানটান হবে, অস্বস্তি বেড়েই চলবে। যতদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফগান যুদ্ধ জারি থাকবে, ততদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কছেদ সম্ভব নয়। কাজেই সবকিছু সত্ত্বেও এ দুই দেশে Ôbusiness as usualচলতে থাকবে।
২৯.১১.২০১১
No comments