বুড়ো হাড়ের ভেলকি by রাহেনুর ইসলাম

০০ বছর বয়সে ম্যারাথন শেষ করে অনন্য রেকর্ড গড়েছেন ফৌজা সিং। কোনো পদক না পেলেও ১০০ বছর বয়সে ২৬.২ কিলোমিটার দৌড়ানোটা নিঃসন্দেহে বিশেষ কিছু। এত বেশি বয়সে না হলেও ক্রিকেট, ফুটবল, অ্যাথলেটিঙ্ বা টেনিসে ৪০, ৫০ এমনকি ৭০ বছর বয়সেও সাফল্য আছে অনেকের।ক্রিকেট : ১৮৭৭ সালের ১৫ মার্চ। ক্রিকেট ইতিহাসের অমর দিন। মেলবোর্নে এ দিনই যে পথচলা শুরু টেস্টের। প্রথম টেস্ট বলে অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের ২২ ক্রিকেটারেরই অভিষেক সেদিন। তার পরও অন্য রকম উচ্ছ্বাস ছিল জেমস সাউদার্নটনের পরিবারে।


নাতি-নাতনিরা যখন নানার ৫০তম জন্মদিন উদ্যাপনের পরিকল্পনা আঁটছেন তখনই কিনা টেস্ট অভিষেক! উচ্ছ্বাস তো হবেই।অভিষেক টেস্ট সাউদার্নটন খেলেছিলেন ৪৯ বছর ১১৯ দিন বয়সে। এত বেশি বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আঙ্গিনায় আর কেউ প্রথম পা দেননি। ক্রিকেট ইনিংসের শুরুটা দেরিতে হলেও জীবনের ইনিংসটা অবশ্য খুব বেশি লম্বা ছিল না। প্রথম টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে ১৮৮০ সালের ১৬ জুন পৃথিবীর ওপারের বাসিন্দা হয়েছেন তিনি। ৫০-এর দ্বারপ্রান্তে অভিষেক যাঁর ৫২ বছর ২১৩ দিন বয়সটা তাঁর জন্য আর এমন কী বেশি ছিল?
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের তুলনায় সেভাবে সাফল্য পাননি উইলফ্রেড রোডস। ইংলিশ এই সাবেক ব্যাটসম্যানের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে রান যেখানে ৩৯ হাজার ৯৬৯ সেখানে ৫৮ টেস্টে মাত্র ২৩২৫। খেলেছেন ১৮৯৯ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত অর্থাৎ ৩১ বছর! আর শেষ টেস্টটা খেলেছেন ৫২ বছর ১৬৫ দিন বয়সে। এত বেশি বয়সে টেস্ট খেলার রেকর্ড নেই আর কারো। কিংস্টনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেই ম্যাচটা দেখতে গিয়েছিলেন রোডসের নাতনি!
৪০ বছরের বেশি বয়সে টেস্টে সেঞ্চুরি করেছেন ১৭ জন। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪৬ বছর ৮২ দিনে সেঞ্চুরি করার কীর্তি ইংল্যান্ডের স্যার জ্যাক হবসের। ১৯২৯ সালে মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেঞ্চুরিটি পেয়েছিলেন তিনি। আর ওয়ানডেতে ২০০৯ সালে ৩৯ বছর ২১২ দিনে ভারতের বিপক্ষে সেঞ্চুরির রেকর্ড চিরসবুজ সনাৎ জয়াসুরিয়ার।
টেনিস : গ্র্যান্ড স্লামের ১৮টি একক শিরোপা জেতা মার্টিনা নাভ্রাতিলোভাকে বলা হয় টেনিসের রানি। কেউ কেউ রানির বদলে বলতে পারেন 'টেনিসের নানি'ও, কেননা ৫১ বছর বয়সেও গ্র্যান্ড স্লাম শিরোপা জিতেছেন তিনি! ৫০তম জন্মদিন পালনের এক বছর পর ২০০৬ সালের ইউএস ওপেনের মিঙ্ড ডাবলস শিরোপা জিতেছিলেন এ কিংবদন্তি। আর ১৯৯০ সালের ইউএস ওপেন একক জয়ের সময় বয়সটা ছিল ৪৪। নাভ্রাতিলোভা 'নানি' হলে টেনিসের 'নানা' বলতে হবে ইংল্যান্ডের আর্থার গোরকে। ১৯০৯ সালের উইম্বলডন একক শিরোপা জয়ের সময় তাঁর বয়স ছিল ৪১ বছর। এটা ওপেন যুগের আগের কীর্তি। ১৯৬৮-তে ওপেন যুগ শুরুর পর সবচেয়ে বেশি বয়সে পুরুষদের গ্র্যান্ড স্লাম একক জিতেছেন স্পেনের আন্দ্রেস জিমেনো। ১৯৭২-এর ফ্রেঞ্চ ওপেন জয়ের সময় তাঁর বয়স ছিল ৩৪ বছর। এ ছাড়া আন্দ্রে আগাসি ২০০৩ অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতেছেন ৩২ বছরে। ৩৩ বছর ১৩ দিন বয়সে হয়েছিলেন আবার নাম্বার ওয়ান খেলোয়াড়ও। এত বেশি বয়সে র‌্যাংকিংয়ের শীর্ষে পেঁৗছতে পারেননি আর কোনো টেনিস তারকা। শিরোপা না জিতলেও ৩৯ বছর বয়সে ১৯৯১-এর ইউএস ওপেনের সেমিফাইনালে পেঁৗছেছিলেন জিমি কনর্স। ওপেন যুগে গ্র্যান্ড স্লামে পুরুষদের এককে এত বয়সে আর কেউ এত দূর যেতে পারেননি।
২০০১ সালের ডেভিস কাপে টোগোর ৬০ ছুঁই ছুঁই গ্যাদোনফিন ইয়াকা র‌্যাকেট নিয়ে নেমেছিলেন ১৭ বছর বয়সী এক তরুণের সঙ্গে। মরিশাসের খেলোয়াড়রা ভেবেছিলেন হয়তো কোচ এসেছেন এক টিনএজ খেলোয়াড়কে সাহস দিতে। কিন্তু না, খেলার জন্যই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি! ইয়াকার টোগো হেরে গিয়েছিলেন ম্যাচটিতে। তবে ৫৯ বছর ১৪৭ দিনে অংশ নেওয়ায় ডেভিস কাপের সবচেয়ে বর্ষীয়ান খেলোয়াড়ে পরিণত হন ইয়াকা।
ফুটবল : ৪০ বছর বয়সটা ঠিক 'দাদু' হওয়ার মতো নয়। তবে ফুটবল বিশ্বকাপের মতো সর্বোচ্চ মঞ্চে খেলার মতোও নয়। অথচ ক্যামেরুন কিংবদন্তি রজার মিলা নায়ক হয়েছেন ৪০ ছুঁই ছুঁই বয়সেই। ১৯৯০ বিশ্বকাপ খেলার সময় তাঁর জীবনে পেরিয়ে গেছে ৩৮টি বসন্ত। সেই টুর্নামেন্টে করেছিলেন চার গোল। আর প্রতিটা গোলের পর কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে গিয়ে মিলার নৃত্যে উন্মাতাল হতো পুরো গ্যালারি। তাঁর নৈপুণ্যে আফ্রিকার প্রথম দেশ হিসেবে ক্যামেরুন খেলেছিল কোয়ার্টার ফাইনালে। পরের বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব থেকে ছিটকে গিয়েছিল আফ্রিকার সিংহরা। তবে মিলা বুড়ো হাড়ের ভেলকি দেখিয়েছেন ঠিকই। রাশিয়ার বিপক্ষে গোল করেছিলেন ৪২ বছর ৩৯ দিনে, যা বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি বয়সে গোলের কীর্তি। মিলার পরেই আছেন সুইডেনের গানার গ্রিন। ১৯৫৮ বিশ্বকাপে ৩৭ বছর ২৩৬ দিন বয়সে তিনি গোল করেছিলেন (তখনকার) পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে।
সবচেয়ে বেশি বয়সে বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছেন ইতালির দিনো জফ। ১৯৮২ বিশ্বকাপ ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে মাঠে নামার সময় এই গোলরক্ষকের বয়স ছিল ৪০ বছর ১৩৩ দিন।
অ্যাথলেটিঙ্, সাঁতার, শ্যুটিং : সব খেলাতেই ফিটনেস বড় একটা ব্যাপার। অ্যাথলেটিঙ্রে ট্র্যাকে সেটার গুরুত্ব আরো বেশি। অথচ ৩৫ বছর ৯২ দিনে ১৯৯৫ বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের ২০০ মিটার স্প্রিন্টে সোনা জেতেন মার্লিন ওটি। এত বেশি বয়সে আর কোনো প্রমীলা অ্যাথলেটই জিততে পারেনি বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের সোনা। ২০০০ সিডনি অলিম্পিকে ৪০ বছর বয়সে ৪ গুণিতক ১০০ মিটার রিলেরও রুপা জিতেছেন এই জ্যামাইকান। এত বেশি বয়সে অলিম্পিকের ট্র্যাকে সোনা জেতেননি আর কোনো প্রমীলা অ্যাথলেট। মারিয়ন জোন্স ডোপ কেলেঙ্কারিতে পদক হারানোয় সেবার ১০০ মিটারের ব্রোঞ্জটাও জেতেন চিরসবুজ ওটি। এত দিনে বয়স ৫০ পেরিয়েছে, তার পরও ২০১০-এর ইউরোপিয়ান অ্যাথলেটিঙ্ চ্যাম্পিয়নশিপের ৪ গুণিতক ১০০ মিটার রিলেতে অংশ নিয়েছিলেন স্লোভেনিয়ার নাগরিকত্ব নেওয়া এই অ্যাথলেট!
২০০৮ অলিম্পিকে ৪১ বছর ১২৫ দিন বয়সে অংশ নিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রমীলা সাঁতারু দারা টোরেস। সেবার অংশ নিয়েছিলেন ৫০ মিটার ফ্রি স্টাইল, ৪ গুণিতক ১০০ মিটার মিডলে রিলে ও ৪ গুণিতক ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইল রিলেতে। টোরেস রুপা জেতেন তিনটি ইভেন্টেই! অলিম্পিকে এত বেশি বয়সে মেয়েদের সাঁতারে পদক পাননি আর কেউ।
৪০ বা ৪১ বছর বয়সটা অস্কার সোয়ানের কাছে তারুণ্যের তেজোদীপ্ত মনে হয়ে থাকতে পারে, কেননা ১৯২০ অলিম্পিকে সুইডিশ এই শ্যুটার অংশ নিয়েছিলেন ৭২ বছর বয়সে! পদক নয়, অংশগ্রহণই বড় কথা_অস্কারের জন্য ব্যাপারটা মোটেও তা ছিল না। সেবার ডাবল শ্যুট রানিং ডিয়ারের রুপা জিতেছিলেন ৭২ বছরের এই তরুণ! এত বেশি বয়সে অলিম্পিকে অংশ নেওয়া ও পদক জেতার রেকর্ড নেই আর কারো। এর আগের ১৯১২ অলিম্পিকে সিঙ্গেল শ্যুট রানিং ডিয়ার টিম ইভেন্টে সোনা জিতেছিলেন ৬৪ বছর বয়সে। এত বেশি বয়সে অলিম্পিক সোনা জয়েরও কীর্তি নেই কারো। সেই অলিম্পিকে অংশ নিয়েছিলেন সিঙ্গেল শ্যুট রানিং ব্যক্তিগত ইভেন্টে। সোনা জেতা হয়নি। তবে সোনাটা হারিয়েছিলেন নিজের ছেলে আলফ্রেড সোয়ানের কাছে! হেরে গিয়েও বাবা হিসেবে তাই বুকটা গর্বে ভরে উঠেছিল অস্কারের। মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বয়সে অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার রেকর্ড লোর্না জনস্টোনের। ১৯৭২ অলিম্পিকে ইংল্যান্ডের এই ইকুয়েস্ট্রিয়ান খেলোয়াড়ের বয়স ছিল ৭০ বছর পাঁচ দিন।
বয়স ৮০ পেরিয়ে গেলে মসজিদ, চার্চ, গির্জা বা মন্দিরে সময় কাটান অনেকেই। কিন্তু ভারতের জন দেবাসির বেছে নিয়েছিলেন অ্যাথলেটিঙ্ ট্র্যাক। তাই তো ৮৫ বছর বয়সেও ২০.৪৮ সেকেন্ডে ২০০৯-এর ওয়ার্ল্ড মাস্টার্স অ্যাথলেটিঙ্ েব্রোঞ্জ জিতেছিলেন ৮০ মিটার হার্ডলসের!
গলফ : গলফকে বলা হয় বুড়োদের খেলা। সেই বুড়োদের খেলায় 'নানা'-'দাদা'দেরই ভালো করার কথা। তবে ৫০ বছরের বেশি বয়সী কেউ জিততে পারেননি মর্যাদার মাস্টার্স শিরোপা। ১৯৬৮ সালের মাস্টার্স শিরোপা ৪৮ বছর বয়সে জিতেছিলেন হুলিয়াস বোরোস। ১৯৮৬ সালে একই টুর্নামেন্টের শিরোপা জ্যাক নিকলাউস জিতেছিলেন ৪৬ বছর বয়সে। সর্বোচ্চ ১৮টি মেজর জেতা এই মার্কিনি গলফ খেলেছেন ২০০৫ পর্যন্ত। অবসর নেওয়ার সময় বয়স ছিল ৬৫ বছর। এমনি এমনি তো আর গলফকে বুড়োদের খেলা বলা হয় না!

No comments

Powered by Blogger.