৫৮-র বদলা ৬১ by নোমান মোহাম্মদ,

০তম ওভারের চতুর্থ বল। সাকিব আল হাসানের ফুলটসটা সীমানাছাড়া করতে ভুল করলেন না কার্লোস ব্র্যাথওয়েট। হতাশার রেণু ছড়িয়ে পড়ল গ্যালারি থেকে প্রেসবক্স হয়ে পুরো বাংলাদেশে। ধ্যাৎ, হলো না বোধহয়!পরের বলেই ব্র্যাথওয়েট এলবিডাব্লিউ। আবার আশায় বসতি। হবে বোধহয়, হতেও পারে। নবম উইকেট উপড়ে নেওয়া গেছে, তখনো যে ২ রানের দূরত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। পারবে না বাংলাদেশ?পরল না। স্বাগতিক খেলোয়াড়-দর্শক-সমর্থকদের হতাশায় ডুবিয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পেঁৗছে যায় সফরকারীরা।


তাতে হলোটা কি জানেন? নাহ্, বাংলাদেশ হারেনি। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তো পেরিয়ে গেল ৫৮! বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কময় সংখ্যাটি ছাড়িয়ে আরো তিন রান দূরে গিয়ে থামল ক্যারিবীয় রান-রথ। তাতেই ৫৮-এর জবাব যথার্থভাবে দেওয়া হলো না বলে স্বাগতিক সবার কী হতাশা!
এরপর মাত্র ২০ ওভার খেলেই দুই উইকেট হারিয়ে জয় মুঠোবন্দি করে বাংলাদেশ। পরিসংখ্যানের বইয়ে কেবল এটিই লেখা থাকবে। অনুল্লেখ্য থাকবে, বাংলাদেশের জন্য এই জয়ের অপরিসীম গুরুত্ব এবং অসীম মাহাত্ম্য। ৫৮ রানের কলঙ্কমোচন যে হলো এই জয়ে। বিশ্বকাপের ওই ক্ষতে কিছুটা হলেও প্রলেপ পড়ল তাতে! আনন্দ-উল্লাস-স্বস্তি সব কিছুতে মিলেমিশে একাকার অমর এক ক্রিকেট-কাব্য, তাই কাল রচিত হলো চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে।
বেশির ভাগ সিরিজের একটা আবহ-সুর থাকে। মুদ্রা নিক্ষেপণের ভাগ্য পরীক্ষায় জয়-পরাজয়ের অনেকখানি নির্ধারিত হয়ে গেলে টস-ফ্যাক্টর, শিশিরের কারণে তা হলে ডিউ-ফ্যাক্টর। আবার বীরেন্দর শেবাগ যখন বাংলাদেশকে হেয় করেন, তখন ওই সিরিজের আবহসংগীত শেবাগ-ফ্যাক্টর। চলতি সিরিজের আষ্টেপৃষ্ঠে তেমনি জড়িয়ে আছে ৫৮-ফ্যাক্টর। বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ৫৮ রানে অলআউট হওয়ার দুঃস্বপ্ন যে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল বাংলাদেশকে। '৫৮' তাই বাংলাদেশের ক্রিকেটার ও সমর্থকদের কাছে শুধু আর একটি সংখ্যা হয়ে থাকেনি, এটি যে স্বপ্নের অপমৃত্যুর প্রতীকও। বিশ্বকাপ ঘিরে মনের গহিনে সাজানো ফুলের বাগানে সাপ ঢুকে পড়ার শামিল। সেই সর্পের দংশনে এত দিন নীল হয়ে ছিল বাংলাদেশ। কেউটে হয়ে এবার তারা হানল পাল্টা ছোবল! গতকালের আট উইকেটের জয়ের আনন্দ ছাপিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৬১ রানে অলআউট করার উচ্ছ্বাসটাই তাই বেশি বাংলাদেশের জন্য।
কিভাবে সম্ভব হলো তা? বোধকরি ক্রিকেট বিধাতা স্বয়ং লিখে রেখেছিলেন এমনটা। নইলে কেন টানা চুতর্থ ম্যাচে টস জিতবেন মুশফিক! না হয় জিতলেন, তার পরও কিভাবে আগের দুই ম্যাচের কাঁধ ঝুলে পড়া দলটি এমন ভোজবাজির মতো উজ্জীবিত হয়ে উঠবে! কী কারণেই বা খেলার পুরো সময় অঝোর কান্নার হুমকি দিয়েও শেষ পর্যন্ত মেঘকে কোলে পুষে রাখবে চট্টগ্রামের আকাশ! আসলে চিত্রনাট্যেই লেখা ছিল, বাংলাদেশের আলোকের ঝরনাধারায় ভেজার। সোনালি চিলের ডানায় ভর করে আনন্দলোকে ভেসে যাওয়ার। বিশ্বকাপের পর থেকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে ফেরা দুঃস্বপ্ন কবরচাপা দেওয়ার। সাহসী সুন্দর ক্রিকেটের অবিশ্বাস্য প্রদর্শনীতে মুশফিকুর রহিমের দল সবুজ গালিচার মঞ্চে ঠিক ঠিকই করে দেখিয়েছেন তা।
অথচ শুরু দেখে কিন্তু তেমন কিছু মনে হয়নি। ১০ রানে ক্যারিবিয়ানদের প্রথম উইকেট উপড়ে ফেলা গেছে ঠিক; কিন্তু সেটি সামলে ৩৩ রানে পেঁঁৗছে যায় তারা। এরপরই চকিত আক্রমণকারীর মতো ওয়েস্ট ইন্ডিজকে একেবারে তছনছ করে দেয় বাংলাদেশ। ১৫ বলের মধ্যে ৫ রান দিয়ে পাঁচ উইকেট তুলে নেয় তারা। ১ উইকেটে ৩৩ থেকে ৬ উইকেটে ৩৮ রানে পরিণত হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আচমকা তখনই যেন প্রতিশোধের নেশা ছলকে ওঠে সবার ভেতর। ৫৮-এর প্রতিশোধ!
শুরু থেকে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট পাওয়ায় এমনিতে বাংলাদেশি ফিল্ডারদের শরীরী ভাষা ছিল উদ্দীপনায় ভরপুর। ৫৮ রানের নিচে অলআউট করার জন্য তখন একেবারে মরিয়া হয়ে ওঠেন তাঁরা। ৪৮ রানে অষ্টম উইকেট পতনের পর তো আরো বেশি করে। 'যখন ৮ উইকেট পড়ে যায়, তখন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলাম, দেখি ৫৭-এর মধ্যে আটকে দেওয়া যায় কি না'_ম্যাচ শেষে বলেছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। আর ক্যারিবীয় অধিনায়কের স্মৃতিতে যে বিশ্বকাপের ছবিচিত্র ভেসে বেড়াচ্ছিল, সেটি স্বীকারে কুণ্ঠা নেই ড্যারেন সামির, 'আমরা এত দ্রুত উইকেট হারাচ্ছিলাম যে, সত্যি বলতে বিশ্বকাপের ম্যাচটির কথা তখন মনে পড়ে যাচ্ছিল।'
নাহ্, বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত ৫৮-এর মধ্যে আটকে রাখতে পারেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। সাকিব (৪/১৬), শফিউল (২/২১), নাসির (২/৩), সোহরাওয়ার্দীদের (১/২) বাধা জয় করে অলআউট হওয়ার আগে ৬১ রান তুলে ফেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২০০৪ সালে কেপটাউনে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৫৪ রানে অলআউট হওয়ার পর এটিই ওয়ানডেতে ক্যারিবীয়দের সর্বনিম্ন স্কোর। তবে বাংলাদেশের তো আর সেসবে কোনো আগ্রহ নেই। ৫৮-এর প্রতিশোধ নেওয়া গেছে, আনন্দ সেখানেই। ৪ মার্চ ২০১১ কে কফিনে মোড়ানো গেল ১৮ অক্টোবর ২০১১ সালে। সেবার বাংলাদেশ খেলেছিল ১৮.৫ ওভার, এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ তার চেয়ে ১৯ বল বেশি। সেবার স্বাগতিকদের দুজন গিয়েছিলেন দুই অঙ্কে (জুনায়েদ সিদ্দিকী ২৫ এবং মোহাম্মদ আশরাফুল ১১); এবার সফরকারীদেরও তাই (কিয়েরান পাওয়েল ২৫, কার্লোস ব্র্যাথওয়েট ১১)। সব মিলিয়ে যেন অঙ্ক মিলিয়ে প্রতিশোধ!
এরপর আর কি! সেবারের মতো এবারও তো প্রথম ইনিংসেই ম্যাচ শেষ। আনুষ্ঠানিকতাটুকু বাংলাদেশ শেষ করেছে ২০ ওভারে। মাত্র দুই উইকেট হারিয়ে জয়ের ছবিতে তুলির শেষ আঁচড় এঁকে দেন তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিমরা। সিরিজ হেরে গেলেও বুকের গহিনে জ্বলতে থাকা গনগনে আগুনটা তো নিভল তাতে। ৫৮-এর কলঙ্কের আগুন!

No comments

Powered by Blogger.