শেয়ারের দরপতন অব্যাহত, কমল নিষ্পত্তির সময়-অনশন স্থগিত
শেয়ারবাজার স্থিতিশীল করার দাবিতে বিনিয়োগকারীদের অনশন কর্মসূচি সাত দিনের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। তবে অনশন স্থগিত করলেও দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। সরকারের নানা পদক্ষেপের মধ্যেও শেয়ারবাজারের দরপতন অব্যাহত রয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বড় ধরনের দরপতনের সঙ্গে ৯ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম টাকা লেনদেন হয় ডিএসইতে। এদিকে শেয়ার লেনদেন নিষ্পত্তির সময় একদিন কমানো হয়েছে। আগে 'এ' 'বি' 'জি' ও 'এন' শ্রেণীর শেয়ার কেনার পর চতুর্থ দিন বিক্রি করা যেত। এখন তৃতীয় দিনেই বিক্রি করা যাবে।
গতকালও দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জে মূল্যসূচক কমেছে ১১৬.৪৮ পয়েন্ট। বর্তমান ডিএসইর সাধারণ মূল্যসূচক দাঁড়িয়েছে ৫৩০৭.৪৩ পয়েন্টে। গতকাল সকালে লেনদেন শুরুর পর থেকেই মূল্যসূচক কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী ছিল। দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সূচক ওঠানামার মধ্যে থাকলেও এরপর থেকেই সূচক কমতে থাকে, যা দিনের শেষ সময় পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। গতকাল ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জে (ডিএসই) ২০৯ কোটি টাকার শেয়ার কেনাবেচা হয়েছে_যা গত ৯ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে গত ২৫ জানুয়ারি ডিএসইতে ২০৬ কোটি ৪১ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছিল।
সোমবার ডিএসইতে লেনদেনের পনিমাণ ছিল ২২৭ কোটি ৮২ লাখ টাকা। সোমবার থেকে গতকাল ১৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা কম লেনদেন হয়েছে। গতকাল লেনদেন হওয়া ২৫৮টি কম্পানির মধ্যে ২৩৪টি শেয়ারের দাম কমেছে। বেড়েছে ১৮টির, আর অন্য ছয়টি কম্পানির শেয়ারের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
নিষ্পত্তির সময় হ্রাস : নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন (এসইসি) 'এ' 'বি' 'জি' ও 'এন' শ্রেণীর শেয়ার লেনদেন নিষ্পত্তির সময় চার দিনের (টি+৩) থেকে কমিয়ে তিন দিনে (টি+২) নামিয়ে এনেছে। তবে 'জেড' ক্যাটাগরির শেয়ার লেনদেনের সময়সীমা (টি+৯) অপরিবর্তিত থাকবে। গতকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত কমিশন সভায় এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এ সিদ্ধান্তের ফলে এখন থেকে শেয়ার কেনার দুই দিন পর তা বিক্রির সুযোগ পাবেন বিনিয়োগকারীরা। আগে কেনার তিন দিন পর বিক্রির সুযোগ পেতেন তাঁরা।
বৈঠক শেষে এসইসির নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ আহমেদ কমিশনের এ সিদ্ধান্তের কথা জানান। তিনি বলেন, 'বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে দুই স্টক এঙ্চেঞ্জের সুপারিশের ভিত্তিতে লেনদেন নিষ্পত্তির সময় একদিন কমানো হয়েছে। ইতিমধ্যেই বিষয়টি স্টক এঙ্চেঞ্জকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কবে থেকে নতুন সময়সীমা কার্যকর হবে_তা স্টক এঙ্চেঞ্জ নির্ধারণ করবে। নিষ্পত্তির সময় একদিন কমানোর ফলে শেয়ারবাজারের লেনদেনে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে তিনি মন্তব্য করেন।'
বর্তমান বাজারে শেয়ার বিক্রির চাপ বেশি থাকায় লেনদেন নিষ্পত্তির সময় হ্রাসের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে_এ ধরনের আশঙ্কার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ফরহাদ আহমেদ বলেন, বিষয়টি তা নয়। লেনদেন নিষ্পত্তির সময় কমানোর ফলে বিক্রির চাপ বৃদ্ধির কোনো কারণ নেই। আবার নিষ্পত্তির সময় বাড়িয়ে দিলে বিক্রির চাপ কমে যাবে_এমনটাও নয়। বরং নিষ্পত্তির সময় কমে যাওয়ায় বাজারে লেনদেনের প্রবণতা বাড়বে। দীর্ঘমেয়াদে বাজারে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এর আগে লেনদেন নিষ্পত্তির সময় কমানোর সুপারিশ করে দুই স্টক এঙ্চেঞ্জের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, নিষ্পত্তির সময়সীমা কমানো হলে গতিশীলতা বাড়বে।
এসইসির এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে চট্টগ্রাম স্টক এঙ্চেঞ্জের সভাপতি ফখর উদ্দিন আলী আহমেদ বলেন, 'আমাদের দাবির বাস্তবায়ন করল এসইসি। এর ফলে বাজারের দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে।'
অনশন স্থগিত : সাত দিনের জন্য অনশন কর্মসূচি স্থগিত করেছেন বিনিয়োগকারীরা। গতকাল পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান-উর-রশিদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অনশন স্থগিত করলেও আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব। আর সাত দিনের মধ্যে সরকার আমাদের দাবি মেনে না নিলে আরো কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।' শেয়ারবাজারে অব্যাহত দরপতনের প্রতিবাদে গত রবিবার ডিএসইর সামনে আমরণ অনশন শুরু করে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ। সোমবার পুলিশ তাঁদের তুলে দিলে বিনিয়োগকারীরা জাতীয় প্রেসক্লাবে অবস্থান নেন। পুলিশ সেখান থেকেও তাঁদের সরিয়ে দেয়।
গতকাল কর্মসূচি পালন করতে প্রথমে জাতীয় প্রেসক্লাবে যান বিনিয়োগকারীরা। সেখানে পুলিশ তাঁদের দাঁড়াতেই দেয়নি। পরে বিক্ষিপ্তভাবে শহীদ মিনারে গেলেও সেখান থেকে মিজানুর রহমান নামে এক বিনিয়োগকারীকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। অন্যদের ভয়ভীতি দেখিয়ে সরিয়ে দেয়। ফলে গতকাল কোথাও অনশন করতে পারেননি বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ বলেন, পুলিশ আমাদের কোনো জায়গায় দাঁড়াতেই দিচ্ছে না। তারপরও আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব।'
বিকেলে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান-উর-রশিদ চৌধুরী অনশন কর্মসূচি স্থগিতের ঘোষণা দেন। গতকালও মতিঝিলে ডিএসই ভবনের সামনে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও র্যাব মোতায়েন ছিল।
যত সমস্যা সেকেন্ডারি মার্কেটে : অর্থমন্ত্রী
'বাজার স্থিতিশীল করার জন্য গত দুই-তিন মাসে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর সুফলও মিলছে আইপিওর ক্ষেত্রে। প্রাইমারি মার্কেটের অবস্থা বেশ ভালো। সেখানে বিনিয়োগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। কিন্তু সেকেন্ডারি মার্কেটেই যত সমস্যা। এখানকার সমস্যা সমাধানের উপায় কী তা আমার জানা নেই।' এভাবেই শেয়ারবাজার নিয়ে নিজের অসহায়ত্ব ব্যক্ত করলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। শেয়ারবাজার চাঙ্গা করার জন্য তিনটি পৃথক প্রজ্ঞাপন দিয়ে নানাভাবে করমুক্ত সুবিধা দিয়েছে সরকার। এর এক দিন পরই গতকাল মঙ্গলবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী এ কথা বলেন। তবে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ব্যাংকগুলোর শেয়ারবাজারের মুনাফা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জমা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক চায়, বিনিয়োগকারীদের বিপদের দিনে সে অর্থ ফের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ হোক।
পুঁজিবাজার স্থিতিশীল রাখতে অর্থ মন্ত্রণালয় গত সোমবার একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করেছে। এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে অর্থমন্ত্রীকে কমিটির আহ্বায়ক বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে গতকাল অর্থমন্ত্রী বলেছেন, তিনি এ উপদেষ্টা কমিটির প্রধান নন; বরং তাঁকে পরামর্শ দিতেই এ কমিটি করা হয়েছে। মন্ত্রী বলেন, 'আমাকে পরামর্শ দেওয়ার জন্যই ওই কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যদের মধ্য থেকে একজনকে চেয়ারম্যান করা হবে। কমিটির সদস্যদের কাছ থেকে আমি আগেও অনানুষ্ঠানিকভাবে (ইনফরমাল) বুদ্ধি-পরামর্শ নিতাম। এখন আনুষ্ঠানিকভাবে (ফরমাল) পরামর্শ নেব।'
অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গত দুই বছর ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। ওই সময় তারা নির্ধারিত সীমার চেয়েও বেশি বিনিয়োগ করেছিল। কিন্তু এখন পুঁজিবাজারে তাদের বিনিয়োগ খুবই কম, এমনকি নির্ধারিত সীমার চেয়েও কম। মূলত বাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার কারণেই এমনটি হয়েছে। তবে ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজার থেকে যে অর্থ মুনাফা করেছে, তা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জমা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক চায়, বিনিয়োগকারীদের বিপদের দিনে ব্যাংকগুলো মুনাফার ওই অর্থ আবারও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করুক।
বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ ও অবস্থান ধর্মঘটে রাজনৈতিক দলের নেতাদের উপস্থিতি ভালোভাবে দেখছেন না অর্থমন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শেয়ারবাজার পরিস্থিতির রাজনৈতিকীকরণ ঠিক নয়। এতে আন্দোলনকারীদেরই ক্ষতি হবে।
সরকারের উদ্যোগ অনেক বড় এবং কার্যকর_সালমান এফ রহমান
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কম্পানিজের (বিএপিএলসি) সভাপতি সালমান এফ রহমান বলেছেন, পুঁজিবাজারে সংকটের বিষয়টি একসময় এড়িয়ে গেলেও এখন বিভিন্ন উদ্যোগ দেখে মনে হচ্ছে এ বিষয়ে সরকারের মাথাব্যথা আছে। এটা শেয়ারবাজারের জন্য ভালো দিক। তিনি বলেন, 'ডিএসই, এসইসি কিংবা এফবিসিসিআইয়ের চেয়ে সরকারের উদ্যোগ অনেক বড় এবং কার্যকর। আমরা হলাম ট্রেড বডি। আমাদের চেয়ে সরকারের উদ্যোগ মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করে। তাই এই আস্থার সংকট কেটে গেলে তারল্য সংকট কেটে যাবে।' গতকাল দুপুরে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশে (আইসিবি) সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন তিনি। সালমান এফ রহমান বলেন, 'শেয়ার বিক্রির চাপ বেশি থাকায় বাজার উঠতে পারছে না। আমরা এই বিক্রির চাপ কমানোর উপায় খুঁজছি।' তিনি বলেন, 'সূচক সামান্য বাড়লেই বিক্রির চাপ বেড়ে যায়। বিক্রির চাপের প্রধান কারণ হলো মার্জিন লোন। সেপ্টেম্বরে বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিওতে মার্জিন লোনের সুদের অঙ্কটা যোগ হয়। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। বাজার সামান্য উঠলেই তাঁরা শেয়ার বিক্রি করে লোকসানের ভার কমাতে চান। এজন্য যেসব ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী এক থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছেন তাঁদের অবস্থা ও সংখ্যা নির্ধারণ এবং তাঁদের ক্ষতির পরিমাণ বের করার চেষ্টা করছি।'
ব্যাংকগুলো যদি আমানতের ১০ শতাংশ পর্যন্ত পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে তাহলে ৬৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হতে পারে। বর্তমানে পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ বা ২২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ আছে। ফলে ব্যাংকগুলোর এখনো পুঁজিবাজারে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। তবে সেই টাকা বিনিয়োগের সক্ষমতা ব্যাংকগুলোর রয়েছে কি-না_তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, হয়তো কোনো ব্যাংকের আছে কোনো ব্যাংকের নেই।
যদি সূচক আরো পড়ে যায়। এসব কারণে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিযোগকারীরা বাজারে প্রবেশ করছে না। তাদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।
সালমান এফ রহমান বলেন, আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্যই সরকার কাজ করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে লেনদেন ফি কমানো হয়েছে। বিশেষ করে ব্রোকারেজ কমিশন কর, বিনিয়োগে কর রেয়াত সুবিধা, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের আয় কর মুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া সিডিবিএল ফি ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো হয়েছে। আস্থার সংকট দূর করার জন্য এগুলো পুঁজিবাজারের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
সোমবার ডিএসইতে লেনদেনের পনিমাণ ছিল ২২৭ কোটি ৮২ লাখ টাকা। সোমবার থেকে গতকাল ১৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা কম লেনদেন হয়েছে। গতকাল লেনদেন হওয়া ২৫৮টি কম্পানির মধ্যে ২৩৪টি শেয়ারের দাম কমেছে। বেড়েছে ১৮টির, আর অন্য ছয়টি কম্পানির শেয়ারের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
নিষ্পত্তির সময় হ্রাস : নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন (এসইসি) 'এ' 'বি' 'জি' ও 'এন' শ্রেণীর শেয়ার লেনদেন নিষ্পত্তির সময় চার দিনের (টি+৩) থেকে কমিয়ে তিন দিনে (টি+২) নামিয়ে এনেছে। তবে 'জেড' ক্যাটাগরির শেয়ার লেনদেনের সময়সীমা (টি+৯) অপরিবর্তিত থাকবে। গতকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত কমিশন সভায় এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এ সিদ্ধান্তের ফলে এখন থেকে শেয়ার কেনার দুই দিন পর তা বিক্রির সুযোগ পাবেন বিনিয়োগকারীরা। আগে কেনার তিন দিন পর বিক্রির সুযোগ পেতেন তাঁরা।
বৈঠক শেষে এসইসির নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ আহমেদ কমিশনের এ সিদ্ধান্তের কথা জানান। তিনি বলেন, 'বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে দুই স্টক এঙ্চেঞ্জের সুপারিশের ভিত্তিতে লেনদেন নিষ্পত্তির সময় একদিন কমানো হয়েছে। ইতিমধ্যেই বিষয়টি স্টক এঙ্চেঞ্জকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কবে থেকে নতুন সময়সীমা কার্যকর হবে_তা স্টক এঙ্চেঞ্জ নির্ধারণ করবে। নিষ্পত্তির সময় একদিন কমানোর ফলে শেয়ারবাজারের লেনদেনে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে তিনি মন্তব্য করেন।'
বর্তমান বাজারে শেয়ার বিক্রির চাপ বেশি থাকায় লেনদেন নিষ্পত্তির সময় হ্রাসের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে_এ ধরনের আশঙ্কার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ফরহাদ আহমেদ বলেন, বিষয়টি তা নয়। লেনদেন নিষ্পত্তির সময় কমানোর ফলে বিক্রির চাপ বৃদ্ধির কোনো কারণ নেই। আবার নিষ্পত্তির সময় বাড়িয়ে দিলে বিক্রির চাপ কমে যাবে_এমনটাও নয়। বরং নিষ্পত্তির সময় কমে যাওয়ায় বাজারে লেনদেনের প্রবণতা বাড়বে। দীর্ঘমেয়াদে বাজারে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এর আগে লেনদেন নিষ্পত্তির সময় কমানোর সুপারিশ করে দুই স্টক এঙ্চেঞ্জের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, নিষ্পত্তির সময়সীমা কমানো হলে গতিশীলতা বাড়বে।
এসইসির এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে চট্টগ্রাম স্টক এঙ্চেঞ্জের সভাপতি ফখর উদ্দিন আলী আহমেদ বলেন, 'আমাদের দাবির বাস্তবায়ন করল এসইসি। এর ফলে বাজারের দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে।'
অনশন স্থগিত : সাত দিনের জন্য অনশন কর্মসূচি স্থগিত করেছেন বিনিয়োগকারীরা। গতকাল পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান-উর-রশিদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অনশন স্থগিত করলেও আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব। আর সাত দিনের মধ্যে সরকার আমাদের দাবি মেনে না নিলে আরো কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।' শেয়ারবাজারে অব্যাহত দরপতনের প্রতিবাদে গত রবিবার ডিএসইর সামনে আমরণ অনশন শুরু করে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ। সোমবার পুলিশ তাঁদের তুলে দিলে বিনিয়োগকারীরা জাতীয় প্রেসক্লাবে অবস্থান নেন। পুলিশ সেখান থেকেও তাঁদের সরিয়ে দেয়।
গতকাল কর্মসূচি পালন করতে প্রথমে জাতীয় প্রেসক্লাবে যান বিনিয়োগকারীরা। সেখানে পুলিশ তাঁদের দাঁড়াতেই দেয়নি। পরে বিক্ষিপ্তভাবে শহীদ মিনারে গেলেও সেখান থেকে মিজানুর রহমান নামে এক বিনিয়োগকারীকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। অন্যদের ভয়ভীতি দেখিয়ে সরিয়ে দেয়। ফলে গতকাল কোথাও অনশন করতে পারেননি বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ বলেন, পুলিশ আমাদের কোনো জায়গায় দাঁড়াতেই দিচ্ছে না। তারপরও আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব।'
বিকেলে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান-উর-রশিদ চৌধুরী অনশন কর্মসূচি স্থগিতের ঘোষণা দেন। গতকালও মতিঝিলে ডিএসই ভবনের সামনে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও র্যাব মোতায়েন ছিল।
যত সমস্যা সেকেন্ডারি মার্কেটে : অর্থমন্ত্রী
'বাজার স্থিতিশীল করার জন্য গত দুই-তিন মাসে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর সুফলও মিলছে আইপিওর ক্ষেত্রে। প্রাইমারি মার্কেটের অবস্থা বেশ ভালো। সেখানে বিনিয়োগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। কিন্তু সেকেন্ডারি মার্কেটেই যত সমস্যা। এখানকার সমস্যা সমাধানের উপায় কী তা আমার জানা নেই।' এভাবেই শেয়ারবাজার নিয়ে নিজের অসহায়ত্ব ব্যক্ত করলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। শেয়ারবাজার চাঙ্গা করার জন্য তিনটি পৃথক প্রজ্ঞাপন দিয়ে নানাভাবে করমুক্ত সুবিধা দিয়েছে সরকার। এর এক দিন পরই গতকাল মঙ্গলবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী এ কথা বলেন। তবে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ব্যাংকগুলোর শেয়ারবাজারের মুনাফা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জমা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক চায়, বিনিয়োগকারীদের বিপদের দিনে সে অর্থ ফের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ হোক।
পুঁজিবাজার স্থিতিশীল রাখতে অর্থ মন্ত্রণালয় গত সোমবার একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করেছে। এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে অর্থমন্ত্রীকে কমিটির আহ্বায়ক বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে গতকাল অর্থমন্ত্রী বলেছেন, তিনি এ উপদেষ্টা কমিটির প্রধান নন; বরং তাঁকে পরামর্শ দিতেই এ কমিটি করা হয়েছে। মন্ত্রী বলেন, 'আমাকে পরামর্শ দেওয়ার জন্যই ওই কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যদের মধ্য থেকে একজনকে চেয়ারম্যান করা হবে। কমিটির সদস্যদের কাছ থেকে আমি আগেও অনানুষ্ঠানিকভাবে (ইনফরমাল) বুদ্ধি-পরামর্শ নিতাম। এখন আনুষ্ঠানিকভাবে (ফরমাল) পরামর্শ নেব।'
অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গত দুই বছর ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। ওই সময় তারা নির্ধারিত সীমার চেয়েও বেশি বিনিয়োগ করেছিল। কিন্তু এখন পুঁজিবাজারে তাদের বিনিয়োগ খুবই কম, এমনকি নির্ধারিত সীমার চেয়েও কম। মূলত বাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার কারণেই এমনটি হয়েছে। তবে ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজার থেকে যে অর্থ মুনাফা করেছে, তা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জমা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক চায়, বিনিয়োগকারীদের বিপদের দিনে ব্যাংকগুলো মুনাফার ওই অর্থ আবারও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করুক।
বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ ও অবস্থান ধর্মঘটে রাজনৈতিক দলের নেতাদের উপস্থিতি ভালোভাবে দেখছেন না অর্থমন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শেয়ারবাজার পরিস্থিতির রাজনৈতিকীকরণ ঠিক নয়। এতে আন্দোলনকারীদেরই ক্ষতি হবে।
সরকারের উদ্যোগ অনেক বড় এবং কার্যকর_সালমান এফ রহমান
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কম্পানিজের (বিএপিএলসি) সভাপতি সালমান এফ রহমান বলেছেন, পুঁজিবাজারে সংকটের বিষয়টি একসময় এড়িয়ে গেলেও এখন বিভিন্ন উদ্যোগ দেখে মনে হচ্ছে এ বিষয়ে সরকারের মাথাব্যথা আছে। এটা শেয়ারবাজারের জন্য ভালো দিক। তিনি বলেন, 'ডিএসই, এসইসি কিংবা এফবিসিসিআইয়ের চেয়ে সরকারের উদ্যোগ অনেক বড় এবং কার্যকর। আমরা হলাম ট্রেড বডি। আমাদের চেয়ে সরকারের উদ্যোগ মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করে। তাই এই আস্থার সংকট কেটে গেলে তারল্য সংকট কেটে যাবে।' গতকাল দুপুরে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশে (আইসিবি) সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন তিনি। সালমান এফ রহমান বলেন, 'শেয়ার বিক্রির চাপ বেশি থাকায় বাজার উঠতে পারছে না। আমরা এই বিক্রির চাপ কমানোর উপায় খুঁজছি।' তিনি বলেন, 'সূচক সামান্য বাড়লেই বিক্রির চাপ বেড়ে যায়। বিক্রির চাপের প্রধান কারণ হলো মার্জিন লোন। সেপ্টেম্বরে বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিওতে মার্জিন লোনের সুদের অঙ্কটা যোগ হয়। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। বাজার সামান্য উঠলেই তাঁরা শেয়ার বিক্রি করে লোকসানের ভার কমাতে চান। এজন্য যেসব ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী এক থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছেন তাঁদের অবস্থা ও সংখ্যা নির্ধারণ এবং তাঁদের ক্ষতির পরিমাণ বের করার চেষ্টা করছি।'
ব্যাংকগুলো যদি আমানতের ১০ শতাংশ পর্যন্ত পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে তাহলে ৬৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হতে পারে। বর্তমানে পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ বা ২২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ আছে। ফলে ব্যাংকগুলোর এখনো পুঁজিবাজারে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। তবে সেই টাকা বিনিয়োগের সক্ষমতা ব্যাংকগুলোর রয়েছে কি-না_তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, হয়তো কোনো ব্যাংকের আছে কোনো ব্যাংকের নেই।
যদি সূচক আরো পড়ে যায়। এসব কারণে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিযোগকারীরা বাজারে প্রবেশ করছে না। তাদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।
সালমান এফ রহমান বলেন, আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্যই সরকার কাজ করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে লেনদেন ফি কমানো হয়েছে। বিশেষ করে ব্রোকারেজ কমিশন কর, বিনিয়োগে কর রেয়াত সুবিধা, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের আয় কর মুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া সিডিবিএল ফি ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো হয়েছে। আস্থার সংকট দূর করার জন্য এগুলো পুঁজিবাজারের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
No comments