প্রথম বৃষ্টির বিন্দু by আখতার হোসেন খান
ঢাকার
বেইলী রোডের অফিসার্স ক্লাবে ১৪২০ বাংলা সনের আষাঢ়ের প্রথম দিনে বর্ষবরণ
অনুষ্ঠানে গান গেয়ে দর্শকদের মাতালেন অদিতি মহসীন ও সুবর্ণা চৌধুরী। নাচের
শৈলীতে মুগ্ধ করল পল্লবীর নৃত্যদল। ‘বর্ষণ-মন্দ্রিত অন্ধকারে’ বা ‘ভিজে
ঘাসের গন্ধেভরা বনপত্রে’ এসে বর্ষাও যে বাংলাভাষীদের সাংস্কৃতিক জীবনের
একটা অনুসঙ্গ বা প্রকরণ হয়ে উঠছে, এ অনুষ্ঠান তারই প্রমাণ। পহেলা বৈশাখ
নিয়ে যে-বর্ধিত ও ক্রমবর্ধমান কলেবরের অনুষ্ঠান সাংস্কৃতিক জীবনকে স্বল্প
সময়ের জন্য হলেও কর্মচাঞ্চল্যে ভরে দেয়, বর্ষার এ অনুষ্ঠান হয়তো তারই এক
সম্প্রসারিত পাদটীকা; নাকি এক স্বয়ংসম্পূর্ণ ঘটনা, তা নিশ্চিত করে বলার সময়
এখনও হয়নি। যে-গৃহস্থের বাড়ির চালার অবস্থা নড়বড়ে, অনেক ক্ষেত্রেই ছিদ্র
দিয়ে পানি ঝরে অথবা জল থই থই শহরে যোগাযোগ হয় বিঘিœত, যার ফলে অফিসগামী নিু
বেতনভুক কর্মচারী বা পোশাক শিল্পকর্মী বসন ভিজিয়ে কর্মস্থলে যান, তাদের
কাছে বর্ষা এতটা মজার নয়। তারা নিজেদের নিুআয়জাত জীবনযাত্রার পথে বর্ষাকে
একটা বাড়তি বিড়ম্বনাই ভেবে থাকেন।
এর পরও বর্ষার যে-প্রাকৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক আকর্ষণ তা উপক্ষেণীয় নয়। বর্ষা এলে ছাত্র-যুবার বাইরে প্রবীণেরাও অল্পক্ষণের জন্য হলেও অন্যমনষ্ক হয়ে পড়তে পারেন। বর্ষার এই দিকটি নিয়ে কোনো বিশ্বখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ গবেষণা করেছেন কিনা, জানি না; তবে বাংলা ভাষার সব কবিয়ই বর্ষার স্তুতিতে মগ্ন ও তার প্রভাবে ধরাশায়ী, এটা সহজবোধ্য। জয়দেব থেকে রবীন্দ্রনাথ, তার পরের কবিরা তাদের অনেকগুলো সেরা গান ও কবিতা বর্ষাকে এড়াতে পারেননি। বিদ্যাপতির ‘ভরা বাদর, মাহ ভাদর, শূন্য মন্দির মোর’ যদিও বলছে ভাদ্র মাসের কথা- বেটা পাঁজির হিসাব মতে শরৎকাল, কিন্তু আসলে তো তা বৃষ্টির ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়ানো। আর তাছাড়া বর্ষা আর শরতের এই পার্থক্য কেন তৈরি করেছি আমরা, তার যুক্তিসঙ্গত কারণই বা কী? বাংলার শরৎ আর বর্ষার পার্থক্যই বা কী? সুপ্রাচীন প্রাজ্ঞদের তিন মাসের কথা বাদ দিলেও বড়– চণ্ডীদাস বাংলার বর্ষাকে দেখেছেন চার মাসব্যাপী।
কান্তাবিরহিত যক্ষ
জানা-অজানার বাইরে বা ঊর্ধ্বে উঠে মহাকবি কালিদাসের সংস্কৃত ভাষার শব্দবন্ধ ‘আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে’ বাগ্ধারার অংশ হয়ে গেছে। আমরা অনেকে হয়তো মনেই রাখি না ওই কথাগুলো বলে মেঘদূত কাব্য তার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে আষাঢ় মাসকে। যদি আষাঢ় না আসত, এই কাব্য কি আদৌ লেখা হতো? অথবা অন্য কোনো মাসকে কি কবি যক্ষের মনোবেদনার সঙ্গে মেলাতে তার প্রথম দিবসের উল্লেখ টেনে আনতেন? পূর্বমেঘের তথা কাব্যের দ্বিতীয় শ্লোকেই আষাঢ়ের আগমন ঘটালেন কবি, যদিবা তখন আটমাস কেটে গেছে ‘কান্তাবিরহিত কামুকের’। আর বিরহী যক্ষের অবস্থা অতি সরাসরি ভাষায়, যা রবীন্দ্র-পরবর্তী কবিরাও পারতেন কিনা সন্দেহ। জানান দিলেন :
‘কামের উদ্রেক করে যে করে, সেই মেঘ দেখে সহসা তার সম্মুথে
যক্ষ কোনোমতে চোখের জল চেপে ভাবলে মনে-মনে বহুখন :
নবীন মেঘ দেখে মিলিত সুখীজন তারাও হয়ে যায় অন্যমনা,
কী আর কথা তবে, যদি সে দূরে থাকে যে চায় কণ্ঠের আলিঙ্গন।’
(পূর্বমেঘ ৩ : বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ)
এবং পরবর্তীতে এলো মেঘের নিরাময়ক গুণ নিয়ে আরও খোলামেলা বক্তব্য :
তোমার দিকে তারা হানবে চাহনির দীর্ঘ মধুকর-পঙ্ক্তি
কেননা নখক্ষতে পরশে আনে সুখ প্রথম বৃষ্টির বিন্দু। “
(পূর্বমেঘ ৩৬ :বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ)
মেঘ কামের উদ্রেক করে বা প্রথম বৃষ্টির বিন্দু নখক্ষতে সুখ আনে, এজাতীয় কথার মূলে আছে এক অভূতপূর্ব স্পষ্টতা। এ ধরনের ভাষা ব্যবহার মহাকবি কালিদাসকে জগৎশ্রেষ্ঠ সব ক্লাসিকের জনক হিসেবে চিহ্নিত। সমাজের এমন এক অংশের তিনি বাসিন্দা যিনি ক্ষুধা-অভাবের ঊর্ধ্বে, যিনি প্রকৃতি ও মানব-মানসের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সব অন্তর্দোলা নিয়ে কাজ করেন।
কিন্তু কালিদাস তো সেই ঐতিহ্যের, যা তারও অনেক আগে বাল্মিকী, সম্ভবত একই ভৌগলিক পরিমণ্ডলে বসবাস করে, বর্ষার স্বর্গীয় সর্বরোগহর উদ্দীপকতা সম্পর্কে জানিয়ে গেছেন। কিষ্কীন্ধা কাণ্ডে রাম যে সুগ্রীবের সস্ত্রীক বর্ষা উপভোগের কথা উল্লেখ করেছেন, তাতো তার নিজের সীতা-বিরহেরই অন্তর্জ্বালারই কথা : নইলে বর্ষা এসে সীতার উদ্ধারকে পিছিয়ে দিয়েছে, তা এই সময়ে তিনি বেশি করে কেন অনুভব করবেন। অন্য জায়গায়, একই বর্ষাকালে, আরও সরাসরি হয়ে, লজ্জার মাথা খেয়ে, অনুজকে স্পষ্ট বলছেন, চোখের সামনে বৃষ-বৃষীর মেলামেশা তাকে সীতার অভাব বেশি মনে করিয়ে দিচ্ছে। বর্ষার পুষ্পভারাবনত বৃক্ষ থেকে যে-উদক কণা ঝরছে, তা যেন তাদের কান্না, মেঘে-ঘেরা বিদ্যুৎ যেন রাবণের অধিকার থেকে মুক্তির চেষ্টারত সীতা : আর তাই পরিষ্কার কথা :‘সীতার জন্য আমার প্রেম আরও গভীরভাবে জাগ্রত হচ্ছে’। বাল্মিকীতে পাই পর্বতমালা যেন যুবাবয়সী বৈদিক বিদ্যার্থী, কালো মেঘ তার কোমরের মৃগ-চর্ম, ঝর্ণা পবিত্র সূত্র।
আর কালিদাসে আছে, ‘বপ্রকেলি করে শোভন গজরাজ আনত পর্বতগাত্রে।’
বহুযুগের ওপারের আষাঢ়
বাল্মিকী আর কালিদাসের ধারাবাহিকতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসে যে সুরের আগুন ছড়িয়ে দিলেন, বর্ষা তাতে অভিনব স্থানে বসলো প্রাকৃতজনের ভাষায়, সুর আর শব্দের তুলনাহীন স্বপ্নভরা সঙ্গতিতে। এ ভাষা দৈনন্দিন ভাষা : সংস্কৃতের কঠিন শৃঙ্খলাবদ্ধ সুশাসন এই ভাষায় নেই বলেই তা জীবনের এত কাছের। কিন্তু তিনি কি তার অগ্রজদের অবদান অস্বীকার করেছেন? অসম্ভব। তার আষাঢ় বন্দনাতো শুরুই হয়েছে এভাবে: ‘বহুযুগের ওপার হতে আষাঢ় এল আমার মনে,/ কোন সে কবির ছন্দ বাজে ঝরো ঝরো বরিষণে’। গীতবিতানের শতাধিক বর্ষাপর্বের গানে অবশ্য কোথাও বাল্মিকী ও কালিদাসের মতো স্পষ্ট যৌনতার উল্লেখ নেই। এমনকি সামান্য ইঙ্গিতও আছে কি? ‘ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে’ গানটিতে ‘পথিকললনা’, ‘জনপদবধূ’ বা ‘অভিসারিকা’ শব্দাবলীতে মেঘদূতের উত্তরমেঘের ৩৬-৩৮ শ্লোক প্রতিধ্বনিত হয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু তা কালিদাসের যৌনতা বা ইন্দ্রিয়বিলাসের সঙ্গে মোটেই তুলনীয় নয়; ঋদ্ধ ঋষিত্বের পথগামী রবীন্দ্রনাথের পক্ষে তা ছিল অকল্পনীয়।
শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন ও পদাবলীর কবিরাও ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সামনে। ছিল জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ যেখানে মেঘের কথা স্মরণীয়ভাবে বলা হয়েছে। বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তনের স্পষ্টতা রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা দুঃসাধ্য। শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তনের নায়িকা আষাঢ়ের আগমনে মেঘদূতের যক্ষের মতোই কাটাকাটা কথায় যা বলছেন, তা আজকের গদ্যে অনেকটা এমন - ‘আষাঢ় মাসে নব মেঘ গর্জন করছে। মদনের কান্নায় আমার চোখের পানি ঝরছে। বড়াই, আমিতো পাখি জাতির নই যে যেখানে আমার প্রাণনাথ কানাই আছে, সেখানে উড়ে যাব। বরষার চার মাস আমি কীভাবে বঞ্চিত করব? এ ভরা যৌবনে কানাই নিরাস করলো’।
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
রবীন্দ্র-পরবর্তী কবিদের মধ্যে প্রায় সবাই বর্ষা নিয়ে কবিতা লিখেছেন, কিন্তু সুধীন দত্তে যেন বৃষ্টি নিয়ে সেই পুরনো হাহাকার সবচেয়ে বেশি হয়ে ফিরে এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রচিত তার ক্ষুদ্র মহাকাব্যসম ১৬৬ পঙ্ক্তির ছয় অনুচ্ছেদের কবিতা ‘সংবর্ত’তো শুরুই হয়েছে এভাবে : এখনও বৃষ্টির দিনে মনে পড়ে তাকে’; এবং বড়– চণ্ডীদাসের ঋতু-হিসাবে এটি বর্ষাকালেরই কবিতা। সংবর্তের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদেও তিনি জানাচ্ছেন যে ‘বৃষ্টির বিবিক্ত দিনে’ ভুলে বসছেন এর আগে বলা ‘বীমাই জীবন’, বা তার কিস্তির টাকা যোগান দিতে গিয়ে যে ‘বাজার খরচে পড়ে টান’ বা ‘চৌধুরীদের ভদ্রাসনক্রোক্’ স্বচক্ষে দেখার ইচ্ছা- সমস্ত কিছু। বরঞ্চ মনে হচ্ছে স্ফূর্তির প্রতীক্ষায় জগৎ্; এবং তাই তিনি ভুলে যাচ্ছেন পারিপার্শ্বিক যুদ্ধভারাবনত দুনিয়াকে: ‘তখন থাকে না মনে- দিগন্তরে / উচ্ছিষ্ট উঞ্ছের বাটোয়ারা,/ হিংসার প্রমারা,/ স্থগিত মারীর বীজ শস্যশূন্য মাঠে;/ চড়ে বসে নিহত বা নির্বাসিত স্বৈরীদের পাটে/ প্রতিদ্বন্দ্বী সর্বেসর্বা যত; নিরর্থক/ অসূর্যের পুরাণ ঝলক,/ হিরন্ময় পাত্র ঠেলে ফেলে,/ দেয় মেলে/ অন্ধ তম অতিপ্রজ বল্মীকে বল্মীকে;/ বিমানের ব্যুহ চতুর্দিকে,/ মাতরিশ্বা পরিভূ কবির কণ্ঠশ্বাস।’
চতুর্থ অনুচ্ছেদে ‘যুদ্ধগামী বর্বর’ মুসোলীনি, ‘উদ্বাস্তু’ ট্রট্স্কি, ‘বালখিল্য নাট্সীদের সমমস্বর নামসংকীর্তন’-এসব বাদ দিয়ে ‘বরঞ্চ বৃষ্টির দিনে স্তব্ধশোকে/ নির্বাক বিদায়/ স্মরণীয় স্বস্থ মর্যাদায় ॥’। এ বৃষ্টির জন্যই হয়তো এ সবের মধ্যেও আরেকজনকে, সেই বিদেশিনীকে, মনে আসছে, যার-
দবভ্রু কেশে অস্তগত সবিতার উত্তরাধিকার,
সংহত শরীরে
দ্রাক্ষার সিতাংশু কান্তি, নীলাঞ্জন চোখের গভীরে
তাচ্ছিল্যের দামিনীবিলাস;’
এবং তাই ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে ‘বৃষ্টির বিবিক্ত দিনে অসংলগ্ন স্মৃতির সংগ্রহে/ কিংবা শুধু মৌখিক বিদ্রোহে /নিঃসংগ জরার আর্তি ভোলার প্রয়াস’। আর ‘হাতুড়িনিষ্পিষ্ট ট্রট্স্কি’ বা ‘হিটলারের সুহৃদ্ স্টালিন্’ বা ‘কবন্ধ ফরাসিদেশ’কে বাদ দিয়ে যুদ্ধরত পৃথিবীর শুধু সেই বহু দূরের একজনের জন্যই শেষাবধি এই চিন্তা আর আর্তি :
‘সে এখনও বেঁচে আছে কি না,
তা শুদ্ধ জানি না ॥’
অর্কেষ্ট্রার ‘শাশ্বতী’ লেখা হয়েছে শ্রান্ত বরষার শেষে; কিন্তু বর্ষারই কিছু ছবি যেন বারবার ঘুরেফিরে আসে এ কবিতায়। ‘বাদলশেষের রাত’, ‘ভরা নদী’ এসবই বৃষ্টির অনুষঙ্গ। এজন্যই কবির মনে এসেছে ‘একটি কথার দ্বিধাথরথর চুড়ে ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী’ তথা ‘একটি স্মৃতির মানুষী দুর্বলতা প্রলয়ের পথ দিল অবারিত করে’। এবং তাই দৃপ্ত আÍপ্রত্যয়ী ঘোষণা কবিতার শেষে :
‘সে ভুল ভুলুক, কোটি মন্বন্তরে
আমি ভুলিব না, আমি কভু ভুলিব না ॥’
প্রাকৃতিক বিপর্যয়
ঋগে¦দে ইন্দ্রকে কল্পনা করা হয়েছে, অন্য আরও অনেক কিছুর সঙ্গে, বৃষ্টির উদ্গাতা হিসেবে। কিন্তু ইন্দ্র যে-যুগের বলে কল্পিত বা হিসাবকৃত বা যে-ভুগোলের, সে-যুগ বা সে-ভুগোল বাংলার নয়, যদিবা পর্জন্য-প্ররোচিত ভেকেদের গলা ছেড়ে ডাক দেয়ার উল্লেখ সেখানে আছে। অনেক পরে বাল্মিকী, আর তারও অনেক পরে কালিদাস যা বলেছেন, তার সঙ্গে বরঞ্চ বাংলার বর্ষার অনেক বেশি মিল। বাংলার কবিরা তাই ওই দুই মহাকবি থেকে দু’হাতে আহরণ করেছেন। প্রাচীন কাব্যে ৯ মাস গর্ভধারণের পর বর্ষা প্রকৃতির প্রসবোৎসব হিসেবে বর্ণিত। কিন্তু আজকের দিনে যখন পরিবেশ বিধ্বস্ত বলে সবাই আতংকিত বা তথাকথিত বৈশ্বিক উষ্ণীভবনের সম্ভাব্য ত্রাসে মন বিপর্যস্ত, তখন ‘প্রথম বৃষ্টির বিন্দু’ আগের মতো নখক্ষত সারাতে আর কতদিন আসবে, বা আসলে কোন মাসে কীভাবে আসবে, বা গর্ভ ভেঙে সৃষ্টির উল্লাস হিসেবে দেখা দেবে কিনা দশম মাসে, তাতে সুনিশ্চয় অনিশ্চিতি। আধুনিক নগরজীবন প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের এক ধরনের দূরত্ব তৈরি করেছে। বহুতল ভবনের ফ্লাট-বাড়ি বা ঢাউস অফিসে বসে আমরা অনেক সময়ে টেরই পাই না কখন বৃষ্টি এলো আর কখন তা শেষ হয়েছে। আর গ্রাম-বাংলার অন্যত্র পথে-প্রান্তরে যাদের সুযোগ আছে, তারা দিনগত জীবন-যুদ্ধের অশেষ অনটনে এতটাই অবসন্ন যে বর্ষা-তাড়িত ইন্দ্রিয়বিলাসে অংশভাক্ হওয়াতো দূরের কথা, বৃষ্টিকে ঠিক করে চোখ মেলে দেখাও তাদের জন্য অসম্ভব।
তারপরও অবশ্যই আসবে বর্ষা-উৎসবকে জীবনের সঙ্গে মেলানোর প্রশ্নটি। যে-অর্থে পহেলা বৈশাখ বা নবান্ন উৎসব বাংলার সমাজ-জীবনের অঙ্গ, আষাঢ়ের প্রথম দিবস সে-অর্থে কি আদৌ জনজীবনের অংশ হয়েছে বা হতে পারবে? এ প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করবে প্রারম্ভেই যাদের কথা বলা হয়েছে, তাদের জীবনের সঙ্গে এ-উৎসবকে একীভূত করার ওপর। নইলে এটা রয়ে যাবে ক্লাবভিত্তিক সংস্কৃতির পাদটীকা হিসেবেই। অবশ্য, প্রথম বৃষ্টির বিন্দু প্রতি বর্ষাতে আসবেই, কবিরা তো জন্মাতে থাকবেন; এবং ক্ষণিকের জন্য হলেও কান্তাবিরহিতেরা অন্যমনা হয়ে পড়বেনই।
এর পরও বর্ষার যে-প্রাকৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক আকর্ষণ তা উপক্ষেণীয় নয়। বর্ষা এলে ছাত্র-যুবার বাইরে প্রবীণেরাও অল্পক্ষণের জন্য হলেও অন্যমনষ্ক হয়ে পড়তে পারেন। বর্ষার এই দিকটি নিয়ে কোনো বিশ্বখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ গবেষণা করেছেন কিনা, জানি না; তবে বাংলা ভাষার সব কবিয়ই বর্ষার স্তুতিতে মগ্ন ও তার প্রভাবে ধরাশায়ী, এটা সহজবোধ্য। জয়দেব থেকে রবীন্দ্রনাথ, তার পরের কবিরা তাদের অনেকগুলো সেরা গান ও কবিতা বর্ষাকে এড়াতে পারেননি। বিদ্যাপতির ‘ভরা বাদর, মাহ ভাদর, শূন্য মন্দির মোর’ যদিও বলছে ভাদ্র মাসের কথা- বেটা পাঁজির হিসাব মতে শরৎকাল, কিন্তু আসলে তো তা বৃষ্টির ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়ানো। আর তাছাড়া বর্ষা আর শরতের এই পার্থক্য কেন তৈরি করেছি আমরা, তার যুক্তিসঙ্গত কারণই বা কী? বাংলার শরৎ আর বর্ষার পার্থক্যই বা কী? সুপ্রাচীন প্রাজ্ঞদের তিন মাসের কথা বাদ দিলেও বড়– চণ্ডীদাস বাংলার বর্ষাকে দেখেছেন চার মাসব্যাপী।
কান্তাবিরহিত যক্ষ
জানা-অজানার বাইরে বা ঊর্ধ্বে উঠে মহাকবি কালিদাসের সংস্কৃত ভাষার শব্দবন্ধ ‘আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে’ বাগ্ধারার অংশ হয়ে গেছে। আমরা অনেকে হয়তো মনেই রাখি না ওই কথাগুলো বলে মেঘদূত কাব্য তার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে আষাঢ় মাসকে। যদি আষাঢ় না আসত, এই কাব্য কি আদৌ লেখা হতো? অথবা অন্য কোনো মাসকে কি কবি যক্ষের মনোবেদনার সঙ্গে মেলাতে তার প্রথম দিবসের উল্লেখ টেনে আনতেন? পূর্বমেঘের তথা কাব্যের দ্বিতীয় শ্লোকেই আষাঢ়ের আগমন ঘটালেন কবি, যদিবা তখন আটমাস কেটে গেছে ‘কান্তাবিরহিত কামুকের’। আর বিরহী যক্ষের অবস্থা অতি সরাসরি ভাষায়, যা রবীন্দ্র-পরবর্তী কবিরাও পারতেন কিনা সন্দেহ। জানান দিলেন :
‘কামের উদ্রেক করে যে করে, সেই মেঘ দেখে সহসা তার সম্মুথে
যক্ষ কোনোমতে চোখের জল চেপে ভাবলে মনে-মনে বহুখন :
নবীন মেঘ দেখে মিলিত সুখীজন তারাও হয়ে যায় অন্যমনা,
কী আর কথা তবে, যদি সে দূরে থাকে যে চায় কণ্ঠের আলিঙ্গন।’
(পূর্বমেঘ ৩ : বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ)
এবং পরবর্তীতে এলো মেঘের নিরাময়ক গুণ নিয়ে আরও খোলামেলা বক্তব্য :
তোমার দিকে তারা হানবে চাহনির দীর্ঘ মধুকর-পঙ্ক্তি
কেননা নখক্ষতে পরশে আনে সুখ প্রথম বৃষ্টির বিন্দু। “
(পূর্বমেঘ ৩৬ :বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ)
মেঘ কামের উদ্রেক করে বা প্রথম বৃষ্টির বিন্দু নখক্ষতে সুখ আনে, এজাতীয় কথার মূলে আছে এক অভূতপূর্ব স্পষ্টতা। এ ধরনের ভাষা ব্যবহার মহাকবি কালিদাসকে জগৎশ্রেষ্ঠ সব ক্লাসিকের জনক হিসেবে চিহ্নিত। সমাজের এমন এক অংশের তিনি বাসিন্দা যিনি ক্ষুধা-অভাবের ঊর্ধ্বে, যিনি প্রকৃতি ও মানব-মানসের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সব অন্তর্দোলা নিয়ে কাজ করেন।
কিন্তু কালিদাস তো সেই ঐতিহ্যের, যা তারও অনেক আগে বাল্মিকী, সম্ভবত একই ভৌগলিক পরিমণ্ডলে বসবাস করে, বর্ষার স্বর্গীয় সর্বরোগহর উদ্দীপকতা সম্পর্কে জানিয়ে গেছেন। কিষ্কীন্ধা কাণ্ডে রাম যে সুগ্রীবের সস্ত্রীক বর্ষা উপভোগের কথা উল্লেখ করেছেন, তাতো তার নিজের সীতা-বিরহেরই অন্তর্জ্বালারই কথা : নইলে বর্ষা এসে সীতার উদ্ধারকে পিছিয়ে দিয়েছে, তা এই সময়ে তিনি বেশি করে কেন অনুভব করবেন। অন্য জায়গায়, একই বর্ষাকালে, আরও সরাসরি হয়ে, লজ্জার মাথা খেয়ে, অনুজকে স্পষ্ট বলছেন, চোখের সামনে বৃষ-বৃষীর মেলামেশা তাকে সীতার অভাব বেশি মনে করিয়ে দিচ্ছে। বর্ষার পুষ্পভারাবনত বৃক্ষ থেকে যে-উদক কণা ঝরছে, তা যেন তাদের কান্না, মেঘে-ঘেরা বিদ্যুৎ যেন রাবণের অধিকার থেকে মুক্তির চেষ্টারত সীতা : আর তাই পরিষ্কার কথা :‘সীতার জন্য আমার প্রেম আরও গভীরভাবে জাগ্রত হচ্ছে’। বাল্মিকীতে পাই পর্বতমালা যেন যুবাবয়সী বৈদিক বিদ্যার্থী, কালো মেঘ তার কোমরের মৃগ-চর্ম, ঝর্ণা পবিত্র সূত্র।
আর কালিদাসে আছে, ‘বপ্রকেলি করে শোভন গজরাজ আনত পর্বতগাত্রে।’
বহুযুগের ওপারের আষাঢ়
বাল্মিকী আর কালিদাসের ধারাবাহিকতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসে যে সুরের আগুন ছড়িয়ে দিলেন, বর্ষা তাতে অভিনব স্থানে বসলো প্রাকৃতজনের ভাষায়, সুর আর শব্দের তুলনাহীন স্বপ্নভরা সঙ্গতিতে। এ ভাষা দৈনন্দিন ভাষা : সংস্কৃতের কঠিন শৃঙ্খলাবদ্ধ সুশাসন এই ভাষায় নেই বলেই তা জীবনের এত কাছের। কিন্তু তিনি কি তার অগ্রজদের অবদান অস্বীকার করেছেন? অসম্ভব। তার আষাঢ় বন্দনাতো শুরুই হয়েছে এভাবে: ‘বহুযুগের ওপার হতে আষাঢ় এল আমার মনে,/ কোন সে কবির ছন্দ বাজে ঝরো ঝরো বরিষণে’। গীতবিতানের শতাধিক বর্ষাপর্বের গানে অবশ্য কোথাও বাল্মিকী ও কালিদাসের মতো স্পষ্ট যৌনতার উল্লেখ নেই। এমনকি সামান্য ইঙ্গিতও আছে কি? ‘ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে’ গানটিতে ‘পথিকললনা’, ‘জনপদবধূ’ বা ‘অভিসারিকা’ শব্দাবলীতে মেঘদূতের উত্তরমেঘের ৩৬-৩৮ শ্লোক প্রতিধ্বনিত হয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু তা কালিদাসের যৌনতা বা ইন্দ্রিয়বিলাসের সঙ্গে মোটেই তুলনীয় নয়; ঋদ্ধ ঋষিত্বের পথগামী রবীন্দ্রনাথের পক্ষে তা ছিল অকল্পনীয়।
শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন ও পদাবলীর কবিরাও ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সামনে। ছিল জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ যেখানে মেঘের কথা স্মরণীয়ভাবে বলা হয়েছে। বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তনের স্পষ্টতা রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা দুঃসাধ্য। শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তনের নায়িকা আষাঢ়ের আগমনে মেঘদূতের যক্ষের মতোই কাটাকাটা কথায় যা বলছেন, তা আজকের গদ্যে অনেকটা এমন - ‘আষাঢ় মাসে নব মেঘ গর্জন করছে। মদনের কান্নায় আমার চোখের পানি ঝরছে। বড়াই, আমিতো পাখি জাতির নই যে যেখানে আমার প্রাণনাথ কানাই আছে, সেখানে উড়ে যাব। বরষার চার মাস আমি কীভাবে বঞ্চিত করব? এ ভরা যৌবনে কানাই নিরাস করলো’।
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
রবীন্দ্র-পরবর্তী কবিদের মধ্যে প্রায় সবাই বর্ষা নিয়ে কবিতা লিখেছেন, কিন্তু সুধীন দত্তে যেন বৃষ্টি নিয়ে সেই পুরনো হাহাকার সবচেয়ে বেশি হয়ে ফিরে এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রচিত তার ক্ষুদ্র মহাকাব্যসম ১৬৬ পঙ্ক্তির ছয় অনুচ্ছেদের কবিতা ‘সংবর্ত’তো শুরুই হয়েছে এভাবে : এখনও বৃষ্টির দিনে মনে পড়ে তাকে’; এবং বড়– চণ্ডীদাসের ঋতু-হিসাবে এটি বর্ষাকালেরই কবিতা। সংবর্তের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদেও তিনি জানাচ্ছেন যে ‘বৃষ্টির বিবিক্ত দিনে’ ভুলে বসছেন এর আগে বলা ‘বীমাই জীবন’, বা তার কিস্তির টাকা যোগান দিতে গিয়ে যে ‘বাজার খরচে পড়ে টান’ বা ‘চৌধুরীদের ভদ্রাসনক্রোক্’ স্বচক্ষে দেখার ইচ্ছা- সমস্ত কিছু। বরঞ্চ মনে হচ্ছে স্ফূর্তির প্রতীক্ষায় জগৎ্; এবং তাই তিনি ভুলে যাচ্ছেন পারিপার্শ্বিক যুদ্ধভারাবনত দুনিয়াকে: ‘তখন থাকে না মনে- দিগন্তরে / উচ্ছিষ্ট উঞ্ছের বাটোয়ারা,/ হিংসার প্রমারা,/ স্থগিত মারীর বীজ শস্যশূন্য মাঠে;/ চড়ে বসে নিহত বা নির্বাসিত স্বৈরীদের পাটে/ প্রতিদ্বন্দ্বী সর্বেসর্বা যত; নিরর্থক/ অসূর্যের পুরাণ ঝলক,/ হিরন্ময় পাত্র ঠেলে ফেলে,/ দেয় মেলে/ অন্ধ তম অতিপ্রজ বল্মীকে বল্মীকে;/ বিমানের ব্যুহ চতুর্দিকে,/ মাতরিশ্বা পরিভূ কবির কণ্ঠশ্বাস।’
চতুর্থ অনুচ্ছেদে ‘যুদ্ধগামী বর্বর’ মুসোলীনি, ‘উদ্বাস্তু’ ট্রট্স্কি, ‘বালখিল্য নাট্সীদের সমমস্বর নামসংকীর্তন’-এসব বাদ দিয়ে ‘বরঞ্চ বৃষ্টির দিনে স্তব্ধশোকে/ নির্বাক বিদায়/ স্মরণীয় স্বস্থ মর্যাদায় ॥’। এ বৃষ্টির জন্যই হয়তো এ সবের মধ্যেও আরেকজনকে, সেই বিদেশিনীকে, মনে আসছে, যার-
দবভ্রু কেশে অস্তগত সবিতার উত্তরাধিকার,
সংহত শরীরে
দ্রাক্ষার সিতাংশু কান্তি, নীলাঞ্জন চোখের গভীরে
তাচ্ছিল্যের দামিনীবিলাস;’
এবং তাই ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে ‘বৃষ্টির বিবিক্ত দিনে অসংলগ্ন স্মৃতির সংগ্রহে/ কিংবা শুধু মৌখিক বিদ্রোহে /নিঃসংগ জরার আর্তি ভোলার প্রয়াস’। আর ‘হাতুড়িনিষ্পিষ্ট ট্রট্স্কি’ বা ‘হিটলারের সুহৃদ্ স্টালিন্’ বা ‘কবন্ধ ফরাসিদেশ’কে বাদ দিয়ে যুদ্ধরত পৃথিবীর শুধু সেই বহু দূরের একজনের জন্যই শেষাবধি এই চিন্তা আর আর্তি :
‘সে এখনও বেঁচে আছে কি না,
তা শুদ্ধ জানি না ॥’
অর্কেষ্ট্রার ‘শাশ্বতী’ লেখা হয়েছে শ্রান্ত বরষার শেষে; কিন্তু বর্ষারই কিছু ছবি যেন বারবার ঘুরেফিরে আসে এ কবিতায়। ‘বাদলশেষের রাত’, ‘ভরা নদী’ এসবই বৃষ্টির অনুষঙ্গ। এজন্যই কবির মনে এসেছে ‘একটি কথার দ্বিধাথরথর চুড়ে ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী’ তথা ‘একটি স্মৃতির মানুষী দুর্বলতা প্রলয়ের পথ দিল অবারিত করে’। এবং তাই দৃপ্ত আÍপ্রত্যয়ী ঘোষণা কবিতার শেষে :
‘সে ভুল ভুলুক, কোটি মন্বন্তরে
আমি ভুলিব না, আমি কভু ভুলিব না ॥’
প্রাকৃতিক বিপর্যয়
ঋগে¦দে ইন্দ্রকে কল্পনা করা হয়েছে, অন্য আরও অনেক কিছুর সঙ্গে, বৃষ্টির উদ্গাতা হিসেবে। কিন্তু ইন্দ্র যে-যুগের বলে কল্পিত বা হিসাবকৃত বা যে-ভুগোলের, সে-যুগ বা সে-ভুগোল বাংলার নয়, যদিবা পর্জন্য-প্ররোচিত ভেকেদের গলা ছেড়ে ডাক দেয়ার উল্লেখ সেখানে আছে। অনেক পরে বাল্মিকী, আর তারও অনেক পরে কালিদাস যা বলেছেন, তার সঙ্গে বরঞ্চ বাংলার বর্ষার অনেক বেশি মিল। বাংলার কবিরা তাই ওই দুই মহাকবি থেকে দু’হাতে আহরণ করেছেন। প্রাচীন কাব্যে ৯ মাস গর্ভধারণের পর বর্ষা প্রকৃতির প্রসবোৎসব হিসেবে বর্ণিত। কিন্তু আজকের দিনে যখন পরিবেশ বিধ্বস্ত বলে সবাই আতংকিত বা তথাকথিত বৈশ্বিক উষ্ণীভবনের সম্ভাব্য ত্রাসে মন বিপর্যস্ত, তখন ‘প্রথম বৃষ্টির বিন্দু’ আগের মতো নখক্ষত সারাতে আর কতদিন আসবে, বা আসলে কোন মাসে কীভাবে আসবে, বা গর্ভ ভেঙে সৃষ্টির উল্লাস হিসেবে দেখা দেবে কিনা দশম মাসে, তাতে সুনিশ্চয় অনিশ্চিতি। আধুনিক নগরজীবন প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের এক ধরনের দূরত্ব তৈরি করেছে। বহুতল ভবনের ফ্লাট-বাড়ি বা ঢাউস অফিসে বসে আমরা অনেক সময়ে টেরই পাই না কখন বৃষ্টি এলো আর কখন তা শেষ হয়েছে। আর গ্রাম-বাংলার অন্যত্র পথে-প্রান্তরে যাদের সুযোগ আছে, তারা দিনগত জীবন-যুদ্ধের অশেষ অনটনে এতটাই অবসন্ন যে বর্ষা-তাড়িত ইন্দ্রিয়বিলাসে অংশভাক্ হওয়াতো দূরের কথা, বৃষ্টিকে ঠিক করে চোখ মেলে দেখাও তাদের জন্য অসম্ভব।
তারপরও অবশ্যই আসবে বর্ষা-উৎসবকে জীবনের সঙ্গে মেলানোর প্রশ্নটি। যে-অর্থে পহেলা বৈশাখ বা নবান্ন উৎসব বাংলার সমাজ-জীবনের অঙ্গ, আষাঢ়ের প্রথম দিবস সে-অর্থে কি আদৌ জনজীবনের অংশ হয়েছে বা হতে পারবে? এ প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করবে প্রারম্ভেই যাদের কথা বলা হয়েছে, তাদের জীবনের সঙ্গে এ-উৎসবকে একীভূত করার ওপর। নইলে এটা রয়ে যাবে ক্লাবভিত্তিক সংস্কৃতির পাদটীকা হিসেবেই। অবশ্য, প্রথম বৃষ্টির বিন্দু প্রতি বর্ষাতে আসবেই, কবিরা তো জন্মাতে থাকবেন; এবং ক্ষণিকের জন্য হলেও কান্তাবিরহিতেরা অন্যমনা হয়ে পড়বেনই।
No comments