টিপাইমুখ বাঁধ : হাওরে দেখা দেবে মহাবিপর্যয় by আখলাক হুসেইন খান
আমাদের দুর্ভাবনা ও আশঙ্কা এত দ্রুত বাস্তবে রূপ নেবে, তা হৃদবোধে ছিল না। কেননা টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আশার বাণীতে আমরা আশ্বস্ত ছিলাম। এ মাসের গোড়ার দিকে অভিন্ন নদী ও পানিপ্রবাহ নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ২২টি অভিন্ন নদীর মধ্যে ভারত ১৮টি নদীতে বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার করছে এবং টিপাইমুখ বাঁধ ১৯তম, এর সঙ্গে ২০তম বাঁধ হিসেবে যোগ হয়েছে মাণ্ডু নদীর বাঁধ।
এর বিরূপ প্রভাবে হাওরাঞ্চলে পানিপ্রবাহের দৈন্যদশাই ছিল আলোচনার বিষয়। বাঁধ প্রতিবন্ধকতায় উজানের পানিপ্রবাহ কমে দ্রুত নদ-নদীগুলো মুমূর্ষু ও মরে যাওয়ায় শুকনো এবং বর্ষা মৌসুমে হাওরে পানিপ্রবাহ অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে। জলবায়ু পরিবর্তনে মৌসুমি রায়ুর অনিয়মে শুকনো মৌসুমে অনাবৃষ্টিতে অধিকাংশ নদীর বুকে ধু-ধু বালুচর আর বর্ষা ও প্রাক-বর্ষায় অতিবৃষ্টি এবং স্বল্পসময়ে প্রচুর বৃষ্টিপাতে পানির চাপ বাড়ে। পানি ধারণক্ষমতা হারানো নদ-নদীগুলোতে কানায় কানায় পানি ভরে ওঠে। আর উজানে পাহাড়ি ঢলের পানির চাপ বাড়লেই ভারত সব কয়টি বাঁধের স্লুইসগেট খুলে দেয়। পানি নেমে নদীর পাড় মাড়িয়ে হাওরে প্রবেশ করায় প্লাবিত হয়ে পড়ে বিস্তীর্ণ এলাকা। এ পরিস্থিতিতে খরা ও বন্যা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে দেশের অর্থনীতির প্রধান শক্তি কৃষি ও কৃষক। নদীভিত্তিক কৃষিসভ্যতা পড়ছে হুমকির মুখে। অভিন্ন ২২টি নদীসহ ৮৩টিরও অধিক নদ-নদী রয়েছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। স্বল্পসময়ে প্রচুর বৃষ্টিতে বৃক্ষহীন ন্যাড়া পাহাড়ে ভূমিধসসহ বালু-মাটি ধুয়ে পানির সঙ্গে নেমে আসছে ভাটির নদ-নদীতে। আর এ পলিবালি সঞ্চারিত হয়ে নদীগুলো দ্রুত মরে যাচ্ছে এবং মুমূর্ষু হয়ে পড়েছে। একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন রুটের নৌপথ। ঠিক এ সময়টায় অত্রাঞ্চলের মুমূর্ষু হয়ে পড়া সুরমা ও কুশিয়ারার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রধান নদীর উৎস নদী বরাকের টিপাইমুখে ভারত জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বাঁধ নির্মাণ করার জন্য সব প্রস্তুতি চূড়ান্ত করল। এই বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন হলে মরার আগেই পানি হারাবে সুরমা-কুশিয়ারাসহ এর শাখা ও উপনদী ২০-২৫টি। নাগা মণিপুরের জলবিভাজিকর দক্ষিণ ঢালে উৎপন্ন বরাক নদ। সুরমা ও কুশিয়ারা নামে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে সিলেটের জকিগঞ্জের অমলশিদ এলাকা দিয়ে প্রবেশ করেছে। ৬৬৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এ অভিন্ন নদীটি ভারতের অংশে ১৫২ কিলোমিটার বয়ে বাংলাদেশ অংশে সুরমা ২৮৯ কিলোমিটার বয়েছে সিলেটের ওপর দিয়ে উত্তরে সুনামগঞ্জ হয়ে, অপেক্ষাকৃত দক্ষিণে কিশোরগঞ্জ হয়ে এবং কুশিয়ারা ২২৮ কিলোমিটার বয়েছে সিলেটের ওপর দিয়ে অপেক্ষাকৃত দক্ষিণে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ হয়ে ভৈরবের কাছে মেঘনা নদীতে মিলিত হয়েছে। এই দুই নদী ও শাখা-উপনদীর অববাহিকায় হাওরের আদি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। ৩৯৫টি হাওরের প্লাবনভূমিতে বোরো, রোপা আমন ও আউশ ধান উৎপাদনে কৃষি অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত। এ ছাড়া মৎস্য সম্পদ, খনিজ সম্পদ, জলজ উদ্ভিদ ও ফল, সোয়াম্প ও রিড ফরেস্টসহ জীববৈচিত্র্যের উর্বর ভূমি। এ বাঁধ নির্মাণ হলে পরিবেশ-প্রতিবেশ বিনষ্ট হয়ে সব বৈচিত্র্যে ধ্বংসলীলা বয়ে যাবে। এককথায় হাওরাঞ্চল চরম ধ্বংসমুখে পতিত হবে এবং অসংখ্য মানুষের জীবন-জীবিকা স্তব্ধ হয়ে যাবে।
ভাটির দেশকে অবজ্ঞা করে ভারত বরাক নদের টিপাইমুখে ১৬৯ মিটার উচ্চতা ও ৩১০ মিটার লম্বা বিশাল বাঁধ তৈরি করছে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য। নদীর দুই পাশে পাহাড় বেড়িবাঁধ হিসেবে কাজ করবে এবং এ বাঁধের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮০ মিটার উচ্চ হবে। তাদের পরিকল্পনা মতো এ বাঁধের উচ্চতা ৫০তলা উঁচু ভবনের সমান। এতে ১৫ দশমিক ৯ মিলিয়ন কিউবেক পানি ধারণ করবে। এই বিশাল জলাধার এখন হাওরবাসীর দুঃস্বপ্নের দৈত্য। আমরা আশা করছি, আন্তর্জাতিক মহল জলবায়ু ও পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনের মতো এ আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে হাওর-নদী বাঁচাতে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ পরিকল্পনা বহু পুরনো। ১৯৯২ সালে যৌথ নদী কমিশনের প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ফ্যাপ ৬-এর একটা হিসাব ছিল টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ হলে জুলাই (আষাঢ়-শ্রাবণ) মাসে ভাটিতে পানির সর্বোচ্চ প্রবাহ ৪০ শতাংশ হ্রাস পাবে। অর্থাৎ ওই মাসে পানির উচ্চতা ২ দশমিক ৬ মিটার নেমে যাবে। বর্ষাকালে পানি হ্রাস পাবে ৩১ শতাংশ। ফ্রেব্রুয়ারি (মাঘ-ফাল্গুন) মাসে পানির সর্বনিম্ন প্রবাহ বাড়বে ৭ দশমিক ৯ গুণ। নদীতে পানির উচ্চতা বাড়বে সাড়ে ৩ মিটার। শুকনো মৌসুমে পানির প্রবাহ বাড়বে ২ দশমিক ৩ গুণ। অর্থাৎ বর্ষা মৌসুমে পানি আসবে কম এবং শুকনো মৌসুমে পানি আসবে বেশি। ফ্যাপ ৬-এর এ হিসাবে বর্ষায় পানি কম এলে বন্যার ঝুঁকি কমবে। কিন্তু এখানে হিসাব অন্যটি। উজানে পানি প্রত্যাহার হওয়ায় বৃহত্তর সিলেট, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লার হাওরাঞ্চলে বর্ষার পানি বিস্তার ২২ হাজার ২২ বর্গকিলোমিটার থেকে নেমে ছয়-সাত হাজার বর্গকিলোমিটারে এসে ঠেকেছে। উচ্চতার পাঁচ-ছয় ফুট কম পানি হচ্ছে। এ ছাড়া অপেক্ষাকৃত উঁচু হাওরে পানি উঠতেই পারছে না। কোনো কোনো বছর এক মাস থেকে দেড় মাস বিলম্বে বর্ষার পানি আসছে। এতে মাছের প্রজনন বিনষ্টসহ বোনা রোপো আমনসহ আউশ ধান উৎপাদন অর্ধেকেরও নিচে নেমে যাচ্ছে। এই যখন বর্তমান অবস্থা। ফ্যাপের হিসাব মতে, বাঁধ হলে বর্ষায় হাওরে ৩১ শতাংশ পানি কমবে। অর্থাৎ এমনিতেই বর্ষায় স্বাভাবিক পানির চেয়ে ৬০ শতাংশ পানি কম আসছে। টিপাইমুখ বাঁধের ফলে সুরমা-কুশিয়ারায় পানিপ্রবাহ আরো ৩১ শতাংশ কমলে বর্ষার চিত্রটি কি হবে তা সহজেই অনুমেয়। বর্ষা হারাবে তার বৈচিত্র্য। প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদ উৎপাদন, জলজ উদ্ভিদ ও ফল, সোয়াম্প ও রিড ফরেস্ট ব্যাপক ক্ষতিসাধনসহ পানিভিত্তিক খনিজ সম্পদ আহরণের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। অক্টোবর-নভেম্বর (আশ্বিন-কার্তিক-অগ্রহায়ণ) মাসে বর্ষার পানি হাওর থেকে নেমে যায়। এ সময় টিপাইয়ের জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের টারবাইন চালু থাকবে। তখন নদীতে পানির চাপ থাকবে। এতে নিম্নাঞ্চলের হাওরের পানি সহজে ভাটিতে নামতে না পারায় জলাবদ্ধতা দেখা দেবে। তখন বোরো বীজতলা তৈরি করা সম্ভব হবে না। এক থেকে দেড় মাস পিছিয়ে পৌষ-মাঘ মাসে বীজ বুনতে হবে। জমিতে চারা বোপণ করতে হবে ফাল্গুন মাসে। ১৪০ ও ১৪৫ দিনে বোরোজাতীয় ধান পাকে। তাহলে ধান কাটা পড়বে জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে। ওই মাসে বর্ষার জলে হাওর জলমগ্ন হয়ে যায়। এমনকি অতিবৃষ্টি হলে উজানের পানিতে হাওর চৈত্র মাসেই প্লাবিত হয়ে পড়ে। মোদ্দাকথা, নিম্নাঞ্চল বোরো আবাদের অযোগ্য হয়ে পড়বে। এতে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার ফসল থেকে আমরা বঞ্চিত হব।
বরাক ও টুইভাই নদীর মোহনার ভাটিতে নির্মিতব্য টিপাইয়ের স্টোরেজ বাঁধে ১৫ দশমিক ৯ মিলিয়ন কিউবিক পানি সংরক্ষণ করবে। এই পরিমাণ পানি সংরক্ষণ করলে বিশেষজ্ঞ না হয়েও বলা যায়, ভাটিতে প্রবাহ কমে নদী প্রাণ হারাবেই। এ ছাড়া টিপাই বাঁধের ভাটিতে ফুলেরতলা এলাকায় ব্যারাজ নির্মাণ করে চ্যানেলের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করে কাছাড় এলাকায় সেচপ্রকল্প চালু করবে বলে তথ্য রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে শুষ্ক মৌসুমে এমনিতেই বৃষ্টিপাতের মাত্রা কমে গেছে। তার ওপর এ সেচপ্রকল্প চালু হলে সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি তলানিতে নেমে যাবে। এমনকি দুই-তিন মিটার উচ্চতার বেশি পানি পাওয়া যাবে না। অববাহিকা নদীর এ অবস্থা হলে মেঘনা নদীর অবস্থাও এমনটি হবে। শাখা উপনদীও পানিশূন্য হয়ে মরার আগেই পানির হাহাকারে ফেলবে। ভেঙে পড়বে সেচব্যবস্থা। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এখনই অস্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। এ বাঁধে এর প্রকটতা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাবে। ভূগর্ভ ও ভূপৃষ্ঠে সমানতালে পানিশূন্য হয়ে পড়বে। সুপেয় পানি নাগালের বাইরে চলে যাবে। বিশেষজ্ঞের মতে, বাঁধের ফলে ভূমিকম্পের ঝুঁকি স্পষ্ট। সিলেটের জকিগঞ্জের সীমান্তের ১০০ কিলোমিটার উজানে এ বাঁধ। ভূমিকম্পের এই দৈত্যাকৃতির বাঁধ ভেঙে গেলে কুশিয়ারা-সুরমাপারের বসত এলাকায় সুনামি দেখা দেওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা। আর এই সুনামি হলে এ অঞ্চল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। আমরা মনে করি, এসব বিষয়ে একটি বিশেষজ্ঞ দল দ্বারা সমীক্ষা চালিয়ে এর পূর্ণ তথ্য জনসমক্ষে তুলে ধরে আতঙ্কমুক্ত করার পাশাপাশি আমাদের বৃহৎ স্বার্থ রক্ষায় জোরদার পদক্ষেপ দরকার কালবিলম্ব না করে। এর সঙ্গে বসবাস করার উপযুক্ত অবকাঠামো গড়ার উদ্যোগ নেওয়াও জরুরি। ভারতের বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা বন্ধে ও পানির ন্যায্য হিস্যা দিতে বাধ্য করতে জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে চাপ সৃষ্টি করা সর্বোত্তম। কেননা দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সফলতা মেলার আশা খুবই ক্ষীণ। অতীত ইতিহাস তা-ই বলে।
লেখক : হাওর গবেষক
ভাটির দেশকে অবজ্ঞা করে ভারত বরাক নদের টিপাইমুখে ১৬৯ মিটার উচ্চতা ও ৩১০ মিটার লম্বা বিশাল বাঁধ তৈরি করছে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য। নদীর দুই পাশে পাহাড় বেড়িবাঁধ হিসেবে কাজ করবে এবং এ বাঁধের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮০ মিটার উচ্চ হবে। তাদের পরিকল্পনা মতো এ বাঁধের উচ্চতা ৫০তলা উঁচু ভবনের সমান। এতে ১৫ দশমিক ৯ মিলিয়ন কিউবেক পানি ধারণ করবে। এই বিশাল জলাধার এখন হাওরবাসীর দুঃস্বপ্নের দৈত্য। আমরা আশা করছি, আন্তর্জাতিক মহল জলবায়ু ও পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনের মতো এ আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে হাওর-নদী বাঁচাতে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ পরিকল্পনা বহু পুরনো। ১৯৯২ সালে যৌথ নদী কমিশনের প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ফ্যাপ ৬-এর একটা হিসাব ছিল টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ হলে জুলাই (আষাঢ়-শ্রাবণ) মাসে ভাটিতে পানির সর্বোচ্চ প্রবাহ ৪০ শতাংশ হ্রাস পাবে। অর্থাৎ ওই মাসে পানির উচ্চতা ২ দশমিক ৬ মিটার নেমে যাবে। বর্ষাকালে পানি হ্রাস পাবে ৩১ শতাংশ। ফ্রেব্রুয়ারি (মাঘ-ফাল্গুন) মাসে পানির সর্বনিম্ন প্রবাহ বাড়বে ৭ দশমিক ৯ গুণ। নদীতে পানির উচ্চতা বাড়বে সাড়ে ৩ মিটার। শুকনো মৌসুমে পানির প্রবাহ বাড়বে ২ দশমিক ৩ গুণ। অর্থাৎ বর্ষা মৌসুমে পানি আসবে কম এবং শুকনো মৌসুমে পানি আসবে বেশি। ফ্যাপ ৬-এর এ হিসাবে বর্ষায় পানি কম এলে বন্যার ঝুঁকি কমবে। কিন্তু এখানে হিসাব অন্যটি। উজানে পানি প্রত্যাহার হওয়ায় বৃহত্তর সিলেট, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লার হাওরাঞ্চলে বর্ষার পানি বিস্তার ২২ হাজার ২২ বর্গকিলোমিটার থেকে নেমে ছয়-সাত হাজার বর্গকিলোমিটারে এসে ঠেকেছে। উচ্চতার পাঁচ-ছয় ফুট কম পানি হচ্ছে। এ ছাড়া অপেক্ষাকৃত উঁচু হাওরে পানি উঠতেই পারছে না। কোনো কোনো বছর এক মাস থেকে দেড় মাস বিলম্বে বর্ষার পানি আসছে। এতে মাছের প্রজনন বিনষ্টসহ বোনা রোপো আমনসহ আউশ ধান উৎপাদন অর্ধেকেরও নিচে নেমে যাচ্ছে। এই যখন বর্তমান অবস্থা। ফ্যাপের হিসাব মতে, বাঁধ হলে বর্ষায় হাওরে ৩১ শতাংশ পানি কমবে। অর্থাৎ এমনিতেই বর্ষায় স্বাভাবিক পানির চেয়ে ৬০ শতাংশ পানি কম আসছে। টিপাইমুখ বাঁধের ফলে সুরমা-কুশিয়ারায় পানিপ্রবাহ আরো ৩১ শতাংশ কমলে বর্ষার চিত্রটি কি হবে তা সহজেই অনুমেয়। বর্ষা হারাবে তার বৈচিত্র্য। প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদ উৎপাদন, জলজ উদ্ভিদ ও ফল, সোয়াম্প ও রিড ফরেস্ট ব্যাপক ক্ষতিসাধনসহ পানিভিত্তিক খনিজ সম্পদ আহরণের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। অক্টোবর-নভেম্বর (আশ্বিন-কার্তিক-অগ্রহায়ণ) মাসে বর্ষার পানি হাওর থেকে নেমে যায়। এ সময় টিপাইয়ের জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের টারবাইন চালু থাকবে। তখন নদীতে পানির চাপ থাকবে। এতে নিম্নাঞ্চলের হাওরের পানি সহজে ভাটিতে নামতে না পারায় জলাবদ্ধতা দেখা দেবে। তখন বোরো বীজতলা তৈরি করা সম্ভব হবে না। এক থেকে দেড় মাস পিছিয়ে পৌষ-মাঘ মাসে বীজ বুনতে হবে। জমিতে চারা বোপণ করতে হবে ফাল্গুন মাসে। ১৪০ ও ১৪৫ দিনে বোরোজাতীয় ধান পাকে। তাহলে ধান কাটা পড়বে জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে। ওই মাসে বর্ষার জলে হাওর জলমগ্ন হয়ে যায়। এমনকি অতিবৃষ্টি হলে উজানের পানিতে হাওর চৈত্র মাসেই প্লাবিত হয়ে পড়ে। মোদ্দাকথা, নিম্নাঞ্চল বোরো আবাদের অযোগ্য হয়ে পড়বে। এতে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার ফসল থেকে আমরা বঞ্চিত হব।
বরাক ও টুইভাই নদীর মোহনার ভাটিতে নির্মিতব্য টিপাইয়ের স্টোরেজ বাঁধে ১৫ দশমিক ৯ মিলিয়ন কিউবিক পানি সংরক্ষণ করবে। এই পরিমাণ পানি সংরক্ষণ করলে বিশেষজ্ঞ না হয়েও বলা যায়, ভাটিতে প্রবাহ কমে নদী প্রাণ হারাবেই। এ ছাড়া টিপাই বাঁধের ভাটিতে ফুলেরতলা এলাকায় ব্যারাজ নির্মাণ করে চ্যানেলের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করে কাছাড় এলাকায় সেচপ্রকল্প চালু করবে বলে তথ্য রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে শুষ্ক মৌসুমে এমনিতেই বৃষ্টিপাতের মাত্রা কমে গেছে। তার ওপর এ সেচপ্রকল্প চালু হলে সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি তলানিতে নেমে যাবে। এমনকি দুই-তিন মিটার উচ্চতার বেশি পানি পাওয়া যাবে না। অববাহিকা নদীর এ অবস্থা হলে মেঘনা নদীর অবস্থাও এমনটি হবে। শাখা উপনদীও পানিশূন্য হয়ে মরার আগেই পানির হাহাকারে ফেলবে। ভেঙে পড়বে সেচব্যবস্থা। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এখনই অস্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। এ বাঁধে এর প্রকটতা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাবে। ভূগর্ভ ও ভূপৃষ্ঠে সমানতালে পানিশূন্য হয়ে পড়বে। সুপেয় পানি নাগালের বাইরে চলে যাবে। বিশেষজ্ঞের মতে, বাঁধের ফলে ভূমিকম্পের ঝুঁকি স্পষ্ট। সিলেটের জকিগঞ্জের সীমান্তের ১০০ কিলোমিটার উজানে এ বাঁধ। ভূমিকম্পের এই দৈত্যাকৃতির বাঁধ ভেঙে গেলে কুশিয়ারা-সুরমাপারের বসত এলাকায় সুনামি দেখা দেওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা। আর এই সুনামি হলে এ অঞ্চল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। আমরা মনে করি, এসব বিষয়ে একটি বিশেষজ্ঞ দল দ্বারা সমীক্ষা চালিয়ে এর পূর্ণ তথ্য জনসমক্ষে তুলে ধরে আতঙ্কমুক্ত করার পাশাপাশি আমাদের বৃহৎ স্বার্থ রক্ষায় জোরদার পদক্ষেপ দরকার কালবিলম্ব না করে। এর সঙ্গে বসবাস করার উপযুক্ত অবকাঠামো গড়ার উদ্যোগ নেওয়াও জরুরি। ভারতের বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা বন্ধে ও পানির ন্যায্য হিস্যা দিতে বাধ্য করতে জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে চাপ সৃষ্টি করা সর্বোত্তম। কেননা দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সফলতা মেলার আশা খুবই ক্ষীণ। অতীত ইতিহাস তা-ই বলে।
লেখক : হাওর গবেষক
No comments