মাহমুদুর রহমানের মন্তব্য প্রতিবেদনঃ ডিজিটাল দুর্নীতির জয়-জয়কার
এক-এগারোর অবৈধ সরকারের হোতারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদের ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগের সমর্থনে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। ওই বিশেষ দিনে বন্দুকের নলের সামনে বসে কম্পিত কণ্ঠে তত্কালীন রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ জাতির উদ্দেশে জরুরি আইন জারি করে ডিজিএফআই লিখিত যে ভাষণখানি পাঠ করেছিলেন, সেখানেও পূর্ববর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ‘সীমাহীন দুর্নীতির’ অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছিল।
পরবর্তী ইতিহাস দেশের মানুষ জানেন। দেশের প্রধান দুই নেত্রীকে সাবজেলে নেয়া হয়েছিল, উভয় দলের বড় বড় নেতারা হয় জেলে গিয়েছিলেন, নয়তো দেশে-বিদেশে পালিয়ে অথবা সামরিক জান্তার সঙ্গে আঁতাত করে সময় পার করেছেন। জেনারেল মাসুদউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন গুরুতর অপরাধ দমন কমিটির টাস্কফোর্সের ফিল্ড কমান্ডাররা সুযোগ বুঝে জন্মের মতো দাঁও মেরে নিয়েছেন। ব্যবসায়ীদের পকেট থেকে কয়েকশ’ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা পড়লেও তার কয়েকগুণ নাকি এক-এগারোর কুশীলবরা ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন। সেই অর্থ এখন প্রবাসে তাদের সপরিবারে অবসর জীবনে কাজে লাগছে। যাদের নাম উচ্চারণে একসময় এদেশে বাঘে-মহিষে একঘাটে পানি পান করত, তারা এখন আমেরিকা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, আরব আমিরাতে বাড়ি-ঘর বানিয়ে সুখেই আছেন। এদের মধ্য থেকে বিশেষ একজন মহাভাগ্যবান অবশ্য এখনও বাংলাদেশ সরকার থেকে নিয়মিত বেতনও নিচ্ছেন।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ ভ্রাতা ও ফেনী বিএনপির প্রেসিডেন্ট মেজর (অব.) সাঈদ এস্কান্দারের আপন ভায়রা লে. জে. মাসুদউদ্দিন চৌধুরী গত তিন বছরেরও অধিককাল ধরে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফাইল ঘাঁটাঘাঁটি করলে তার চেয়ে দীর্ঘসময় ধরে এক দেশে কর্মরত দ্বিতীয় কোনো রাষ্ট্রদূতের উদাহরণ নাও মিলতে পারে। ক’দিন আগে আমাদের প্রধানমন্ত্রী অস্ট্রেলিয়া সফরে গেলে এই মাসুদউদ্দিনকে সর্বক্ষণ তার আশপাশেই দেখা গেছে। এই শ্রেণীর উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তাদের বিশ্বখ্যাত ম্যাজিশিয়ান হুডিনির চেয়েও ম্যাজিকশিল্পে পারদর্শী মেনে নিতে হয়। নইলে বেগম খালেদা জিয়া রক্ষীবাহিনীর সাবেক যে আত্মীয় কর্মকর্তাটিকে নবম ডিভিশনের জিওসি পদে পর্যন্ত নিয়োগ দিয়েছিলেন, তিনিই আবার শেখ হাসিনার কাছে এতটাই বিশ্বস্ত যে তার চাকরি অনন্তকাল পর্যন্ত চলছে, এমন ঘটনা ঘটা সম্ভব ছিল না।
এই মাসুদউদ্দিনকে এক-এগারো পরবর্তী সময়ে বগলে স্টিকসহ সদম্ভে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে প্রায় প্রতিদিন দুর্নীতিবিরোধী জেহাদের হুংকার দিতে দেখা গেছে। দুষ্ট লোকে বলে, জাতিসংঘ নির্দেশিত ক্যুদেতার প্রথম ছয় মাসের মধ্যেই তত্কালীন সামরিক লৌহমানবদ্বয় এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা যে পরিমাণ অর্থ বন্দুকের জোরে অবৈধ পন্থায় আয় করেছে, একটি নির্বাচিত সরকারের দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীদের পক্ষে পুরো পাঁচ বছরেও সেরকম সম্পদশালী হওয়া সম্ভব নয়। অবশ্য এবার মহাজোট সরকারের শেয়ারবাজার তেলেসমাতি সেই রেকর্ডকেও অবশেষে অতিক্রম করেছে।
মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন জামানার বিশেষ দু’টি অমৃতবচন দেশবাসী আশা করি এখনও ভুলে যাননি। একসময়ের কথিত জাতীয়তাবাদী সৈনিক এবং ২০০৭ সালের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) এমএ মতিন ঘোষণা করেছিলেন, দুর্নীতির সব রুই-কাতলাকে এবার ধরা হবে। একই সময়ের মহাপ্রতাপশালী দুদক চেয়ারম্যান লে. জে. (অব.) হাসান মশহুদ চৌধূরী আরও একধাপ এগিয়ে হুংকার ছেড়েছিলেন, শুধু রুই-কাতলা কেন, চুনোপুঁটিও কারেন্ট জাল দিয়ে ছেঁকে ফেলা হবে। কারণ বাজারে চুনোপুঁটিরও অনেক দাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আজ ভারতের পদতলে বিসর্জনের পর এসব বাগাড়ম্বরের জন্য তারা লজ্জায় মাথা হেঁট করে থাকেন কি-না, আমার জানার কোনো উপায় নেই। লে. জে. হাসান মশহুদ শুনেছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার একসময়ের প্রভুদের আশ্রয়ে আছেন। আর মেজর জেনারেল (অব.) মতিন আগের মতো চট্টগ্রামের কোনো এক কিন্ডারগার্টেন স্কুল চালাচ্ছেন কি-না, সে খবর রাখার প্রয়োজন বোধ করিনি। তবে তারা যেখানেই থাকুন না কেন, বাংলাদেশের বর্তমান দুরবস্থার সম্মিলিত দায় কোনোদিনই এড়াতে পারবেন না।
বর্তমান বাংলাদেশে দুর্নীতির মহোত্সব নিয়ে লিখতে বসেই এতসব পুরনো কথা টেনে আনতে হলো। দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপন করে বিশ্বব্যাংক, এডিবি এবং জাইকা পদ্মা সেতু প্রকল্পে তাদের প্রতিশ্রুত ঋণসহায়তা স্থগিত করেছে। আইএমএফও বার্ষিক বাজেট সহায়তা আটকে দিয়েছে। উপায়ান্তর না দেখে পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার আইডিবির (ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক) শরণাপন্ন হলে সেখান থেকেও সরকারের জন্য কোনো সুখবর আনতে পারেননি। উল্টো তারা বাংলাদেশে প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি এবং অদক্ষতার সমালোচনা করেছেন।
মাঝখানে একদিন স্বপ্নে পাওয়ার মতো করে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব পদ্মা সেতু নির্মাণে মালয়েশিয়ার বায়বীয় বিনিয়োগকারীদের সংবাদ রেডিও-টেলিভিশনে ফলাও করে জাতিকে জানিয়েছিলেন। তবে সেই বাগাড়ম্বরের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ২৪ ঘণ্টা। পদ্মা সেতু নির্মাণে মালয়েশীয় বিনিয়োগ নিয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য সরকারি তরফ থেকে এরপর শোনা যায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা বাংলাদেশের জনগণকে সচরাচর মূর্খ এবং নির্বোধরূপেই বিবেচনা করেন। নইলে তার শাসনামলে গোটা মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে এতটা দূরত্ব সৃষ্টি করার পর আমাদের ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক কিংবা মালয়েশিয়ার অর্থ সহায়তার স্বপ্ন দেখানোর চেষ্টা করতেন না।
গত সপ্তাহে রাজশাহীতে এক জনসভায় বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী তার স্বভাবসুলভ ভাষায় বিএনপির পাঁচ বছর আগেকার সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন। ক’দিন আগে গিয়াসউদ্দিন মামুনের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের এক মামলায় সাক্ষ্য দিতে ডেবরা লাপ্রেভট নামের এক মার্কিন নাগরিক বাংলাদেশে উড়ে এসেছিলেন। তার বক্তব্য দেশের তাবত পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সেই সাক্ষ্যে নতুন কিংবা চাঞ্চল্যকর কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও শেখ হাসিনা দাবি করেছেন, তারেক রহমানের মানি লন্ডারিং প্রমাণ করতে ডেবরার এই উড়ে আসায় নাকি লজ্জায় তার মাথাও হেঁট হয়েছে। প্রথম কথা হলো, প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, জনকণ্ঠের মতো চরম তারেকবিদ্বেষী পত্রিকায়ও খুঁজে পাওয়া যায়নি যে এই মার্কিন সাক্ষী তারেক রহমান মানি লন্ডারিং করেছেন এমন কোনো বক্তব্য তার সাক্ষ্যে দিয়েছেন। পাঁচ বছর ধরে দুর্নীতির অনেক গল্প ফাঁদা হলেও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে তার বন্ধু গিয়াসউদ্দিন মামুনের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের অভিযোগই এ পর্যন্ত সরকার আনতে পেরেছে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, তারেক রহমানের মানি লন্ডারিং প্রমাণিত হলে তো একদা ডজনেরও অধিক দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত শেখ হাসিনার মাথা উঁচু হওয়ার কথা, মাথা হেঁট হবে তারেক রহমান এবং জাতীয়তাবাদী দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের। যাকগে এসব তর্ক।
বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে দুর্নীতিবিষয়ক আমার অন্য দু-একটি প্রশ্ন রয়েছে। আপনার পুত্রবধূর দেশের যোগসাজশে ডেবরা লাপ্রেভটকে আপনার সরকারই সাক্ষ্য দিতে নিয়ে আসায় আপনার মাথা হেঁট হয়ে গেল। অথচ পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি নিয়ে আপনারই আমলে দেশ-বিদেশে এত হৈচৈয়ের পরও সেই মাথা যথাস্থলে বহাল তবিয়তে থাকল কী করে? সংসদে দাঁড়িয়ে আপনিই তো একাধিকবার চরম দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত যোগাযোগমন্ত্রীর পক্ষে সাফাই গেয়েছেন! রক্তচক্ষু দেখিয়ে থামিয়ে দিয়েছেন আপনার দলেরই অন্যান্য সমালোচনাকারীদের। আপনার মন্ত্রী, এমপি, উপদেষ্টারা মিলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের লক্ষ কোটি টাকারও অধিক শেয়ারবাজার থেকে লুটপাট করে হিল্লি-দিল্লিতে পাচার করলেন, অথচ আপনি বিন্দুমাত্র লজ্জিত না হয়ে গোটা জাতিকে উল্টো দুর্নীতিবাজ হতে উত্সাহিত করলেন!
বাংলাদেশের কোন সরকারপ্রধান নিজে ঘোষণা দিয়েছেন যে দুর্নীতিলব্ধ অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করলে দুদক অথবা এনবিআর এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবে না? বাংলাদেশের চল্লিশ বছরের ইতিহাসে এমন দ্বিতীয় উদাহরণ আমার অন্তত মনে পড়ছে না। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে বর্তমান বাংলাদেশে তথাকথিত স্বাধীন দুদক তারই শিকলে বাঁধা আজ্ঞাবহ বিশেষ প্রাণীমাত্র। এই দেশে সুশাসনের কিছুমাত্র অস্তিত্ব থাকলে এই ঘোষণার পর দুদক চেয়ারম্যানের পদত্যাগ করা উচিত ছিল। অবশ্য শেখ হাসিনার একসময়ের বশংবদ সচিবের কাছ থেকে আমার এমন প্রত্যাশাও চরম নির্বুদ্ধিতা। দুর্নীতিকে সরাসরি উত্সাহদানকারী প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পর এনবিআর কালবিলম্ব না করে রীতিমত প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে, দুর্নীতিবাজরা নির্ভয়ে শেয়ার মার্কেটে লেনদেন করতে পারে, তাদের টিকিটিও স্পর্শ করা হবে না। এতকিছুর পরও শেয়ারবাজারে সূচক যে অব্যাহতভাবে পড়েই যাচ্ছে, সেটা অবশ্য অর্থনীতি বিষয়ক ভিন্ন তত্ত্বগত আলোচনা।
পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে, মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেই সরকারি কেনাকাটায় দলীয় লোকজনের জন্য দুর্নীতির অবাধ সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। বিনা টেন্ডারে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত ঠিকাদারি কাজ দেয়ার বন্দোবস্তের মাধ্যমে নেতাকর্মীদের রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়ার পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য ডিজিটাল মন্ত্রিসভার তারিফ না করে উপায় নেই। বাংলাদেশের জনগণ এই দুর্নীতি বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়ার ফলস্বরূপ অতঃপর দেশের সম্পদ নিয়ে রীতিমত ডাকাতির রাস্তা খুলে দেয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এই দেশে যোগাযোগ, বাণিজ্য, স্থানীয় সরকার, টেলিযোগাযোগ এবং জ্বালানি ও বিদ্যুত্ মন্ত্রণালয় দুর্নীতির ঘাঁটি হিসেবে সুপরিচিত। বুদ্ধিমান সরকার জনগণের বিদ্যুত্ নিয়ে অসহায় অবস্থাটি ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন। অনেকদিন ধরেই দেশের জনগণ বিদ্যুত্ ঘাটতির জন্য যথেষ্ট ভোগান্তিতে রয়েছেন। সেই ভোগান্তিকে পুঁজি করে এবার ক্ষমতাসীনদের মধ্যে বিনা টেন্ডারে রেন্টাল বিদ্যুত্ কেন্দ্র বণ্টন শুরু হলো। শুধু তা-ই নয়, এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার পথও রুদ্ধ করল মার্কিন-ভারত সমর্থিত মহাজোট সরকার। দেশে আইন করা হলো, বিনা টেন্ডারে অতি উচ্চমূল্যে রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্র থেকে বিদ্যুত্ কেনার সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে কোনো নাগরিক মামলা করতে পারবে না।
আমার গ্রেফতারের আগে সরকারের এসব অনৈতিক এবং দুর্নীতিতে সহায়তাকারী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে মন্তব্য-প্রতিবেদন লেখার পাশাপাশি টেলিভিশন টকশোতেও যথাসম্ভব প্রতিবাদ করেছিলাম। একটি পুরনো লেখার কথা এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করছি। ‘মার্কিন এজেন্ডায় আর সুশাসন নেই’ শিরোনামের লেখায় বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গি দমনের ধুয়া তুলে মার্কিন নেতৃত্বে উন্নয়ন সহযোগীদের বাংলাদেশ সরকারকে তাবত জুলুম, নির্যাতন ও দুর্নীতির লাইসেন্স দেয়ার বিরোধিতা করেছিলাম। লোকমুখে শুনেছি, আমার ওই লেখার কারণে তত্কালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত নাকি আমার ওপর ভয়ানক কুপিত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে আমার গ্রেফতার এবং রিমান্ডে নির্যাতনেও ওই লেখার নাকি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। আমার মন্তব্য-প্রতিবেদনটি ২০১০ সালের ১৭ মে ছাপা হয়েছিল। দেড় বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর সেই মার্কিনিরাই এখন সরকারের বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী দুর্নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলছেন।
রিমান্ডে টিএফআই সেলে আমাকে বিদ্যুত্ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ, বিশেষ করে কুইক রেন্টাল পদ্ধতির বিরোধিতার কারণ জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। প্রশ্নকর্তাদের আমি বলেছিলাম, রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া করে ক্ষমতাসীনদের লুটপাটের সুবিধার জন্যই এই কুইক রেন্টাল পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছে। সেইসঙ্গে এটাও যোগ করেছিলাম, এত উচ্চমূল্যে বিদ্যুত্ কেনা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতি সহসাই ভঙ্গুর হয়ে পড়বে। উত্তরায় অবস্থিত র্যাব-১ হেডকোয়ার্টারের টিএফআই সেলে আমার জিজ্ঞাসাবাদের তারিখ ছিল ২০১০ সালের ২৪ জুন। আজ প্রায় দেড় বছরের ব্যবধানে আশা করি সেদিন উপস্থিত বিভিন্ন বাহিনীর সেই সব তরুণ প্রশ্নকর্তারা বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান দুরবস্থার কারণ উপলব্ধি করতে পারছেন।
কুইক রেন্টাল নিয়ে এখন অন্যান্য পত্রিকাও লেখালেখি শুরু করেছে। ২৬ নভেম্বরের নয়াদিগন্ত পত্রিকার লিড স্টোরির শিরোনাম, ‘কুইক রেন্টাল আইপিপির বিদ্যুত্ ক্রয় : ভর্তুকি ১২ হাজার কোটি টাকা, দায় চাপছে গ্রাহকের ওপর।’ আমি নিশ্চিত যে, বর্তমান অর্থবছরের ১২ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি এই সরকারের মেয়াদকালেই ২০ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করবে। ভর্তুকির এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কোন দেশে, কার পকেটে যাচ্ছে সেই খবর দেশের সাধারণ নাগরিক হয়তো কোনোদিনই জানতে পারবে না। তবে দেশের সর্বনাশ যা হওয়ার, সেটা বোধহয় সম্পন্ন হয়েছে। এদিকে প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে হুমকি দিয়ে রেখেছেন, যারাই এসব ভর্তুকি নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসস্থানের বিদ্যুত্ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে। সুতরাং সরকার পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত দেশবাসীর মূক ও বধিরের ভূমিকা পালন করে ক্ষমতাসীনদের সীমাহীন দুর্নীতি সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই।
বিদ্যুত্খাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই চলছে টেলি-যোগাযোগের লুণ্ঠন। ভিওআইপির গল্প বেশ পুরনো হয়ে গেছে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী সরকারের চিহ্নিত কর্তাব্যক্তিদের পুত্র-কন্যারা এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিএনপি আমলের প্রথম দিকে মন্ত্রণালয়ে স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা করা হলেও নানান চাপের কাছে সেই সদিচ্ছা বেশিদিন স্থায়িত্ব পায়নি। অভিযোগ রয়েছে, তত্কালীন ক্ষমতাবানরাও পরবর্তীকালে নাকি জড়িয়ে পড়েছিলেন এই অনৈতিক কর্মকাণ্ডে। আওয়ামী লীগের এবারের আমলে লুণ্ঠনের নিত্যনতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করা হয়েছে। লন্ডন, আমেরিকা, কানাডা থেকে নিয়ন্ত্রণ করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে বাংলাদেশের বারোটা বাজিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা হচ্ছে। গুজব রয়েছে, সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রীর পিএস, এপিএসরাই নাকি প্রতি বছর কয়েক কোটি টাকার মালিক হচ্ছেন। বর্তমান সরকারের ডাকসাঁইটে সব মন্ত্রী হত্যা, লুটপাটে সরাসরি জড়িত থেকেও যে রক্ষা পেয়ে যাচ্ছেন, তার পেছনেও রয়েছে এই অবৈধ সম্পদের দেশ-বিদেশে ভাগবাটোয়ারা।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সম্পর্কে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক অভাবনীয় মন্তব্য নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেই আজকের মন্তব্য-প্রতিবেদনের সমাপ্তি টানব। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেছেন, তার পিতার আমলেও রিজার্ভে কোনো টাকা ছাড়াই দেশ চললে এখনও কোনো অসুবিধা হবে না। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, নানাবিধ চাপে মানসিকভাবে বিক্ষিপ্ত থাকার কারণেই শেখ হাসিনা এ ধরনের অসংলগ্ন, অপ্রধানমন্ত্রীসুলভ মন্তব্য করেছেন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি প্রসঙ্গে তত্কালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের চরম অবমাননাকর মন্তব্য ছিল, বাংলাদেশ একটি তলাবিহীন ঝুড়ি (Basket case)। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং একসময়ের বাম অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী ১৯৭৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর ফেনীতে এক জনসভায় তত্কালীন আওয়ামী সরকারের দুর্নীতি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আজকের আওয়ামী লীগ হচ্ছে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, লুটপাট আর পারমিটবাজির আখড়া। মাছ যেমন জল ছাড়া বাঁচতে পারে না, আওয়ামী লীগও তেমনি দুর্নীতি ছাড়া বাঁচতে পারে না।’ মরহুম শেখ মুজিবের শাসনামলে বাংলাদেশের রিজার্ভে টাকা ছিল না—দীর্ঘদিন পর এমন মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী হয়তো তার অজান্তেই হেনরি কিসিঞ্জার এবং মতিয়া চৌধুরীর মূল্যায়ন মেনে নিয়ে তার মরহুম পিতার শাসনামলকে হেয় করলেন। তদুপরি তিনি বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দ্বারা বিধ্বস্ত একটি যুদ্ধপরবর্তী রক্তাক্ত রাষ্ট্রের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করে আমাদের চার দশকের অর্জনকে অস্বীকার করেছেন। ডজনেরও অধিক ডক্টরেটধারী প্রধানমন্ত্রী কেন এমন তুলনা করলেন, তা তিনিই ভালো জানেন। রিজার্ভে টান ধরলে মূলত আমদানিনির্ভর বাংলাদেশের যে দেউলিয়া হতে বিশেষ একটা সময় লাগবে না, সেটি বুঝতে অর্থনীতি নিয়ে বিশেষ পড়াশোনার কোনো প্রয়োজন নেই। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার আশু কর্তব্য রিজার্ভ দ্রুত হ্রাস হওয়ার পেছনের কারণগুলো খুঁজে বের করে সেই ফাঁক-ফোকরগুলো অনতিবিলম্বে বন্ধ করা। ২০০৮ সালে নির্বাচনী প্রচারাভিযানকালে মহাজোট নেত্রী দেশবাসীকে একেবারে স্বপ্নের মায়াপুরীতে নিয়ে গিয়েছিলেন। ঢাকার কারওয়ানবাজারে দেয়া একটা বক্তৃতার কথা আমার প্রায়ই মনে পড়ে। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, নৌকায় ভোট দিলে পাতাল রেল, উড়াল সেতু, পদ্মা সেতু, মনোরেল কোনো কিছুরই অভাব থাকবে না। জনগণ কেবল কষ্ট করে মুখ ফুটে চাইবে আর তিনি জাদুবলে সঙ্গে সঙ্গে সব চাহিদা তাদের সামনে হাজির করবেন। তার বক্তৃতা শুনে সেদিন মনে হয়েছিল, বাংলাদেশ টাকার অফুরান সাগরে ভাসছে।
সত্তরের দশকের শেষের দিকে মরহুম জিয়াউর রহমান একবার বলেছিলেন, দেশের উন্নয়নে অর্থ কোনো সমস্যা নয়, সদিচ্ছাটাই বড় কথা। তার এই বক্তব্যের কদর্থ করে আওয়ামী অর্থনীতিবিদরা এখনও সুযোগ পেলেই কঠোর সমালোচনা করে থাকেন। অথচ একই বুদ্ধিজীবীকুল মহাজোট নেত্রীর বাস্তবতাবিবর্জিত এসব বক্তব্যে আপত্তিজনক কোনো বিষয় খুঁজে পান না। কেবল এখানেই শেষ নয়, রিজার্ভ ছাড়াও দেশের অর্থনীতি চলমান থাকতে পারে, এ-জাতীয় উদ্ভট বক্তব্যের সমর্থনেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ডাকসাঁইটে আওয়ামী শিক্ষককুল সরকারদলীয় পত্রিকাগুলোতে কলম ধরেছেন। তবে ডিজিটাল দুর্নীতির পক্ষে আবোল-তাবোল লিখে শেষরক্ষা হবে কি-না, সেটি জানতে আমাদের বর্তমান সরকারের মেয়াদ সমাপ্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। একই ভোটার গোষ্ঠীকে অবাস্তব ও চটকদার প্রতিশ্রুতির তোড়ে পাঁচ বছরের ব্যবধানে দ্বিতীয়বার বিভ্রান্ত করে ক্ষমতায় পুনর্বার আসীন হওয়ার অলীক কল্পনা বাস্তবে রূপ নেয়া জালিমের বিরুদ্ধে ক্রমেই ফুঁসে ওঠা জনমতের পরিপ্রেক্ষিতে অসম্ভবই ঠেকছে। পরিবর্তনের জোয়ার বেগবান হলে ডিজিটাল দুর্নীতির হিসাব-নিকাশও একদিন জনগণই ইনশাআল্লাহ আদায় করবে।
ই-মেইল : admahmudrahman@gmail.com
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ ভ্রাতা ও ফেনী বিএনপির প্রেসিডেন্ট মেজর (অব.) সাঈদ এস্কান্দারের আপন ভায়রা লে. জে. মাসুদউদ্দিন চৌধুরী গত তিন বছরেরও অধিককাল ধরে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফাইল ঘাঁটাঘাঁটি করলে তার চেয়ে দীর্ঘসময় ধরে এক দেশে কর্মরত দ্বিতীয় কোনো রাষ্ট্রদূতের উদাহরণ নাও মিলতে পারে। ক’দিন আগে আমাদের প্রধানমন্ত্রী অস্ট্রেলিয়া সফরে গেলে এই মাসুদউদ্দিনকে সর্বক্ষণ তার আশপাশেই দেখা গেছে। এই শ্রেণীর উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তাদের বিশ্বখ্যাত ম্যাজিশিয়ান হুডিনির চেয়েও ম্যাজিকশিল্পে পারদর্শী মেনে নিতে হয়। নইলে বেগম খালেদা জিয়া রক্ষীবাহিনীর সাবেক যে আত্মীয় কর্মকর্তাটিকে নবম ডিভিশনের জিওসি পদে পর্যন্ত নিয়োগ দিয়েছিলেন, তিনিই আবার শেখ হাসিনার কাছে এতটাই বিশ্বস্ত যে তার চাকরি অনন্তকাল পর্যন্ত চলছে, এমন ঘটনা ঘটা সম্ভব ছিল না।
এই মাসুদউদ্দিনকে এক-এগারো পরবর্তী সময়ে বগলে স্টিকসহ সদম্ভে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে প্রায় প্রতিদিন দুর্নীতিবিরোধী জেহাদের হুংকার দিতে দেখা গেছে। দুষ্ট লোকে বলে, জাতিসংঘ নির্দেশিত ক্যুদেতার প্রথম ছয় মাসের মধ্যেই তত্কালীন সামরিক লৌহমানবদ্বয় এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা যে পরিমাণ অর্থ বন্দুকের জোরে অবৈধ পন্থায় আয় করেছে, একটি নির্বাচিত সরকারের দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীদের পক্ষে পুরো পাঁচ বছরেও সেরকম সম্পদশালী হওয়া সম্ভব নয়। অবশ্য এবার মহাজোট সরকারের শেয়ারবাজার তেলেসমাতি সেই রেকর্ডকেও অবশেষে অতিক্রম করেছে।
মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন জামানার বিশেষ দু’টি অমৃতবচন দেশবাসী আশা করি এখনও ভুলে যাননি। একসময়ের কথিত জাতীয়তাবাদী সৈনিক এবং ২০০৭ সালের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) এমএ মতিন ঘোষণা করেছিলেন, দুর্নীতির সব রুই-কাতলাকে এবার ধরা হবে। একই সময়ের মহাপ্রতাপশালী দুদক চেয়ারম্যান লে. জে. (অব.) হাসান মশহুদ চৌধূরী আরও একধাপ এগিয়ে হুংকার ছেড়েছিলেন, শুধু রুই-কাতলা কেন, চুনোপুঁটিও কারেন্ট জাল দিয়ে ছেঁকে ফেলা হবে। কারণ বাজারে চুনোপুঁটিরও অনেক দাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আজ ভারতের পদতলে বিসর্জনের পর এসব বাগাড়ম্বরের জন্য তারা লজ্জায় মাথা হেঁট করে থাকেন কি-না, আমার জানার কোনো উপায় নেই। লে. জে. হাসান মশহুদ শুনেছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার একসময়ের প্রভুদের আশ্রয়ে আছেন। আর মেজর জেনারেল (অব.) মতিন আগের মতো চট্টগ্রামের কোনো এক কিন্ডারগার্টেন স্কুল চালাচ্ছেন কি-না, সে খবর রাখার প্রয়োজন বোধ করিনি। তবে তারা যেখানেই থাকুন না কেন, বাংলাদেশের বর্তমান দুরবস্থার সম্মিলিত দায় কোনোদিনই এড়াতে পারবেন না।
বর্তমান বাংলাদেশে দুর্নীতির মহোত্সব নিয়ে লিখতে বসেই এতসব পুরনো কথা টেনে আনতে হলো। দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপন করে বিশ্বব্যাংক, এডিবি এবং জাইকা পদ্মা সেতু প্রকল্পে তাদের প্রতিশ্রুত ঋণসহায়তা স্থগিত করেছে। আইএমএফও বার্ষিক বাজেট সহায়তা আটকে দিয়েছে। উপায়ান্তর না দেখে পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার আইডিবির (ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক) শরণাপন্ন হলে সেখান থেকেও সরকারের জন্য কোনো সুখবর আনতে পারেননি। উল্টো তারা বাংলাদেশে প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি এবং অদক্ষতার সমালোচনা করেছেন।
মাঝখানে একদিন স্বপ্নে পাওয়ার মতো করে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব পদ্মা সেতু নির্মাণে মালয়েশিয়ার বায়বীয় বিনিয়োগকারীদের সংবাদ রেডিও-টেলিভিশনে ফলাও করে জাতিকে জানিয়েছিলেন। তবে সেই বাগাড়ম্বরের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ২৪ ঘণ্টা। পদ্মা সেতু নির্মাণে মালয়েশীয় বিনিয়োগ নিয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য সরকারি তরফ থেকে এরপর শোনা যায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা বাংলাদেশের জনগণকে সচরাচর মূর্খ এবং নির্বোধরূপেই বিবেচনা করেন। নইলে তার শাসনামলে গোটা মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে এতটা দূরত্ব সৃষ্টি করার পর আমাদের ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক কিংবা মালয়েশিয়ার অর্থ সহায়তার স্বপ্ন দেখানোর চেষ্টা করতেন না।
গত সপ্তাহে রাজশাহীতে এক জনসভায় বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী তার স্বভাবসুলভ ভাষায় বিএনপির পাঁচ বছর আগেকার সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন। ক’দিন আগে গিয়াসউদ্দিন মামুনের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের এক মামলায় সাক্ষ্য দিতে ডেবরা লাপ্রেভট নামের এক মার্কিন নাগরিক বাংলাদেশে উড়ে এসেছিলেন। তার বক্তব্য দেশের তাবত পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সেই সাক্ষ্যে নতুন কিংবা চাঞ্চল্যকর কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও শেখ হাসিনা দাবি করেছেন, তারেক রহমানের মানি লন্ডারিং প্রমাণ করতে ডেবরার এই উড়ে আসায় নাকি লজ্জায় তার মাথাও হেঁট হয়েছে। প্রথম কথা হলো, প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, জনকণ্ঠের মতো চরম তারেকবিদ্বেষী পত্রিকায়ও খুঁজে পাওয়া যায়নি যে এই মার্কিন সাক্ষী তারেক রহমান মানি লন্ডারিং করেছেন এমন কোনো বক্তব্য তার সাক্ষ্যে দিয়েছেন। পাঁচ বছর ধরে দুর্নীতির অনেক গল্প ফাঁদা হলেও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে তার বন্ধু গিয়াসউদ্দিন মামুনের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের অভিযোগই এ পর্যন্ত সরকার আনতে পেরেছে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, তারেক রহমানের মানি লন্ডারিং প্রমাণিত হলে তো একদা ডজনেরও অধিক দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত শেখ হাসিনার মাথা উঁচু হওয়ার কথা, মাথা হেঁট হবে তারেক রহমান এবং জাতীয়তাবাদী দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের। যাকগে এসব তর্ক।
বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে দুর্নীতিবিষয়ক আমার অন্য দু-একটি প্রশ্ন রয়েছে। আপনার পুত্রবধূর দেশের যোগসাজশে ডেবরা লাপ্রেভটকে আপনার সরকারই সাক্ষ্য দিতে নিয়ে আসায় আপনার মাথা হেঁট হয়ে গেল। অথচ পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি নিয়ে আপনারই আমলে দেশ-বিদেশে এত হৈচৈয়ের পরও সেই মাথা যথাস্থলে বহাল তবিয়তে থাকল কী করে? সংসদে দাঁড়িয়ে আপনিই তো একাধিকবার চরম দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত যোগাযোগমন্ত্রীর পক্ষে সাফাই গেয়েছেন! রক্তচক্ষু দেখিয়ে থামিয়ে দিয়েছেন আপনার দলেরই অন্যান্য সমালোচনাকারীদের। আপনার মন্ত্রী, এমপি, উপদেষ্টারা মিলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের লক্ষ কোটি টাকারও অধিক শেয়ারবাজার থেকে লুটপাট করে হিল্লি-দিল্লিতে পাচার করলেন, অথচ আপনি বিন্দুমাত্র লজ্জিত না হয়ে গোটা জাতিকে উল্টো দুর্নীতিবাজ হতে উত্সাহিত করলেন!
বাংলাদেশের কোন সরকারপ্রধান নিজে ঘোষণা দিয়েছেন যে দুর্নীতিলব্ধ অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করলে দুদক অথবা এনবিআর এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবে না? বাংলাদেশের চল্লিশ বছরের ইতিহাসে এমন দ্বিতীয় উদাহরণ আমার অন্তত মনে পড়ছে না। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে বর্তমান বাংলাদেশে তথাকথিত স্বাধীন দুদক তারই শিকলে বাঁধা আজ্ঞাবহ বিশেষ প্রাণীমাত্র। এই দেশে সুশাসনের কিছুমাত্র অস্তিত্ব থাকলে এই ঘোষণার পর দুদক চেয়ারম্যানের পদত্যাগ করা উচিত ছিল। অবশ্য শেখ হাসিনার একসময়ের বশংবদ সচিবের কাছ থেকে আমার এমন প্রত্যাশাও চরম নির্বুদ্ধিতা। দুর্নীতিকে সরাসরি উত্সাহদানকারী প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পর এনবিআর কালবিলম্ব না করে রীতিমত প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে, দুর্নীতিবাজরা নির্ভয়ে শেয়ার মার্কেটে লেনদেন করতে পারে, তাদের টিকিটিও স্পর্শ করা হবে না। এতকিছুর পরও শেয়ারবাজারে সূচক যে অব্যাহতভাবে পড়েই যাচ্ছে, সেটা অবশ্য অর্থনীতি বিষয়ক ভিন্ন তত্ত্বগত আলোচনা।
পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে, মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেই সরকারি কেনাকাটায় দলীয় লোকজনের জন্য দুর্নীতির অবাধ সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। বিনা টেন্ডারে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত ঠিকাদারি কাজ দেয়ার বন্দোবস্তের মাধ্যমে নেতাকর্মীদের রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়ার পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য ডিজিটাল মন্ত্রিসভার তারিফ না করে উপায় নেই। বাংলাদেশের জনগণ এই দুর্নীতি বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়ার ফলস্বরূপ অতঃপর দেশের সম্পদ নিয়ে রীতিমত ডাকাতির রাস্তা খুলে দেয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এই দেশে যোগাযোগ, বাণিজ্য, স্থানীয় সরকার, টেলিযোগাযোগ এবং জ্বালানি ও বিদ্যুত্ মন্ত্রণালয় দুর্নীতির ঘাঁটি হিসেবে সুপরিচিত। বুদ্ধিমান সরকার জনগণের বিদ্যুত্ নিয়ে অসহায় অবস্থাটি ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন। অনেকদিন ধরেই দেশের জনগণ বিদ্যুত্ ঘাটতির জন্য যথেষ্ট ভোগান্তিতে রয়েছেন। সেই ভোগান্তিকে পুঁজি করে এবার ক্ষমতাসীনদের মধ্যে বিনা টেন্ডারে রেন্টাল বিদ্যুত্ কেন্দ্র বণ্টন শুরু হলো। শুধু তা-ই নয়, এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার পথও রুদ্ধ করল মার্কিন-ভারত সমর্থিত মহাজোট সরকার। দেশে আইন করা হলো, বিনা টেন্ডারে অতি উচ্চমূল্যে রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্র থেকে বিদ্যুত্ কেনার সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে কোনো নাগরিক মামলা করতে পারবে না।
আমার গ্রেফতারের আগে সরকারের এসব অনৈতিক এবং দুর্নীতিতে সহায়তাকারী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে মন্তব্য-প্রতিবেদন লেখার পাশাপাশি টেলিভিশন টকশোতেও যথাসম্ভব প্রতিবাদ করেছিলাম। একটি পুরনো লেখার কথা এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করছি। ‘মার্কিন এজেন্ডায় আর সুশাসন নেই’ শিরোনামের লেখায় বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গি দমনের ধুয়া তুলে মার্কিন নেতৃত্বে উন্নয়ন সহযোগীদের বাংলাদেশ সরকারকে তাবত জুলুম, নির্যাতন ও দুর্নীতির লাইসেন্স দেয়ার বিরোধিতা করেছিলাম। লোকমুখে শুনেছি, আমার ওই লেখার কারণে তত্কালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত নাকি আমার ওপর ভয়ানক কুপিত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে আমার গ্রেফতার এবং রিমান্ডে নির্যাতনেও ওই লেখার নাকি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। আমার মন্তব্য-প্রতিবেদনটি ২০১০ সালের ১৭ মে ছাপা হয়েছিল। দেড় বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর সেই মার্কিনিরাই এখন সরকারের বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী দুর্নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলছেন।
রিমান্ডে টিএফআই সেলে আমাকে বিদ্যুত্ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ, বিশেষ করে কুইক রেন্টাল পদ্ধতির বিরোধিতার কারণ জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। প্রশ্নকর্তাদের আমি বলেছিলাম, রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া করে ক্ষমতাসীনদের লুটপাটের সুবিধার জন্যই এই কুইক রেন্টাল পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছে। সেইসঙ্গে এটাও যোগ করেছিলাম, এত উচ্চমূল্যে বিদ্যুত্ কেনা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতি সহসাই ভঙ্গুর হয়ে পড়বে। উত্তরায় অবস্থিত র্যাব-১ হেডকোয়ার্টারের টিএফআই সেলে আমার জিজ্ঞাসাবাদের তারিখ ছিল ২০১০ সালের ২৪ জুন। আজ প্রায় দেড় বছরের ব্যবধানে আশা করি সেদিন উপস্থিত বিভিন্ন বাহিনীর সেই সব তরুণ প্রশ্নকর্তারা বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান দুরবস্থার কারণ উপলব্ধি করতে পারছেন।
কুইক রেন্টাল নিয়ে এখন অন্যান্য পত্রিকাও লেখালেখি শুরু করেছে। ২৬ নভেম্বরের নয়াদিগন্ত পত্রিকার লিড স্টোরির শিরোনাম, ‘কুইক রেন্টাল আইপিপির বিদ্যুত্ ক্রয় : ভর্তুকি ১২ হাজার কোটি টাকা, দায় চাপছে গ্রাহকের ওপর।’ আমি নিশ্চিত যে, বর্তমান অর্থবছরের ১২ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি এই সরকারের মেয়াদকালেই ২০ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করবে। ভর্তুকির এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কোন দেশে, কার পকেটে যাচ্ছে সেই খবর দেশের সাধারণ নাগরিক হয়তো কোনোদিনই জানতে পারবে না। তবে দেশের সর্বনাশ যা হওয়ার, সেটা বোধহয় সম্পন্ন হয়েছে। এদিকে প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে হুমকি দিয়ে রেখেছেন, যারাই এসব ভর্তুকি নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসস্থানের বিদ্যুত্ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে। সুতরাং সরকার পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত দেশবাসীর মূক ও বধিরের ভূমিকা পালন করে ক্ষমতাসীনদের সীমাহীন দুর্নীতি সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই।
বিদ্যুত্খাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই চলছে টেলি-যোগাযোগের লুণ্ঠন। ভিওআইপির গল্প বেশ পুরনো হয়ে গেছে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী সরকারের চিহ্নিত কর্তাব্যক্তিদের পুত্র-কন্যারা এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিএনপি আমলের প্রথম দিকে মন্ত্রণালয়ে স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা করা হলেও নানান চাপের কাছে সেই সদিচ্ছা বেশিদিন স্থায়িত্ব পায়নি। অভিযোগ রয়েছে, তত্কালীন ক্ষমতাবানরাও পরবর্তীকালে নাকি জড়িয়ে পড়েছিলেন এই অনৈতিক কর্মকাণ্ডে। আওয়ামী লীগের এবারের আমলে লুণ্ঠনের নিত্যনতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করা হয়েছে। লন্ডন, আমেরিকা, কানাডা থেকে নিয়ন্ত্রণ করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে বাংলাদেশের বারোটা বাজিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা হচ্ছে। গুজব রয়েছে, সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রীর পিএস, এপিএসরাই নাকি প্রতি বছর কয়েক কোটি টাকার মালিক হচ্ছেন। বর্তমান সরকারের ডাকসাঁইটে সব মন্ত্রী হত্যা, লুটপাটে সরাসরি জড়িত থেকেও যে রক্ষা পেয়ে যাচ্ছেন, তার পেছনেও রয়েছে এই অবৈধ সম্পদের দেশ-বিদেশে ভাগবাটোয়ারা।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সম্পর্কে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক অভাবনীয় মন্তব্য নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেই আজকের মন্তব্য-প্রতিবেদনের সমাপ্তি টানব। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেছেন, তার পিতার আমলেও রিজার্ভে কোনো টাকা ছাড়াই দেশ চললে এখনও কোনো অসুবিধা হবে না। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, নানাবিধ চাপে মানসিকভাবে বিক্ষিপ্ত থাকার কারণেই শেখ হাসিনা এ ধরনের অসংলগ্ন, অপ্রধানমন্ত্রীসুলভ মন্তব্য করেছেন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি প্রসঙ্গে তত্কালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের চরম অবমাননাকর মন্তব্য ছিল, বাংলাদেশ একটি তলাবিহীন ঝুড়ি (Basket case)। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং একসময়ের বাম অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী ১৯৭৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর ফেনীতে এক জনসভায় তত্কালীন আওয়ামী সরকারের দুর্নীতি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আজকের আওয়ামী লীগ হচ্ছে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, লুটপাট আর পারমিটবাজির আখড়া। মাছ যেমন জল ছাড়া বাঁচতে পারে না, আওয়ামী লীগও তেমনি দুর্নীতি ছাড়া বাঁচতে পারে না।’ মরহুম শেখ মুজিবের শাসনামলে বাংলাদেশের রিজার্ভে টাকা ছিল না—দীর্ঘদিন পর এমন মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী হয়তো তার অজান্তেই হেনরি কিসিঞ্জার এবং মতিয়া চৌধুরীর মূল্যায়ন মেনে নিয়ে তার মরহুম পিতার শাসনামলকে হেয় করলেন। তদুপরি তিনি বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দ্বারা বিধ্বস্ত একটি যুদ্ধপরবর্তী রক্তাক্ত রাষ্ট্রের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করে আমাদের চার দশকের অর্জনকে অস্বীকার করেছেন। ডজনেরও অধিক ডক্টরেটধারী প্রধানমন্ত্রী কেন এমন তুলনা করলেন, তা তিনিই ভালো জানেন। রিজার্ভে টান ধরলে মূলত আমদানিনির্ভর বাংলাদেশের যে দেউলিয়া হতে বিশেষ একটা সময় লাগবে না, সেটি বুঝতে অর্থনীতি নিয়ে বিশেষ পড়াশোনার কোনো প্রয়োজন নেই। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার আশু কর্তব্য রিজার্ভ দ্রুত হ্রাস হওয়ার পেছনের কারণগুলো খুঁজে বের করে সেই ফাঁক-ফোকরগুলো অনতিবিলম্বে বন্ধ করা। ২০০৮ সালে নির্বাচনী প্রচারাভিযানকালে মহাজোট নেত্রী দেশবাসীকে একেবারে স্বপ্নের মায়াপুরীতে নিয়ে গিয়েছিলেন। ঢাকার কারওয়ানবাজারে দেয়া একটা বক্তৃতার কথা আমার প্রায়ই মনে পড়ে। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, নৌকায় ভোট দিলে পাতাল রেল, উড়াল সেতু, পদ্মা সেতু, মনোরেল কোনো কিছুরই অভাব থাকবে না। জনগণ কেবল কষ্ট করে মুখ ফুটে চাইবে আর তিনি জাদুবলে সঙ্গে সঙ্গে সব চাহিদা তাদের সামনে হাজির করবেন। তার বক্তৃতা শুনে সেদিন মনে হয়েছিল, বাংলাদেশ টাকার অফুরান সাগরে ভাসছে।
সত্তরের দশকের শেষের দিকে মরহুম জিয়াউর রহমান একবার বলেছিলেন, দেশের উন্নয়নে অর্থ কোনো সমস্যা নয়, সদিচ্ছাটাই বড় কথা। তার এই বক্তব্যের কদর্থ করে আওয়ামী অর্থনীতিবিদরা এখনও সুযোগ পেলেই কঠোর সমালোচনা করে থাকেন। অথচ একই বুদ্ধিজীবীকুল মহাজোট নেত্রীর বাস্তবতাবিবর্জিত এসব বক্তব্যে আপত্তিজনক কোনো বিষয় খুঁজে পান না। কেবল এখানেই শেষ নয়, রিজার্ভ ছাড়াও দেশের অর্থনীতি চলমান থাকতে পারে, এ-জাতীয় উদ্ভট বক্তব্যের সমর্থনেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ডাকসাঁইটে আওয়ামী শিক্ষককুল সরকারদলীয় পত্রিকাগুলোতে কলম ধরেছেন। তবে ডিজিটাল দুর্নীতির পক্ষে আবোল-তাবোল লিখে শেষরক্ষা হবে কি-না, সেটি জানতে আমাদের বর্তমান সরকারের মেয়াদ সমাপ্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। একই ভোটার গোষ্ঠীকে অবাস্তব ও চটকদার প্রতিশ্রুতির তোড়ে পাঁচ বছরের ব্যবধানে দ্বিতীয়বার বিভ্রান্ত করে ক্ষমতায় পুনর্বার আসীন হওয়ার অলীক কল্পনা বাস্তবে রূপ নেয়া জালিমের বিরুদ্ধে ক্রমেই ফুঁসে ওঠা জনমতের পরিপ্রেক্ষিতে অসম্ভবই ঠেকছে। পরিবর্তনের জোয়ার বেগবান হলে ডিজিটাল দুর্নীতির হিসাব-নিকাশও একদিন জনগণই ইনশাআল্লাহ আদায় করবে।
ই-মেইল : admahmudrahman@gmail.com
No comments