রামমোহন রায় লাইব্রেরি নিয়ে ত্রিমুখী রশি টানাটানি
সরকারের এক কর্তৃপক্ষ বলছে, জরাজীর্ণ ভবনটি বিপজ্জনক। যেকোনো সময় ভেঙে পড়ে প্রাণহানি ঘটাতে পারে। আরেক দপ্তর বলছে, পুরনো ভবনটি মহামূল্যবান। এর ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার জন্য ভবনটি রক্ষা করতে হবে। সরকারেরই আরেক অফিস বলছে, স্থাপনাটি অতি সাধারণ মানের। তার মধ্যে প্রত্নতাত্তি্বক কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। এই হচ্ছে ঢাকার প্রথম গণগ্রন্থাগার হিসেবে স্বীকৃত ১৮৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরি ভবনের বর্তমান অবস্থা। ১৪০ বছরের পুরনো এ পাঠাগারটির সঙ্গে
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, শামসুর রাহমানসহ আরো অনেক খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যিক, লেখক ও বুদ্ধিজীবীর স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তবে পাঠাগার ভবনটি নিয়ে ত্রিমুখী রশি টানাটানির ফলে ঢাকা ব্রাহ্মসমাজও দ্বিধাবিভক্ত। এ পরিস্থিতিতে লাইব্রেরিটি দীর্ঘদিন ধরে তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে।
এরই মধ্যে ভবটির পলেস্তারা খসে পড়তে শুরু করেছে। ভবনের কোথাও কোথাও বড় ধরনের ফাটল দেখা দিয়েছে। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ব্রাহ্মসমাজের ট্রাস্টি বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লাইব্রেরি ভবনটি প্রায় ১০ বছর ধরে পরিত্যক্ত রয়েছে। ভবনের ভেতরে থাকা হাজার হাজার পুরনো ও দুষ্প্রাপ্য বই, জার্নাল ও পত্রপত্রিকা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সাইনবোর্ড টানিয়ে পথচারীদের উদ্দেশে প্রচার করা হয়েছে বিপজ্জনক ভবনের সর্তকবাণী। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পাটুয়াটুলীতে ঢাকা ব্রাহ্মসমাজ ফটকের পূর্ব পাশে দোতলা লাইব্রেরি ভবনটি কোনো রকম দাঁড়িয়ে আছে। ব্রাহ্মসমাজের ভানু বলেন, বিপজ্জনক ভবনটি জনবহুল এলাকায় অবস্থিত বলে যে কোনো সময় তা ধসে পড়ে লোকক্ষয় কিংবা সম্পদের ক্ষতি হতে পারে।
জানা যায়, যেকোনো সময় রাস্তার ওপর ধসে পড়তে পারে এ আশঙ্কায় রাজউক ২০০৪ সালের ১৯ এপ্রিল ভবনটিকে পুরনো, নকশাবিহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হিসেবে চিহ্নিত করে নোটিশ পাঠায়। একপর্যায়ে রাজউক কারণ দর্শানো নোটিশ ও চূড়ান্ত নোটিশ দেয়। এরপর রাজউকের অথরাইজড অফিসার-১ স্বাক্ষরিত চিঠিতে সাত দিনের মধ্যে ওই ভবন ভেঙে ফেলার তাগিদ দিয়ে বলা হয়, তা না করা হলে ইমারত বিধিমালা সংশোধনী অ্যাক্ট নম্বর-১২/১৯৮৩ এর ৩ ধারার ৭ উপধারা মোতাবেক ভবনটি ভেঙে ফেলা হবে এবং তার খরচ পাঠাগার কর্তৃপক্ষকে বহন করতে হবে। নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে সাত দিনের মধ্যে ভবনটি ভাঙা হয়নি বলে ২০০৫ সালের ২৫ মে অনুরূপ আরেকটি চিঠি দিয়ে একই কথা জানানো হয়।
এ পর্যায়ে পুরনো লাইব্রেরি ভবন এবং একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্রাহ্মসমাজ ছাড়াও পুরান ঢাকার সুধী মহল থেকে নানা তৎপরতা চালানো হয়। ২০০৫ সালে স্থাপনাটি রক্ষা এবং লাইব্রেরি চালু রাখার জন্য ব্রাহ্মসমাজের আচার্য ও ট্রাস্টি প্রাণেশ সমাদ্দার উচ্চ আদালতে একটি রিট পিটিশন (নম্বর-৩৭৭৯) দাখিল করেছিলেন। তিনি উচ্চ আদালতের কাছে লাইব্রেরি ভবনটি পুরাকীর্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করার জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংরক্ষণের আবেদন করেন। এ ছাড়া স্থানীয় বাসিন্দা রবীন ঘোষ সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একটি আবেদনপত্র দিয়ে দেশের সবচেয়ে প্রাচীন লাইব্রেরি ভবনটি রক্ষার দাবি জানান। এতে সাড়া দিয়ে মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মাধ্যমে তদন্তপূর্বক একটি প্রতিবেদন দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. শফিকুল আলম সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের বরাবরে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। সেখানে বলা হয়, পুরাকীর্তি আইনের আওতায় এ নিদর্শনটি প্রাচীন কীর্তি হিসেবে গণ্য করা যায় না। তা পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণেরও উপযোগী নয়। ওই বছরই ডিসিসি এক চিঠিতে বলে, রাজউকের করা ঢাকার ঐতিহাসিক এবং নান্দনিক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ৯৩টি স্থাপনার মধ্যে এই লাইব্রেরিটিও রয়েছে।
ব্রাহ্মসমাজের সাধারণ সম্পাদক রণবীর পাল রবি বলেন, রাজউকের পত্রবাণে আক্রান্ত হয়ে তাঁরা ওপর মহলে যোগাযোগ করেন। কিন্তু সহযোগিতা না পেয়ে সিদ্ধান্ত নেন, বিপজ্জনক ভবনটি ভেঙে সেখানে নতুন একটি লাইব্রেরি কমপ্লেঙ্ ভবন গড়ে তোলা হবে। ব্রাহ্মসমাজের ট্রাস্টি বোর্ড থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরি কমপ্লেঙ্ ভবন নামে একটি নতুন বহুতল স্থাপনা নির্মাণের জন্য একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। এরই মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাদের প্রাথমিক কাজকর্ম শুরু করে। কিন্তু এরই মধ্যে আচমকা ভবনটিকে ঐতিহাসিক ভবনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেয় রাজউকের নগর উন্নয়ন কমিটি।
ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) থেকে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জারি করা এক চিঠিতে বলা হয়, ঢাকা নগরে রাজউকের মহাপরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত ঐতিহাসিক এবং নান্দনিক তালিকায় যে ৯৩টি স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়েছে, এর মধ্যে ব্রাহ্মসমাজের আওতাধীন রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরির নাম রয়েছে। ওই বছরেরই ১৫ অক্টোবর ডিসিসির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, নগর উন্নয়ন কমিটির অনুমোদন ছাড়া তালিকাভুক্ত স্থাপনার আংশিক বা সম্পূর্ণ অপসারণ, পুনর্নির্মাণ ও পরিবর্ধন করা যাবে না। ব্রাহ্মসমাজের নেতারা জানান, নানা জটিলতার কারণে লাইব্রেরি ভবনটি তাঁদের গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে।
ব্রাহ্মসমাজের সাধারণ সম্পাদক বলেন, যেকোনো সময় ভবনটি ধসে পড়ে জানমালের ক্ষতি হতে পারে। আইনি জটিলতার কারণে ভবনটি সংস্কার করতে তাঁরা যেমন পারছেন না আবার ভবন ভেঙে সেখানে নতুন করে স্থাপনা নির্মাণ করতেও পারছেন না। শাঁখের করাতের মতো অবস্থা।
সাধারণ সম্পাদক আরো বলেন, নগর উন্নয়ন কমিটি শুধু ব্রাহ্মসমাজের লাইব্রেরি ভবন নয়, রামকৃষ্ণ মিশন পর্যন্ত সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছেন। অথচ এ তালিকা করার আগে ওই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কেউ সামান্যতম আলোচনা পর্যন্ত করেনি। গেজেট প্রকাশিত হওয়ার পর এ তালিকার কথা তাঁরা জানতে পারেন। এ ব্যাপারে ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাদের ট্রাস্টি বোর্ডের সিদ্ধান্ত এবং অর্থায়নে ব্রাহ্ম মন্দির, লাইব্রেরি ভবনসহ অন্যান্য স্থাপনা সংস্কার এবং নির্মাণ করা হয়ে থাকে। এসব স্থাপনার ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কেও তারা ওয়াকিবহাল। নগর উন্নয়ন কমিটি তাদের অজান্তে সেসব স্থাপনা পুরাকীর্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করার আইনগত অধিকার সম্পর্কেও ব্রাহ্মসমাজ প্রশ্ন তুলেছে।
এ ব্যাপারে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এবং ব্রাহ্মসমাজের ট্রাস্টি বি কে দাস বলেন, যেকোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা পুরাকীর্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করার আগে তাদের মতামত নেওয়া দরকার। কারণ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব নীতিরীতিতে চলে। প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডও পরিচালিত হয় সে রীতিনীতির ওপর নির্ভর করে।
নগর উন্নয়ন কমিটির তালিকায় স্থাপনাটির নাম অন্তর্ভুক্ত করায় বিভিন্ন মহল থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সাধারণ মানের এবং ধর্মীয় স্থাপনা ওই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে উদ্যোগটি প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে বলে নাম প্রকাশে একাধিক প্রত্নতত্ত্ববিদ কালের কণ্ঠের কাছে অভিমত প্রকাশ করেছেন। যার কারণে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে এ ধরনের বেশ কিছু স্থাপনা পুরাকীর্তির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে নতুন আরো কয়েকটি স্থাপনা অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে দেশের প্রখ্যাত পুরাতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ বলেন, 'দেশের পুরাকীর্তি নিয়ে গণপূর্ত বিভাগ কিংবা রাজউকের ভাবার কথা নয়। তারা ভাবলে দেশে প্রত্নতত্ত্ববিদ কিংবা ঐতিহাসিকরা রয়েছেন কেন?'
১৯৫১ সালে প্রকাশিত শ্রী বঙ্গবিহারি করের লেখা পূর্ববঙ্গের ব্রাহ্মসমাজের ইতিবৃত্ত বইয়ে পাঠাগারটির প্রতিষ্ঠা সাল ১৮৬৯ উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্য পাঠাগার ভবনের গায়ে উৎকীর্ণ করা আছে ১৮৭১ সাল। জানা যায়, ১৮৭১ সালে পাঠাগারটি নতুন ভবনে স্থানান্তর করার সময় রাজা রামমোহনের নামের এর নামকরণ করা হয়। স্থানান্তরের সালটিই ভবনের গায়ে লেখা আছে। ভবনের দ্বিতীয় তলায় পাঠাগারটি অবস্থিত। ১৯১০ সালে পাঠাগারটি উদ্বোধন করেন প্রথম ভারতীয় প্রিভি কাউন্সিলর এবং প্রথম আইসিএস স্যার কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্ত (স্যার কেজি গুপ্ত)।
এরই মধ্যে ভবটির পলেস্তারা খসে পড়তে শুরু করেছে। ভবনের কোথাও কোথাও বড় ধরনের ফাটল দেখা দিয়েছে। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ব্রাহ্মসমাজের ট্রাস্টি বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লাইব্রেরি ভবনটি প্রায় ১০ বছর ধরে পরিত্যক্ত রয়েছে। ভবনের ভেতরে থাকা হাজার হাজার পুরনো ও দুষ্প্রাপ্য বই, জার্নাল ও পত্রপত্রিকা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সাইনবোর্ড টানিয়ে পথচারীদের উদ্দেশে প্রচার করা হয়েছে বিপজ্জনক ভবনের সর্তকবাণী। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পাটুয়াটুলীতে ঢাকা ব্রাহ্মসমাজ ফটকের পূর্ব পাশে দোতলা লাইব্রেরি ভবনটি কোনো রকম দাঁড়িয়ে আছে। ব্রাহ্মসমাজের ভানু বলেন, বিপজ্জনক ভবনটি জনবহুল এলাকায় অবস্থিত বলে যে কোনো সময় তা ধসে পড়ে লোকক্ষয় কিংবা সম্পদের ক্ষতি হতে পারে।
জানা যায়, যেকোনো সময় রাস্তার ওপর ধসে পড়তে পারে এ আশঙ্কায় রাজউক ২০০৪ সালের ১৯ এপ্রিল ভবনটিকে পুরনো, নকশাবিহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হিসেবে চিহ্নিত করে নোটিশ পাঠায়। একপর্যায়ে রাজউক কারণ দর্শানো নোটিশ ও চূড়ান্ত নোটিশ দেয়। এরপর রাজউকের অথরাইজড অফিসার-১ স্বাক্ষরিত চিঠিতে সাত দিনের মধ্যে ওই ভবন ভেঙে ফেলার তাগিদ দিয়ে বলা হয়, তা না করা হলে ইমারত বিধিমালা সংশোধনী অ্যাক্ট নম্বর-১২/১৯৮৩ এর ৩ ধারার ৭ উপধারা মোতাবেক ভবনটি ভেঙে ফেলা হবে এবং তার খরচ পাঠাগার কর্তৃপক্ষকে বহন করতে হবে। নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে সাত দিনের মধ্যে ভবনটি ভাঙা হয়নি বলে ২০০৫ সালের ২৫ মে অনুরূপ আরেকটি চিঠি দিয়ে একই কথা জানানো হয়।
এ পর্যায়ে পুরনো লাইব্রেরি ভবন এবং একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্রাহ্মসমাজ ছাড়াও পুরান ঢাকার সুধী মহল থেকে নানা তৎপরতা চালানো হয়। ২০০৫ সালে স্থাপনাটি রক্ষা এবং লাইব্রেরি চালু রাখার জন্য ব্রাহ্মসমাজের আচার্য ও ট্রাস্টি প্রাণেশ সমাদ্দার উচ্চ আদালতে একটি রিট পিটিশন (নম্বর-৩৭৭৯) দাখিল করেছিলেন। তিনি উচ্চ আদালতের কাছে লাইব্রেরি ভবনটি পুরাকীর্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করার জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংরক্ষণের আবেদন করেন। এ ছাড়া স্থানীয় বাসিন্দা রবীন ঘোষ সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একটি আবেদনপত্র দিয়ে দেশের সবচেয়ে প্রাচীন লাইব্রেরি ভবনটি রক্ষার দাবি জানান। এতে সাড়া দিয়ে মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মাধ্যমে তদন্তপূর্বক একটি প্রতিবেদন দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. শফিকুল আলম সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের বরাবরে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। সেখানে বলা হয়, পুরাকীর্তি আইনের আওতায় এ নিদর্শনটি প্রাচীন কীর্তি হিসেবে গণ্য করা যায় না। তা পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণেরও উপযোগী নয়। ওই বছরই ডিসিসি এক চিঠিতে বলে, রাজউকের করা ঢাকার ঐতিহাসিক এবং নান্দনিক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ৯৩টি স্থাপনার মধ্যে এই লাইব্রেরিটিও রয়েছে।
ব্রাহ্মসমাজের সাধারণ সম্পাদক রণবীর পাল রবি বলেন, রাজউকের পত্রবাণে আক্রান্ত হয়ে তাঁরা ওপর মহলে যোগাযোগ করেন। কিন্তু সহযোগিতা না পেয়ে সিদ্ধান্ত নেন, বিপজ্জনক ভবনটি ভেঙে সেখানে নতুন একটি লাইব্রেরি কমপ্লেঙ্ ভবন গড়ে তোলা হবে। ব্রাহ্মসমাজের ট্রাস্টি বোর্ড থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরি কমপ্লেঙ্ ভবন নামে একটি নতুন বহুতল স্থাপনা নির্মাণের জন্য একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। এরই মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাদের প্রাথমিক কাজকর্ম শুরু করে। কিন্তু এরই মধ্যে আচমকা ভবনটিকে ঐতিহাসিক ভবনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেয় রাজউকের নগর উন্নয়ন কমিটি।
ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) থেকে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জারি করা এক চিঠিতে বলা হয়, ঢাকা নগরে রাজউকের মহাপরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত ঐতিহাসিক এবং নান্দনিক তালিকায় যে ৯৩টি স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়েছে, এর মধ্যে ব্রাহ্মসমাজের আওতাধীন রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরির নাম রয়েছে। ওই বছরেরই ১৫ অক্টোবর ডিসিসির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, নগর উন্নয়ন কমিটির অনুমোদন ছাড়া তালিকাভুক্ত স্থাপনার আংশিক বা সম্পূর্ণ অপসারণ, পুনর্নির্মাণ ও পরিবর্ধন করা যাবে না। ব্রাহ্মসমাজের নেতারা জানান, নানা জটিলতার কারণে লাইব্রেরি ভবনটি তাঁদের গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে।
ব্রাহ্মসমাজের সাধারণ সম্পাদক বলেন, যেকোনো সময় ভবনটি ধসে পড়ে জানমালের ক্ষতি হতে পারে। আইনি জটিলতার কারণে ভবনটি সংস্কার করতে তাঁরা যেমন পারছেন না আবার ভবন ভেঙে সেখানে নতুন করে স্থাপনা নির্মাণ করতেও পারছেন না। শাঁখের করাতের মতো অবস্থা।
সাধারণ সম্পাদক আরো বলেন, নগর উন্নয়ন কমিটি শুধু ব্রাহ্মসমাজের লাইব্রেরি ভবন নয়, রামকৃষ্ণ মিশন পর্যন্ত সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছেন। অথচ এ তালিকা করার আগে ওই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কেউ সামান্যতম আলোচনা পর্যন্ত করেনি। গেজেট প্রকাশিত হওয়ার পর এ তালিকার কথা তাঁরা জানতে পারেন। এ ব্যাপারে ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাদের ট্রাস্টি বোর্ডের সিদ্ধান্ত এবং অর্থায়নে ব্রাহ্ম মন্দির, লাইব্রেরি ভবনসহ অন্যান্য স্থাপনা সংস্কার এবং নির্মাণ করা হয়ে থাকে। এসব স্থাপনার ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কেও তারা ওয়াকিবহাল। নগর উন্নয়ন কমিটি তাদের অজান্তে সেসব স্থাপনা পুরাকীর্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করার আইনগত অধিকার সম্পর্কেও ব্রাহ্মসমাজ প্রশ্ন তুলেছে।
এ ব্যাপারে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এবং ব্রাহ্মসমাজের ট্রাস্টি বি কে দাস বলেন, যেকোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা পুরাকীর্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করার আগে তাদের মতামত নেওয়া দরকার। কারণ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব নীতিরীতিতে চলে। প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডও পরিচালিত হয় সে রীতিনীতির ওপর নির্ভর করে।
নগর উন্নয়ন কমিটির তালিকায় স্থাপনাটির নাম অন্তর্ভুক্ত করায় বিভিন্ন মহল থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সাধারণ মানের এবং ধর্মীয় স্থাপনা ওই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে উদ্যোগটি প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে বলে নাম প্রকাশে একাধিক প্রত্নতত্ত্ববিদ কালের কণ্ঠের কাছে অভিমত প্রকাশ করেছেন। যার কারণে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে এ ধরনের বেশ কিছু স্থাপনা পুরাকীর্তির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে নতুন আরো কয়েকটি স্থাপনা অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে দেশের প্রখ্যাত পুরাতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ বলেন, 'দেশের পুরাকীর্তি নিয়ে গণপূর্ত বিভাগ কিংবা রাজউকের ভাবার কথা নয়। তারা ভাবলে দেশে প্রত্নতত্ত্ববিদ কিংবা ঐতিহাসিকরা রয়েছেন কেন?'
১৯৫১ সালে প্রকাশিত শ্রী বঙ্গবিহারি করের লেখা পূর্ববঙ্গের ব্রাহ্মসমাজের ইতিবৃত্ত বইয়ে পাঠাগারটির প্রতিষ্ঠা সাল ১৮৬৯ উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্য পাঠাগার ভবনের গায়ে উৎকীর্ণ করা আছে ১৮৭১ সাল। জানা যায়, ১৮৭১ সালে পাঠাগারটি নতুন ভবনে স্থানান্তর করার সময় রাজা রামমোহনের নামের এর নামকরণ করা হয়। স্থানান্তরের সালটিই ভবনের গায়ে লেখা আছে। ভবনের দ্বিতীয় তলায় পাঠাগারটি অবস্থিত। ১৯১০ সালে পাঠাগারটি উদ্বোধন করেন প্রথম ভারতীয় প্রিভি কাউন্সিলর এবং প্রথম আইসিএস স্যার কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্ত (স্যার কেজি গুপ্ত)।
No comments