বই থেকে বইয়ের মেলা by হাসান ফেরদৌস

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডাকঘর নাটকের শেষে রাজবৈদ্যকে সুধা অনুরোধ করে, অমলের কানে কানে যেন একটা কথা সে বলে দেয়৷ কী কথা, জানতে চায় রাজবৈদ্য৷ সুধা জানায়, বলবে যে সুধা ওকে ভোলেনি৷ অমল ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ সুধা অমলের জন্য ফুল নিয়ে এসেছিল তাকে নিজ হাতে দেবে বলে৷ ফুল দেওয়া হয় না, অমল হয়তো আর কখনোই জাগবে না৷ তা সত্ত্বেও ঠিক কেন সুধার মুখ দিয়ে অমলের কাছে ওই কথাগুলো বলা এত জরুরি মনে করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ? এ প্রশ্নের উত্তর রবীন্দ্রনাথ জানিয়ে যাননি, কোথাও এ নিয়ে কিছু লিখেছেন বলেও জানি না৷ কিন্তু নাটকটি পড়ার পর প্রশ্নটি আমাকে তাড়িত করেছে৷ মনে মনে তার একটি ব্যাখ্যাও আমি করে নিয়েছি৷ আমি জানি, মৃত্যুতেই জীবনের সমাপ্তি—এ কথা রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন না৷ বস্তুত, যে চক্রাবর্তে জীবন প্রবহমান, মৃত্যু তার একটি অধ্যায় মাত্র, এ কথায় তাঁর বিশ্বাস ছিল৷ মানুষ বেঁচে থাকে, সে অমৃতস্য পুত্রা, কিন্তু তা এ কারণে নয় যে, কোথাও না–কোথাও সে দেহ ধারণ করে থাকে৷ মানুষ বেঁচে থাকে আমাদের স্মৃতিতে, যে স্মৃতিকে আমরা স্থানান্তর করি গ্রন্থে, যার মাধ্যমে মানুষ—তার স্মৃতি—স্থায়ী হয় অনন্তকাল৷

আমি বই পড়ি অনন্তের সেই স্মৃতিকে ধারণ করার জন্য৷ গতকালের, আজকের ও আগামীকালের—প্রতিটি মানব-অস্তিত্বের সঙ্গে আমার রয়েছে আত্মার বন্ধন৷ আর এই সত্যটা আমাকে শেখায় বই৷ আমি দীর্ঘকাল পরবাসে, জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান বছর কাটিয়েছি নিজ বাসভূমি থেকে দূরে৷ অথচ কখনো সে বাসভূমি ও আমার মধ্যে যে কোনো দূরত্ব জন্মায়নি, তার এক বড় কারণ বই৷ মুদ্রিত অক্ষরের ভেতর আমি কেবল নিজের দেশকে নয়, সে দেশের মানুষ, তাদের স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের সঙ্গে পরিচিত হই৷ শুধু বই ও মুদ্রিত অক্ষরের কারণে স্থানগত অর্থে সব দূরত্ব অনায়াসে ঘুচে যায়, তারা আমরা হয়ে যায়, সে হয় আমি৷ এমন আশ্চর্য ক্ষমতা বইয়ের৷ আমি যখন খুব একা হই, বইতে আশ্রয় পাই, ফলে আর একা থাকি না৷ এবং শুধু বইয়ের কারণে জনারণ্যেও একা হওয়ার সুযোগ পাই, কারণ নিঃশব্দ কথোপকথনের বাহন হয়ে আসে বই৷ মনের মধ্যে নানা ভাবনা জন্মে, সেসব যাচাইয়ের সুযোগ পাই গ্রন্থে৷ নিজের ভুল ভাঙে বই পড়ে, নিজের উদ্ভট ভাবনা সম্পূর্ণ উদ্ভট নয়, এই অভয়ও পাই বইয়ে৷
বই থেকে বইমেলা৷ আমি জানি, ঢাকায় বা বাংলাদেশের অধিকাংশ শহরে বছরজুড়েই বইয়ের মেলা বসে৷ এতে না আছে নতুনত্ব, না আছে অভিনবত্ব৷ কিন্তু প্রবাসে, যেখানে আমরা বাস করি শেওলার মতো, সাংস্কৃতিক পরগাছা হয়ে, সেখানে?
অবিশ্বাস্য মনে হবে, একটানা ২৩ বছর ধরে এই নিউইয়র্ক শহরে বাংলা বইমেলা হয়ে আসছে৷ এই মেলার সঙ্গে মুক্তধারা নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত৷ প্রায় আড়াই দশক আগে, ব্রুকলিনের এক স্কুলের হলঘরে প্রথম এই মেলার আয়োজন করা হয়৷ বিশ্বজিৎ সাহার উদ্যোগে৷ বিশ্বজিৎ পেশায় সাংবাদিক, আদি মুক্তধারার কর্ণধার চিত্তরঞ্জন সাহার নিকট আত্মীয়, ফলে রক্তে বইয়ের নেশা তার বংশগত৷ শুনেছি, ১৯৭২ সালে চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে চাদর বিছিয়ে নিজেই প্রথম বইয়ের মেলা বসিয়েছিলেন৷ আমি সে দৃশ্য দেখিনি, কিন্তু বিশ্বজিৎকে দেখেছি ফেরিওয়ালার মতো কাঁধে বই নিয়ে ঘুরতে৷ মেলার সূত্রে জমেছে কবিতা ও গানের আসর, সাহিত্যের আড্ডা৷ প্রথমে ছিল মোটে ঘণ্টা তিনেকের মেলা৷ এখন ২৩ বছর পর সেই মেলাই চলে তিন দিন ধরে৷
ঢাকা ও কলকাতার সেরা লেখক ও শিল্পীরা যোগ দেওয়ায় এই মেলা শুধু যে সমৃদ্ধ হয়েছে তা-ই নয়, তা পরিণত হয়েছে সব বাঙালির এক বর্ণাঢ্য মিলনমেলায়৷ ঢাকা বা কলকাতায় যঁারা আকাশের চাঁদ, তাঁদের অনেকেই এখানে অভিবাসী বাঙালির আলিঙ্গনে উষ্ণ হয়েছেন৷ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় প্রতিবছর মেলায় যোগ দিতেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়৷ ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেনা-অচেনা পাঠক-বন্ধুর সঙ্গে গল্প জুড়েছেন, অটোগ্রাফ দিয়েছেন৷ আরও এসেছেন সৈয়দ শামসুল হক, ড. আনিসুজ্জামান, হাসান আজিজুল হক, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, রফিক আজাদ, গোলাম মুরশিদ, নির্মলেন্দু গুণ, জয় গোস্বামী, আনিসুল হক৷
এ বছর বইমেলা উপলক্ষে ঢাকা থেকে আসছেন মহাদেব সাহা, বার্লিন থেকে দাউদ হায়দার ও কলকাতা থেকে সমরেশ মজুমদার৷ এর বাইরে উত্তর আমেরিকার বাঙালি কবি-লেখকেরা তো থাকছেনই৷ আরও থাকবেন বেঙ্গলি হার্লেম গ্রন্থের লেখক ভিভেক বাল্ড৷ থাকছে রবীন্দ্রনাথের ‘স্ত্রীর পত্র’ অবলম্বনে রচিত ইংরেজি নাটক মৃণালস লেটার এবং রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্তোরিয়া ওকাম্পোকে নিয়ে লেখা নাটক দ্বিতীয় বিজয়া৷ রবীন্দ্রনাথের গান শোনাতে ঢাকা থেকে আসবেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, স্থানীয় শিল্পীরা শোনাবেন পঞ্চকবির গান৷ প্রথমবারের মতো আয়োজিত হচ্ছে র্যাফল ড্র, যার প্রথম পুরস্কার রবীন্দ্রনাথের রচনাবলি৷
মোটে তিন দিন—বস্তুত তিন নয়, আড়াই দিনের মেলা৷ সেই আড়াই দিনের জন্য অপেক্ষায় থাকি সারা বছর৷ এই কদিন আমাদের চোখের সামনে এই শহর বদলে গিয়ে হয়ে পড়বে ফেলা আসা একফালি ঢাকা৷ চারদিকে অপরিচিত জনস্রোত, স্বল্প পরিচিত-অপরিচিত ভাষার কোলাহল ছাপিয়ে কেবলই শোনা যাবে প্রিয় বাংলা৷ শোনা যাবে রবিঠাকুরের গান৷ কানে ভেসে আসবে শহীদ কাদরীর কবিতা৷ বুকের মধ্যে বাজবে ঢাকের সেই চেনা গুড়গুড় শব্দ৷
আপনাদের প্রতিও রইল নিউইয়র্কের বইমেলায় আসার আমন্ত্রণ৷
নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷

No comments

Powered by Blogger.