হায় হাতিরঝিল! by শামীমা চৌধুরী

সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়তেই ভ্রমণপিপাসু মানুষ, প্রেমিক-প্রেমিকার পদচারণায় মুখর হওয়া হাতিরঝিল! সন্ধ্যা নামতেই নিয়ন আলোর ঝলকানিতে পানিতে সৃষ্ট অপরূপ নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলীর হাতিরঝিল! জ্যোৎস্না রাতে চাঁদের আলোয় ঝিলিক দেয়া হাতিরঝিল- আজ অনেকটাই ম্রিয়মাণ। ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি উদ্বোধন হয় এই দৃষ্টিনন্দন হাতিরঝিলের। ঢাকার এই আধুনিক নয়নাভিরাম স্থাপত্যকলা সুনাম কুড়িয়েছিল দেশে-বিদেশে। কিন্তু মাত্র কিছুদিনের ব্যবধানে এটি হারাতে বসেছে তার আকর্ষণ। এমনকি হাতিরঝিলের লেকের পানির বর্জ্য-দুর্গন্ধ এখন জনস্বাস্থ্যের জন্য রীতিমতো হুমকি। সীমাহীন অবহেলা আর নির্মাণের সময় বর্জ্য অপসারণের ত্র“টি থাকায় ধানমন্ডি, কলাবাগান, পান্থপথ, তেজগাঁও, রামপুরা, মগবাজার, গুলশান, পশ্চিম বাড্ডার বর্জ্য মিশ্রিত পানি আটকে স্থায়ী জলাবদ্ধতা হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশংকা প্রকাশ করেছেন।

বেশিদিনের কথা নয়, মাত্র ১০ বছর আগেও হাতিরঝিল ছিল ঢাকা শহরের প্রধান বর্জ্য নির্গমনের পথ। এটি ছিল উন্মুক্ত। আর এ কারণে পরিবেশবিদরা এটিকে ঢাকার প্রধান উন্মুক্ত বেসিন বলতেন। ধানমন্ডি থেকে রামপুরা পর্যন্ত স্যুয়ারেজ লাইনের মাধ্যমে প্রতিদিন পাঁচ লাখ ঘন লিটার সলিড বর্জ্য হাতিরঝিলে নির্গত হতো। রামপুরা ব্রিজের নিচ দিয়ে তা চলে যেত বালু নদী হয়ে শীতলক্ষ্যায়। গত ক’বছরে ঢাকা ও এর আশপাশে বন্যা না হওয়ায় হাতিরঝিলের বর্জ্য অপসারণ প্রক্রিয়ায় ত্র“টির ভয়াবহ প্রভাব দেখতে পায়নি ধানমন্ডি, গুলশান, তেজগাঁও, মগবাজার, রামপুরা ও আশপাশের বাসিন্দারা। এখন দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়তেই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে মানুষ এর জ্বালা। পাশাপাশি ময়লা জমে থাকায় সেগুলো পচে দুর্গন্ধময় করে তুলেছে ঝিলের চারপাশের এলাকাকে। নির্মাণ পরিকল্পনা অনুযায়ী চেক বাল্বগুলো বর্ষা মৌসুমের শেষে বন্ধ করে দেয়ার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। ফলে আগামী আরও বেশ কিছুদিন এলাকার মানুষকে বায়ুদূষণের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সহ্য করতে হবে। তা ছাড়াও ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের জন্য নতুন করে জমি অধিগ্রহণ ও বিপুল অংকের টাকার সংস্থানও এ মুহূর্তে সম্ভব কি-না, বিষয়টিও ভাবিয়ে তুলেছে সংশ্লিষ্টদের। সব পেলেও তা স্থাপনে সময় যাবে কয়েক বছর।
বিশাল উন্মুক্ত ও খালি জায়গা হওয়ায় এখানে কয়েক যুগ ধরে ভাসমান মানুষ গড়ে তুলেছিল তাদের আবাস। ঝিলের ওপরে বাঁশ আর কাঠ দিয়ে গড়ে তুলেছিল ভাসমান বস্তি। সরকার একবার এখানে স্টেডিয়াম তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল। পরে হাতিরঝিল লেক নির্মাণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। ২০০৭ সালে ৩০২ একর জমির ওপর এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১ হাজার ৯৭১ দশমিক ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্প সম্পন্ন করার কথা থাকলেও প্রকল্প বাস্তবায়নের বাজেট ও সময় বৃদ্ধি করা হয় কয়েক দফা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিল রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৬ ইঞ্জিনিয়ারিং কন্সট্রাকশন ব্যাটালিয়ন, ঢাকা ওয়াসা ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর। স্ট্রর্ম স্যুয়ারেজ লাইনের নকশা ও পরিকল্পনা করে স্পেশাল স্যুয়ারেজ ডাইভারশন স্ট্রাকচার (এসএসডিএস) এবং প্রকল্পের সার্বিক নকশা প্রণয়ন করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)।
নকশা ও পরিকল্পনার ত্র“টির কারণে কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের হাতিরঝিল এখন বহু সংকটে নিমজ্জিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, বন্যা বা অতি বৃষ্টি হলেই হাতিরঝিলের ড্রেনেজ সিস্টেম অকেজো হয়ে পড়বে। একই সঙ্গে বন্যা, বৃষ্টি ও স্যুয়ারেজের বিপুল পানি অপসারণ করতে পারবে না এ প্রকল্প। তখনই প্রতিটি এলাকার ম্যানহোল ও স্যুয়ারেজের মুখ খুলে উপচে পড়বে মানববর্জ্য। আবাসিক টয়লেটের কমোড ও পাম্পগুলোও জ্যাম হয়ে যেতে পারে পানির ঊর্ধ্বমুখী চাপে। এ বিপর্যয় ঠেকাতে এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও ঢাকা ওয়াসাসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরগুলো। তাৎক্ষণিকভাবে রামপুরা ব্রিজের পশ্চিম প্রান্তে পাম্প লাগিয়ে বর্জ্য নিষ্কাশনের পাইলট প্রজেক্ট নেয়া হলেও এর স্থায়ী সমাধানের জন্য তারা বুয়েট ও নগর পরিকল্পনাবিদের দ্বারস্থ হয়েছে। তবে বিপত্তি দেখা দিয়েছে ওয়েস্ট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন নিয়ে। এই প্লান্ট স্থাপনের জন্য প্রয়োজন আরও কমপক্ষে ১১০ একর জমি এবং প্রাথমিকভাবে ১৫০০ কোটি টাকা। ওয়াসা এরই মধ্যে জমি অধিগ্রহণের জন্য গৃহায়ন ও পূর্ত মন্ত্রণালয় এবং টাকার ডোনার খোঁজার জন্য ইকোনমিক রিলেশন্স ডিভিশনের (ইআরডি) মাধ্যমে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। ওয়াসা জানিয়েছে, বনশ্রীর পূর্ব প্রান্তে দাশেরকান্দি এলাকায় এ ট্রিটমেন্ট প্রকল্প নেয়া হবে। সেখান থেকেই হাতিরঝিলের পানি শোধন করা হবে ।
হাতিরঝিল বাঁচানোর পরিকল্পনা নিয়ে আর কালক্ষেপণ নয়। এ মুহূর্তেই পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে, বাঁচাতে হবে ঢাকার জনস্বাস্থ্য আর সৌন্দর্যকে।
শামীমা চৌধুরী : গণমাধ্যম কর্মী
shamima.c2013@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.