ঝাঁঝালো গ্যাসে বিশ্বকাপের বিবর্ণ সূচনা
দুনিয়াজুড়ে যখন সাম্বার তালে তাল মেলানোর
অপেক্ষা, ঠিক তখনই ব্রাজিলের সাও পাওলোতে ঘটে গেছে এক অঘটন। পুলিশের ছোড়া
ঝাঁঝালো গ্যাসে অনেকটাই বিবর্ণ হয়ে গেল বিশ্বকাপের জৌলুস। বিশ্বকাপ আয়োজনের
বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভে কাঁদানে গ্যাস ছুড়েছে পুলিশ। এ সময় সাও
পাওলোতে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যে এরিনা করিন্থিয়াস স্টেডিয়ামে
বিশ্বকাপের উদ্বোধন হয় তার কাছেই এমন অবস্থায় সৃষ্টি হয় এক ভীতিকর
পরিস্থিতি। কাঁদানে গ্যাসে রাস্তা অন্ধকার হয়ে যায়। সিএনএন-এর এক
সাংবাদিককে দেখা যায়, আহত হয়েও সরাসরি সংবাদ দিচ্ছেন। ওই শহরে সমবেত বিদেশী
দর্শক, পর্যটকদের মধ্যে এ সময় ছড়িয়ে পড়ে ভীতি। বিশ্বকাপ উদ্বোধন ও
উদ্বোধনী ম্যাচের আগে এমন পরিস্থিতিতে এবারের বিশ্বকাপের গায়ে লাগলো এক
কলঙ্ক।
এরিনা করিন্থিয়াস স্টেডিয়ামেই গত রাতে স্বাগতিক ব্রাজিল ও ক্রোয়েশিয়ার মধ্যে হয় উদ্বোধনী ম্যাচ। কিন্তু তার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই বিশ্বকাপের প্রতিবাদে ওই স্টেডিয়ামের কাছে বিক্ষোভ করে বেশ কিছু মানুষ। তারা এ সময় বিশ্বকাপ বিরোধী স্লোগান দেয়। তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে একজনকে। ভেঙে গেছে এক সাংবাদিকের পা। তবে বিক্ষোভকারীরা বলেছে, বিক্ষোভ চলতেই থাকবে। শহরে শহরে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে তা। তাদের কথায়, ব্রাজিলে এখনও কয়েক লাখ নারীকে দেহ বিক্রি করে বাঁচতে হয়। তার সন্তানের দুধ কিনতে হয়। নিজেকে টিকে থাকতে দেহ দান করতে হয় অজানা পুরুষের কাছে। বিশ্বকাপের দর্শকদের জন্য তারা বাড়তি আয়ের জন্য মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ তার ইজ্জত, তা ফেরি করে বেড়াচ্ছে। এছাড়া রয়েছে দুর্নীতি চরমে। এমন একটি দেশে এত বিপুল অর্থ খরচ করে বিশ্বকাপ আয়োজনের কি অর্থ থাকতে পারে! বিশ্বকাপ আয়োজনে শুধু ব্রাজিলই খরচ করছে ১১৭০ কোটি ডলার। এ অর্থে স্টেডিয়াম নির্মাণ ও অবকাঠামোর উন্নয়ন করা হয়। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, এই অর্থের বেশির ভাগই লোপাট করেছেন রাজনীতিবিদ ও কর্মকর্তারা। শেষ মুহূর্তে তড়িঘড়ি করে নির্মাণ করা হয় স্টেডিয়াম, রাস্তাঘাট। গত সপ্তাহেও এমন নির্মাণ কাজ করা হয়। এতে এর মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এরই প্রতিবাদে গতকাল যে করিন্থিয়াস স্টেডিয়ামে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও ম্যাচ হওয়ার কথা তার কাছাকাছি বিক্ষোভে ফেটে পড়ে তারা। এ সময় পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। লাঠিপেটা করে। টেলিভিশনে প্রচারিত ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে পুলিশ। একপর্যায়ে তারা এলোপাতাড়ি কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। গতকাল সারাবিশ্ব যখন জমকালো উদ্বোধন অনুষ্ঠান দেখার অপেক্ষায় ঠিক তখনই এমন খবরে হতবিহ্বল হয়ে যান তারা। অনেকেরই মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। ভাবতে বসে যান, এ অবস্থায় সেখানে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও ম্যাচ হবে তো! গতকাল ঘটনাস্থল থেকে সিএনএন-এর সাংবাদিক সাস্তা ডারলিংটন জানান, এ ঘটনায় একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আহত হয়েছেন তিনি ও প্রযোজক বারবারা আরভানিতিডিস। তারা মনে করছেন বারবারার পা ভেঙে গেছে। সাস্তা বলেছেন, বিক্ষোভকারীদের কোনমতেই স্টেডিয়ামের ধারেকাছে ঘেষতে দেয়া হয়নি। এ সময় বিক্ষোভকারীরা ‘দেয়ার ওন্ট বি এ কাপ’ অর্থাৎ এখানে কোন বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতা হতে পারে না বলে স্লোগান দেয়। আগে থেকেই এমন বিক্ষোভের পরিকল্পনা নিয়েছিল তারা। গত বছর ৫ লাখেরও বেশি মানুষ দেশজুড়ে বিক্ষোভ করেছে। তারা উন্নত সরকারি সুবিধার দাবি তুলেছে। বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে যে দুর্নীতি তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। পণ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ করেছে। তখন তাদের কথায়, এমন বিশ্বকাপ আয়োজন করে কি লাভ। তারপর থেকেই ব্রাজিলের বিভিন্ন শহরে হয়েছে বিক্ষোভ। এর মধ্যে কোন কোনটিতে হয়েছে সংঘর্ষ।
বর্ণিল উদ্বোধন
নাচে-গানে ভরপুর, ইতিহাস-ঐতিহ্যের বর্ণিল উপস্থাপনা। বিশ্বসেরা পপ গায়িকা জেনিফার লোপেজের নয়ন-মনোহরী গানে উন্মাতাল মাঠের প্রায় ৭০০০০ দর্শক। সাও পাওলোর করিন্থিয়ান্স এরেনায় ১২টি দেশের প্রধান ও জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনও ছিলেন অপলক। সুরের মূর্ছনায় বিমোহিত আবালবৃদ্ধবণিতা। লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত হয় ওলে ওলা। যার অর্থ আমরা সবাই সমান। জেনিফার লোপেজের সঙ্গে এই মহা-আয়োজনে পারফর্ম করেন আরেক জগৎখ্যাত র্যাপার পিটবুল। বাদ্যযন্ত্রে ছিল ব্রাজিলের ‘ওলোদাম’। তাদের একদিকে বিক্ষোভ আরেক দিকে বিশ্বকাপ ফুটবল। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দেড় ঘণ্টা বাদেই স্বাগতিক ব্রাজিল তাদের হেক্সা মিশনে প্রথম মাঠে নামে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে।
গতকাল স্থানীয় সময় বিকাল সোয়া তিনটায় জমকালো আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে পর্দা ওঠে বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসরের। ৭ বছরের প্রস্তুতির পর আরাধনার এই ফুটবলোৎসব। অবাক বিস্ময়ে কোটি কোটি দর্শক। সময় মাত্র ২৫ মিনিট। মন ভরে তো চোখ ভরে না। কয়েক শ’ নৃত্যশিল্পী, বাদক, জিমন্যাস্ট অংশ নেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। ব্রাজিলিয়ান গায়িকা ক্লদিয়া লিত্তেও গান পরিবেশন করেন। বেলজিয়ান শিল্প নির্দেশক ডাফিন করনাজ পুরো অনুষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন। ৬ শতাধিক পারফরমার ব্রাজিলের কৃষ্টি-কালচার, ফুটবল প্রকৃতি সব ফুটিয়ে তোলেন নিখুঁতভাবে। মোট ১২০০ জন জড়িত ছিলেন এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে। জানা গেছে, প্রতি মিনিটের পারফরমেন্স নিখুঁত করার জন্য অন্তত ২০ কর্মঘণ্টা সময় দেয়া হয়েছে। এত গোপনীয়তা রক্ষা করা হয় মহড়াতে যে পারফরমারদের মোবাইল ফোনও নিতে দেয়া হয়নি।
এর আগে গত রোববার খবর বেরোয় জেনিফার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আসছেন না। গুঞ্জন ছড়ায় বয়ফ্রেন্ড ও ব্যাকআপ ড্যান্সার ক্যাসপার স্মার্টের সঙ্গে বিরোধের জেরে মন খারাপ লোপেজের। ফিফাও প্রচার করে নিজের প্রোডাকশন নিয়ে ব্যস্ততার কারণে তিনি আসতে পারবেন না। কিন্তু দু’দিন পরেই অবস্থান বদল। লোপেজ এমন বিশ্বমঞ্চ উপেক্ষা করতে পারছেন না। তিনি আসবেন এবং গাইবেন। কারণ তার গানটি এতটা জনপ্রিয়তা পাবে ভাবতে পারেননি। বুধবার পর্যন্ত প্রায় ৭৫ মিলিয়ন বার ইউটিউবে দর্শক এটি দেখেছেন। যদিও অনেকে বলেন যে, ১৯৯৮ সালে রিকি মার্টিনের কাপ অব লাইফ এবং শাকিরার ওয়াকা ওয়াকা এরচেয়ে অনেক ভাল ও বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এক বার্তায় লোপেজ বলেন, ভক্তদের আমি হতাশ করতে চাই না। আমার জন্ম এমন এক পরিবারে যেখানে সবাই ফুটবল ভালবাসে। সুতরাং এমন আসরে থাকার সুযোগ হারাতে চাই না। আমি এই সুযোগ পেয়ে অত্যন্ত গর্বিত ও অধীর হয়ে আছি। বিশ্বজুড়ে এ এক অসাধারণ উৎসব।
No comments