শ্রদ্ধেয় মমতাজ স্যার by আমীরুল ইসলাম
আমাদের
অতি প্রিয় এক ব্যক্তি মমতাজ স্যার। আমাদের প্রিয় শিক্ষক। প্রিয়
ব্যক্তিত্ব। প্রিয় নাট্যজন। মমতাজ স্যারের কোনো বিকল্প নাই। এক ও অদ্বিতীয়
তিনি। হাস্যরস ও কৌতুক স্নিগ্ধতা তার বৈশিষ্ট্য। আজীবন অধ্যাপনা করেছেন।
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক তার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্রদের জন্য তিনি নিবেদিত প্রাণ। মমতাজ স্যার মহান নটরাজ। নাট্য অন্ত জীবন। মঞ্চ, টেলিভিশন, রেডিও-সবখানে মহাপ্রতাপশালী অভিনেতা, নাট্যকার, পরিচালক। নাটকের বাইরে চলচ্চিত্রের কাহিনিকার। চিত্র নাট্যকার। কত পরিচয় দেব মমতাজ স্যারের? তিনি নাট্যকার। লেখক-প্রাবন্ধিক। তিনি হাস্যরস-লেখক। রম্য রচনাকার বলা হয় শাদা বাংলার।
রাজা অনুস্বারের পালা তার মহত নাটক। হাস্য লাস্য ভাষ্য, জমিদার দর্পণ, দুইবোন-এসব মঞ্চ নাটক। সাত ঘাটের কানাকড়ি তার মঞ্চ জনপ্রিয়তার শীর্ষ অবস্থানের নাটক। স্বৈরাচার বিরোধী এমন হাস্যরসাত্মক নাটক বাংলা নাট্যসাহিত্যেই বিরল। স্যারের সাহিত্যিক রচনার পরিমাণও ছিল। সারা জীবন কর্মময় ব্যক্তিত্ব তিনি। কাজ ছাড়া তিনি এক মুহূর্ত উদ্যাপন করেন নি। শিক্ষকতায় তিনি উৎসর্গীকৃত প্রাণ। কোনো দিন ক্লাস ফাঁকি দেন নি। বাংলাদেশ টেলিভিশনে তিনি শত শত সফল নাটক লিখেছেন। আশি নব্বই দশকে এ সপ্তাহের নাটক বলতে আমরা বুঝতাম মমতাজ উদদীন আহমদের নাটক। আর ছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশিদ, সেলিম আলদীন। এদের পরেই হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন। মমতাজ স্যার অসাধারণ বাগ্মী।
বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলা সাহিত্য এসব তার প্রিয় বিষয়। বাংলা একাডেমি, মহিলা, সমিতি, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, শিল্পকলা একাডেমি-স্যার যেখানেই বক্তৃতা দিতেন আমি, মাযহার ছুটে যেতাম। আর আসতেন আসলাম সানী। আমরা স্যারের বক্তৃতার অন্ধভক্ত ছিলাম। খুব নাটকীয় বক্তৃতা অভিনয় এবং সুচারু বাক্যবন্ধে মূল বিষয়কে তুলে ধরতেন। তৎসম শব্দবহুল বাক্য তিনি অনায়াসে বক্তৃতায় ব্যবহার করেন। কিন্তু সেটা কঠিন বা বিসদৃশ মনে হয় না। মনে আছে ৯৪ সালে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে মমতাজ স্যার বিকালে এক বক্তৃতা দিলেন। ৩২ নম্বর সড়কে মঞ্চ ও প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে। থই থই করছে বঙ্গবন্ধু ভক্তবৃন্দ। সেদিন ১৫ই আগস্ট। আমি শাহ আলম সারওয়ার, বিখ্যাত ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ, আহমাদ মাযহার, খায়রুল আলম সবুজ, শিরীন বকুল প্রমুখ স্যারের বক্তৃতা শুনব বলে পেছনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। স্যার বক্তৃতা দিয়ে আমাদের প্রত্যেককে কাঁদিয়ে দিলেন। স্যার শেষে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু, হে মহান বঙ্গবন্ধু, আমার বন্ধু তোমার বন্ধু-বঙ্গবন্ধু-আমরা জানি তুমি বেহেশতের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। বাঙালিদের নিয়ে আপনি বেহেশতে প্রবেশ করবেন। একজন বাঙালির স্বার্থ ক্ষুণœ হবে এমন কোনো কাজ জ্ঞানত আপনি করবেন না। আপনার জাতিকে আপনি এতটাই ভালোবাসেন।
পরে সারওয়ার ভাই আমাদের কফি খাইয়েছিলেন। ঝর্ণা ভাবিও ছিলেন। মমতাজ স্যার সেই কফি আড্ডায় বলেছিলেন, বক্তৃতা দেয়া এক ধরনের টেকনিক। অনেক প্র্যাকটিস করতে হয় ভালো বক্তৃতা দেয়ার জন্য। স্যার আপনি শিক্ষক হিসেবেও সফল। রুমেও কি বক্তৃতা দেন?
সব সময় নয় কখনো কখনো কোনো স্পেশাল ক্লাসে হয়তো বক্তৃতা দেই।
স্যারের শিক্ষক সত্ত্বাও অনেক বড়। স্যার সারাজীবন পাজামা পাঞ্জাবি পরেছেন শিক্ষকতার কারণেই। ১৯৫৮ সালে বাংলা বিভাগ থেকে হরগঙ্গা কলেজে তার কর্মজীবন শুরু হয়। এই কলেজের অধ্যক্ষ তখন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের পিতা আবীমউদ্দিন আহমদ। স্যার দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে ও শেষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে অবসর নেন। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি তার ছাত্র। ছাত্রদের তিনি প্রাণাধিক ভালোবাসেন। অনেক মেধাবী ছাত্রের বেতনও পরীক্ষা ফি নিজ পকেট দিয়ে দিতেন। মনে আছে সদ্য প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক আশির দশকে মাত্র পোশাক ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছেন। মমতাজ স্যারকে তিনি অসম্ভব সম্মান করতেন। স্যার কিছু চাইলে আনিসুল হক তার সামর্থ্যরে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে সেটা সমাধান করতে চেষ্টা করতেন। ছাত্র, সাধারণ মানুষ, নাট্যাঙ্গনের অভাবগ্রস্ত শিল্পীদের অনেক সাহায্য সহযোগিতা করতেন। মমতাজ স্যার। পেছনে নীরবে সহায়তা করতেন আনিসুল হক।
মমতাজ স্যার অসাধারণ চরিত্র অভিনেতা। জাত অভিনয় শিল্পী। মঞ্চে, টেলিভিশনে এবং রেডিও সবখানেই দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। প্রচন্ড জনপ্রিয় এক নাট্যব্যক্তিত্ব তিনি। সেই ১৯৭৬ সালে তিনি নাট্যসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। জনপ্রিয়তাকে স্যার মজা লুটেছেন। স্যার আসলে হতে চেয়েছেন শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ, লেখক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার। মমতাজ স্যার যা চেয়েছেন তাই পেয়েছেন এক জীবনে। বয়স আশি পেরিয়ে গেছেন। কিন্তু তরুণের চেয়েও তরুণ হৃদয় তার। অসম্ভব কমুনিকেটি ও রাখেন। যখন কথা বলবেন মনে হবে তিনি যেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কোনো তরুণ।
একদা দীর্ঘদিন স্যারের স্নেহভাজন ছিলাম। স্যার আমাকে আর মাযহারকে শিশুপাঠ্য প্রাইমার লেখার পদ্ধতি শিখিয়েছিলেন। একডেমিক পদ্ধতি, কবি আসলাম সানী স্যারের মতোই আরেক রসিক ব্যক্তি। সানী ভাই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যেকোনো আড্ডায় সব সময় বলতেন, ঐ যে আমাদের সফোক্লিস স্যার আইতাছে। সক্রেটিস স্যার উপরে। পাঠচক্র চালাইতাছে। সফোক্লিস নাট্যকার। তাই মমতাজ স্যার। সায়ীদ স্যার দার্শনিক ও চিন্তাবিদ ব্যক্তি। তাই তার নাম সক্রেটিস।
১৯৮৮ সালে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল ঢাকা শহরে। ঢাকাও জলে ডুবে গিয়েছিল। মমতাজ স্যার ও সায়ীদ স্যার খুব কাতর হয়ে গেলেন বন্যা দুর্গতদের জন্য। মমতাজ স্যার নিজেরাই টাকা বরাদ্দ করলেন। আমি, আহমাদ মাযহার ও আসলাম সানী সবাই মিলে নৌকা ভাড়া করে সাহায্য সামগ্রী নিয়ে গেলাম কেরানীগঞ্জে। প্রায় তিন চার ঘণ্টা মমতাজ স্যার, সায়ীদ স্যার, আবেদ খান, সানজীদা আক্তার ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করলেন। তীব্র রোদ, ভ্যাপসা গরম। ঘামে মমতাজ স্যারের কপাল চিকচিক করছে। কিন্তু মানুষের প্রতি দরদের শেষ নেই। আমাদের প্রিয় শিক্ষকদের দেখেছি মানুষকে তারা অনেক ভালোবেসেছেন। মমতাজ স্যার, সায়ীদ স্যার তাদের কোনো বিকল্প নেই। একবার মাযহার আর আমি মমতাজ স্যারকে নিয়ে ফরিদপুরে আলতাফ ভাইয়ের ওখানে গেলাম। পরদিনই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পুরস্কার বিতরণ আছে।
সারা পথ স্যার আমাদের নানা বিষয় নিয়ে কথা বলে হাসালেন। লিখে সেসব প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কারণ বাচনভঙ্গি, অভিনয় এবং বক্তব্য এমনভাবে মিশে থাকে যে তার বিশদ বর্ণনা লিখিতরূপে সম্ভব নয়। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একই স্টাইলে সৈয়দ আলী আহসানের বক্তৃতা স্যার এমনভাবে উপস্থাপন করতেন যে হাসতে হাসতে আমরা পাগল হয়ে যেতাম। স্যার আমাদের হাসাতেন। নিজে কিন্তু গম্ভীর। হাসতেন না। স্যার কথার পিঠে দ্রুত জবাব দেন। অপরপক্ষকে ধরাশায়ী করতে এক সেকেন্ডও সময় লাগে না স্যারের। স্যার খুব ভোজন রসিক। কম খাবেন। কিন্তু ভালো ও সুস্বাদু খাবার খাবেন।
শোনপাপড়ি, চানাচুর, ভালো বিস্কুট, আম, সন্দেশ এসব স্যারের খুব প্রিয়। মাছ-ভাত এবং কাচ্চি বিরিয়ানি।
আরেকটি বিষয় স্যার ৫০ বছর ধরে প্রতি সকালে পাকা পেঁপে খান। সুদূর নিউ ইয়র্ক গেছেন। নাটকের সেমিনারে থাকবেন ৩০ দিন। লাগেজে পনেরটা পেঁপে নিয়ে স্যার রওয়ানা দিলেন। ছোট মেয়ে তাহিতিতে স্যার প্রাণাধিক ভালোবাসেন। ইডেনের উল্টো দিকে আজিমপুর কলোনীতে স্যার দীর্ঘদিন ছিলেন। আমরা কত গেছি সেই বাসায়। অনেক সন্ধ্যা কাটিয়েছি আজিমপুর মাঠে বসে। স্যার গরমে খালি গায়ে গামছা পেঁচিয়ে গল্প শুনিয়েছেন। স্যার খুব শৌখিন মানুষ। নিজে সারাজীবন বানানো পাঞ্জাবি পরেছেন। অভিনব সব ডিজাইনের কাপড়। স্যার দামি জিনিস ব্যবহার করতেন। দামি কলমে ফুলস্কেপ কাগজে লেখেন। দামি পারফিউম ও ওডিকোলন। স্যার ভাবিকে খুব ভালোবাসেন। ভয়ও পান। নানা বক্তৃতায় স্যার শুরুতে ভাবির যেকোনো একটা গল্প শুনিয়ে দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। স্যারের ছায়াসঙ্গী আমাদের প্রিয় ভাবি।
স্যার বই কিনতে ও পড়তে খুব ভালোবাসেন। স্যারের সংগ্রহে প্রচুর বই। স্যার ইদানীংকালে মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিন আমেরিকায় ছেলেমেয়েদের কাছে থাকবেন। কিন্তু আবার চিরচেনা ঢাকা শহরে ফিরে এসেছেন। বাংলাদেশ ছাড়া কোথাও থাকবেন না মমতাজ স্যার। স্যার চিরজীবী ব্যক্তি। ভালো থাকবেন সব সময়।
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক তার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্রদের জন্য তিনি নিবেদিত প্রাণ। মমতাজ স্যার মহান নটরাজ। নাট্য অন্ত জীবন। মঞ্চ, টেলিভিশন, রেডিও-সবখানে মহাপ্রতাপশালী অভিনেতা, নাট্যকার, পরিচালক। নাটকের বাইরে চলচ্চিত্রের কাহিনিকার। চিত্র নাট্যকার। কত পরিচয় দেব মমতাজ স্যারের? তিনি নাট্যকার। লেখক-প্রাবন্ধিক। তিনি হাস্যরস-লেখক। রম্য রচনাকার বলা হয় শাদা বাংলার।
রাজা অনুস্বারের পালা তার মহত নাটক। হাস্য লাস্য ভাষ্য, জমিদার দর্পণ, দুইবোন-এসব মঞ্চ নাটক। সাত ঘাটের কানাকড়ি তার মঞ্চ জনপ্রিয়তার শীর্ষ অবস্থানের নাটক। স্বৈরাচার বিরোধী এমন হাস্যরসাত্মক নাটক বাংলা নাট্যসাহিত্যেই বিরল। স্যারের সাহিত্যিক রচনার পরিমাণও ছিল। সারা জীবন কর্মময় ব্যক্তিত্ব তিনি। কাজ ছাড়া তিনি এক মুহূর্ত উদ্যাপন করেন নি। শিক্ষকতায় তিনি উৎসর্গীকৃত প্রাণ। কোনো দিন ক্লাস ফাঁকি দেন নি। বাংলাদেশ টেলিভিশনে তিনি শত শত সফল নাটক লিখেছেন। আশি নব্বই দশকে এ সপ্তাহের নাটক বলতে আমরা বুঝতাম মমতাজ উদদীন আহমদের নাটক। আর ছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশিদ, সেলিম আলদীন। এদের পরেই হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন। মমতাজ স্যার অসাধারণ বাগ্মী।
বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলা সাহিত্য এসব তার প্রিয় বিষয়। বাংলা একাডেমি, মহিলা, সমিতি, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, শিল্পকলা একাডেমি-স্যার যেখানেই বক্তৃতা দিতেন আমি, মাযহার ছুটে যেতাম। আর আসতেন আসলাম সানী। আমরা স্যারের বক্তৃতার অন্ধভক্ত ছিলাম। খুব নাটকীয় বক্তৃতা অভিনয় এবং সুচারু বাক্যবন্ধে মূল বিষয়কে তুলে ধরতেন। তৎসম শব্দবহুল বাক্য তিনি অনায়াসে বক্তৃতায় ব্যবহার করেন। কিন্তু সেটা কঠিন বা বিসদৃশ মনে হয় না। মনে আছে ৯৪ সালে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে মমতাজ স্যার বিকালে এক বক্তৃতা দিলেন। ৩২ নম্বর সড়কে মঞ্চ ও প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে। থই থই করছে বঙ্গবন্ধু ভক্তবৃন্দ। সেদিন ১৫ই আগস্ট। আমি শাহ আলম সারওয়ার, বিখ্যাত ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ, আহমাদ মাযহার, খায়রুল আলম সবুজ, শিরীন বকুল প্রমুখ স্যারের বক্তৃতা শুনব বলে পেছনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। স্যার বক্তৃতা দিয়ে আমাদের প্রত্যেককে কাঁদিয়ে দিলেন। স্যার শেষে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু, হে মহান বঙ্গবন্ধু, আমার বন্ধু তোমার বন্ধু-বঙ্গবন্ধু-আমরা জানি তুমি বেহেশতের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। বাঙালিদের নিয়ে আপনি বেহেশতে প্রবেশ করবেন। একজন বাঙালির স্বার্থ ক্ষুণœ হবে এমন কোনো কাজ জ্ঞানত আপনি করবেন না। আপনার জাতিকে আপনি এতটাই ভালোবাসেন।
পরে সারওয়ার ভাই আমাদের কফি খাইয়েছিলেন। ঝর্ণা ভাবিও ছিলেন। মমতাজ স্যার সেই কফি আড্ডায় বলেছিলেন, বক্তৃতা দেয়া এক ধরনের টেকনিক। অনেক প্র্যাকটিস করতে হয় ভালো বক্তৃতা দেয়ার জন্য। স্যার আপনি শিক্ষক হিসেবেও সফল। রুমেও কি বক্তৃতা দেন?
সব সময় নয় কখনো কখনো কোনো স্পেশাল ক্লাসে হয়তো বক্তৃতা দেই।
স্যারের শিক্ষক সত্ত্বাও অনেক বড়। স্যার সারাজীবন পাজামা পাঞ্জাবি পরেছেন শিক্ষকতার কারণেই। ১৯৫৮ সালে বাংলা বিভাগ থেকে হরগঙ্গা কলেজে তার কর্মজীবন শুরু হয়। এই কলেজের অধ্যক্ষ তখন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের পিতা আবীমউদ্দিন আহমদ। স্যার দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে ও শেষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে অবসর নেন। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি তার ছাত্র। ছাত্রদের তিনি প্রাণাধিক ভালোবাসেন। অনেক মেধাবী ছাত্রের বেতনও পরীক্ষা ফি নিজ পকেট দিয়ে দিতেন। মনে আছে সদ্য প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক আশির দশকে মাত্র পোশাক ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছেন। মমতাজ স্যারকে তিনি অসম্ভব সম্মান করতেন। স্যার কিছু চাইলে আনিসুল হক তার সামর্থ্যরে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে সেটা সমাধান করতে চেষ্টা করতেন। ছাত্র, সাধারণ মানুষ, নাট্যাঙ্গনের অভাবগ্রস্ত শিল্পীদের অনেক সাহায্য সহযোগিতা করতেন। মমতাজ স্যার। পেছনে নীরবে সহায়তা করতেন আনিসুল হক।
মমতাজ স্যার অসাধারণ চরিত্র অভিনেতা। জাত অভিনয় শিল্পী। মঞ্চে, টেলিভিশনে এবং রেডিও সবখানেই দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। প্রচন্ড জনপ্রিয় এক নাট্যব্যক্তিত্ব তিনি। সেই ১৯৭৬ সালে তিনি নাট্যসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। জনপ্রিয়তাকে স্যার মজা লুটেছেন। স্যার আসলে হতে চেয়েছেন শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ, লেখক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার। মমতাজ স্যার যা চেয়েছেন তাই পেয়েছেন এক জীবনে। বয়স আশি পেরিয়ে গেছেন। কিন্তু তরুণের চেয়েও তরুণ হৃদয় তার। অসম্ভব কমুনিকেটি ও রাখেন। যখন কথা বলবেন মনে হবে তিনি যেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কোনো তরুণ।
একদা দীর্ঘদিন স্যারের স্নেহভাজন ছিলাম। স্যার আমাকে আর মাযহারকে শিশুপাঠ্য প্রাইমার লেখার পদ্ধতি শিখিয়েছিলেন। একডেমিক পদ্ধতি, কবি আসলাম সানী স্যারের মতোই আরেক রসিক ব্যক্তি। সানী ভাই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যেকোনো আড্ডায় সব সময় বলতেন, ঐ যে আমাদের সফোক্লিস স্যার আইতাছে। সক্রেটিস স্যার উপরে। পাঠচক্র চালাইতাছে। সফোক্লিস নাট্যকার। তাই মমতাজ স্যার। সায়ীদ স্যার দার্শনিক ও চিন্তাবিদ ব্যক্তি। তাই তার নাম সক্রেটিস।
১৯৮৮ সালে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল ঢাকা শহরে। ঢাকাও জলে ডুবে গিয়েছিল। মমতাজ স্যার ও সায়ীদ স্যার খুব কাতর হয়ে গেলেন বন্যা দুর্গতদের জন্য। মমতাজ স্যার নিজেরাই টাকা বরাদ্দ করলেন। আমি, আহমাদ মাযহার ও আসলাম সানী সবাই মিলে নৌকা ভাড়া করে সাহায্য সামগ্রী নিয়ে গেলাম কেরানীগঞ্জে। প্রায় তিন চার ঘণ্টা মমতাজ স্যার, সায়ীদ স্যার, আবেদ খান, সানজীদা আক্তার ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করলেন। তীব্র রোদ, ভ্যাপসা গরম। ঘামে মমতাজ স্যারের কপাল চিকচিক করছে। কিন্তু মানুষের প্রতি দরদের শেষ নেই। আমাদের প্রিয় শিক্ষকদের দেখেছি মানুষকে তারা অনেক ভালোবেসেছেন। মমতাজ স্যার, সায়ীদ স্যার তাদের কোনো বিকল্প নেই। একবার মাযহার আর আমি মমতাজ স্যারকে নিয়ে ফরিদপুরে আলতাফ ভাইয়ের ওখানে গেলাম। পরদিনই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পুরস্কার বিতরণ আছে।
সারা পথ স্যার আমাদের নানা বিষয় নিয়ে কথা বলে হাসালেন। লিখে সেসব প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কারণ বাচনভঙ্গি, অভিনয় এবং বক্তব্য এমনভাবে মিশে থাকে যে তার বিশদ বর্ণনা লিখিতরূপে সম্ভব নয়। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একই স্টাইলে সৈয়দ আলী আহসানের বক্তৃতা স্যার এমনভাবে উপস্থাপন করতেন যে হাসতে হাসতে আমরা পাগল হয়ে যেতাম। স্যার আমাদের হাসাতেন। নিজে কিন্তু গম্ভীর। হাসতেন না। স্যার কথার পিঠে দ্রুত জবাব দেন। অপরপক্ষকে ধরাশায়ী করতে এক সেকেন্ডও সময় লাগে না স্যারের। স্যার খুব ভোজন রসিক। কম খাবেন। কিন্তু ভালো ও সুস্বাদু খাবার খাবেন।
শোনপাপড়ি, চানাচুর, ভালো বিস্কুট, আম, সন্দেশ এসব স্যারের খুব প্রিয়। মাছ-ভাত এবং কাচ্চি বিরিয়ানি।
আরেকটি বিষয় স্যার ৫০ বছর ধরে প্রতি সকালে পাকা পেঁপে খান। সুদূর নিউ ইয়র্ক গেছেন। নাটকের সেমিনারে থাকবেন ৩০ দিন। লাগেজে পনেরটা পেঁপে নিয়ে স্যার রওয়ানা দিলেন। ছোট মেয়ে তাহিতিতে স্যার প্রাণাধিক ভালোবাসেন। ইডেনের উল্টো দিকে আজিমপুর কলোনীতে স্যার দীর্ঘদিন ছিলেন। আমরা কত গেছি সেই বাসায়। অনেক সন্ধ্যা কাটিয়েছি আজিমপুর মাঠে বসে। স্যার গরমে খালি গায়ে গামছা পেঁচিয়ে গল্প শুনিয়েছেন। স্যার খুব শৌখিন মানুষ। নিজে সারাজীবন বানানো পাঞ্জাবি পরেছেন। অভিনব সব ডিজাইনের কাপড়। স্যার দামি জিনিস ব্যবহার করতেন। দামি কলমে ফুলস্কেপ কাগজে লেখেন। দামি পারফিউম ও ওডিকোলন। স্যার ভাবিকে খুব ভালোবাসেন। ভয়ও পান। নানা বক্তৃতায় স্যার শুরুতে ভাবির যেকোনো একটা গল্প শুনিয়ে দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। স্যারের ছায়াসঙ্গী আমাদের প্রিয় ভাবি।
স্যার বই কিনতে ও পড়তে খুব ভালোবাসেন। স্যারের সংগ্রহে প্রচুর বই। স্যার ইদানীংকালে মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিন আমেরিকায় ছেলেমেয়েদের কাছে থাকবেন। কিন্তু আবার চিরচেনা ঢাকা শহরে ফিরে এসেছেন। বাংলাদেশ ছাড়া কোথাও থাকবেন না মমতাজ স্যার। স্যার চিরজীবী ব্যক্তি। ভালো থাকবেন সব সময়।
No comments