ঘাসের আড়ালে মৃত্যু
লম্বা লম্বা ঘাস। মৃদুলয়ে দুলছে।
বিন্দুমাত্র সন্দেহ না করে যে কেউ আনমনে এগিয়ে যেতে পারে সেখানে। আর এটাই
হতে পারে তার জন্য কাল। কারণ এ দুলুনির দোলক গোখরার মতো কোনো বিষধর সাপ,
যার ছোবলে এক ঘণ্টার মধ্যে হতে পারে প্রাণপাত। মিয়ানমারের গ্রামাঞ্চলে
বিষধর সাপের ছোবলে এমন মৃত্যুর ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। সাধারণভাবে মিয়ানমার
বড় বড় অজগর সাপের দেশ বলে পরিচিত। কিন্তু গোটা দেশজুড়েই রয়েছে সাপের
রাজত্ব। সামরিক জান্তার প্রভাববলয়ে থাকা দেশটিতে প্রায় ১৫০ প্রজাতির সাপ
রয়েছে। এর মধ্যে রাজগোখরা ও স্পিটিং কোবরাসহ বিভিন্ন জাতের গোখরা, রাসেল
ভাইপার, শঙ্খিনীর মতো বিষধর সাপ রয়েছে ৪০ প্রজাতির।
মিয়ানমারের শহরতলি থেকে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত যে পরিমাণ সাপ রয়েছে, সে তুলনায় প্রতিরোধ বা চিকিত্সাব্যবস্থা সে রকম নেই। কাজেই দেশটিতে সর্পদংশনে মৃত্যুর হার বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। ২০১১ সালে মিয়ানমারে বিষধর সাপের ছোবলে মারা গেছেন সাত হাজার ৮০০ জন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, সাপে দংশন করেছে—এমন লোকজনের মধ্যে গড়ে ৮ শতাংশের বেশি মানুষ মারা গেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বে এ পরিসংখ্যান গড়ে ৪ শতাংশ।
বিষধর সাপ নিয়ে জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন, মিয়ানমারের এমন এক সাপুড়ে সেইন থিন। সাপ ধরতে ও পোষ মানাতে গিয়ে তিনি কতবার যে সর্পদংশনের জ্বালা সয়েছেন, এর কোনো হিসাব নেই। তবে চারবার রাজগোখরার ছোবলের জ্বালার কথা স্মৃতিতে গেঁথে আছে। তাঁর বিশ্বাস, তাঁর হাতে ও শরীরে মিয়ানমারের পৌরাণিক সামুদ্রিক সাপ ‘নাগা’র উল্কি থাকায় তিনি বেঁচে গেছেন। একধরনের কালির সঙ্গে সাপের বিষ ও একধরনের ভেষজ মিশিয়ে এই উল্কির রং তৈরি করা হয়। এই তরল শরীরে প্রবিষ্ট করা হয় বলেও তিনি জানান।
দেশটির গ্রামগঞ্জে বাঁশঝাড়, বড় বড় ঘাস বা মাটির সঙ্গে সাপ এমনভাবে মিশে থাকে, টেরই পাওয়া যায় না। এসব অঞ্চলে, বিশেষ করে কৃষকদের জন্য সাপ প্রকৃতই হুমকির কারণ। সে ক্ষেত্রে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হিসেবে তাঁরা বেছে নেন উল্কির মতো টোটকা চিকিত্সা।
ধানচাষি ফো নিজি একদিন তাঁর খেতে কাজ করছিলেন। হঠাত্ মনে হলো তাঁর পা জ্বলে যাচ্ছে। ফো বলেন, ‘আমি প্রথম মনে করেছি হয়তো মৌমাছি হুল ফুটিয়েছে। কিন্তু পরে তাকিয়ে দেখি বিষধর ভাইপার। এরপর পরই আমি আমার লুঙ্গির একটি অংশ ছিঁড়ে দংশন বসানো জায়গাটি শক্ত করে বাঁধি।’
ইয়াংগুনের এসওএস ইন্টারন্যাশনাল ক্লিনিকের প্রধান চিকিত্সা কর্মকর্তা চানতাল বোনফিলস বলেন, সাপের দংশন করলে দৌড়াতে নেই। দৌড়ালে পায়ে রক্ত চলাচলের গতি বেড়ে যায়। এতে বিষ দ্রুত রক্তের মধ্য দিয়ে হূিপণ্ডে এবং প্রধান প্রধান শিরায় পৌঁছে যেতে পারে। এতে অন্ধত্ব, অঙ্গছেদ—এমনকি মৃত্যুও হতে পারে একই সঙ্গে আহত ব্যক্তিকে ছেঁকা না দেওয়া, চুষে রক্ত বের না করা বা ক্ষতস্থানে বরফ না ঘষার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
আর সাপের দংশন থেকে বাঁচার অন্যতম উপায় হলো মাঠে যাওয়ার সময় আচ্ছাদিত জুতা পরা। মিয়ানমারের শিল্প মন্ত্রণালয়ের পরিচালিত ফার্মাসিউটিক্যাল কারখানার উপব্যবস্থাপক অং জাও বলেন, এর পরও যদি দংশন করেই ফেলে, তাহলে সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে পরিমাণমতো বিষনাশক শরীরে ঢোকানো।
সর্পদংশনের ওষুধ তৈরি করতে সামান্য পরিমাণে বিষ ইনজেকশনের মাধ্যমে কোনো প্রাণীর শরীরে ঢোকানো হয়। এরপর ওই প্রাণীর শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তা সংগ্রহ করে প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এএফপি অবলম্বনে
No comments