মমতা-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিমান বসুর মন্তব্য by সুব্রত আচার্য্য
মঙ্গলবার ২২ নভেম্বর যখন এই লেখাটা লিখছি, এর এক দিন আগে ঠিক করে নিয়েছিলাম যে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে ছয় মাসে বামফ্রন্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠ গরম করতে পারল কি পারল না তা নিয়ে লিখব। লিখব সম্প্রতি বিমান বসুর করা কুৎসিত এক মন্তব্য নিয়ে মিডিয়া-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে হৈচৈয়ের কথা। লিখব কলকাতার অদূরে এক উপনগরী, বামফ্রন্টের শেষদিকে যেটাকে 'জ্যোতি বসু নগরী' বলে ঘোষণা করা হয়েছিল, সেই নগরী নিয়ে
বর্তমান তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের অবস্থান ইত্যাদি নিয়ে। কিন্তু এর মধ্যে ২১ নভেম্বর সন্ধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বড় এক ঘটনা ঘটে যাওয়ায় লেখার বিষয় খানিটকা উল্টেপাল্টে নিতে হলো। কারণ পশ্চিমবঙ্গের সরকারকে মমতার অন্যতম রাজনৈতিক পরামর্শদাতা হিসেবে পরিচিত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী 'ফ্যাসিস্ট' সরকার বলে অভিহিত করেছেন।
ঘটনাপর্ব এক। কলকাতা প্রেসক্লাব। সময় বিকেল ৪টা। গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি নামের কলকাতারই এক মানবাধিকার সংগঠনের ডাকা সংবাদ সম্মেলন। উপলক্ষ মাওবাদীদের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান বন্ধ এবং মাওবাদী হিসেবে আটক প্রায় সব রাজনৈতিক বন্দির মুক্তির দাবিতে ২৩ ও ২৪ নভেম্বর কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলার মেট্রো চ্যানেলে অবস্থান ধর্মঘট বা প্রতিবাদ সভার তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার অনুমতি না দেওয়ার প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন। এপিডিআর নামে ওই সংগঠনের ডাকা এ সংবাদ সম্মেলন কলকাতার শীর্ষস্থানীয় স্যাটেলাইট চ্যানেল শুধু নয়, কভার করতে হাজির সর্বভারতীয়, এমনকি বাংলাদেশি শীর্ষস্থানীয় সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতিনিধিরাও। এর কারণ, এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হবেন দুই বাংলার জনপ্রিয় সাহিত্যিক-আদিবাসীদের আন্দোলনের নেত্রী মহাশ্বেতা দেবী। না, শুধু এই কারণ নয়। কারণ আরো আছে। এই প্রথম রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে একটি সংবাদ সম্মেলন হবে। এবং যেসব পরিবর্তনপন্থী বুদ্ধিজীবী বামফ্রন্ট সরকারের পরিবর্তন চেয়ে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারকে ক্ষমতায় বসানোর ডাক দিয়েছিলেন, তাঁদেরই সিংহভাগ বুদ্ধিজীবী এদিন পরিবর্তিত এই সরকারের নীতির সমালোচনা করবেন এবং উপস্থিত হবেন। আর সে কারণে সংবাদ সম্মেলনটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ সম্মেলনে নানা কারণে সশরীরে আসতে পারেননি সাহিত্যিক শঙ্খ ঘোষ, সংগীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়, অভিনেত্রী অপর্ণা সেন, নাট্যকার কৌসিক সেন, সাহিত্যিক নবারুণ ভট্টাচার্য, সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্য, সুমন মুখোপাধ্যায় এবং তৃণমূল সাংসদ জীবনমুখী গানের কবীর সুমনসহ আরো অনেক বিশিষ্টজন। কিন্তু তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেরই পাঠানো লিখিত বিবৃতি খামে করে ততক্ষণেই পেঁৗছে গেছে সংবাদ সম্মেলনে। সবাই একবাক্যে এই প্রতিবাদ সভা না করতে দেওয়া তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় সমালোচনা করেছেন। তবে অনুষ্ঠানের মধ্যমণি ছিলেন সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী। প্রথমে মহাশ্বেতা দেবী নিজে তাঁর লিখিত বক্তব্য পাঠন করেন, যার কথা ছিল ঠিক এ রকম_'আমরা বিগত ৬৪ বছরে যা ভাবতে পারিনি, জনগণের সরকার এসে সেই কাজটি করল। অর্থাৎ মেট্রো চ্যানেলে সমবেত হয়ে জনসাধারণ স্বীয় বক্তব্য দেওয়ার অধিকার হারাল। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানালাম। প্রতিবাদ করার অধিকার ছিল বলে ক্রমে জনমত গড়ে উঠেছে এবং আজকে একটা নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেছে। এসে তারা প্রতিবাদ করার অধিকারটাই কেড়ে নিল। অস্বাভাবিক কথা। আমরা কি ডেকে ফ্যাসিজম নিয়ে এসেছি?'
ঘটনাচক্র দুই : সোমবার বিকেল সাড়ে ৫টা। মহাকরণে প্রেস কর্নারে এসে দাঁড়ালেন তৃণমূল সভানেত্রী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি প্রায় আধা ঘণ্টা কথা বললেন। কিন্তু প্রথম কয়েক মিনিটে মোটামুটি মূল বক্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন তিনি বললেন_'আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলছি, কোনো একটি সংগঠন অ্যাবসলিউটলি মাওবাদীদের সমর্থনে সামনে গণতন্ত্রের ব্যানার আর পেছনে মাওবাদীদের ব্যানার নিয়ে অযথা কতগুলো মিথ্যা অপপ্রচার এবং কুৎসা রটাচ্ছে।' 'আমি বলছি, গণতান্ত্রিক রক্ষা কমিটি বললেই গণতন্ত্র রক্ষা হয় না। এটা মাওবাদীদের একটা মুখোশ। মহাশ্বেতা দেবী আজ অনেক কিছু বলছিলেন। তাঁকে আমি সম্মান করি। ওনার বয়স হয়েছে। ওনার বিরুদ্ধে আমি একটি কথাও বলব না। যা বলার আমি পলিটিক্যাললি বলব।' 'আমি দেখলাম, ওনার পাশে এসে এসে বলে দিয়ে যাচ্ছেন কেউ যে কী বলতে হবে। প্রেস কনফারেন্সটা আসলে প্যারোডি বলে মনে হচ্ছিল।' যা-ই হোক, ২৩-২৪ তারিখে মেট্রো চ্যানেলটি অন্য একটি সংগঠনের সভা করার জন্য বুক করা রয়েছে। তাই পুলিশ এই সংগঠনকে কলেজ স্কয়ার কিংবা গান্ধীমূর্তির পাদদেশে এই প্রতিবাদ সভা করার অনুরোধ করেছিল। এটুকু রিয়ালাইজেশন থাকা উচিত এই গণতান্ত্রিক সংগঠনের...।'
কবীর সুমনও এ দিনের সংবাদ সম্মেলনে মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে একমত পোষণ করেন এবং তিনি তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের সমালোচনা করেন। এক সাংবাদিক এ নিয়ে মমতার প্রতিক্রিয়া জানতে চান। এর উত্তরে মমতা বলেন, 'আমরা এক সেকেন্ডে ডিসিশন নিয়ে মাওবাদীদের গ্লোরিফাই করার জন্য ওনাকে বরখাস্ত করতে পারি। কিন্তু উনি যা করছেন করুন। আমি গণতান্ত্রিক কণ্ঠটা রোধ করতে চাই না। এর আগেও ছত্রধর মাহাতো (মাওবাদীদের ছায়া সংগঠন জনসাধারণের কমিটির প্রধান হয়ে) গান গেয়েছেন, আরো আছেন জাগরী বাস্কে (সম্প্রতি মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গিয়ে এই মাওবাদী শীর্ষ নেত্রী স্বামী-সন্তানসহ আত্মসমর্পণ করেন)। আমি আগেই বলেছি, আমরা ওনাকে (কবীর সুমনকে) এনে ভুল করেছিলাম। বুদ্ধিজীবী-সাহিত্যিকদের অংশগ্রহণের সুযোগ হিসেবে ওনাকে আমরা এনেছিলাম। কিন্তু আমরা ভাবতে পারিনি, উনি চরমপন্থীদের একজন সমর্থক।'
...একপর্যায়ে ফ্যাসিস্ট বলার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে মমতার মন্তব্য, 'ওনাকে আমরা সাহিত্য একাডেমীর পরিচালক করেছি। এই প্রথম ওনাকে সম্মান দিয়ে আমরা সেটা করেছি। উনি প্রবীণ মানুষ। ওনাকে দিয়ে এসব বলিয়ে নিচ্ছেন। আগে আমাদের হয়ে বলেছেন এ জন্য আমি কৃতজ্ঞ। এখন বলছেন না এর জন্যও কৃতজ্ঞ। আমাদের ফ্যাসিস্ট বলছেন। আরো বেশি করে বলুক। আর কী কী স্টাইল আছে বের করুক। কিন্তু এসব করে উগ্রপন্থীদের প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে সরকার আইনত ব্যবস্থা নেবে।'
এবার আসা যাক এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলের দু-একটি বিশ্লেষণে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বর্তমান সরকার ২০ নভেম্বর ছয় মাস পূর্ণ করল। স্বাভাবিকভাবে মুখ্যমন্ত্রী আশা করেছিলেন, এই সময়ে আর কিছু না হোক এই পরিবর্তনপন্থী বুদ্ধিজীবীরা ছয় মাসের সরকারের ভালো কাজের প্রশংসা করবেন। কিন্তু সেটা হলো না। বুদ্ধিজীবীদের এই অংশ রাজ্যটিতে তৃণমূল কংগ্রেসকে ২০০৭ সালের গ্রামপঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে রাজ্য সরকারে অধিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে অবশ্যই বড় ভূমিকা পালন করেছেন, সন্দেহ নেই। ছয় মাসের মধ্যে পরিবর্তনপন্থীরা এখন এই সরকারকেই 'ফ্যাসিজম' চালানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করলেন। আর তাও পরিবর্তনপন্থী বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম সমন্বয়কারী মহাশ্বেতা দেবীর মুখ থেকেই উচ্চারিত হলো। তাও আবার ফ্যাসিজমের মতো ভাষায়। বামফ্রন্টের সময় জঙ্গলমহলে যৌথ বাহিনী প্রত্যাহারের দাবিতে এসব বুদ্ধিজীবীর একটি বড় অংশকে নিয়ে তীব্র আন্দোলনে নেমেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু তা-ই নয়, সুশীল সমাজের ব্যানারে জঙ্গলমহলেও গিয়ে ছত্রধর মাহাতোর সঙ্গে প্রকাশ্যে বৈঠকও করেছিলেন আরো অনেকেই। ওই বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ এখন অবশ্যই রাজ্য সরকারের দেওয়া বিভিন্ন সরকারি পদে দায়িত্ব পালন করছেন। মমতা-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এমন দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসায় স্বাভাবিকভাবে এর আগের সপ্তাহে কংগ্রেস ও তৃণমূলের সঙ্গে জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান ও বর্ষীয়ান সিপিআইএম নেতা বিমান বসুর কুৎসিত মন্তব্য আপাতত মানুষ ভুলে যাবে। 'কংগ্রস-তৃণমূলের জোট শাড়ির ওপর না নিচে সেটা তাদের গিয়ে জিজ্ঞেস করুন'_প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে করা এই মন্তব্যটি গত কয়েক দিন টক অব দ্য স্টেটে পরিণত হয়েছিল।
লেখক : কলকাতার সাংবাদিক
subrata.acharjee@gmail.com
ঘটনাপর্ব এক। কলকাতা প্রেসক্লাব। সময় বিকেল ৪টা। গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি নামের কলকাতারই এক মানবাধিকার সংগঠনের ডাকা সংবাদ সম্মেলন। উপলক্ষ মাওবাদীদের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান বন্ধ এবং মাওবাদী হিসেবে আটক প্রায় সব রাজনৈতিক বন্দির মুক্তির দাবিতে ২৩ ও ২৪ নভেম্বর কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলার মেট্রো চ্যানেলে অবস্থান ধর্মঘট বা প্রতিবাদ সভার তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার অনুমতি না দেওয়ার প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন। এপিডিআর নামে ওই সংগঠনের ডাকা এ সংবাদ সম্মেলন কলকাতার শীর্ষস্থানীয় স্যাটেলাইট চ্যানেল শুধু নয়, কভার করতে হাজির সর্বভারতীয়, এমনকি বাংলাদেশি শীর্ষস্থানীয় সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতিনিধিরাও। এর কারণ, এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হবেন দুই বাংলার জনপ্রিয় সাহিত্যিক-আদিবাসীদের আন্দোলনের নেত্রী মহাশ্বেতা দেবী। না, শুধু এই কারণ নয়। কারণ আরো আছে। এই প্রথম রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে একটি সংবাদ সম্মেলন হবে। এবং যেসব পরিবর্তনপন্থী বুদ্ধিজীবী বামফ্রন্ট সরকারের পরিবর্তন চেয়ে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারকে ক্ষমতায় বসানোর ডাক দিয়েছিলেন, তাঁদেরই সিংহভাগ বুদ্ধিজীবী এদিন পরিবর্তিত এই সরকারের নীতির সমালোচনা করবেন এবং উপস্থিত হবেন। আর সে কারণে সংবাদ সম্মেলনটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ সম্মেলনে নানা কারণে সশরীরে আসতে পারেননি সাহিত্যিক শঙ্খ ঘোষ, সংগীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়, অভিনেত্রী অপর্ণা সেন, নাট্যকার কৌসিক সেন, সাহিত্যিক নবারুণ ভট্টাচার্য, সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্য, সুমন মুখোপাধ্যায় এবং তৃণমূল সাংসদ জীবনমুখী গানের কবীর সুমনসহ আরো অনেক বিশিষ্টজন। কিন্তু তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেরই পাঠানো লিখিত বিবৃতি খামে করে ততক্ষণেই পেঁৗছে গেছে সংবাদ সম্মেলনে। সবাই একবাক্যে এই প্রতিবাদ সভা না করতে দেওয়া তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় সমালোচনা করেছেন। তবে অনুষ্ঠানের মধ্যমণি ছিলেন সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী। প্রথমে মহাশ্বেতা দেবী নিজে তাঁর লিখিত বক্তব্য পাঠন করেন, যার কথা ছিল ঠিক এ রকম_'আমরা বিগত ৬৪ বছরে যা ভাবতে পারিনি, জনগণের সরকার এসে সেই কাজটি করল। অর্থাৎ মেট্রো চ্যানেলে সমবেত হয়ে জনসাধারণ স্বীয় বক্তব্য দেওয়ার অধিকার হারাল। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানালাম। প্রতিবাদ করার অধিকার ছিল বলে ক্রমে জনমত গড়ে উঠেছে এবং আজকে একটা নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেছে। এসে তারা প্রতিবাদ করার অধিকারটাই কেড়ে নিল। অস্বাভাবিক কথা। আমরা কি ডেকে ফ্যাসিজম নিয়ে এসেছি?'
ঘটনাচক্র দুই : সোমবার বিকেল সাড়ে ৫টা। মহাকরণে প্রেস কর্নারে এসে দাঁড়ালেন তৃণমূল সভানেত্রী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি প্রায় আধা ঘণ্টা কথা বললেন। কিন্তু প্রথম কয়েক মিনিটে মোটামুটি মূল বক্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন তিনি বললেন_'আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলছি, কোনো একটি সংগঠন অ্যাবসলিউটলি মাওবাদীদের সমর্থনে সামনে গণতন্ত্রের ব্যানার আর পেছনে মাওবাদীদের ব্যানার নিয়ে অযথা কতগুলো মিথ্যা অপপ্রচার এবং কুৎসা রটাচ্ছে।' 'আমি বলছি, গণতান্ত্রিক রক্ষা কমিটি বললেই গণতন্ত্র রক্ষা হয় না। এটা মাওবাদীদের একটা মুখোশ। মহাশ্বেতা দেবী আজ অনেক কিছু বলছিলেন। তাঁকে আমি সম্মান করি। ওনার বয়স হয়েছে। ওনার বিরুদ্ধে আমি একটি কথাও বলব না। যা বলার আমি পলিটিক্যাললি বলব।' 'আমি দেখলাম, ওনার পাশে এসে এসে বলে দিয়ে যাচ্ছেন কেউ যে কী বলতে হবে। প্রেস কনফারেন্সটা আসলে প্যারোডি বলে মনে হচ্ছিল।' যা-ই হোক, ২৩-২৪ তারিখে মেট্রো চ্যানেলটি অন্য একটি সংগঠনের সভা করার জন্য বুক করা রয়েছে। তাই পুলিশ এই সংগঠনকে কলেজ স্কয়ার কিংবা গান্ধীমূর্তির পাদদেশে এই প্রতিবাদ সভা করার অনুরোধ করেছিল। এটুকু রিয়ালাইজেশন থাকা উচিত এই গণতান্ত্রিক সংগঠনের...।'
কবীর সুমনও এ দিনের সংবাদ সম্মেলনে মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে একমত পোষণ করেন এবং তিনি তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের সমালোচনা করেন। এক সাংবাদিক এ নিয়ে মমতার প্রতিক্রিয়া জানতে চান। এর উত্তরে মমতা বলেন, 'আমরা এক সেকেন্ডে ডিসিশন নিয়ে মাওবাদীদের গ্লোরিফাই করার জন্য ওনাকে বরখাস্ত করতে পারি। কিন্তু উনি যা করছেন করুন। আমি গণতান্ত্রিক কণ্ঠটা রোধ করতে চাই না। এর আগেও ছত্রধর মাহাতো (মাওবাদীদের ছায়া সংগঠন জনসাধারণের কমিটির প্রধান হয়ে) গান গেয়েছেন, আরো আছেন জাগরী বাস্কে (সম্প্রতি মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গিয়ে এই মাওবাদী শীর্ষ নেত্রী স্বামী-সন্তানসহ আত্মসমর্পণ করেন)। আমি আগেই বলেছি, আমরা ওনাকে (কবীর সুমনকে) এনে ভুল করেছিলাম। বুদ্ধিজীবী-সাহিত্যিকদের অংশগ্রহণের সুযোগ হিসেবে ওনাকে আমরা এনেছিলাম। কিন্তু আমরা ভাবতে পারিনি, উনি চরমপন্থীদের একজন সমর্থক।'
...একপর্যায়ে ফ্যাসিস্ট বলার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে মমতার মন্তব্য, 'ওনাকে আমরা সাহিত্য একাডেমীর পরিচালক করেছি। এই প্রথম ওনাকে সম্মান দিয়ে আমরা সেটা করেছি। উনি প্রবীণ মানুষ। ওনাকে দিয়ে এসব বলিয়ে নিচ্ছেন। আগে আমাদের হয়ে বলেছেন এ জন্য আমি কৃতজ্ঞ। এখন বলছেন না এর জন্যও কৃতজ্ঞ। আমাদের ফ্যাসিস্ট বলছেন। আরো বেশি করে বলুক। আর কী কী স্টাইল আছে বের করুক। কিন্তু এসব করে উগ্রপন্থীদের প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে সরকার আইনত ব্যবস্থা নেবে।'
এবার আসা যাক এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলের দু-একটি বিশ্লেষণে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বর্তমান সরকার ২০ নভেম্বর ছয় মাস পূর্ণ করল। স্বাভাবিকভাবে মুখ্যমন্ত্রী আশা করেছিলেন, এই সময়ে আর কিছু না হোক এই পরিবর্তনপন্থী বুদ্ধিজীবীরা ছয় মাসের সরকারের ভালো কাজের প্রশংসা করবেন। কিন্তু সেটা হলো না। বুদ্ধিজীবীদের এই অংশ রাজ্যটিতে তৃণমূল কংগ্রেসকে ২০০৭ সালের গ্রামপঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে রাজ্য সরকারে অধিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে অবশ্যই বড় ভূমিকা পালন করেছেন, সন্দেহ নেই। ছয় মাসের মধ্যে পরিবর্তনপন্থীরা এখন এই সরকারকেই 'ফ্যাসিজম' চালানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করলেন। আর তাও পরিবর্তনপন্থী বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম সমন্বয়কারী মহাশ্বেতা দেবীর মুখ থেকেই উচ্চারিত হলো। তাও আবার ফ্যাসিজমের মতো ভাষায়। বামফ্রন্টের সময় জঙ্গলমহলে যৌথ বাহিনী প্রত্যাহারের দাবিতে এসব বুদ্ধিজীবীর একটি বড় অংশকে নিয়ে তীব্র আন্দোলনে নেমেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু তা-ই নয়, সুশীল সমাজের ব্যানারে জঙ্গলমহলেও গিয়ে ছত্রধর মাহাতোর সঙ্গে প্রকাশ্যে বৈঠকও করেছিলেন আরো অনেকেই। ওই বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ এখন অবশ্যই রাজ্য সরকারের দেওয়া বিভিন্ন সরকারি পদে দায়িত্ব পালন করছেন। মমতা-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এমন দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসায় স্বাভাবিকভাবে এর আগের সপ্তাহে কংগ্রেস ও তৃণমূলের সঙ্গে জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান ও বর্ষীয়ান সিপিআইএম নেতা বিমান বসুর কুৎসিত মন্তব্য আপাতত মানুষ ভুলে যাবে। 'কংগ্রস-তৃণমূলের জোট শাড়ির ওপর না নিচে সেটা তাদের গিয়ে জিজ্ঞেস করুন'_প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে করা এই মন্তব্যটি গত কয়েক দিন টক অব দ্য স্টেটে পরিণত হয়েছিল।
লেখক : কলকাতার সাংবাদিক
subrata.acharjee@gmail.com
No comments