শেয়ারের দরপতন চলছেই মানববন্ধন, বিক্ষোভ-অর্থমন্ত্রীর উক্তিতে 'আগুনে ঘি'

প্রথম ১০ মিনিটেই সূচক কমল ১১৬ পয়েন্ট। দুপুর ১২টা পর্যন্ত কমতে কমতে সেটি দাঁড়ায় ১৮৪ পয়েন্টে। সেখান থেকে সূচক একপর্যায়ে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও দিন শেষে ডিএসইর সাধারণ মূল্যসূচক নেতিবাচকই থাকে। তবে লেনদেন গতকাল বুধবার আগের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। এই ছিল গতকাল দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের (ডিএসই) চিত্র। একই ধারায় দরপতন ঘটেছে চট্টগ্রাম স্টক এঙ্চেঞ্জেও।কয়েক দিনের ধারাবাহিকতায় গতকাল ডিএসইর মূল্যসূচক কমেছে ৪৮ পয়েন্ট। আর দরপতনের প্রতিবাদে গতকালও রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা।


বাজার স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত লেনদেন বন্ধ রাখারও দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের নিষ্ক্রিয়তার ফলেই শেয়ারবাজার দরপতনের ধারা থেকে ফিরতে পারছে না।
'টাকা থাকার পরও মার্চেন্ট ব্যাংক ও অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কম্পানিগুলো বিনিয়োগ করছে না। যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাই বিনিয়োগ করছে না, সেখানে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা থাকবে না_সেটাই তো স্বাভাবিক।' কালের কণ্ঠকে গতকাল বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক এবং ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড. সালাউদ্দিন আহমেদ খান। তিনি বলেন, গত কয়েক দিনে বেশ কিছু ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর পরও বিনিয়োগকারীদের সাহস ফিরছে না। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগেরও পরামর্শ দেন তিনি।
বিক্ষোভ, মানববন্ধন : গতকাল দরপতনের প্রতিবাদে দুপুর সাড়া ১২টা থেকেই ডিএসই ভবনের সামনে বিক্ষোভ শুরু করেন বিনিয়োগকারীরা। সোয়া ২টার দিকে বিনিয়োগকারীরা ডিএসই ভবন থেকে মতিঝিলের শাপলা চত্বর পর্যন্ত মানববন্ধন করেন। এ সময় মতিঝিলের ইত্তেফাক মোড় থেকে শাপলা চত্বর পর্যন্ত রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আর যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় মতিঝিল এলাকার অন্য সব সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। বিকেল ৪টার দিকে এ এলাকায় যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
মানববন্ধনের পর বিকেল ৩টায় বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। বিক্ষোভ সমাবেশে বিনিয়োগকারীরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। তাঁরা শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান ও প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমানকে দায়ী করে তাঁদের বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দেন।
বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান রশিদ চৌধুরী বলেন, 'আমরা শেয়ার বাজার স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব। শিগগিরই বিনিয়োগকারীদের নিয়ে মহাসমাবেশের ডাক দেওয়া হবে।' বাজার স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত লেনদেন স্থগিতের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বৃহস্পতিবার থেকে লেনদেন বন্ধ রাখুন। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের লেনদেন না করার আহ্বানও জানান তিনি।
আগুনে ঘি দিল মন্ত্রীর উক্তি : শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে ষাটোর্ধ্ব হাজি মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন এখন প্রায় নিঃস্ব। গতকাল অন্য সব বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে তিনিও মানববন্ধন করছিলেন ডিএসই ভবনের সামনে। তিনি বলেন, 'সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী যখন বলেন শেয়ারবাজার সমস্যার সমাধান কী, তা তাঁর জানা নেই, তখন বুঝতে হবে আমরা এই সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কত অসহায়। আমাদের জন্য কেউ নেই।' ফারুক আহমেদ নামের এক বিনিয়োগকারী বলেন, 'অর্থমন্ত্রী বাজারের সমস্যা না বুঝে দায় এড়াতে পারেন না। আর সমস্যার সমাধান যদি তিনি না-ই জানেন, তাহলে পদত্যাগ করছেন না কেন?'
৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীর সমস্যার সমাধান যদি কোনো অর্থমন্ত্রী না জানেন, তাহলে আর কে জানবেন_প্রশ্ন রেখে হারুন অর রশিদ নামের অপর এক বিনিয়োগকারী বলেন, 'হয় সরকার চাচ্ছে না শেয়ারবাজার চাঙ্গা হোক, না হয় দরবেশ বাবাদের আরো মুনাফা করার সুযোগ করে দেওয়ার পথ খুঁচ্ছে।'
গত মঙ্গলবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, 'বাজার স্থিতিশীল করার জন্য গত দু-তিন মাসে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর সুফল মিলেছে আইপিওর ক্ষেত্রে। প্রাইমারি মার্কেটের অবস্থা বেশ ভালো। সেখানে বিনিয়োগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। কিন্তু সেকেন্ডারি মার্কেটেই যত সমস্যা। এখানকার সমস্যা সমাধানের উপায় কী, তা আমার জানা নেই।'
গতকাল ৪৮.৯৭ পয়েন্ট কমে ডিএসইর সাধারণ সূচক ৫২৫৮.৪৬ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। গত মঙ্গলবার ডিএসইতে ৯ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেন হলেও গতকাল লেনদেনের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। ডিএসইতে কাল আগের দিনের চেয়ে ৬৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকা বেশি লেনদেন হয়েছে। গতকাল ২৭৭ কোটি ৭১ লাখ টাকার শেয়ার হাতবদল হয়েছে। লেনদেন হওয়া ২৫৫টি কম্পানির মধ্যে ১৪২টির শেয়ারের দাম কমেছে। দাম বেড়েছে ১০০টি কম্পানির আর বাকি ১৩টি কম্পানির শেয়ারের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
এদিকে গতকাল দুপুর ১২টার দিকে ডিএসইর মূল ভবনের সাত তলায় ইন্টারনেট সংযোগ লাইনে আগুন ধরে যায়। এতে ডিএসই ভবনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নেমে আসেন। তবে বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনার আগেই নিরাপত্তাকর্মীরা তা নিভিয়ে ফেলেন।
সম্প্রতি শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকে করমুক্ত ঘোষণা করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ব্রোকারেজ হাউসগুলোর উৎসে কর ১০০ টাকায় ১০ পয়সা থেকে কমিয়ে পাঁচ পয়সা করা হয়েছে। তালিকাভুক্ত কম্পানির শেয়ার, ডিবেঞ্চার, সিকিউরিটিজ বা মিউচ্যুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের ওপর আয়কর রেয়াত দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য সোমবার উচ্চ পর্যায়ের একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে। মঙ্গলবার পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কম্পানিগুলোর শেয়ার লেনদেন নিষ্পত্তির (সেটেলমেন্ট) সময় কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন (এসইসি)। তবে এর পরও দরপতনের ধারা থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না শেয়ারবাজার।

No comments

Powered by Blogger.