প্রেসিডেন্ট সিসির বন্ধু সমাচার! by কামাল আহমেদ
কায়রোতে আমার এক বন্ধুর গাড়িচালক,
ইসমাতের বিবেচনায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ একজন ভালো মানুষ৷
ইসমাত রাষ্ট্রপতি হামিদকে চেনেন না, দেখেননি, তাঁর সম্পর্কে যে খুব একটা
জানেন, সেই সম্ভাবনাও শূন্য৷ গত শনিবার তিনি যে রাষ্ট্রপতি হামিদের প্রশংসা
করলেন, তার একমাত্র কারণ ফিল্ড মার্শাল আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসিকে পাঠানো
তাঁর অভিনন্দনবার্তা৷ মাত্র বছর খানেক আগে পূর্বসূরি ইসলামপন্থী
প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে উৎখাতকারী সাবেক এই সেনাপ্রধান গণতান্ত্রিক
বিশ্বকে এতটাই অপ্রস্তুত ও বিব্রত করেছিলেন যে মিসরের পরীিক্ষত বন্ধু
পাশ্চাত্যের দেশগুলো সেই পালাবদলকে সেনা-অভ্যুত্থান হিসেবেই চিহ্নিত
করেছিল৷ ফলে কূটনৈতিক পরিসরে সিসি কিছুটা একঘরে হয়ে ছিলেন৷ সুতরাং, তাঁর
নির্বাচনী সাফল্যেও গণতান্ত্রিক বিশ্বে বন্ধু খুঁজে পেতে তাঁকে কিছুটা যে
বেগ পেতে হবে, সেটা মোটামুটি সবাই জানেন৷ বাংলাদেশ এ রকম একজন বিপন্ন
নেতার পাশে এগিয়ে আসায় স্বভাবতই তাঁর সমর্থকেরা খুশি৷ আর সেই উচ্ছ্বাসের
প্রতিফলনই হলো রাষ্ট্রপতি হামিদের প্রশংসা৷
ষাটোর্ধ্ব ইসমাত কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নন এবং ফিল্ড মার্শাল সিসি এখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হননি বা কোনো দলের সঙ্গে প্রকাশ্য কোনো বোঝাপড়ায় পেঁৗছাননি৷ ইসমাত ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে অংশ নেওয়া একজন সাবেক সৈনিক৷ মিসরের বিশাল সেনাবাহিনী এবং অর্থনীতি ও রাজনীতিতে তাঁর কয়েক দশকের প্রাধান্যের প্রত্যক্ষ প্রভাব হচ্ছে, প্রায় প্রতিটি পরিবারেই কেউ না কেউ সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত৷ সিসির প্রতি ইসমাতের অগাধ আস্থা৷ তাঁর বিশ্বাস, মিসরে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং অর্থনীতিকে সচল করার কাজটি একমাত্র সিসির পক্ষেই সম্ভব৷
ইসমাতের এই মতামত মোটেও বিচ্ছিন্ন কিছু নয়৷ টুর গাইডের কাজ করেন চটপটে এক তরুণী ইমান৷ তিনি হিজাব পরেন, নামাজের সময় হলে একটু বিরতি চেয়ে নিয়ে সময়মতো নামাজ পড়েন৷ ইমানের কথায়ও পাওয়া গেল আল-সিসির প্রতি আস্থার প্রতিফলন৷ রাজনীতিকদের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ এই তরুণী৷ তাঁর বিশ্বাস, মিসরের প্রয়োজন দৃঢ় নেতৃত্ব৷ আসলে পর্যটনশিল্পের সঙ্গে জড়িত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মধ্যেই এই আশাবাদের আভাস দেখা গেল৷ পর্যটকদের কাছে প্রিয় কায়রোর আল-আজহার মসজিদের কাছে খান এ খলিলি নামের বাণিজ্যিক এলাকায় এক দোকানি আহমদের কথায়, পর্যটনশিল্পে কিছুদিন ধরে যে ধস নেমেছে, তা অনেককেই পথে বসিয়েছে৷ সুতরাং, সিসির ক্ষমতারোহণে তাঁরা দিনবদলের সম্ভাবনা দেখছেন৷ মানুষ যে শক্তির পূজারি, সে কথারই এক প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত সাধারণ মিসরীয়দের সিসিপ্রীতি৷
নিতান্তই ভ্রমণের উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ১ জুন আমি নয় দিনের জন্য মিসরে আসি৷ ৪ জুন নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার পর রাত ১২টার সময়ও মানুষকে সপরিবারে রাজপথে উল্লাস করতে দেখে আমি যারপরনাই বিস্মিত হয়েছি৷ এর পর থেকে যাঁর কাছেই এর ব্যাখ্যা চেয়েছি, তাঁরাই বলেছেন নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার কথা৷ তাঁদের বিশ্বাস, সেনাবাহিনী ও সাবেক সেনাপতি আল-সিসি ছাড়া এটা সম্ভব ছিল না৷
মোবারক-উত্তর মিসরের সবচেয়ে সংগঠিত রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত করার পর ১১ মাসে আনুমানিক এক হাজার ৪০০ বিক্ষোভকারীকে হত্যা এবং প্রায় ১৫ হাজার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে কারান্তরীণ করার মাধ্যমে তিনি তাঁর বেপরোয়া দৃঢ়তার প্রমাণ রেখেছেন৷ পরীক্ষিত বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের শতকোটি ডলারের সামরিক সহায়তা স্থগিতের সিদ্ধান্ত এবং পাশ্চাত্যের আরও শতকোটি ডলারের অনুদান ও ঋণ আটকে যাওয়ার পরও তিনি তাঁর অবস্থান থেকে একটুও পিছপা হননি৷ সেনাপ্রধান হিসেবে যে অঙ্ক কষে রাজনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে তিনি এগিয়েছেন, তাতে কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থন না পেলেও সেনাবাহিনীর আনুগত্য অটুট রেখেছেন৷ প্রায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন অসম নির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহী করতে ব্যর্থ হলেও প্রেসিডেন্ট সিসির অভিষেক উদ্যাপনে বিপুলসংখ্যক মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে ইঙ্গিত মেলে, একনায়কতান্ত্রিক শাসনে মিসরীয়দের অভ্যস্ততা এখনো কাটেনি৷ রাস্তায় রাস্তায় তাই নানা ব্যানারে গামাল আবদেল নাসের ও আনোয়ার সাদাতের পাশে সিসির ছবি টাঙানো হয়েছে৷ তাঁরা হয়তো নাসের ও সাদাতের মতো একনায়কই দেখতে চান সিসির মধ্যে৷ কেননা, নাসের ও সাদাত তাঁদের কাছে উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার প্রতীক৷
অন্যদিকে, সিসি বিশ্বরাজনীতিতে আরব অনৈক্যের সুযোগ নিয়েছেন শতকরা ১০০ ভাগ৷ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কুয়েতের কাছ থেকে প্রায় নিঃশর্ত সমর্থন আদায় করে নিয়েছেন৷ শতকোটি ডলারের ঋণ, অনুদান ও অবিশ্বাস্য রকম সস্তা দরে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করেছেন৷ ফলে পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক মোড়লদের চাপ কোনো কাজে আসেনি৷ সিসির শপথ অনুষ্ঠানে তাই অংশ নিতে এসেছেন সৌদি যুবরাজ, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েতসহ আরব ও আফ্রিকার মিত্র রাজনীতিকেরা৷ বিপরীতে মুরসি ও ব্রাদারহুডের নির্বাচিত সরকারকে সমর্থনের কারণে কাতারকে আমন্ত্রণ পর্যন্ত করা হয়নি৷ যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলো নিম্ন পর্যায়ের প্রতিনিধি বা কূটনীতিক পাঠিয়ে মুখরক্ষা করেছে৷ সে কারণেই ইসমাতের কাছে সৌদি বাদশা ভালো মানুষ, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হামিদ ভালো মানুষ৷ তাঁর কাছে প্রেসিডেন্ট ওবামা বা কাতারের আমির আল থানি মিসরের বন্ধু নন৷
তবে নির্বাচনের পর এখন পাশ্চাত্যের নেতাদের সুর বদলাতে শুরু করেছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে৷ ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান প্রেসিডেন্ট সিসিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন৷ উইলিয়াম হেগ অবশ্য তাঁর বিবৃতিতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মিসরের সংবিধানে বিধৃত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংগঠন করার অধিকার নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন৷ তবে এতে করে ক্ষুব্ধ মুসলিম ব্রাদারহুডের আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রধান ইব্রাহিম মুনির অভিযোগ করেছেন যে যুক্তরাজ্য এই অভিনন্দনবার্তার মাধ্যমে সামরিক অভ্যুত্থানকে স্বীকৃতি দিচ্ছে৷ প্রেসিডেন্ট সিসির জন্য সবচেয়ে বড় স্বস্তির ইঙ্গিতটি এসেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের তরফ থেকে৷ তারা মিসরের অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য ঋণ দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা শুরু করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে৷ এরও আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিসরের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়৷ এমনকি, এ বছরের আরও আগের দিকে নতুন সংবিধান গণভোটে গৃহীত হওয়ার বিষয়টিকে গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনের জন্য একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে স্বাগত জানানো হয়েছে৷ নতুন সংবিধানে প্রেসিডেন্টের একচ্ছত্র ক্ষমতা খর্ব করে পার্লামেন্টের সঙ্গে ভারসাম্য তৈরির চেষ্টাই ইউরোপীয়দের উৎসাহের কারণ৷ এগুলোকে আলামত হিসেবে গণ্য করলে এই অনুমান অন্যায় হবে না যে গণতন্ত্রের প্রবক্তা পাশ্চাত্যের দেশগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশে রাজনৈতিক দলাদলি বা সংঘাতে পীড়িত কোনো রাষ্ট্রে সামরিক হস্তক্ষেপকে মেনে নেওয়ার পথে হাঁটতে শুরু করেছে৷ আর দলাদলিপীড়িত দেশটিতে যদি ইসলামি জঙ্গিবাদের হুমকির কোনো আছর থাকে, তাহলে তো কথাই নেই৷
অনেকের অবশ্য আশঙ্কা যে পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট আল-সিসি ডিক্রি জারির মাধ্যমে নিজের হাতে বাড়তি ক্ষমতা তুলে নেবেন এবং ভবিষ্যৎ পার্লামেন্টের ক্ষমতা খর্ব করবেন (বাংলাদেশের সাবেক দুই সেনাশাসকের অভিজ্ঞতা থেকে সিসি অবশ্য কোনো শিক্ষা নিয়ে থাকলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না)৷ এ ধরনের ডিক্রি জারির ক্ষেত্রে তাঁর সামনে কোনো বাধা নেই৷ বিশেষ করে তাঁর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক শক্তিগুলো সংগঠিত হওয়ার উদ্যোগ জোরদার করলেই তিনি এ ধরনের কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠতে পারেন৷ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর তিনি বলেছেন যে সন্ত্রাসকে তিনি কঠোর হাতে দমন করবেন এবং যঁারা অতীতে সহিংসতার জন্য দায়ী, তাঁদের সঙ্গে কোনো ধরনের রাজনৈতিক সংলাপ হবে না৷ দেশটিতে ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতার অভিযোগ অনেক দিনের; বিশেষ করে সেনাবাহিনীর সমর্থনপুষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গের সমালোচনা প্রায় নিষিদ্ধ বললেও খুব একটা ভুল হবে না৷
একদিকে পাশ্চাত্যের বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রভাবে ক্ষরণ, অন্যদিকে আরব রাজনীতির মেরুকরণের কারণে সৌদি নেতৃত্বাধীন ধনী দেশগুলোর উদার সমর্থন প্রেসিডেন্ট আল-সিসির সরকারের অবস্থানকে যে অনেকটাই সংহত করবে, তাতে সন্দেহ নেই৷ ফলে বিশ্বকে হয়তো আরও একজন মিসরীয় একনায়কের উত্থান প্রত্যক্ষ করতে হবে৷ তবে, মিসরে একজন সেনাপতির রাজনৈতিক উত্থানের এই দৃষ্টান্ত যেন তৃতীয় বিশ্বের অন্য কোনো দেশে অনুসৃত না হয়; যদিও ইতিমধ্যে রাজনীতিকদের লাগামছাড়া বিবাদ আর দলাদলির বলি হয়েছে থাইল্যান্ডের গণতন্ত্র এবং সেখানেও মুক্তবিশ্বের নেতারা তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম কি না, সন্দেহ৷
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন৷
No comments