মরা তত্ত্বাবধায়কের এমপি সুরঞ্জিত! by ফজলুল বারী
তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অতঃপর মরা গাছের সঙ্গে তুলনা করেছেন আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত! বলেছেন, ‘বিরোধীদল বিএনপি এ নিয়ে যত চেষ্টা করুক যে গাছ মরে গেছে সেটি আর জেতা করতে পারবেনা।’ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও ডাকসাঁইটে আমলা ড. আকবর আলী খান দিয়েছেন আরেকটি অগ্নিতে ঘি-ঢালা বক্তব্য। ড আকবর বলেছেন, সামাজিক চুক্তি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা আইনের দোহাই দিয়ে ভেঙ্গে দেওয়া যায় না! সুরঞ্জিত-আকবর আলী দু’জনের বক্তব্য প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শিবির দুটিতে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে!
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মন্তব্যটি অবশ্য তার জীবন থেকে নেয়া। সবশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার তথা মরাগাছের অধীনে নির্বাচনে জিতে তার একটুও লাভ হয়নি! তার রাজনৈতিক ছাত্র তথা রাজনীতিতে যারা তার কাছে কিন্ডারগার্টেনের শিশু, তারাও মন্ত্রী হয়ে গেছেন! কিন্তু শিঁকে ছিঁড়েনি তার ভাগ্যে! এখন কী করলে ছিঁড়বে সে চেষ্টায় প্রতিদিন আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন! একবার না পারিলে দেখ শতবার!
আওয়ামী লীগের আগের আমলে সুরঞ্জিতকে সংসদ নেত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা করা হয়েছিল। এবার তাও না! তখন অবশ্য আব্দুস সামাদ আজাদ নামের একজন সারাক্ষণ তার বিরুদ্ধে পাহারায় ছিলেন! বলা হতো ঢাকায় বা সিলেটে নিজের একচ্ছত্র কর্তৃ্ত্ব-আধিপত্যে সুরঞ্জিত যাতে ভাগ বসাতে না পারেন সে কারণে সারাক্ষণ তাকে চোখে চোখে রাখতেন আব্দুস সামাদ আজাদ। তিনি ইহধাম থেকে যাবার পর যে স্বস্তি সুরঞ্জিত আশা করেছিলেন আওয়ামী লীগ এমন বিপুলভাবে ক্ষমতায় গেলেও তা তার আর জোটেনি!
সেই যে দোষ অথবা বদনাম একটাই!—‘সংস্কারবাদী!’ এবার ক্ষমতায় যাবার পর শেখ হাসিনা একবার সুরঞ্জিতের সুনামগঞ্জ এলাকার এক জনসভায় বক্তৃতা দিতে যান। মঞ্চে দাদাকে একান্তে পেয়ে জিজ্ঞেস করে বসেন, আপনিও যে কেন সংস্কারবাদীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন তা আমি আজও ভেবে পাইনা। সে মঞ্চে আসীন এক নেতার ভাষ্যে এক্সক্লুসিভ সে আলাপচারিতাও পরে মিডিয়ায় চলে আসে।
বলাইবাহুল্য দাদার মুখটা তখন বিব্রত লালই শুধু হয়েছে! সুরঞ্জিতও বুঝে ফেলেন এই মরাগাছের মরাফলের এমপিত্বের যুগে তিনি আর কী পেতে বা আশা করতে পারেন! আস্থার আকালে মাঝে সংবিধান সংশোধনী কমিটিতেও তাকে চেয়ারম্যান করা হয়নি। শেখ হাসিনার আস্থাভাজন সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করা হয়েছে। সাজেদা যেহেতু সংবিধানের খুঁটিনাটি সুরঞ্জিতের মতো বোঝেন না তাই তাকে সেখানে কো-চেয়ারম্যান নামের মূল দায়িত্বটি দেয়া হয়।
এরপর সুরঞ্জিত বহুদিন পর তেমন একটি কাজের কাজ পেয়ে প্রতিদিন নানা শ্রেনী-পেশার মানুষজনের সঙ্গে বৈঠক-মিডিয়া ব্রিফিং’এ প্রতিদিন এত ভালো ভালো কথা বলেন যে দেশের মানুষ আশাবাদী হয়ে ভাবতে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের বাহাত্তরের সংবিধান, তত্ত্বাবধায়ক সহ সব ভালো বিষয়াদিই নতুন সংবিধানে থাকবে। কিন্তু মূলত প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে বৈঠকের পর সব যেন গেল উল্টে! সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত হয়ে গেলেন বাকবাকুম পায়রা! তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা, আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ বিশিষ্টজনরা কী পরামর্শ দিয়েছেন না দিয়েছেন সব গেল বাদ! তার বদলে প্রধানমন্ত্রী কী চান সেটিই হয়ে গেল সব তরিকার মূল মন্ত্র!
পুরো বিষয়টির যবনিকা আমজনতা পাবলিকের সামনে এমনভাবে এল যে পাবলিক মনে করল, আসলে বুঝি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের জন্যেই এতকিছু করা হয়েছে! সুপ্রীমকোর্টের রায়ের নামে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হলেও সুপ্রীমকোর্ট যে পরবর্তী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বলেছে সে ফর্মুলাও বেমালুম যাওয়া হলো চেপে!
সবশেষ ড. আকবর আলী খান বলেছেন সামাজিক চুক্তি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা আইনের নামে ভেঙ্গে দেওয়া যায়না। স্মরনকালের মেধাবী ডাকসাঁইটে আমলাদের মধ্যে ড. আকবর অন্যতম। জিয়া-এরশাদ-খালেদা-হাসিনা সব সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন। আমাদের বেশিরভাগ সামরিক-বেসামরিক আমলা চুরিচামারি জীবনে এত বেশি করেন বা করেছেন যে সবাই মুখ ফুটে কথাবার্তা তেমন বলেননা বা বলতে পারেননা। আকবর আলী সম্ভবত সে সমস্যা থেকে মুক্ত বলেই এখনও প্রতিদিন কথা বলতে পারেন! নইলে ডিএজএফআই’র ফাইলতো কবে হেঁটে হেঁটে চলে যেত প্রধানমন্ত্রীর দফতরে!
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার কাজটিও যে কত জটিল-কঠিন অথবা ব্যবস্থাটি কতটা ত্রুটিপূর্ণ তা আকবর আলী নিজে এরসঙ্গে কাজ করে দেখেছেন! ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তিনি কাজ করেছেন। সেখানে কেবিনেটের মিটিং’এ নানা বিষয় আলোচনার পরও দেখেন কেবিনেটে কোন সিদ্ধান্ত হচ্ছেনা! এরপর বোধগম্য সমস্যাটি ঠাওর করতে পারেন! তাদেরকে কেবিনেটের মিটিং’এ বসিয়ে রেখে ব্রেকের কথা বলে ইয়াজউদ্দিন চলে যান বিএনপির হাইকমান্ডের সঙ্গে টেলিফোনে শলামর্শে! অর্থাৎ বিএনপির হাইকমান্ড ইয়েস বললে ইয়াজউদ্দিন ইয়েস! তারা নো’ বললে ইয়াজউদ্দিন নো’! অতএব এক সময়ে নিজেদের মানসম্মান রক্ষায় সুলতানা কামাল সহ তাদের কয়েকজন সেখান থেকে পদত্যাগ করে চলে আসেন।
এতকিছুর পরও সেই আকবর আলী খান সামাজিক চুক্তির নামে তেমন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে যে কথা বলছেন তা কী একেবারেই যুক্তিহীন? এরশাদের অধীনে নির্বাচন নিরপেক্ষ হতে পারেনা এই ধারনা থেকেই তখন সবাই এই তত্ত্ববধায়ক সরকার চেয়েছে। খালেদা জিয়ার অধীনে নির্বাচন নিরপেক্ষ হতে পারেনা ভেবে তত্ত্ববধায়ক সরকার চেয়েছেন শেখ হাসিনা। রাজনীতিকরা রাজনীতিকদের বিশ্বাস করেননা বলেইতো তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার নামে একদল অরাজনৈতিক ফেরেস্তার(!) শাসন কবুল করেছিলেন। এখন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একই অবিশ্বাস খালেদা জিয়ার মধ্যে! অবিশ্বাসটি এমন চরম অবস্থার যে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনের নির্বাচনে চিটাগাং’এ তাদের মেয়র জিতলেও এখন কসম করে বলছেন জাতীয় নির্বাচনে তারা এই মেশিন ব্যবহার করতে দেবেননা।
আর শেখ হাসিনাসহ সরকারি দলের নেতারা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এভাবে কোমরবেঁধে অবস্থান নেওয়াতে বহুদিন রাজনৈতিক ইস্যু বিহীন বিরোধীদলও যেন মোক্ষম একটা ইস্যু পেয়ে গেছে! এতদিন ইস্যু ছিল খালেদা জিয়ার বাড়ি, তারেক-কোকোর বিদেশে টাকা পাচার নিয়ে কথা না বলার বিষয়। আর এখন তত্ত্বাবধায়কের মতো মোক্ষম রাজনৈতিক ইস্যুটি হাতে পেয়ে যাওয়াতে লাজ-লজ্জা ভুলে যুদ্ধাপরাধী জামায়াতকেও আবার আদরের হেফাজতে নিতে পেরেছেন খালেদা জিয়া। যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেফতার শুরুর পর অন্তরাত্মার কাঁপুনিতে ঘরে ঢুকে যাওয়া তাদের আণ্ডা-বাচ্চাগুলোও ফিরে এসেছে মাঠে! সবশেষ নয়াপল্টনের জনসভায় এর প্রমান মিলেছে। খালেদা জিয়ার নিরাপদ আদরের ছায়ায় আগামিতে রোর্ড মার্চেও তারা ঘুরে বেড়াবে সারাদেশ!
অতএব তত্ত্বাবধায়ক বিষয়টি এখন বহুদূর যাবে মনে করা হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করার সরকারি রাজনৈতিক সততা, বিপুল বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ নানা সাফল্য পিছনে ঠেলে দিয়ে অগ্নি দ্রব্যমূল্য আর তত্ত্বাবধায়কের মতো জনপ্রিয় রাজনৈতিক ইস্যু সরকারকে পিছনে ফেলবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুর কোন হারের রেকর্ড নেই। এই বোধ-রেকর্ডটিও আওয়ামী লীগের সৃষ্টি। কারণ আওয়ামী লীগই এই ইস্যুটিকে বারবার করে দেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় করেছে। দেশের মানুষকে ভাবতে শিখিয়েছে কী করে তত্ত্বাবধায়ক আন্দোলন-নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় যেতে হয়।
এখন সেই আওয়ামী লীগ যদি উল্টো তা ‘আর দেব না দেব না’ বলে জেদাজেদি করে তাহলে পাবলিকের ধারনা হবে আওয়ামী লীগ আসলে তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচনে ফের জিতে আসার বিষয়ে আস্থাশীল নয় বলেই এখন এর বিরুদ্ধে একাট্টা অবস্থান নিয়েছে! এমন ধারনা যদি পাবলিকের মন একবার অন্ধকার করে তাহলে নতুন উৎপাদিত বিদ্যুতের আলো দিয়েও সে অন্ধকার দূর করা যাবেনা। আওয়ামী লীগ যেন ভুলে না যায় আগামি নির্বাচনই দেশের শেষ নির্বাচন নয়।
আওয়ামী লীগের আগের আমলে সুরঞ্জিতকে সংসদ নেত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা করা হয়েছিল। এবার তাও না! তখন অবশ্য আব্দুস সামাদ আজাদ নামের একজন সারাক্ষণ তার বিরুদ্ধে পাহারায় ছিলেন! বলা হতো ঢাকায় বা সিলেটে নিজের একচ্ছত্র কর্তৃ্ত্ব-আধিপত্যে সুরঞ্জিত যাতে ভাগ বসাতে না পারেন সে কারণে সারাক্ষণ তাকে চোখে চোখে রাখতেন আব্দুস সামাদ আজাদ। তিনি ইহধাম থেকে যাবার পর যে স্বস্তি সুরঞ্জিত আশা করেছিলেন আওয়ামী লীগ এমন বিপুলভাবে ক্ষমতায় গেলেও তা তার আর জোটেনি!
সেই যে দোষ অথবা বদনাম একটাই!—‘সংস্কারবাদী!’ এবার ক্ষমতায় যাবার পর শেখ হাসিনা একবার সুরঞ্জিতের সুনামগঞ্জ এলাকার এক জনসভায় বক্তৃতা দিতে যান। মঞ্চে দাদাকে একান্তে পেয়ে জিজ্ঞেস করে বসেন, আপনিও যে কেন সংস্কারবাদীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন তা আমি আজও ভেবে পাইনা। সে মঞ্চে আসীন এক নেতার ভাষ্যে এক্সক্লুসিভ সে আলাপচারিতাও পরে মিডিয়ায় চলে আসে।
বলাইবাহুল্য দাদার মুখটা তখন বিব্রত লালই শুধু হয়েছে! সুরঞ্জিতও বুঝে ফেলেন এই মরাগাছের মরাফলের এমপিত্বের যুগে তিনি আর কী পেতে বা আশা করতে পারেন! আস্থার আকালে মাঝে সংবিধান সংশোধনী কমিটিতেও তাকে চেয়ারম্যান করা হয়নি। শেখ হাসিনার আস্থাভাজন সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করা হয়েছে। সাজেদা যেহেতু সংবিধানের খুঁটিনাটি সুরঞ্জিতের মতো বোঝেন না তাই তাকে সেখানে কো-চেয়ারম্যান নামের মূল দায়িত্বটি দেয়া হয়।
এরপর সুরঞ্জিত বহুদিন পর তেমন একটি কাজের কাজ পেয়ে প্রতিদিন নানা শ্রেনী-পেশার মানুষজনের সঙ্গে বৈঠক-মিডিয়া ব্রিফিং’এ প্রতিদিন এত ভালো ভালো কথা বলেন যে দেশের মানুষ আশাবাদী হয়ে ভাবতে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের বাহাত্তরের সংবিধান, তত্ত্বাবধায়ক সহ সব ভালো বিষয়াদিই নতুন সংবিধানে থাকবে। কিন্তু মূলত প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে বৈঠকের পর সব যেন গেল উল্টে! সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত হয়ে গেলেন বাকবাকুম পায়রা! তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা, আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ বিশিষ্টজনরা কী পরামর্শ দিয়েছেন না দিয়েছেন সব গেল বাদ! তার বদলে প্রধানমন্ত্রী কী চান সেটিই হয়ে গেল সব তরিকার মূল মন্ত্র!
পুরো বিষয়টির যবনিকা আমজনতা পাবলিকের সামনে এমনভাবে এল যে পাবলিক মনে করল, আসলে বুঝি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের জন্যেই এতকিছু করা হয়েছে! সুপ্রীমকোর্টের রায়ের নামে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হলেও সুপ্রীমকোর্ট যে পরবর্তী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বলেছে সে ফর্মুলাও বেমালুম যাওয়া হলো চেপে!
সবশেষ ড. আকবর আলী খান বলেছেন সামাজিক চুক্তি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা আইনের নামে ভেঙ্গে দেওয়া যায়না। স্মরনকালের মেধাবী ডাকসাঁইটে আমলাদের মধ্যে ড. আকবর অন্যতম। জিয়া-এরশাদ-খালেদা-হাসিনা সব সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন। আমাদের বেশিরভাগ সামরিক-বেসামরিক আমলা চুরিচামারি জীবনে এত বেশি করেন বা করেছেন যে সবাই মুখ ফুটে কথাবার্তা তেমন বলেননা বা বলতে পারেননা। আকবর আলী সম্ভবত সে সমস্যা থেকে মুক্ত বলেই এখনও প্রতিদিন কথা বলতে পারেন! নইলে ডিএজএফআই’র ফাইলতো কবে হেঁটে হেঁটে চলে যেত প্রধানমন্ত্রীর দফতরে!
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার কাজটিও যে কত জটিল-কঠিন অথবা ব্যবস্থাটি কতটা ত্রুটিপূর্ণ তা আকবর আলী নিজে এরসঙ্গে কাজ করে দেখেছেন! ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তিনি কাজ করেছেন। সেখানে কেবিনেটের মিটিং’এ নানা বিষয় আলোচনার পরও দেখেন কেবিনেটে কোন সিদ্ধান্ত হচ্ছেনা! এরপর বোধগম্য সমস্যাটি ঠাওর করতে পারেন! তাদেরকে কেবিনেটের মিটিং’এ বসিয়ে রেখে ব্রেকের কথা বলে ইয়াজউদ্দিন চলে যান বিএনপির হাইকমান্ডের সঙ্গে টেলিফোনে শলামর্শে! অর্থাৎ বিএনপির হাইকমান্ড ইয়েস বললে ইয়াজউদ্দিন ইয়েস! তারা নো’ বললে ইয়াজউদ্দিন নো’! অতএব এক সময়ে নিজেদের মানসম্মান রক্ষায় সুলতানা কামাল সহ তাদের কয়েকজন সেখান থেকে পদত্যাগ করে চলে আসেন।
এতকিছুর পরও সেই আকবর আলী খান সামাজিক চুক্তির নামে তেমন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে যে কথা বলছেন তা কী একেবারেই যুক্তিহীন? এরশাদের অধীনে নির্বাচন নিরপেক্ষ হতে পারেনা এই ধারনা থেকেই তখন সবাই এই তত্ত্ববধায়ক সরকার চেয়েছে। খালেদা জিয়ার অধীনে নির্বাচন নিরপেক্ষ হতে পারেনা ভেবে তত্ত্ববধায়ক সরকার চেয়েছেন শেখ হাসিনা। রাজনীতিকরা রাজনীতিকদের বিশ্বাস করেননা বলেইতো তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার নামে একদল অরাজনৈতিক ফেরেস্তার(!) শাসন কবুল করেছিলেন। এখন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একই অবিশ্বাস খালেদা জিয়ার মধ্যে! অবিশ্বাসটি এমন চরম অবস্থার যে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনের নির্বাচনে চিটাগাং’এ তাদের মেয়র জিতলেও এখন কসম করে বলছেন জাতীয় নির্বাচনে তারা এই মেশিন ব্যবহার করতে দেবেননা।
আর শেখ হাসিনাসহ সরকারি দলের নেতারা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এভাবে কোমরবেঁধে অবস্থান নেওয়াতে বহুদিন রাজনৈতিক ইস্যু বিহীন বিরোধীদলও যেন মোক্ষম একটা ইস্যু পেয়ে গেছে! এতদিন ইস্যু ছিল খালেদা জিয়ার বাড়ি, তারেক-কোকোর বিদেশে টাকা পাচার নিয়ে কথা না বলার বিষয়। আর এখন তত্ত্বাবধায়কের মতো মোক্ষম রাজনৈতিক ইস্যুটি হাতে পেয়ে যাওয়াতে লাজ-লজ্জা ভুলে যুদ্ধাপরাধী জামায়াতকেও আবার আদরের হেফাজতে নিতে পেরেছেন খালেদা জিয়া। যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেফতার শুরুর পর অন্তরাত্মার কাঁপুনিতে ঘরে ঢুকে যাওয়া তাদের আণ্ডা-বাচ্চাগুলোও ফিরে এসেছে মাঠে! সবশেষ নয়াপল্টনের জনসভায় এর প্রমান মিলেছে। খালেদা জিয়ার নিরাপদ আদরের ছায়ায় আগামিতে রোর্ড মার্চেও তারা ঘুরে বেড়াবে সারাদেশ!
অতএব তত্ত্বাবধায়ক বিষয়টি এখন বহুদূর যাবে মনে করা হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করার সরকারি রাজনৈতিক সততা, বিপুল বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ নানা সাফল্য পিছনে ঠেলে দিয়ে অগ্নি দ্রব্যমূল্য আর তত্ত্বাবধায়কের মতো জনপ্রিয় রাজনৈতিক ইস্যু সরকারকে পিছনে ফেলবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুর কোন হারের রেকর্ড নেই। এই বোধ-রেকর্ডটিও আওয়ামী লীগের সৃষ্টি। কারণ আওয়ামী লীগই এই ইস্যুটিকে বারবার করে দেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় করেছে। দেশের মানুষকে ভাবতে শিখিয়েছে কী করে তত্ত্বাবধায়ক আন্দোলন-নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় যেতে হয়।
এখন সেই আওয়ামী লীগ যদি উল্টো তা ‘আর দেব না দেব না’ বলে জেদাজেদি করে তাহলে পাবলিকের ধারনা হবে আওয়ামী লীগ আসলে তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচনে ফের জিতে আসার বিষয়ে আস্থাশীল নয় বলেই এখন এর বিরুদ্ধে একাট্টা অবস্থান নিয়েছে! এমন ধারনা যদি পাবলিকের মন একবার অন্ধকার করে তাহলে নতুন উৎপাদিত বিদ্যুতের আলো দিয়েও সে অন্ধকার দূর করা যাবেনা। আওয়ামী লীগ যেন ভুলে না যায় আগামি নির্বাচনই দেশের শেষ নির্বাচন নয়।
No comments