কাঠফাটা রোদ ও তালপাখা by মাহবুব আলম
জ্যৈষ্ঠের গরমে দেশের অধিকাংশ মানুষ যারা
এই একুশ শতকে পা দিয়েও বিদ্যুৎ–সংযোগ, বৈদ্যুতিক পাখা বা পানি ঠান্ডা করার
যন্ত্রের কথা ভাবতেও পারেন না; তাদের ভরসা আদিকালের হাতপাখার বাতাস আর
মাটির কলসের ঠান্ডা পানি৷ দেশে যখন বিদ্যুৎ ছিল না তখন ধনীর ঘরের সিলিংয়ে
ঝুলত বিশাল টানাপাখা, যা টানার জন্য ছিল ভৃত্য৷ থাকত তালপাতার বিশাল পাখা
হাতে পাঙ্খা-বর্দার। সাধারণ মানুষের জন্য ছিল ছোট ও মাঝারি আকারের তালপাতার
পাখা৷ বঙ্কিমচন্দ্র খেদ করে লিখেছিলেন ‘লাঠি তোমার দিন গিয়াছে’৷ তাঁর
অক্ষম অনুকরণে বলা চলে: ‘টানা পাখা তোমার ও দিন গিয়াছে’। কিন্তু তালপাতার
পাখা এখনো গ্রামগঞ্জ, শহর এমনকি খোদ রাজধানীতেও টিকে রয়েছে।
আগের মতো এখন তালপাতা খুব সহজলভ্য নয়। ফলে এই প্রাচীন পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক উপাদানটির অভাবে হালফিল হাতপাখায় ব্যবহার হচ্ছে শক্ত কাগজের বোর্ড অথবা কুশ্রী দর্শন প্লাস্টিক। প্রাক-বিদ্যুৎ যুগেও হিন্দু-মুসলমান বাঙালির অন্দরমহলে টানা পাখা কখনোই ঠঁাই পায়নি। কারণ, পুরুষ পাঙ্খা পুলারের পক্ষে রাতে তো দূরের কথা দিনের বেলাও অন্দরমহলে ঠোকার হুকুম ছিল না। সাহেবসুবোর বাড়িতে অন্য কথা; কিন্তু সেখানেও একসময় পাঙ্খা পুলার নিয়োগ দেওয়া হতো শুধু দৃষ্টিহীন অন্ধ পুরুষদের।
কিছুদিন আগেও মানুষের স্নেহ, ভালোবাসা, সম্মান, বশ্যতা, আদর–আপ্যায়ন—এমন সব মূল্যবোধ প্রকাশের মাধ্যম ছিল একটি সামান্য তালপাখার পাখা। অসুস্থ প্রিয়জনের মাথার কাছে হাতপাখা নিয়ে বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছেন মা, ভগ্নি বা স্ত্রী। সেখানে কর্তব্যের চেয়ে মমত্ববোধ ও স্নেহের দায়ই বেশি। গুরুজন কেউ বেড়াতে এসেছেন, কনিষ্ঠরা তাকে সম্মান করে বসিয়ে পাখার বাতাস করছে। জমিদার এসেছেন মহালে, নায়েব গোমস্তা পাখার বাতাস করছে, ভক্তিতে নয়, ভয়ে। জামাই গেছে শ্বশুরবাড়ি, শাশুড়ি খাবার সাজিয়ে পাখার বাতাস করছেন।
কাঠফাটা রোদে আকাশ থেকে আগুন ঝরে আর গৃহস্থের গলায় আকুল আহ্বান, ‘আয় বৃষ্টি ঝেপে, ধান দেবো মেপে’। অনাবৃষ্টির ক্ষতি থেকে চাষাবাদ বাঁচাতে হবে নতুবা পরিবারসহ অনাহার নিশ্চিন্ত। তাই বৃষ্টিকে ডাকা হয়েছে ধানের লোভ দেখিয়ে, আজকের ভাষায় যাকে বলা যায়, প্রণোদনার অঙ্গীকার করে। বৃষ্টিকে ধান দেওয়া হবে মুঠো ভরে নয়, দাঁড়িপাল্লা দিয়ে মেপে। সহজ কথায় ধানের মুষ্টি ভিক্ষা নয়, ধান দেওয়া হবে যথেষ্ট পরিমাণে, যাতে বৃষ্টির মন ভরে। বাংলাদেশে এত রসাল ফল ও নানা বর্ণের ফুল থাকা সত্ত্বেও ধানের ওপর বৃষ্টির পক্ষপাতিত্ব কেন—এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে। এখন প্রচুর বোরো ধান উঠেছে। সকালে যে ধান নেহাত খাদ্যশস্য, বিকেলে তা হাটে বিক্রি হয়ে অতি সহজে কড়কড়ে নোট। গৃহস্থ বা চাষির হাতে সব সময় নগদ টাকা থাকে না। তবে সারা বছরই কিছু না কিছু ধান পুঁজি হিসেবে ঘরে থাকে। তাই বৃষ্টিকে চটজলদি কিছু উপহার দিতে হলে ধান ছাড়া গৃহস্থের আর কীই–বা আছে।
শুধু কৃষকই নন, জেলে, মাছচাষি এবং মাছের রেণু পোনা ব্যবসায়ীরা চৈত্র, বৈশাখ মাস থেকেই হালদা নদীর বাঁক ধরে মােছর লেজ ঘুরিয়ে নড়া বা ভেেস ওঠার দিকে সতর্ক চোখ রাখেন। মাছের সাদা পেট ফুলে চকচকে, পেটের ভেতরে রয়েছে অজস্র রুপালি ডিম। ডিম ছাড়ার সময় এখন। আবহমান কাল থেকে প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে বছরের এই সময়টাতে কর্ণফুলীসহ আশপাশের সব ছোট–বড় নদীর রুই, কাতলা, মৃগেল জাতের মা-মাছেরা হালদা নদীতে ডিম ছাড়ার জন্য একে একে ছুটে আসে। জেলেরা নাপিতের ঘাট, অন্তরদীঘির বাঁকে বাঁকে নৌকা সাজিয়ে বসে আছেন পয়মস্ত মাছের ডিমের আশায়৷ বাংলাদেশের ধনধান্য পুষ্পভরা ছবিটি সার্থকতা খুঁজে পায় এই জৈ্যষ্ঠ মাসের ফসল, ফল আর পুষ্পরাজির প্রাচুর্যের সমারোহে। বৈশাখ মাস থেকে বোরো ধান কাটা শুরু হয়। জৈ্যষ্ঠ মাস নাগাদ কৃষকের আঙিনা সেই বোরো ধানের মাড়াই–ঝাড়াই আর বাছাইয়ের কলতানে মুখর হয়ে ওঠে।
সোনালি রঙের সূর্যমুখী ফুলের সারি চারদিক আলো করে ফুটে রয়েছে। না, কোনো ধনী বাগানবিলাসীর বাড়ির লনের নয়। এই ফুল ফুটেছে পটুয়াখালী জেলার সদর উপজেলার বদরপুর গ্রাম এবং বরগুনার আমতলী উপজেলায় একরের পর একর চাষ করা সূর্যমুখী ফুলের বাগানে। এবার ফলন খুব ভালো হয়েছে আর ফুল আবাদের জমির পরিমাণ বেড়েছে গত তিন বছরের তিন গুণ।
সূর্যমুখী চাষে সেচ, সার এবং কীটনাশক তুলনামূলকভাবে কম ব্যবহৃত হয়। এক কেজি সূর্যমুখী ফুলের বীজ থেকে প্রায় ৫০০ গ্রাম তেল পাওয়া যায়। যা অন্যান্য তেলবীজের চেয়ে অনেক বেশি। ভোজ্যতেলের বীজ হিসেবে সূর্যমুখী ফুলের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। পাহাড়ি এলাকায় বিদেশি জাতের চায়না– ৩ লিচুর ভালো ফলন পাহাড়িদের মনে খুশির বান ডেকেছে। পাটচাষিরা বৃষ্টির অভাবে সেচ দিয়ে পাটের আবাদ করছেন। এতে কৃষকের খরচ বেড়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কা সত্ত্বে চাষিদের পাট চাষ না করে উপায় কী। এসব জমিতে তো আর অন্য ফসল তেমন হয় না। মানুষ, পশুপাখি, গাছপালা—সবাই বৃষ্টির জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঝড় চাই না, চাই অঝোর ধারার বৃষ্টি। তাই যুগ যুগ ধরে এই অসহায় মানুষের প্রার্থনা—আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে।
মাহবুব আলম: সাবেক রাষ্ট্রদূত, লেখক।
mahboob1122@hotmail.com
No comments