প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে গরমিল!-সুশাসন by মোঃ মাসুদ পারভেজ রানা
গণতান্ত্রিক চর্চায় সরকারি দল ও বিরোধী দলের মতের অমিল অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরং কোনো জাতীয় ইস্যু নিয়ে তাদের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ এবং সেই মোতাবেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ একটি ভালো পদক্ষেপ। কারণ বিরোধী দলের যুক্তিপূর্ণ বিরোধিতা বা সমালোচনা সরকারি দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক ভূমিকা রাখে। মূলত, এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই সংসদীয় গণতন্ত্রের সূচনা হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন মতের অমিল, বাকবিতণ্ডা এবং প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে
গরমিল নতুন কিছু নয়। আমরা হয়তো আরও খুশি হতাম যদি জাতীয় সংসদে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো নিয়ে বিরোধী দলের উপস্থিতিতে যুক্তিপূর্ণ আলোচনা হতো। এরপরও কিছুটা হলেও ভালো লাগার বিষয় হলো, কথা বা আলোচনা থেমে নেই। হোক না সেটা সংসদের বাইরে দলীয় ফোরামে, সুশীল সমাজের আলোচনায়। জাতীয় ইস্যুতে আমাদের কী করণীয় তা কিন্তু আমরা অনেকেই ভাবছি, বলছি, আলোচনা করছি। এ ক্ষেত্রে প্রচারমাধ্যমগুলো ধন্যবাদ পেতে পারে এ জন্যই যে, যেসব আলোচনা সংসদে হতে পারত, তা হয়তো আরও বড় পরিসরে করার জোগাড় তারা করে দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। যেভাবেই হোক না কেন, সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতি বিরোধী দলের অবস্থান, জনগণের অবস্থান প্রচারমাধ্যমের সহযোগিতায় আমরা জানতে পারছি। এ পর্যায়ে আমরা কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হতে পারি। কারণ দুই দলের ভূমিকা, ব্যর্থতা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে এবং জনগণ আগের চাইতে অনেক সজাগ ও সচেতন হয়ে উঠেছে। তারা কিছুটা হলেও কথা বলতে পারছে। তারই প্রতিফলস্বরূপ গত কয়েক দিন ধরে একটি বিষয় আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। মূলত সেটাই এ প্রবন্ধে তুলে ধরার চেষ্টা করব। সংক্ষেপে বলতে গেলে বিষয়টি হলো, বর্তমান সরকার পরিচালনায় সাম্প্রতিক অসঙ্গতি ও মতভেদ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চারটি অসঙ্গতি টিপাইমুখ প্রসঙ্গ, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, স্থানীয় ও সাধারণ নির্বাচন এবং অর্থনৈতিক সংকট। পাঠক, লক্ষ্য করবেন নিশ্চয়, এই বিষয়গুলো নিয়ে জাতীয় সংসদে বিস্তর আলোচনা না হলেও আমরা কিন্তু ভালোভাবেই অবগত হয়েছি, সরকার ও বিরোধী দল কী করছে, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির গরমিল কোথায়।
প্রথমেই টিপাইমুখ বাঁধ প্রসঙ্গে আসা যাক। বেশ কয়েক বছর ধরে আমরা রাজনৈতিক ফোরামে, প্রচারমাধ্যমে টিপাইমুখ নিয়ে আলোচনা শুনেছি। প্রসঙ্গটি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এবং বন্ধুপ্রতিম ছোট দেশের প্রতি ভারতের মনোভাবের দারুণ একটি উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে। তা ছাড়াও বর্তমান সরকার ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কতটা জুতসই পর্যায়ে আছে, তারও নজির পাওয়া গেছে। আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়েছে, ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা এবং ন্যায্য অধিকার আদায়ে বাংলাদেশ সরকার কতটা ফলপ্রসূ। খবরে এসেছে, ভারতের মণিপুর রাজ্যের বরাক নদীতে বহুল আলোচিত টিপাইমুখ প্রকল্প চূড়ান্ত হয়েছিল গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। গত মাসে তার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আমরা জানতে পেরেছি গত ১৯ নভেম্বর। আর সর্বশেষ এর চারদিন পর বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাবি জানিয়েছে, 'স্বচ্ছতার সঙ্গে ভারতের তথ্য দেওয়া উচিত।' টিভিতে দেখেছি, ১৯ নভেম্বরের পর টিপাইমুখ নিয়ে সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের মন্তব্যে ছিল হতাশার বাণী। পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী তো বলেই বসলেন, টিপাইমুখ ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। শুনে হতাশায় মুষড়ে গেছি! এই যদি হয় কোনো দায়িত্বশীল মন্ত্রীর কূটনৈতিক অবস্থান, তাহলে আদতে আমরা কী পাব, কত ফলপ্রসূভাবে আমরা আমাদের ন্যায্য দাবি আদায় করতে পারব! ওদিকে অপেক্ষার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উদ্বেগ না জানিয়ে শোনাল, ভারতের কী করা উচিত ছিল। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে কোনো কথাই বললেন না। পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর উক্তি আর শেষমেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবস্থান থেকে বোঝা যায়, বর্তমান সরকার টিপাইমুখ প্রসঙ্গ নিয়ে কতটা অপ্রস্তুত অবস্থায় ছিল এবং রয়েছে। তাহলে প্রশ্ন হলো, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এত সফর, এত কথাবার্তা সত্ত্বেও তিনি করছেনটা কী? নাকি তারা সব জেনেও লুকোচুরি খেলছেন? তারা কি ভেবেই নিয়েছেন, টিপাইমুখ প্রসঙ্গ গোপন রাখলে সফল দায়িত্বশীলতার পরিচয় মিলবে? এমন অস্পষ্টতা আর লুকোচুরি বাংলাদেশ, বাংলাদেশের সরকার এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগের যে কত বড় ক্ষতি_ তা কি তারা কখনও চিন্তা করেছেন?
এবার আসি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটা ভালো না মন্দ তা নিয়ে মন্তব্য করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যতই বলুন_ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি গত ১০ বছরের চেয়ে ভালো, দেশের জনগণ কিন্তু সঠিক হিসাব কষে নিয়েছে। সর্বক্ষেত্রে ব্যাপক অরাজকতা যে ছেয়ে গেছে, তা প্রতীয়মান। নরসিংদীর জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হত্যাকাণ্ড কি দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির জাজ্বল্য প্রমাণ নয়?
জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশন নিয়েও চলছে একই ধরনের টানাপড়েন। হ্যাঁ, একটি স্বায়ত্তশাসিত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের যে কোনো ধরনের উন্নয়নমূলক পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা সংযোজনের অধিকার রয়েছে। আবার দেশের সার্বিক উন্নয়ন বিবেচনায় নির্বাচন কমিশনের সব দায়ভার সরকারের ওপরও বর্তায়। কারণ অর্থায়ন থেকে শুরু করে নির্বাচনকালীন লজিস্টিক সহযোগিতা সরকারকেই দিতে হয়। এ জন্য প্রয়োজন হয় সরকার ও নির্বাচন কমিশনের উন্নয়ন ইস্যুতে সহমত। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি, নির্বাচন কমিশন যা চায়, সরকার তা দিতে নারাজ। সর্বশেষ, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেনা মোতায়েন নিয়ে টানাপড়েন পরিলক্ষিত হয়েছে। নির্বাচনে ব্যাপক সংঘাতের আশঙ্কায় নির্বাচন কমিশন সামরিক সহযোগিতা চাইলেও সরকার নীরব থেকেছে। আমার মনে আছে, সে সময় এক মন্ত্রী কোনো এক টিভির টক শোতে বলেছিলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশে না থাকার কারণে সেনা মোতায়েন সংক্রান্ত নির্বাচন কমিশনের চিঠি বিবেচনা করা যায়নি। আবার অনেকেই বলেছিলেন, সেনা মোতায়েনের প্রয়োজন না হলে দরকার কী। অথচ নির্বাচনের আগের দিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বললেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে তার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। কারণ তিনি সেনা সহযোগিতা চেয়েও পাননি। যা হোক, আবারও অনেক অপেক্ষার পর গত ২০ নভেম্বর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সেনা মোতায়েন সংক্রান্ত নির্বাচন কমিশনের চিঠির জবাব দিয়েছে। পাঠকগণ, আপনারা নিশ্চয় অসঙ্গতি লক্ষ্য করছেন। নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, নির্বাচনের কতদিন পর জবাব এলো, আর জবাবটাই-বা কী হবে!
নির্বাচনসংশ্লিষ্ট আর একটি কথা বলা জরুরি। সেটি হলো, বর্তমান সরকার সাধারণ জনগণ, সুশীল সমাজের পরামর্শ তোয়াক্কা না করেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বেআইনি বলে বাতিল করেছে। সরকার সবাইকে সমানভাবে আশ্বস্ত করতে পারবে না_ এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু উদ্বেগের বিষয়, সরকার অন্তত নির্বাচন কমিশনকে বোঝাতে পারত যে, তাদের উদ্দেশ্য হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বাতিল করা ও রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন চালু করা। কিন্তু সরকার সেটি করতে ব্যর্থ হয়েছে। তার প্রমাণ হলো, গত ২২ নভেম্বর সিইসি এটিএম শামসুল হুদা বলেছেন, রাজনৈতিক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন কঠিন। অর্থাৎ অনুমান করা যায়, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অবস্থানগত কত অসঙ্গতি।
সর্বশেষ, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে সরকারের অবস্থানগত অসঙ্গতি আলোকপাত করতে চাই। শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থা, আশানুরূপ বিনিয়োগ আকর্ষণে ব্যর্থতা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বর্গতি, অল্প সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং ব্যাংক থেকে সরকারের ব্যাপক হারে ঋণ গ্রহণ দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক সংকট প্রকাশ করে। দেশের স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদরা প্রতিনিয়ত বলে চলেছেন এসব সংকটের কথা। কিন্তু আমরা কী দেখলাম! প্রধানমন্ত্রী বললেন, দেশে কোনো অর্থনৈতিক সংকট নেই। ব্যাংক রিজার্ভেরও নাকি প্রয়োজন নেই। তাহলে অর্থনীতিবিদরা কি ভুল বলছেন? নাকি দেশের বিরুদ্ধে, সরকারের বিরুদ্ধে তারা ষড়যন্ত্র করছেন? এক বছর ধরে শেয়ারবাজারের এই সংকট সত্ত্বেও সরকার উল্লেখযোগ্য কিছুই করতে পারেনি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন, মাছের বাজারে বিড়ালকে নাকি রাজা বানানো হয়েছে। তার সাম্প্রতিক উক্তিগুলো বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, তিনি আওয়ামী লীগ ও দেশের বিবেক হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু এই বিবেকবানদের কথা সরকার গ্রাহ্য করছে না কেন? এখন তিনি মন্ত্রী। দেখা যাক কী বলেন ও করেন। অনেকে বলছেন, শর্ষের মধ্যে ভূত লুকিয়ে আছে। এই ভূত তাড়াবে কে? মূল সমস্যা হলো, দেশের জনগণ ও অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা ভাবছেন এক; আর সরকার বলছে ও করছে আর এক। সরকার কি বুঝতে পারছে না, জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে তাদের কথাবার্তা আর কর্মকাণ্ডের কতটা বিভেদ রয়েছে। সারাবিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে_ এ কথা সত্যি। কিন্তু সরকার জনগণকে কতটুকু বোঝাতে সক্ষম হয়েছে_ তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, সরকারের বর্তমান অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে মিলছে না। স্পষ্টভাবে পরস্পর আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের বিশ্বাস, সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ এ ধরনের অসঙ্গতি অচিরেই দূর করবেন। আশা করি, বিরোধী দল জনকল্যাণমুখী রাজনীতির প্রয়াসে সরকারকে প্রয়োজনে সমালোচনা ও সহযোগিতা করবে। অন্যথায় বাংলাদেশ গভীর সংকটে আবদ্ধ হতে চলেছে! এর জন্য বর্তমান সরকারের কাণ্ডারি হিসেবে আওয়ামী লীগকে চরম মূল্য দিতে হবে_ এটা নিশ্চিত।
মোঃ মাসুদ পারভেজ রানা :শিক্ষক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
mmprana@yahoo.com
প্রথমেই টিপাইমুখ বাঁধ প্রসঙ্গে আসা যাক। বেশ কয়েক বছর ধরে আমরা রাজনৈতিক ফোরামে, প্রচারমাধ্যমে টিপাইমুখ নিয়ে আলোচনা শুনেছি। প্রসঙ্গটি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এবং বন্ধুপ্রতিম ছোট দেশের প্রতি ভারতের মনোভাবের দারুণ একটি উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে। তা ছাড়াও বর্তমান সরকার ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কতটা জুতসই পর্যায়ে আছে, তারও নজির পাওয়া গেছে। আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়েছে, ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা এবং ন্যায্য অধিকার আদায়ে বাংলাদেশ সরকার কতটা ফলপ্রসূ। খবরে এসেছে, ভারতের মণিপুর রাজ্যের বরাক নদীতে বহুল আলোচিত টিপাইমুখ প্রকল্প চূড়ান্ত হয়েছিল গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। গত মাসে তার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আমরা জানতে পেরেছি গত ১৯ নভেম্বর। আর সর্বশেষ এর চারদিন পর বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাবি জানিয়েছে, 'স্বচ্ছতার সঙ্গে ভারতের তথ্য দেওয়া উচিত।' টিভিতে দেখেছি, ১৯ নভেম্বরের পর টিপাইমুখ নিয়ে সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের মন্তব্যে ছিল হতাশার বাণী। পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী তো বলেই বসলেন, টিপাইমুখ ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। শুনে হতাশায় মুষড়ে গেছি! এই যদি হয় কোনো দায়িত্বশীল মন্ত্রীর কূটনৈতিক অবস্থান, তাহলে আদতে আমরা কী পাব, কত ফলপ্রসূভাবে আমরা আমাদের ন্যায্য দাবি আদায় করতে পারব! ওদিকে অপেক্ষার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উদ্বেগ না জানিয়ে শোনাল, ভারতের কী করা উচিত ছিল। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে কোনো কথাই বললেন না। পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর উক্তি আর শেষমেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবস্থান থেকে বোঝা যায়, বর্তমান সরকার টিপাইমুখ প্রসঙ্গ নিয়ে কতটা অপ্রস্তুত অবস্থায় ছিল এবং রয়েছে। তাহলে প্রশ্ন হলো, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এত সফর, এত কথাবার্তা সত্ত্বেও তিনি করছেনটা কী? নাকি তারা সব জেনেও লুকোচুরি খেলছেন? তারা কি ভেবেই নিয়েছেন, টিপাইমুখ প্রসঙ্গ গোপন রাখলে সফল দায়িত্বশীলতার পরিচয় মিলবে? এমন অস্পষ্টতা আর লুকোচুরি বাংলাদেশ, বাংলাদেশের সরকার এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগের যে কত বড় ক্ষতি_ তা কি তারা কখনও চিন্তা করেছেন?
এবার আসি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটা ভালো না মন্দ তা নিয়ে মন্তব্য করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যতই বলুন_ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি গত ১০ বছরের চেয়ে ভালো, দেশের জনগণ কিন্তু সঠিক হিসাব কষে নিয়েছে। সর্বক্ষেত্রে ব্যাপক অরাজকতা যে ছেয়ে গেছে, তা প্রতীয়মান। নরসিংদীর জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হত্যাকাণ্ড কি দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির জাজ্বল্য প্রমাণ নয়?
জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশন নিয়েও চলছে একই ধরনের টানাপড়েন। হ্যাঁ, একটি স্বায়ত্তশাসিত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের যে কোনো ধরনের উন্নয়নমূলক পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা সংযোজনের অধিকার রয়েছে। আবার দেশের সার্বিক উন্নয়ন বিবেচনায় নির্বাচন কমিশনের সব দায়ভার সরকারের ওপরও বর্তায়। কারণ অর্থায়ন থেকে শুরু করে নির্বাচনকালীন লজিস্টিক সহযোগিতা সরকারকেই দিতে হয়। এ জন্য প্রয়োজন হয় সরকার ও নির্বাচন কমিশনের উন্নয়ন ইস্যুতে সহমত। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি, নির্বাচন কমিশন যা চায়, সরকার তা দিতে নারাজ। সর্বশেষ, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেনা মোতায়েন নিয়ে টানাপড়েন পরিলক্ষিত হয়েছে। নির্বাচনে ব্যাপক সংঘাতের আশঙ্কায় নির্বাচন কমিশন সামরিক সহযোগিতা চাইলেও সরকার নীরব থেকেছে। আমার মনে আছে, সে সময় এক মন্ত্রী কোনো এক টিভির টক শোতে বলেছিলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশে না থাকার কারণে সেনা মোতায়েন সংক্রান্ত নির্বাচন কমিশনের চিঠি বিবেচনা করা যায়নি। আবার অনেকেই বলেছিলেন, সেনা মোতায়েনের প্রয়োজন না হলে দরকার কী। অথচ নির্বাচনের আগের দিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বললেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে তার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। কারণ তিনি সেনা সহযোগিতা চেয়েও পাননি। যা হোক, আবারও অনেক অপেক্ষার পর গত ২০ নভেম্বর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সেনা মোতায়েন সংক্রান্ত নির্বাচন কমিশনের চিঠির জবাব দিয়েছে। পাঠকগণ, আপনারা নিশ্চয় অসঙ্গতি লক্ষ্য করছেন। নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, নির্বাচনের কতদিন পর জবাব এলো, আর জবাবটাই-বা কী হবে!
নির্বাচনসংশ্লিষ্ট আর একটি কথা বলা জরুরি। সেটি হলো, বর্তমান সরকার সাধারণ জনগণ, সুশীল সমাজের পরামর্শ তোয়াক্কা না করেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বেআইনি বলে বাতিল করেছে। সরকার সবাইকে সমানভাবে আশ্বস্ত করতে পারবে না_ এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু উদ্বেগের বিষয়, সরকার অন্তত নির্বাচন কমিশনকে বোঝাতে পারত যে, তাদের উদ্দেশ্য হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বাতিল করা ও রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন চালু করা। কিন্তু সরকার সেটি করতে ব্যর্থ হয়েছে। তার প্রমাণ হলো, গত ২২ নভেম্বর সিইসি এটিএম শামসুল হুদা বলেছেন, রাজনৈতিক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন কঠিন। অর্থাৎ অনুমান করা যায়, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অবস্থানগত কত অসঙ্গতি।
সর্বশেষ, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে সরকারের অবস্থানগত অসঙ্গতি আলোকপাত করতে চাই। শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থা, আশানুরূপ বিনিয়োগ আকর্ষণে ব্যর্থতা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বর্গতি, অল্প সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং ব্যাংক থেকে সরকারের ব্যাপক হারে ঋণ গ্রহণ দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক সংকট প্রকাশ করে। দেশের স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদরা প্রতিনিয়ত বলে চলেছেন এসব সংকটের কথা। কিন্তু আমরা কী দেখলাম! প্রধানমন্ত্রী বললেন, দেশে কোনো অর্থনৈতিক সংকট নেই। ব্যাংক রিজার্ভেরও নাকি প্রয়োজন নেই। তাহলে অর্থনীতিবিদরা কি ভুল বলছেন? নাকি দেশের বিরুদ্ধে, সরকারের বিরুদ্ধে তারা ষড়যন্ত্র করছেন? এক বছর ধরে শেয়ারবাজারের এই সংকট সত্ত্বেও সরকার উল্লেখযোগ্য কিছুই করতে পারেনি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন, মাছের বাজারে বিড়ালকে নাকি রাজা বানানো হয়েছে। তার সাম্প্রতিক উক্তিগুলো বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, তিনি আওয়ামী লীগ ও দেশের বিবেক হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু এই বিবেকবানদের কথা সরকার গ্রাহ্য করছে না কেন? এখন তিনি মন্ত্রী। দেখা যাক কী বলেন ও করেন। অনেকে বলছেন, শর্ষের মধ্যে ভূত লুকিয়ে আছে। এই ভূত তাড়াবে কে? মূল সমস্যা হলো, দেশের জনগণ ও অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা ভাবছেন এক; আর সরকার বলছে ও করছে আর এক। সরকার কি বুঝতে পারছে না, জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে তাদের কথাবার্তা আর কর্মকাণ্ডের কতটা বিভেদ রয়েছে। সারাবিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে_ এ কথা সত্যি। কিন্তু সরকার জনগণকে কতটুকু বোঝাতে সক্ষম হয়েছে_ তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, সরকারের বর্তমান অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে মিলছে না। স্পষ্টভাবে পরস্পর আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের বিশ্বাস, সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ এ ধরনের অসঙ্গতি অচিরেই দূর করবেন। আশা করি, বিরোধী দল জনকল্যাণমুখী রাজনীতির প্রয়াসে সরকারকে প্রয়োজনে সমালোচনা ও সহযোগিতা করবে। অন্যথায় বাংলাদেশ গভীর সংকটে আবদ্ধ হতে চলেছে! এর জন্য বর্তমান সরকারের কাণ্ডারি হিসেবে আওয়ামী লীগকে চরম মূল্য দিতে হবে_ এটা নিশ্চিত।
মোঃ মাসুদ পারভেজ রানা :শিক্ষক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
mmprana@yahoo.com
No comments