সময়ের প্রতিধ্বনি-দেশ কি আবার ওয়ান-ইলেভেনের দিকেই যাচ্ছে! by মোস্তফা কামাল
অনেক দিন আগে থেকেই মার্কিন লবি বেশ সক্রিয়। লবিটি সরকারের সঙ্গে একটা নিবিড় সম্পর্ক রক্ষার পাশাপাশি সুধীসমাজকে চাঙ্গা করার উদ্যোগ ও তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। কাজও এগিয়েছে অনেক দূর। সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে আগেই এ অংশটির একটা ভিন্ন রূপ আমরা দেখতে পারি। ইতিমধ্যেই সিটিজেন ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (সিডিএইচআর) নামের একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, যার মূল নেতৃত্বে আছেন
ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। তিনি মার্কিন লবিটির বিশেষ পছন্দের লোক। প্রস্তাবিত জাতীয় সরকারের প্রধান হিসেবে তাঁর নামটিই বারবার উচ্চারিত হচ্ছে।প্রিয় পাঠক, বিষয়টি আপনাদের মধ্যে বিস্ময় জাগাতে পারে। আবার কেউ কেউ এ বিষয়ে জেনেও থাকতে পারেন। কিন্তু গত কয়েক মাসে এই আলোচনা আমরা শুনে আসছি। অন্তত দুই মাস আগে মার্কিন লবির একটি অংশ বলে আসছে, 'বিএনপিকে আর নয়; হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট অথবা সেনাসমর্থিত জাতীয় সরকার।' এটা ভাবার কারণ হচ্ছে, বিএনপির পরবর্তী কর্ণধার তারেক রহমান এবং তাঁর সহোদর আরাফাত রহমানের দুর্নীতির অকাট্য প্রমাণ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। ইতিমধ্যেই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের প্রতিনিধি ঢাকায় এসে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। মার্কিন পলিসিতেও অন্য দেশে গিয়ে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধির সাক্ষ্য দেওয়ার ঘটনা সচরাচর ঘটে না। এফবিআই প্রতিনিধির আদালতে সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে মার্কিন সরকার তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। বিষয়টি নিশ্চয়ই বিএনপি নেতৃত্ব উপলব্ধি করতে সক্ষম।
মার্কিন লবির একটি বিশেষ গ্রুপের সঙ্গে আলোচনা করে জেনেছি, মূলত দুটি কারণে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপিকে আবার ক্ষমতায় দেখতে চায় না। একটি হচ্ছে তারেক-কোকোর দুর্নীতি এবং দুর্নীতির অর্থ বিদেশে পাচার আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের ব্যাপক বিস্তার লাভ। মার্কিন সরকারও মনে করে, বিএনপি সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদীদের উত্থান ঘটেছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে আন্তরিক ছিল এবং এ ক্ষেত্রে তারা সক্ষম হয়েছে। বর্তমান সরকার যদি জঙ্গিদের রাস টানতে ব্যর্থ হতো, তাহলে হয়তো বাংলাদেশের ভিন্ন চেহারা দেখতে হতো। এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন আর্থিক ও প্রযুক্তি সহায়তা দিয়েছে। আর ভারত গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করেছে। আবার ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করতেও বাংলাদেশ ভারতকে সব ধরনের সহযোগিতা দিয়েছে। ফলে আফগানিস্তান-পাকিস্তান হয়ে ভারত ও বাংলাদেশে আসা প্রশিক্ষিত জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা এ অঞ্চলে আস্তানা গাড়তে ব্যর্থ হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের কঠোর মনোভাবের কারণে। এ কারণে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের এখনো সহানুভূতি আছে। কিন্তু সরকারের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অসন্তোষ রয়েছে; বিশেষ করে মন্ত্রিসভার বেশির ভাগ সদস্যের অদক্ষতা, সরকার পরিচালনা ও সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়হীনতা, কোনো কোনো মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সরকারকে চাপে ফেলেছে।
আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের চাপ কমাতে সরকার জ্বালানি তেলে ভর্তুকি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বর্তমান সরকারের গত তিন বছরের মেয়াদকালে জ্বালানি তেল ও সিএনজির দাম কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। ডিসেম্বর নাগাদ আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এসব সিদ্ধান্তই সরকারের জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়াতে পারে। জ্বালানি তেল, সিএনজি ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর। একদিকে জিনিসপত্রের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি, অন্যদিকে জ্বালানি তেল ও সিএনজির নাম বাড়ানোর কারণে পরিবহন ব্যয়সহ জীবনযাত্রার মান কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। ফলে সাধারণ মানুষ আর আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না।
এদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন, ঢাকা বিভাজন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে মিত্রদের সঙ্গেও সরকারের সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। বিরোধী দল তো সরকার পতনের আন্দোলন অনেক আগেই শুরু করে দিয়েছে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেই দিয়েছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। আর বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচন হলে সেটা কতটা গ্রহণযোগ্য হবে, সে বিষয়টি নিয়েও তাঁরা চিন্তাভাবনা করছেন। তবে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এ রকম একটা ভাবনা রয়েছে যে মহাজোট থেকে এরশাদকে বের করে বিএনপি ছাড়াই নির্বাচন করা হবে। একই সঙ্গে বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা চলতে থাকবে।
এমনও ভাবা হচ্ছে, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের আবার একত্র করা হবে। তাঁরা তৃতীয় ধারার একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তুলবেন। এই শক্তিকে নাগরিক কমিটি এবং এ দেশে সক্রিয় আন্তর্জাতিক শক্তি সমর্থন ও
সহযোগিতা করবে।
আমরা দেখেছি, গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তিকে সক্রিয় করার নানা তৎপরতা চলেছে। সংস্কারপন্থী রাজনৈতিক নেতা এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের রাজনৈতিক দল গঠনের প্রচেষ্টা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার অর্থায়নে ছোট দলগুলো নিয়ে রাজনৈতিক মোর্চা গঠনের তৎপরতাও ছিল, যারা কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সেই তৎপরতা ব্যর্থ হয় দুই নেত্রীকে গ্রেপ্তার করার কারণে। তখনকার নীতিনির্ধারকরা ভেবেছিলেন, 'মাইনাস টু ফর্মুলা' বাস্তবায়ন করতে পারলে রাজনীতিতে তৃতীয় ধারা সৃষ্টি করা সহজ হবে। এই তৃতীয় ধারাটিই সরকার পরিচালনা করবে এবং এটিই জাতীয় সরকার হিসেবে পরিচিতি পাবে। কিন্তু দুই নেত্রীকে গ্রেপ্তারের পর দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট পাল্টে যায়।
তবে সেই তৎপরতা এখনো থেমে নেই। এসব উদ্যোগ ব্যর্থ হলে রাজনৈতিক সংকটের ধুয়া তুলে আবার সেনাসমর্থিত সরকার গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। তারই ক্ষেত্র তৈরির চেষ্টা চলছে। অবশ্য সরকার ভাবছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত যেহেতু এখনো সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, সেহেতু দুশ্চিন্তার কারণ নেই। ভবিষ্যতেও ওই দুই দেশের সমর্থন আওয়ামী লীগের ওপরই থাকবে। ওই দুই দেশের আভাস-ইঙ্গিতে সে ধারণা তারা করতেই পারে, তবে ভেতরে ভেতরে চলছে অন্য খেলা। অনেকে মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত বাংলাদেশের ব্যাপারে দ্বৈতনীতি নিয়েছে। সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে আবার তৃতীয় শক্তিকেও হাওয়া দিয়ে যাচ্ছে।
এ কারণেই হয়তো দেশের সাধারণ মানুষ চিন্তিত। দেশের অভ্যন্তরে কী ঘটতে যাচ্ছে, দেশ আসলে কোন দিকে যাচ্ছে এবং দেশের ভবিষ্যৎ কী_এসব নিয়ে সব মহলেই অল্পবিস্তর আলোচনা হচ্ছে। কেউ বলছেন, দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক অস্থিরতাকে পুঁজি করে একটি মহল ওয়ান-ইলেভেন সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। প্রধান দুটি দলের মধ্যে ক্রমাবনতিশীল সম্পর্ক দেশের রাজনীতিকে বড় ধরনের সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মানুষ এখন বারবারই মনে করছে ওয়ান-ইলেভেন-পূর্ববর্তী ঘটনাপ্রবাহের কথা। কিন্তু কেন রাজনীতিকে বারবার সংঘাতের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে? কেন দেশে সুষ্ঠু রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে বাধার সৃষ্টি করা হচ্ছে?
স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনামল বাদ দিলে বাংলাদেশে কোনো দলই একাধারে দুইবার ক্ষমতায় ছিল না। ব্যাপক জনপ্রিয়তা নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলেও এখন সেই অবস্থানে আর নেই। সরকার যত ভালো কাজই করুক, মানুষের সহানুভূতি কিন্তু বিরোধী দলের ওপরই বেশি থাকে। আর সরকার যতটা সম্ভব বিরোধী দলকে চাপে রাখতে চায়। এটা আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয় দলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এতে সরকারের প্রতি মানুষের সহানুভূতি আরো কমে যায়।
আওয়ামী লীগ যদি মনে করে তাদের জনপ্রিয়তা আগের মতোই আছে এবং মানুষের সহানুভূতিও কমেনি, তাহলে ভুল করবে। দিন দিন আওয়ামী লীগ বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে। জোটের শরিকরাও সরকারের কর্মকাণ্ডের ব্যাপক সমালোচনা করছেন। জোটের অন্যতম শরিক এরশাদ বারবার জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। আবার তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে সৌদি আরব, ভারতসহ কয়েকটি দেশ সফরও করেছেন। আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক লবি ঠিক থাকলে হয়তো এরশাদ শেষ পর্যন্ত মহাজোটেই থাকবেন। কিন্তু বিএনপি নির্বাচনে না গেলে কী হবে? রাজনৈতিক অস্থিরতা অনিবার্য হয়ে উঠবে।
বিদ্যমান এই পরিস্থিতিতে সরকার কী করতে পারে? তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করে সংকট নিরসন করতে পারে, আবার শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে একটি ফর্মুলাও বের করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে তিনি বিরোধীদলীয় নেত্রীকে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করার প্রস্তাব দিতে পারেন। বর্তমান নির্বাচন কমিশনারদের মেয়াদও শেষের দিকে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও দুজন কমিশনারের নিয়োগ চূড়ান্ত হতে পারে সব রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করার প্রস্তাব নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনা করতে পারে।
তবে আমি মনে করি, দেশের ভবিষ্যৎ এখন দুই নেত্রীর হাতে। তাঁরা আন্তরিক হলে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট নিরসন করা কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু তাঁদের আন্তরিকতায় ঘাটতি থাকলে তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব ঘটা অস্বাভাবিক নয়। এখন দুই নেত্রীকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তাঁরা দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় এগিয়ে নেবেন, নাকি আবার ওয়ান-ইলেভেনের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে সহায়তা করবেন! তাঁদের দুজনের একগুঁয়ে মনোভাবের কারণে যদি দেশে আবার ওয়ান-ইলেভেনের সৃষ্টি হয়, তাহলে এর দায়ও কিন্তু দুই নেত্রীকেই নিতে হবে।
আমরা আশা করি, দেশের স্বার্থে শেষ পর্যন্ত দুই নেত্রী সমঝোতায় পেঁৗছবেন এবং সংঘাতের রাজনীতি পরিহার করতে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করবেন। আমরা বিশ্বাস করি, তাঁদের নিজেদের স্বার্থের চেয়ে দেশের স্বার্থ অনেক বড়। সব ধরনের ক্ষুদ্রতার ঊধর্ে্ব উঠে তাঁরা দেশের স্বার্থকেই বড় করে দেখবেন।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com
মার্কিন লবির একটি বিশেষ গ্রুপের সঙ্গে আলোচনা করে জেনেছি, মূলত দুটি কারণে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপিকে আবার ক্ষমতায় দেখতে চায় না। একটি হচ্ছে তারেক-কোকোর দুর্নীতি এবং দুর্নীতির অর্থ বিদেশে পাচার আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের ব্যাপক বিস্তার লাভ। মার্কিন সরকারও মনে করে, বিএনপি সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদীদের উত্থান ঘটেছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে আন্তরিক ছিল এবং এ ক্ষেত্রে তারা সক্ষম হয়েছে। বর্তমান সরকার যদি জঙ্গিদের রাস টানতে ব্যর্থ হতো, তাহলে হয়তো বাংলাদেশের ভিন্ন চেহারা দেখতে হতো। এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন আর্থিক ও প্রযুক্তি সহায়তা দিয়েছে। আর ভারত গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করেছে। আবার ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করতেও বাংলাদেশ ভারতকে সব ধরনের সহযোগিতা দিয়েছে। ফলে আফগানিস্তান-পাকিস্তান হয়ে ভারত ও বাংলাদেশে আসা প্রশিক্ষিত জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা এ অঞ্চলে আস্তানা গাড়তে ব্যর্থ হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের কঠোর মনোভাবের কারণে। এ কারণে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের এখনো সহানুভূতি আছে। কিন্তু সরকারের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অসন্তোষ রয়েছে; বিশেষ করে মন্ত্রিসভার বেশির ভাগ সদস্যের অদক্ষতা, সরকার পরিচালনা ও সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়হীনতা, কোনো কোনো মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সরকারকে চাপে ফেলেছে।
আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের চাপ কমাতে সরকার জ্বালানি তেলে ভর্তুকি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বর্তমান সরকারের গত তিন বছরের মেয়াদকালে জ্বালানি তেল ও সিএনজির দাম কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। ডিসেম্বর নাগাদ আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এসব সিদ্ধান্তই সরকারের জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়াতে পারে। জ্বালানি তেল, সিএনজি ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর। একদিকে জিনিসপত্রের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি, অন্যদিকে জ্বালানি তেল ও সিএনজির নাম বাড়ানোর কারণে পরিবহন ব্যয়সহ জীবনযাত্রার মান কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। ফলে সাধারণ মানুষ আর আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না।
এদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন, ঢাকা বিভাজন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে মিত্রদের সঙ্গেও সরকারের সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। বিরোধী দল তো সরকার পতনের আন্দোলন অনেক আগেই শুরু করে দিয়েছে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেই দিয়েছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। আর বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচন হলে সেটা কতটা গ্রহণযোগ্য হবে, সে বিষয়টি নিয়েও তাঁরা চিন্তাভাবনা করছেন। তবে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এ রকম একটা ভাবনা রয়েছে যে মহাজোট থেকে এরশাদকে বের করে বিএনপি ছাড়াই নির্বাচন করা হবে। একই সঙ্গে বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা চলতে থাকবে।
এমনও ভাবা হচ্ছে, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের আবার একত্র করা হবে। তাঁরা তৃতীয় ধারার একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তুলবেন। এই শক্তিকে নাগরিক কমিটি এবং এ দেশে সক্রিয় আন্তর্জাতিক শক্তি সমর্থন ও
সহযোগিতা করবে।
আমরা দেখেছি, গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তিকে সক্রিয় করার নানা তৎপরতা চলেছে। সংস্কারপন্থী রাজনৈতিক নেতা এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের রাজনৈতিক দল গঠনের প্রচেষ্টা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার অর্থায়নে ছোট দলগুলো নিয়ে রাজনৈতিক মোর্চা গঠনের তৎপরতাও ছিল, যারা কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সেই তৎপরতা ব্যর্থ হয় দুই নেত্রীকে গ্রেপ্তার করার কারণে। তখনকার নীতিনির্ধারকরা ভেবেছিলেন, 'মাইনাস টু ফর্মুলা' বাস্তবায়ন করতে পারলে রাজনীতিতে তৃতীয় ধারা সৃষ্টি করা সহজ হবে। এই তৃতীয় ধারাটিই সরকার পরিচালনা করবে এবং এটিই জাতীয় সরকার হিসেবে পরিচিতি পাবে। কিন্তু দুই নেত্রীকে গ্রেপ্তারের পর দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট পাল্টে যায়।
তবে সেই তৎপরতা এখনো থেমে নেই। এসব উদ্যোগ ব্যর্থ হলে রাজনৈতিক সংকটের ধুয়া তুলে আবার সেনাসমর্থিত সরকার গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। তারই ক্ষেত্র তৈরির চেষ্টা চলছে। অবশ্য সরকার ভাবছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত যেহেতু এখনো সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, সেহেতু দুশ্চিন্তার কারণ নেই। ভবিষ্যতেও ওই দুই দেশের সমর্থন আওয়ামী লীগের ওপরই থাকবে। ওই দুই দেশের আভাস-ইঙ্গিতে সে ধারণা তারা করতেই পারে, তবে ভেতরে ভেতরে চলছে অন্য খেলা। অনেকে মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত বাংলাদেশের ব্যাপারে দ্বৈতনীতি নিয়েছে। সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে আবার তৃতীয় শক্তিকেও হাওয়া দিয়ে যাচ্ছে।
এ কারণেই হয়তো দেশের সাধারণ মানুষ চিন্তিত। দেশের অভ্যন্তরে কী ঘটতে যাচ্ছে, দেশ আসলে কোন দিকে যাচ্ছে এবং দেশের ভবিষ্যৎ কী_এসব নিয়ে সব মহলেই অল্পবিস্তর আলোচনা হচ্ছে। কেউ বলছেন, দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক অস্থিরতাকে পুঁজি করে একটি মহল ওয়ান-ইলেভেন সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। প্রধান দুটি দলের মধ্যে ক্রমাবনতিশীল সম্পর্ক দেশের রাজনীতিকে বড় ধরনের সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মানুষ এখন বারবারই মনে করছে ওয়ান-ইলেভেন-পূর্ববর্তী ঘটনাপ্রবাহের কথা। কিন্তু কেন রাজনীতিকে বারবার সংঘাতের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে? কেন দেশে সুষ্ঠু রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে বাধার সৃষ্টি করা হচ্ছে?
স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনামল বাদ দিলে বাংলাদেশে কোনো দলই একাধারে দুইবার ক্ষমতায় ছিল না। ব্যাপক জনপ্রিয়তা নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলেও এখন সেই অবস্থানে আর নেই। সরকার যত ভালো কাজই করুক, মানুষের সহানুভূতি কিন্তু বিরোধী দলের ওপরই বেশি থাকে। আর সরকার যতটা সম্ভব বিরোধী দলকে চাপে রাখতে চায়। এটা আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয় দলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এতে সরকারের প্রতি মানুষের সহানুভূতি আরো কমে যায়।
আওয়ামী লীগ যদি মনে করে তাদের জনপ্রিয়তা আগের মতোই আছে এবং মানুষের সহানুভূতিও কমেনি, তাহলে ভুল করবে। দিন দিন আওয়ামী লীগ বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে। জোটের শরিকরাও সরকারের কর্মকাণ্ডের ব্যাপক সমালোচনা করছেন। জোটের অন্যতম শরিক এরশাদ বারবার জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। আবার তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে সৌদি আরব, ভারতসহ কয়েকটি দেশ সফরও করেছেন। আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক লবি ঠিক থাকলে হয়তো এরশাদ শেষ পর্যন্ত মহাজোটেই থাকবেন। কিন্তু বিএনপি নির্বাচনে না গেলে কী হবে? রাজনৈতিক অস্থিরতা অনিবার্য হয়ে উঠবে।
বিদ্যমান এই পরিস্থিতিতে সরকার কী করতে পারে? তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করে সংকট নিরসন করতে পারে, আবার শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে একটি ফর্মুলাও বের করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে তিনি বিরোধীদলীয় নেত্রীকে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করার প্রস্তাব দিতে পারেন। বর্তমান নির্বাচন কমিশনারদের মেয়াদও শেষের দিকে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও দুজন কমিশনারের নিয়োগ চূড়ান্ত হতে পারে সব রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করার প্রস্তাব নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনা করতে পারে।
তবে আমি মনে করি, দেশের ভবিষ্যৎ এখন দুই নেত্রীর হাতে। তাঁরা আন্তরিক হলে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট নিরসন করা কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু তাঁদের আন্তরিকতায় ঘাটতি থাকলে তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব ঘটা অস্বাভাবিক নয়। এখন দুই নেত্রীকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তাঁরা দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় এগিয়ে নেবেন, নাকি আবার ওয়ান-ইলেভেনের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে সহায়তা করবেন! তাঁদের দুজনের একগুঁয়ে মনোভাবের কারণে যদি দেশে আবার ওয়ান-ইলেভেনের সৃষ্টি হয়, তাহলে এর দায়ও কিন্তু দুই নেত্রীকেই নিতে হবে।
আমরা আশা করি, দেশের স্বার্থে শেষ পর্যন্ত দুই নেত্রী সমঝোতায় পেঁৗছবেন এবং সংঘাতের রাজনীতি পরিহার করতে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করবেন। আমরা বিশ্বাস করি, তাঁদের নিজেদের স্বার্থের চেয়ে দেশের স্বার্থ অনেক বড়। সব ধরনের ক্ষুদ্রতার ঊধর্ে্ব উঠে তাঁরা দেশের স্বার্থকেই বড় করে দেখবেন।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com
No comments