জাতিসংঘে যে প্রশ্নে বাংলাদেশের ব্যর্থতা দেখছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ
চেপে
ধরা মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগের জবাব দিতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। ১৪ই মে
জাতিসংঘের ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ (ইউপিআর)-এ বাংলাদেশি প্রতিনিধিরা
এমন ব্যর্থতার পরিচয় দেন। গতকাল এক প্রতিবেদনে এসব কথা লিখেছে আন্তর্জাতিক
মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। জেনেভা থেকে প্রকাশিত ওই
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ইউপিআর-এ প্রতিনিধিত্ব করেন
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। সরকার যেসব ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে তিনি শুধু
সেগুলোকে সেখানে জোর গলায় তুলে ধরেন। কিন্তু জোরপূর্বক গুম, গোপন ও
খেয়ালখুশি মতো আটক রাখা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও
সভা-সমাবেশ করার স্বাধীনতার ওপর দমন-পীড়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো
নিয়ে যে উদ্বেগ রয়েছে তা তিনি এড়িয়ে গেছেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ লিখেছে,
অন্য দেশগুলো থেকে যেসব সুপারিশ দেয়া হয়েছে মানবাধিকার রক্ষায় তা
পূর্ণাঙ্গভাবে বিবেচনা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বাংলাদেশ- এটা প্রদর্শন বা
প্রমাণ করা উচিত তাদের। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মানদণ্ড মেনে
চলার ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নতি হওয়া উচিত। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক
পরিচালক ব্রাড এডামস বলেন, বাংলাদেশে নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী
জোরপূর্বক গুম, হত্যা, নির্যাতন, খেয়ালখুশি মতো গ্রেপ্তারের মতো গুরুতর
যেসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে সে বিষয়ে দৃষ্টি দিতে শুরু করা উচিত।
একই সঙ্গে এ ক্ষেত্রে যে অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হচ্ছে তা বন্ধ করা উচিত
বাংলাদেশের। এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের বেশির ভাগই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
ব্রাড এডামস আরো বলেছেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ইউনিভার্সাল
পিরিয়ডিক রিভিউকে নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা উচিত
বাংলাদেশ সরকারের। নিজেদেরকে নিজেদেরই অভিনন্দিত করার জন্য এটা ব্যবহার করা
উচিত নয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরো লিখেছে, এই পরিষদের সদস্য দেশের মধ্যে
অনেকেই স্বেচ্ছায় নির্যাতিত কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ার জন্য সীমান্ত
খুলে দেয়া ও তাদেরকে সহায়তা দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করেছে।
ক্রমবর্ধমান রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কীভাবে মোকাবিলা বা দেখাশোনা করা হচ্ছে
তা নিয়ে দীর্ঘ বক্তব্য রেখেছেন বাংলাদেশি প্রতিনিধি। কিন্তু যখন অনেক দেশ
বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, জোরপূর্বক গুম, মানবাধিকারের পক্ষের
লোকজনের ওপর হামলার বিষয়ে উদ্বেগ নিয়ে প্রশ্ন ও সুপারিশ উত্থাপন করে, তখন
বাংলাদেশি ওই প্রতিনিধি ছিলেন নীরব এবং এসব প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছেন। বিভিন্ন
দেশ এসব নিয়ে যেসব সুপারিশ করেছে তা বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেছে
না কি প্রত্যাখ্যান করেছে তা কিছু দিনের মধ্যেই জানা যাবে না। হিউম্যান
রাইটস ওয়াচ লিখেছে, বাংলাদেশে মানবাধিকার নিয়ে অনেক বছর ধরে উদ্বেগ প্রকাশ
করছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অন্যান্য মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপ। এ ছাড়া আরো
অনেক বিষয়ে উদ্বেগ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ শুনানিতে যথেষ্টভাব সাড়া দেয়নি
সে বিষয়ে। এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দেয়া যাক। এর আগে ২০১৩ সালে ইউপিআরের
অধিবেশন হয়। তখন সব রকম মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিশেষ করে নিরাপত্তা
রক্ষাকারীদের হাতে যেসব মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে তার পূর্ণাঙ্গ ও পক্ষপাতহীন
তদন্ত ও বিচার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু তখন থেকেই
তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি অবজ্ঞা ও প্রত্যাখ্যান করে আসছে। এর মধ্যে
রয়েছে ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনের সময় নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের সহিংসতা।
যারা নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে তাদের বিরুদ্ধে তারা
ব্যবস্থা নিয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে
বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশি প্রতিনিধিরা। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় আস্থা বা
স্বচ্ছতা নেই বললেই চলে। বিরোধী অনেক রাজনীতিককে জোরপূর্বক গুম করা হয়েছে
অথবা অভিযোগ ছাড়াই গোপনে আটকে রাখা হয়েছে, এমন অনেক ঘটনা প্রামাণ্য আকারে
তুলে ধরেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির বহু
নেতাকর্মীকে বেআইনিভাবে আটক রাখা হয়েছে। তাদের অনেকেই এখনো নিখোঁজ।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ লিখেছে, ২০১৬ সালের আগস্টে নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা তুলে
নিয়ে যায় জামায়াতে ইসলামীর দুই নেতার ছেলেদের। তারা কোথায় আছে অথবা তাদের
অবস্থা কি এ বিষয়ে আর জানা যায়নি। সাবেক একজন কূটনীতিক মারুফ জামান ২০১৭
সালের ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। ঢাকায় হলি আর্টিজান বেকারিতে ২০১৬
সালের ১লা জুলাই সন্ত্রাসী হামলা হয়। তারপর থেকে কোনো অভিযোগ ছাড়াই
নিরাপত্তা হেফাজতে রয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বৃটিশ নাগরিক হাসনাত করিম।
সমালোচনাকারী মিডিয়া ও বেসরকারি সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে হামলা নিয়ে ইউপিআরে
প্রশ্ন তোলা হয়। তাতেও বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল উপযুক্ত জবাব দেননি। তথ্য ও
যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার অধীনে অনেক মানুষকে জেল ও অভিযোগ গঠন করা
হয়েছে অথবা অব্যাহত আছে। এ ধারায় মুক্ত মত প্রকাশকে ব্যাপকভাবে টার্গেট
করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৬ সালের এই আইনকে বেসরকারি গ্রুপগুলোতে বিদেশি
অর্থায়নকে নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হচ্ছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরো লিখেছে,
৫৭ ধারার অধীনে নাগরিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট
করতে ব্যবহার করা হচ্ছে। সরকার বলছে, তারা ৫৭ ধারাকে খসড়া ডিজিটাল
নিরাপত্তা আইনে রিভাইজ করবে। কিন্তু এরও অনেক ধারা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড
থেকে অনেকটাই দূরে। মুক্ত মত প্রকাশকে টার্গেট করতে সরকার রাষ্ট্রদ্রোহ ও
অন্যান্য ফৌজদারি আইনের ব্যবহার করছে। ইউপিআরের শুনানিতে শ্রমিকদের
অধিকারের বিষয়েও যথেষ্ট তথ্য দেয়া হয়নি। যদিও শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে
নিরাপত্তায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু বেশির ভাগই রয়ে গেছে বাকির খাতায়।
ইউনিয়ন নেতারা বা যারা ইউনিয়নে যোগ দিতে চাইছেন তাদেরকে হুমকির মুখে পড়তে
হচ্ছে। অথবা কারখানা মালিক ও ম্যানেজারদের বিরোধিতার মুখে পড়তে হচ্ছে।
বাল্য বা শিশুদের বিয়ে বন্ধ করার ক্ষেত্রে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা রক্ষা
করতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকার একটি আইন
অনুমোদন করে। তাতে একটি ব্যতিক্রম রাখা হয়। বলা হয়, বিশেষ অবস্থার
প্রেক্ষিতে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েকে বিয়ে দেয়া যাবে। তবে, বিয়ের ন্যূনতম
বয়স নির্ধারণ করা হয়নি। জাতীয় ভিত্তিতে বাল্যবিয়ে বন্ধের যে প্রতিশ্রুতি বা
পরিকল্পনা ছিল তা তিন বছর আগের কথা। ব্রাড এডামস বলেছেন, রোহিঙ্গা
শরণার্থীদের অধিকারের জন্য বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু যখন নিজ দেশের
নাগরিকদের প্রসঙ্গ আসে তখন তাদের ক্ষেত্রেও একই নীতি গ্রহণ করা উচিত।
বছরের শেষের দিকে জাতীয় নির্বাচন। তাই গণতান্ত্রিক জায়গা (ডেমোক্রেটিক
স্পেস) করে দেয়া আবশ্যক সরকারের, যেখানে বিতর্ক চলতে পারে।
ভিন্নমতাবলম্বীরা কথা বলতে পারেন।
No comments