আশিয়ানের আগ্রাসনে দিশাহারা রূপগঞ্জের দুই লাখ মানুষ

শিয়ান সিটির শীতল ছায়া প্রকল্পের ভূমি আগ্রাসনের শিকার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ। এই উপজেলার কায়েতপাড়া ও সদর ইউনিয়নের প্রায় দুই লাখ মানুষ আশিয়ানের ভূমিদস্যুতার আগ্রাসনে আজ দিশেহারা। অনেকে ভিটাবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। অন্যরাও দিন কাটাচ্ছেন বাড়ি-জমি হারানোর আতঙ্কে। জবরদস্তিমূলকভাবে চারটি খালের মুখ বালু ফেলে বন্ধ করে দেওয়ায় জলাবদ্ধতায় প্রায় তিন হাজার বিঘা জমি অনাবাদি থাকার আশঙ্কা


দেখা দিয়েছে। রাতের অন্ধকারে বালু ফেলে জমি দখলের ঘটনা ঘটছে অহরহ। এ অবস্থায় ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ ক্রমেই ফুঁসে উঠছে। আগ্রাসন বন্ধ না হলে আশিয়ানের বিরুদ্ধে গত বছরের মতো আরেকটি গণবিস্ফোরণের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন এলাকাবাসী।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, রাজধানীর কোল ঘেঁষেই অবস্থান রূপগঞ্জের। যাতায়াতব্যবস্থার উন্নয়নে এলাকাবাসী স্বপ্নের জাল বুনেছিল আর্থিকভাবে সচ্ছল হয়ে ওঠার। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্নভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আশিয়ানের আগ্রাসন। রূপগঞ্জের ওপর
লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে আশিয়ান শীতল ছায়াসহ কয়েকটি অননুমোদিত হাউজিং কম্পানির।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কায়েতপাড়া ও সদর ইউনিয়নের বেশির ভাগ লোকেরই জীবিকা কৃষি। এখানে বর্ষায় আমন ধান আর পাট এবং শুষ্ক মৌসুমে দুই বার ইরি ধানের চাষ হয়। কিন্তু তাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়ার অপচেষ্টা চালিয়েছে আশিয়ান শীতল ছায়া। আশিয়ান শীতল ছায়াসহ কয়েকটি হাউজিং কম্পানির আগ্রাসন আর দৌরা@ে@@@্য দিশেহারা প্রায় দুই লাখ মানুষ। তারা পৈতৃক বসতভিটা থেকে উচ্ছেদের আতঙ্কে ভুগছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, আশিয়ান শীতল ছায়া স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কিছু নেতা-কর্মীকে জমি কেনা আর বালু ভরাটের কাজে ব্যবহার করছে। এদের পাশাপাশি রয়েছে কিছু দালাল। তারা জমির মালিকদের জমি বিক্রি করতে চাপ দিচ্ছে। এতে কাজ না হলে কখনো কৌশলে আবার কখনো জোর করে দখল করে নিচ্ছে সেই জমি। পুরো প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মদদ দিচ্ছে আশিয়ান সিটি। এ অবস্থায় একজন আরেকজনের জমি বিক্রি করে দিচ্ছে। আবার এক জমি একাধিকবার বিক্রির ঘটনাও ঘটছে। তারা অসিয়তনামা আর ওয়ারিশনামায় জাল দলিল এবং জমির একাংশ কিনে পুরো জমি গ্রাস করছে। ফলে এলাকায় জমিজমা-সংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমা বেড়ে গেছে।
কায়েতপাড়া ও রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় গত দুই দিনে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে মিলেছে জালজালিয়াতি আর জবরদখলের নানা তথ্য। বাতাসে ভাসছে মানুষের বুকফাটা আর্তনাদ। পৈতৃক বাড়িঘর হারানোর আতঙ্কে সাধারণ মানুষের চোখে ঘুম নেই। সারাক্ষণ আতঙ্ক তাড়া করে ফেরে_কখন জমিতে বালু পড়ে ভরাট হয়ে যায়, বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ হতে হয়! চাপা ক্ষোভে ফুঁসছে আতঙ্কিত মানুষগুলো।
নাওড়া এলাকার হাজার হাজার বিঘা কৃষিজমি এখন ধু-ধু মরুভূমি। কথা হয় ক্ষতিগ্রস্ত ও ভুক্তভোগী অনেক কৃষক আর সাধারণ মানুষের সঙ্গে। কিন্তু তারা এতটাই অসহায় যে ভয়ে মুখে কথা সরে না। মুশুরি গ্রামের হতদরিদ্র কৃষক নুরা মিয়া কথা বলতে গিয়ে একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, 'কী কমু বাপ? আমার মুশুরি মৌজার ৪০ শতাংশ জমিন আছিল শেষ পুঞ্জি। এই জমিনের ধান দিয়া বছরের খাওন জুটত। এহন খামু কী? আশিয়ান বালু দিয়া বইরা (ভরাট) ফালাইছে আমার জমিন।'
মুশুরি মৌজায় দক্ষিণ নবগ্রামের বাসুরউদ্দিন বাসুর ৫০ শতাংশ জমি বালু ফেলে ভরাট করে ফেলেছে আশিয়ান শীতল ছায়া। তাঁর কণ্ঠে ক্ষোভ, 'জমিন বুইঝা না পাইলে আন্দোলনে নামমু। আশিয়ানরে পলাইনের সময় দিমু না।'
একই এলাকার সাহাজদ্দিন মিয়ার চোখে-মুখেও প্রতিবাদের আগুন। তিনি বলেন, 'আমার নাওড়া মৌজার ২৮ শতাংশ জমি আশিয়ানে বালু দিয়া ভরাট কইরা ফালাইছে। জান দিমু, বাপ-দাদাগো পৈতৃক ভিটা ছাড়মু না।'
রূপগঞ্জ এলাকার অ্যাডভোকেট মাহমুদুল আহসান খোকা এত দিন বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন বাপ-দাদার জমি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অপশক্তির কাছে তাঁকে হার মানতে হয়েছে। আশিয়ান শীতল ছায়া কেড়ে নিয়েছে বাপ-দাদার জমি। নাওড়া ও বাঘবেড় মৌজায় তাঁর দুই বিঘা জমি আশিয়ান বালু দিয়া ভরাট করে ফেলেছে। মাহমুদুল ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, 'এটা কেমন দেশে বাস করি? এ দেশে কি কোনো সরকার নাই? কোনো বিচার নাই?'
মুশুরি এলাকার কৃষক রহিজ উদ্দিনের দেখা মেলে স্থানীয় একটি চায়ের দোকানে। কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতেই চড়াগলায় বলে ওঠেন, 'কিমুন আর থাকমু? আশিয়ানে তো আমাগো সব গিইল্যা খাইয়া ফালাইতাছে।' তিনি কেঁদে কেঁদে বলেন, 'বাবা রে, আমার দুই বিঘা জমি এখন বালুর নিচে। বালু দিয়া ভরাট করে ফেলাইছে আশিয়ান।' কৃষক কফিল উদ্দিন জানান, বাঘবেড় মৌজায় সোয়া বিঘা জমিই তাঁর শেষ সম্বল। এই জমির ফসল দিয়েই তাঁর সংসার চলত। আশিয়ান সিটি তাঁর সেই জমিটুকু বালু দিয়ে ভরাট করে ফেলছে।
তিন হাজার বিঘা জমিতে কৃত্রিম জলাবদ্ধতা
বালু ভরাটের কারণে গজারিয়া, কান্দুরা ও নাওড়াসহ চারটি খালের মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রায় তিন হাজার বিঘা ফসলি জমিতে অস্থায়ী জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। ফলে এ বছর জমিগুলো অনাবাদি পড়ে থাকার আশঙ্কা জমির মালিকদের।
মুশুরি এলাকার সাইদুর রহমানের ১০ বিঘা জমিতে এখনো পানি। এবার তিনি কিভাবে জমি চাষ করবেন তা নিয়ে চিন্তিত। রূপগঞ্জের মাকসুল হাসান মতিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ্ েচাকরির পাশাপাশি বাপ-দাদার জমি দেখাশোনা করে আসছেন। মুশুরি মৌজায় তাঁর এক বিঘা জমি আশিয়ান বালু দিয়ে ভরাট করে ফেলেছে। বাকি ৯ বিঘা জমি পানির নিচে। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, 'আমার জমিন আশিয়ান বালু দিয়ে ভরাট করে ফেলেছে। বাধা দিতে গেলে সন্ত্রাসীরা ভয়-ভীতি দেখায়। আমরা আবারও আন্দোলনে নামব।'
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার আজিবপুর এলাকার আবদুল মতিন নাওড়া মৌজার ৩৮৪৮ দাগে ২৯ শতাংশ জমি কিনেছিলেন। তাঁর এই জমিটুকুও আশিয়ানের বালু-সন্ত্রাস থেকে রেহাই পায়নি।
নাওড়া গ্রামের ক্ষতিগ্রস্তরা আশিয়ানের পোষা সন্ত্রাসী মোশারফ ভুঁইয়া ও তার বাহিনীর তাণ্ডবে এতটাই ভীত যে মুখ খুলতে রাজি হননি। নাওড়া পশ্চিমপাড়া এলাকায় গিয়ে শোনা গেছে কেবলই সাধারণ মানুষের ফিসফিসানি। নিজের কষ্টের কথাটাও ওরা শব্দ করে বলার সাহস হারিয়ে ফেলেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কৃষক বলেন, 'অনেক মানুষের জমিন আশিয়ান বালু দিয়া ভইরা ফালাইছে। এগো কি বিচার করব না আল্লায়?' আরেক কৃষক কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, 'আমরা হিন্দু মানুষ। আমাগো জায়গা-জমি আশিয়ানে নিছেগা, আমরা অহন কী করমো? ভগবান হেগো বিচার করব।'
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আশিয়ানের জমি রেজিস্ট্রি করতেও চলে গোপনীয়তা। আশিয়ানের ঢাকার গুলশান অফিসে রেজিস্ট্রি কার্যক্রম চলে কমিশনের মাধ্যমে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আশিয়ানের বিরুদ্ধে রূপগঞ্জবাসীর ক্ষোভ ক্রমেই বিস্ফোরণের পথে এগুচ্ছে। এলাকাবাসীর এই পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আবার গত বছরের ২৩ অক্টোবরের ঘটনার জন্ম দিতে পারে বলে অনেকের ধারণা। গত বছরের ওই ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে নিহত জামালের বাবা রফিক মিয়াকে আহ্বায়ক করে ইতিমধ্যে ভূমিরক্ষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করেছে এলাকাবাসী। কমিটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে আশিয়ান শীতল ছায়ার বিরুদ্ধে স্মারকলিপি দিয়েছে। এ ছাড়া রূপগঞ্জ থানায় ১৪টি সাধারণ ডায়েরি ও একটি মামলা হয়েছে।
ভূমিরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক রফিক মিয়ার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'আমার ছেলে জমি রক্ষার আন্দোলনে গিয়ে নিহত হয়েছে। আমি মরে যাব, তবু পিছু হটব না। আন্দোলন চলবে।'

No comments

Powered by Blogger.