চরাচর-সুন্দরবনের চিত্রা হরিণ
একসময় বাংলাদেশে অসংখ্য হরিণ ছিল। সব বনাঞ্চলেই এরা অবাধে বিচরণ করত। এখন যা আছে তা-ও দিন দিন সংখ্যায় অতিদ্রুত কমে আসছে এবং নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় এদের বিচরণ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বিশ্বে ৪০ প্রজাতির হরিণ রয়েছে। বাংলাদেশে কয়েক দশক আগেও পাঁচ প্রজাতির হরিণ ছিল। এগুলো হচ্ছে_পারা হরিণ, বারা শিঙা হরিণ, সাম্বার হরিণ, মায়া হরিণ ও চিত্রা হরিণ। এর মধ্যে পারা হরিণ ও বারা শিঙা হরিণ_এই দুই প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
অবশিষ্ট তিন প্রজাতির মধ্যে সাম্বার হরিণ ও মায়া হরিণ বিলুপ্তির মুখে রয়েছে। সাম্বার হরিণ ও মায়া হরিণ সিলেট, চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে কিছু কিছু দেখা যায়। আর চিত্রা হরিণ সুন্দরবনে এখনো নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পেরেছে। চিত্রা হরিণের ইংরেজি নাম Spotted Deer। আর এর বৈজ্ঞানিক নাম Curvus Axis। অনেকের কাছে এরা চিতল হরিণ, ফোঁটা হরিণ, চিত্রাল ইত্যাদি নামে পরিচিত। আমাদের দেশের হরিণের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর হচ্ছে এই চিত্রা হরিণ। দেহের লালচে বা গাঢ় বাদামির ওপর সাদা ফোঁটার সমাহার যেন প্রকৃতির অপরূপ সুন্দর সৃষ্টিতে পরিণত করেছে। শান্ত-নির্জন পাখ-পাখালির কূজনে মোহনীয় সুন্দরবনের সৌন্দর্যকে আরো মোহনীয় ও সুষমামণ্ডিত করেছে এই চিত্রা হরিণ। চিত্রা হরিণ আকারের দিক দিয়ে মাঝারি আকৃতির বন্য প্রাণীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। একটি পূর্ণবয়স্ক চিত্রা হরিণের ওজন ১০০ কেজির কাছাকাছি। মেয়ে হরিণের ওজন পুরুষের তুলনায় কিছু কম হয়। পুরুষ হরিণের রয়েছে চমৎকার লম্বা শিং। এদের শিং ৩০ থেকে ৪০ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। প্রতিবছর একবার এদের শিং পড়ে গিয়ে আবার নতুন করে গজায়। একটি পূর্ণবয়স্ক হরিণ প্রতিদিন ছয় থেকে ১০ কেজি করে খাবার খায়। চিত্রা হরিণের প্রজননের সময় হচ্ছে বর্ষাকাল। এদের গর্ভধারণকাল ছয় থেকে সাত মাস। এরা বছরে একটি বাচ্চা দেয়। কখনো কখনো যমজ বাচ্চাও দেয়। মা হরিণ বাচ্চাকে ২০ থেকে ২৫ দিন দুধ খাওয়ায়। চিত্রা হরিণ দলবেঁধে থাকতে পছন্দ করে। প্রতিটি দলে ১০ থেকে ১৫টি হরিণ থাকে। শক্তিশালী একটি পুরুষ হরিণ দল নিয়ন্ত্রণ করে। প্রায় সময়ই দলপ্রধানের সঙ্গে দলের অন্য কোনো সবল পুরুষ হরিণের লড়াই বেধে যায়। এই লড়াইয়ে অনেক সময় প্রতিপক্ষের শিঙের আঘাতে লড়াইরত অন্যটি গুরুতর আহত হয়ে পড়ে। হরিণের চামড়া, শিং ও মাংস খুবই মূল্যবান। চিত্রা হরিণ এখনো সুন্দরবনে স্বাভাবিক অবস্থায় টিকে আছে। তবে বনের অভ্যন্তরে হরিণ নিধন চলছে ঠিকই। প্রতিনিয়ত বনের কোনো না কোনো স্থানে বন্দুকের গুলিতে প্রাণ দিচ্ছে এরা। একশ্রেণীর চোরা শিকারি জাল পেতে যথেচ্ছাচার হরিণ ধরে চামড়া ও মাংস বিক্রি করছে অবাধে। হরিণ নিধনের এই ধারা অব্যাহত থাকলে একসময় সুন্দরবনের চিত্রা হরিণও বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
আজিজুর রহমান
আজিজুর রহমান
No comments