৩৮ লাখ বছর আগের মাথার খুলিই কি মানুষের পূর্বপুরুষ?
ইথিওপিয়ায় গবেষকরা প্রায় ৩৮ লাখ
বছর আগের একটি মাথার খুলি খুঁজে পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এটি প্রথম
দিকের মানুষের মতো দেখতে এপ প্রজাতির পূর্বজ।
নতুন এই নমুনাটির বিশ্লেষণ, এপ প্রজাতির বানর থেকে মানুষে রূপান্তরিত হওয়ার বিবর্তন প্রক্রিয়ার ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে।
নতুন
মতবাদ বলছে, লুসি নামে এপ প্রজাতির বানর থেকে প্রথম মানুষের উৎপত্তি
হওয়ার যে মতবাদ প্রচলিত আছে তা আবার বিবেচনা করার অবকাশ আছে।
ন্যাচার জার্নালে এই আবিষ্কারটি সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
ইথিওপিয়ার আফার রাজ্যের মিল্লা জেলার মিরো দোরা এলাকায় মাথার খুলিটি খুঁজে পান অধ্যাপক ইয়োহানেস হাইলি সেলাইসি।
যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইয়োর ক্লিভল্যান্ড মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল
হিস্ট্রি-এর সাথে যুক্ত এই বিজ্ঞানী বলেছেন, তিনি সাথে সাথেই জীবাশ্মটির
গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন।
"আমি নিজেই নিজেকে বলি, আমি যা দেখছি সেটি
কি আসলেই সত্যি? তারপর হঠাৎই আমি লাফিয়ে উঠি এবং বুঝতে পারি যে, এটিই আমার
সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল," তিনি বিবিসি নিউজকে বলেন।
অধ্যাপক হাইলি
সেলাইসি বলেন, মানুষের পূর্বপুরুষ হিসেবে পরিচিত এপ প্রজাতির এ পর্যন্ত
পাওয়া নমুনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে এটি।
ওই
প্রজাতিটির বৈজ্ঞানিক নাম অস্ট্রালোপিথিকুস আনামেনসিস- সবচেয়ে পুরনো
অস্ট্রালোপিথিসিন যা প্রায় ৪২ লাখ বছর আগে পৃথিবীতে বাস করতো।
ধারণা করা হয় যে, এ. আনামেনসিস ছিল আরো উন্নত প্রজাতি যা অস্ট্রালোপিথিকুস আফারেনসিস নামে পরিচিত তার সরাসরি বংশধর।
এই উন্নত প্রজাতিটি প্রাথমিক মানুষের প্রথম জেনাস বা বর্গ বা দল যা হোমো নামে পরিচিত ছিল, তাদের পূর্বজ।
আবিষ্কার হওয়া মাথার খুলি তৈরি করেছেন এক শিল্পী। আনামেনসিস দেখতে কেমন ছিলো তিনি সেটি তৈরির চেষ্টা করেছেন। |
বর্তমানে বেঁচে থাকা মানুষের বর্গকেও হোমো বলা হয়।
১৯৭৪ সালে আবিষ্কার হওয়া প্রথম আফারেনসিস কংকাল নিয়ে বেশ আলোড়ন তৈরি হয়েছিলো। তার নাম দেয়া হয়েছিলো লুসি।
বিটলসের
বিখ্যাত গান 'লুসি ইন দ্য স্কাই উইথ ডায়মন্ডস' খননের সাইটে বাজার সময়
কংকালটি আবিষ্কার করা হয়েছিলো বলে সেটির এমন নাম দিয়েছিলেন গবেষকরা।
'প্রথম এপটি হেটেছিলো,' লুসিকে এভাবে বর্ণনা করার পর তা পুরো পৃথিবীর মনোযোগ কেড়েছিল।
লন্ডনের
ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের সাথে জড়িত অধ্যাপক ফ্রেড স্পুর ন্যাচার
জার্নালে একটি মন্তব্যে লিখেছেন, "দেখে মনে হচ্ছে, মানুষের বির্বতনের আরেক
আইকন হতে যাচ্ছে এই আনামেনসিস।"
এটি এতো গুরুত্ব পাওয়ার কারণ হচ্ছে,
আমরা বলতে পারি যে, আনামেনসিস এবং আফারেনসিস প্রায় সমসাময়িক ছিল। আগের
ধারণা অনুযায়ী, পূর্বেরটি সরাসরি একটি সরল প্রক্রিয়ায় বিবর্তিত হয়ে
পরেরটিতে পরিণত হয়নি।
নতুন এই ধারণাটি সামনে আসে আগের বিবর্তনের ধারণাটির পুনর্ব্যাখ্যা থেকে।
নতুন জীবাশ্মটিতে আগে আবিষ্কার হওয়া ৩৯ লাখ বছর পুরনো মাথার খুলির অবশিষ্টাংশের কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
ওই অবশিষ্টাংশকে আনামেনসিস নামে ধরা হয়েছিলো।
কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি আসলে আফারেনসিসের দেহাবশেষের অংশ। তার মানে হচ্ছে, এই প্রজাতির ইতিহাস আরো গভীর।
বর্তমানে ধারণা করা হচ্ছে যে, দুটি প্রজাতিই একসাথে বেঁচেছিলো প্রায় এক লক্ষ বছর ধরে।
যা
ধারণা করা হচ্ছে তা হল-আনামেনসিসের ছোট একটি দল অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে
পড়ে এবং সময়ের সাথে সাথে স্থানীয় পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে এগুলো
বিবর্তিত হয়ে আফারেনসিসে পরিণত হয়।
আনামেনসিস নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই দুই প্রজাতি কিছু সময়ের জন্য হলে একই সময়ে বেঁচেছিলো।
নতুন
এই তথ্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ তাহলে এটি ধারণা দেয় যে, এপ প্রজাতির সাথে
অন্য আরো উন্নত প্রজাতিরও আসলে সমসাময়িক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আর এর ফলে প্রথম মানুষ হওয়ার বিবর্তনের অনেক গুলো উপায় আমাদের সামনে চলে আসে।
সংক্ষেপে
বলতে গেলে, যদিও এই ধারণা লুসি থেকে মানুষের হোমো বর্গের সৃষ্টি হওয়ার
মতবাদকে বাতিল করে দেয় না, কিন্তু এটি এই ধারণার সাথে আরো কয়েকটি
প্রজাতির নাম সংশ্লিষ্ট করেছে।
অধ্যাপক হাইলি সেলিইসি একমত প্রকাশ করেন যে, কোন প্রজাতি মানুষের পূর্ব-পুরুষ তা নিয়ে 'সব ধরণের পণ এখন বন্ধ' হয়ে গেলো।
তিনি
বর্ণনা করেন: "দীর্ঘ সময় ধরে, মানুষের পূর্ব পুরুষ হিসেবে আফারেনসিসের
নাম আসতো সবার আগে, কিন্তু আসলে আগের সেই অবস্থানে নেই আমরা। এখন আমাদেরকে
ওই সময়ে বেঁচে থাকা সব প্রজাতিকেই বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে যে আসলে প্রথম
মানুষের সাথে কোনটির সবচেয়ে বেশি মিল ছিল।"
নতুন পাওয়া মাথার খুলির বিভিন্ন দিক থেকে তোলা ছবি। |
'মিসিং লিংক' এই শব্দ দুটিকে যখন নৃবিজ্ঞানীরা কারো কাছ থেকে বিশেষ করে
সাংবাদিকদের কাছে থেকে শোনেন, তখন তারা অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়েন।
কারণ, তারা এটি এমন একটি জীবাশ্মকে ব্যাখ্যা করতে এই শব্দ ব্যবহার করছে যা অর্ধেক এপ এবং অর্ধেক মানুষ।
ন্যাচার
জার্নালের জ্যেষ্ঠ সম্পাদক ড. হেনরি গি- আমার "কলিজা বের করে পেঁয়াজ,
বরলটি বিন আর এক গ্লাস ক্লারেটের সাথে খেয়ে ফেলার" হুমকি দিয়েছিল। সেসময়
পুরনো একটি আবিষ্কার নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করছিলাম আমি।
অবশ্য
হেনরির খেপে যাওয়ার অনেক কারণও ছিল। যার মধ্যে অন্যতম ছিল, মানব বিবর্তন
চক্রের অনেক সূত্র রয়েছে এবং এগুলোর মধ্যে বেশিরভাগেরই এখনো কোন সন্ধান
মেলেনি।
আনামেনসিস হচ্ছে সম্প্রতি আবিষ্কার হওয়া সূত্রগুলোর মধ্যে
সবচেয়ে নতুন যা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, আধুনিক মানুষের বিবর্তন ব্যাখ্যা করার
আসলে সরল কোন রেখা নেই।
সত্য এর চেয়েও আরো অনেক জটিল এবং মজার। এটি
বিবর্তনের এমন গল্প বলে, যা বিভিন্ন পরিবেশে মানুষের পূর্বপুরুষের বিভিন্ন
"প্রোটোটাইপ" নিয়ে "পরীক্ষা করে"।
আর এটা ততক্ষণ পর্যন্ত চলতে থাকে
যতক্ষণ পর্যন্ত না কোন প্রজাতি যা জলবায়ু পরিবর্তন, বাসস্থান এবং খাদ্য
সংকটের চাপ উপেক্ষা করে টিকে থেকে শেষ পর্যন্ত মানুষে রূপান্তরিত হওয়ার
পক্ষে শক্ত কোন বৈশিষ্ট্য সামনে তুলে ধরতে না পারে।
অধ্যাপক হাইলি
সেলাইসি মানব বিবর্তন নিয়ে কাজ করা গুটি কয়েক আফ্রিকান বিজ্ঞানীদের মধ্যে
একজন। এখন তিনি বেশ পরিচিতি পেলেও এই অধ্যাপক স্বীকার করেছেন যে, যোগ্য
আফ্রিকান গবেষকদের জন্য পশ্চিমা ভিত্তিক অর্থায়নকারী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে
গবেষণার তহবিল পাওয়া বেশ দুঃসাধ্য।
"আমাদের উদ্ভবের সাথে জড়িত
বেশিরভাগ জীবাশ্মই আফ্রিকায় পাওয়া যায়। আর আমার মনে হয়, আফ্রিকানরা
তাদের নিজেদের মহাদেশে থাকা এসব সম্পদ ব্যবহারে সক্ষমতা পাওয়া উচিত যাতে
নৃ-বিজ্ঞানের মৌল ও জীবাশ্ম বিষয়ক শাখা পালায়েও-অ্যানথ্রপলজিতে তারা
তাদের ক্যারিয়ার এগিয়ে নিতে পারে। এ খাতে তাদের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা
হল অর্থায়ন," তিনি বলেন।
প্রথম মানুষের পূর্বজ লুসি নামে পরিচিত এপের দেহাবশেষ |
No comments