পাহাড়ের কোলে-আবার ঝরনাতলার নির্জনে by বিপ্রদাশ বড়ুয়া

রিচাং ঝরনা। সৌন্দর্যের অমরা। ত্রিপুরীরা বলে পেরাং তৈ কালাই ঝরনা। আলু টিলার তিনটি বট-অশ্বত্থ ফেলে দুই কিলোমিটার পথ যেতে হবে রামগড়ের দিকে। তারপর বাঁয়ে ইট বিছানো পথে যেতে হবে আরো দুই কিলোমিটার পথ! পাহাড় ও দু-চারটি বাঁশের ঘর। মাচার ওপর। আবার জুমের ধান, খইস্যা ও সহযোগী ফসল তোলার জন্য আছে টংঘর। অমন ঘরে দু-এক মাস থাকতে পারলে বলতে পারি, 'তোমারি ধুলামাটি অঙ্গে মাখি ধন্য জীবন মানি।


' শরীরের অনেক অসুখ ও ক্লেদও তাতে ঝরে যাবে মানি।একটি ঘরের কাছে বেবি ট্যাঙ্ িরেখে হাঁটা দিয়েছি। বেশ ঢালু রাস্তা, নেমে গেছে অনেকখানি। গাড়ি নামতে পারবে, উঠতে পারবে না। ইট বিছানো। দুই পাশে পাহাড়ের মাটির দেয়াল, পাহাড় কেটে রাস্তা করলে যা হয়। এবার মাটির দেয়াল আর নেই। ডান পাশে পাহাড়ের ঢাল নেমে গেছে বিজন কলগে, দুই পাশ থেকে পাহাড় নেমে মিশেছে। পাহাড়ে গাছ নেই বললেই ভালো, কিন্তু কলগ গাছে ভরা। ঘন সবুজের সায়া-শাড়িতে মোড়া। ওখান থেকে ঝিরিঝিরি একটানা শিহরণ শব্দ ছুটি নিয়ে আসছে। খুব মৃদু, খুব শান্ত সেই মদির শীৎকার। সাংবাদিক প্রদীপ বলল, 'ওটা পেরাং তৈ কালাই ঝরনার জল ছড়া হয়ে গিয়ে আরেকটি ঝরনা সৃষ্টি করেছে। তার আনন্দলহরি, রত্যাতুর গান। সাংবাদিক দাউদ ছবি তুলছে না, ভিডিও করছে। ফটোশিকারি হাসানকে কে পায়? পিঠে বোঝা, হাতে ক্যামেরা। দেবাশীষ চাকমা এ যাত্রায় সঙ্গী হয়নি। ও রয়ে গেছে দীঘিনালায়, ওর সদ্য নির্মিতব্য ঘরে।
এখানে কিছু পাখি ডাক দিয়ে জানাচ্ছে ওদের বিপন্ন অস্তিত্ব। ওটা দোয়েল। এদিকে বুলবুল। জুমের পরিত্যক্ত ঢালে একটা ফুলচুষি গাছ ডাল ঝুলিয়ে সলজ্জ ভঙ্গিতে দেখছে। আশপাশে বৃক্ষজাতীয় গাছ নেই। সবই আগাছা। আসামলতা যেখানে-সেখানে। নীল ফুল ফুটেছে, ওটা কী? নাম জানি না। চড়ুই ধান খুঁজছে
পরিত্যক্ত জুমের ধানগাছে ঝুলে। নাকি পোকা? অথবা কৌশল দেখাচ্ছে সদ্য গড়ে ওঠা সঙ্গীর প্রতি। ওদিকে ছোট একটি দলের ব্রু পেরই বা ভরুই পাখি? মাকড়সার একটি ছেঁড়া জাল অসচরাচর দৃশ্য সৃষ্টি করে উড়ে যাচ্ছে। দাউদ ও প্রদীপ এগিয়ে গেছে আমাকে ফেলে। আমার একটি হৃৎপিণ্ড একটু বেড়ে বড় হয়ে গেছে ৩০ বছর আগে। একটি ফিঙে ডাকছে দূরে, ৎসি ৎসি রাংগা...। পাঁচজনের ত্রিপুরী নারীর একটি দল কল্লোং পিঠে ঝুলিয়ে বনে যাচ্ছে। নাকি আসার সময় দেখেছিলাম! ওদের নেত্রী প্রৌঢ় রমণী ডাক দিলেন ছবি না তুলতে। জানতে চাওয়ার আগেই বলে দিলেন, 'ছবি তুলে তোমরা টাকা পাবে, আমরা কী পাব?' আমি বললাম, 'মানা করলে তুলব, এমন বান্দা আমি নই।'
হাসান, দাউদ থেমে গেল। প্রদীপ এগিয়ে গিয়ে ত্রিপুরী ভাষায় সম্ভাষণ জানিয়ে কী কী বলল, এক বর্ণও বুঝতে পারলাম না। চাকমা ভাষা হলে বুঝতে পারতাম। চাকমা গানও জুমের পাহাড়ের মতো ধীরস্থির লয় দিয়ে সম্মোহন জাগায়, ঢিমে তালের। ভূপেন হাজারিকার গানের সুরের কাছাকাছি, নেপালি সুরের ভগিনী বলতে পারি না কি! বশীর আহমদ তাঁর নেপালি গায়িকা পত্নীর প্রভাবে বাংলা গানের সুরে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। বাংলা গানে ভূপেন হাজারিকাও অহমিয়া সুরের প্রভাব ফেলেছেন। ৪ঠা নভেম্বরে জানতে পারলাম তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে মুম্বাইয়ের হাসপাতালে। সঙ্গে সঙ্গে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলছে তাঁর 'প্রতিধ্বনি শুনি' ও 'দোলা, এ দোলা, এ দোলা'-এর সুর। পার্বত্য চট্টগ্রামের গানের সুরে অহমিয়া গানের সুরের আবেশ পাই। আমি সংগীতজ্ঞ নই। তবুও ছেলেবেলা থেকে জুম্ম জাতির গানের পিপাসু। ৫ই নভেম্বর শুনলাম ভূপেন হাজারিকা আর জীবিত নেই। গানের সুরে তিনি বেঁচে থাকবেন। 'বিস্তীর্ণ দুপারের অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনে, ও গঙ্গা' গানটি কেমন?
ঝরনায় নামার সিঁড়ির ধাপের ডান পাশে নিঃসঙ্গ ফুলচুষি গাছ রোদসী ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে। কী তার করুণ ও নিবেদন-ভঙ্গি! তার পাশ দিয়ে খাড়া সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নামছি। দুটি পত্তাপত্তি (প্রজাপতি) উড়ছে পাতা থেকে পাতায়। আবার একা হয়ে গেল। ছবি তুলছে হাসান। বড় একটি মাকড়সার জাল। ছবিতে ধরলাম। ভূপেন হাজারিকাকে আবার মনে করিয়ে দিল ঝরনার সুরের সুরধুনী। আমন্ত্রণ। আপনারা এমন ভালোবাসার আহ্বানের মুখোমুখি হয়েছেন নিশ্চয়ই! প্রেম, ভালোবাসা, আসঙ্গ, নিভৃতাচার, অদেখা ও অজানি সুখের মুখোমুখি হয়েছেন সচেতন গৌরবে! বাংলার ভূস্বর্গ পার্বত্য চট্টগ্রামের মুখোমুখি! শুভদৃষ্টি! বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিশাল শামিয়ানার ছায়ায় আমরা কি আদিবাসীদের ডেকে নিতে পেরেছি! নাকি শুধু বাঙালি অভিবাসী ঢুকিয়ে দখল করা! ভালোবাসা ছাড়া শুধু বন্দুক দিয়ে কোনো ক্ষুদ্র জাতিসত্তাকে বৃহত্তর জাতি দাবিয়ে রাখতে কি পারে! ফিলিস্তিনিদের পারবে ক্ষমতাধর ইহুদিরা! প্রজাপতি দুটি আবার পাশাপাশি উড়ছে। ঝরনা থেকে নেমে আসা স্রোতস্বিনীর ধারে দুই থোকা সাদা বরুণ ফুটে আছে না! কী করে হয়! পরে ৩১শে অক্টোবর সিকির চরে (চাঁদপুর) বেশ কয়েক থোকা ফুল দেখেছি। কিন্তু বরুণ ফোটা শুরু হয় মাঘ মাসে যে! প্রকৃতির রাজ্যে এমন কত কী ঘটে।
উরেব্বাস! পঞ্চাশ ফুট খাড়া উঁচু থেকে পড়ছে স্বচ্ছসলিল স্রোতধারা। সেই স্রোত বেগে ছুটে চলেছে ঢালু ও পিচ্ছিল পাথরের বুক বেয়ে। ওখান থেকে সাহসী তরুণ-তরুণী ভ্রমণবিলাসীরা স্লিপার থেকে বাচ্চাদের মতো গড়িয়ে নামার খেলায় মাতে। তার নিদর্শন পেছন দিকে ছেঁড়া পাতলুন ও সালোয়ার-কামিজ এখানে-ওখানে পড়ে আছে। প্লাস্টিকের খালি বোতলও। ঢালু পাথরের শেষ প্রান্তে জল জমে আছে। তারপর একটি বাঁধের মতো। ওটা পেরিয়ে পাহাড় বেয়ে ওঠা যায় ঝরনার শীর্ষে। হাসান ও প্রদীপ অনেক দূর উঠে গেছে। দাউদ ও আমি মাঝ বরাবর উঠে গেলাম। আর না। হলুদ-সোনা রঙের ঝুটিদার দুটি পাখি বেশ ওপরে ডালে পাশাপাশি বসে প্রেমবিষয়ক আলাপ করছে? দুজনকে সামনের দিক থেকে দেখেছি। ঢাকায় ফিরে সালিম আলীর পাখিবিষয়ক সাত খণ্ড বইয়ে ছবি দেখে শনাক্ত করতে পারিনি। দুর্লভ বা আমার দেখা নতুন পাখি হয়তো! ঝরনা পাখি ও পশুদের খুব প্রিয় ও খুব প্রয়োজন। ঝরনার স্রোতস্বিনী পেরিয়ে ফেরার সময় বাঁধের ধারের যজ্ঞ ডুমুর দেখি টসটস করছে। ওর জাত ভাই সুস্বাদু আঞ্জিরের মতো দেখতে। আচ্ছা, ঝরনার ব্যাপক সৌন্দর্য দু'কথায় কে কবে বর্ণনায় প্রফুল্ল কমল করে তুলতে পেরেছে! পাথরে পাথরে ছড়ানো ঝরনার উৎক্ষিপ্ত সৌন্দর্যচ্ছটার সম্ভোগ অল্পে কে তৃপ্ত হতে পারে!
ফেরার পথে ত্রিপুরী চা দোকানে বসে চা ও বাঁশের দাবায় তামাক সেবন, হাসান ছবিতে তুলে রাখতে পারে। আমিও তুলেছি। কিন্তু বঞ্চিত-লাঞ্ছিত আদি বাসিন্দারা আমাকে সন্দেহের চোখে দেখে থাকলে আমি দোষ দিতে পারি না। কারণ আমি তো তাদের কোনো কল্যাণ করতে পারিনি। বরং অরণ্য ধ্বংস করে, ধ্বংস করতে বাধ্য করে, পরিবেশ বিনষ্ট করে ঝরনা শুকিয়ে যেতে দিচ্ছি। ভবিষ্যতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের সব ঝরনায় শুধু বর্ষাকালে জল ও সৌন্দর্য দেখা যাবে। শুধু।

No comments

Powered by Blogger.